নিকোটিন প্যাচ কিভাবে কাজ করে?
নিকোটিন প্যাচ কিভাবে কাজ করে? - ছবি : সংগৃহীত
শুধু সিগারেট খাওয়াই কিন্তু তামাক ব্যবহার নয়। গুটকা খাওয়ার অভ্যেস, গুড়াকু (তামাক ও গুড়ের মিশ্রণ) দিয়ে দাঁত পরিষ্কার করা, রেডিমেড পান-মশলা, চুন দিয়ে খইনি খাওয়া, সুগন্ধিমেশানো জর্দা ব্যবহারও কিন্তু তামাক সেবনের অধীনেই পড়ে। এই ধরনের বেশিরভাগ বস্তুতে থাকে নিকোটিন, যা আমাদের আসক্ত করে তোলে। তবে ওই সমস্ত বস্তুতে নিকোটিন ছাড়াও থাকে আরো কিছু উপাদান, যা শরীরের পক্ষে ভয়ঙ্কর ক্ষতিকারক।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, অনেকেই খইনির সাথে চুন মিশিয়ে খান। মুখগহ্বর জুড়ে থাকা দেওয়ালের ক্ষয় করতে থাকে চুন এবং খইনি। তৈরি হয় ক্ষত ও ক্যান্সার। খইনি ছাড়াও পান-মশলা, গুটকা, জর্দার মতো দীর্ঘ সময় ধরে মুখে রেখে সেবন করার নেশাসামগ্রীর ক্ষেত্রেও মুখে একইরকম প্রভাব দেখা যায়।
সেক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠতে পারে ধূমপানকেও কেন ক্ষতিকর বলা হয়? আসলে সিগারেট বা বিড়ি সেবনে শুধু যে তামাক পোড়ে তা নয়, পোড়ে কাগজ এবং পাতাও। ফলে তৈরি হয় কার্বন ডাই অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড, সালফার ডাই অক্সাইড ইত্যাদি। তামাক নিজে পুড়ে তৈরি করে টার। এই সমস্ত উপাদান ফুসফুসে ঢুকে অঙ্গটির প্রবল ক্ষতি করে। সুতরাং ক্যান্সারসহ নানাবিধ শারীরিক ক্ষতির জন্য শুধু নিকোটিন নয়, বরং দায়ী থাকে অন্যান্য উপাদানও। আর নিকোটিনের কাজ মূলত আসক্তি তৈরি করা।
নিকোটিন থেরাপি
তামাক সেবনে আসক্তি ছাড়াতে যেসব থেরাপি ব্যবহার করা হয়, তার মধ্যে অন্যতম হলো নিকোটিন প্যাচ ব্যবহার। নিকোটিন প্যাচ নিয়ে নানা দেশে নানাসময়ে একাধিক সমীক্ষা হয়েছে। তবে প্রায় সব স্টাডিই ছয় মাসের। স্টাডিতে যোগ দেয়া অর্ধেক অংশগ্রহণকারীকে দেয়া হয় সত্যিকারের নিকোটিন প্যাচ। বাকি অর্ধেকদের দেয়া হয় প্লাসিবো। এই প্লাসিবো নিকোটিন প্যাচের মতো দেখতে। তবে তার মধ্যে নিকোটিন থাকে না।
ছয় মাসের স্টাডি শেষে দেখা যায় প্লাসিবো ব্যবহারকারীর তুলনায় নিকোটিন প্যাচ ব্যবহারকারীদের ৩০-৭০ শতাংশেরও বেশি ব্যক্তি সফলভাবে ওই ছয় মাস সরাসরি তামাক সেবন ছাড়া থাকতে পারছেন।
এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে, একজন তামাকে আসক্ত ব্যক্তি না হয় ছয় মাস অবধি সফলভাবে তামাক সেবন ছাড়া থাকলেন। কিন্তু তারপর? তিনি কি সত্যিই তামাকের দিকে আর ফিরেও তাকাচ্ছেন না? নাকি কয়েক মাসেই ফিরছেন তামাকের আশ্রয়ে? অতএব একটা বিষয় পরিষ্কার, তামাক ছাড়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বিষয় হলো মানসিক দৃঢ়তা।
নিকোটিন প্যাচ কী?
নিকোটিন প্যাচ দেখতে অনেকটা ব্যান্ড এইড-এর মতোই। এক্ষেত্রেও চামড়ার সাথে প্যাচ লেগে থাকে আঠার সাহায্যে। প্যাচে থাকে শুধু নিকোটিন। প্যাচ থেকে ধীরে ধীরে ত্বক নিকোটিন শোষণ করে ও এরপর সেই নিকোটিন রক্তে মিশে যায়। মোটামুটি ৭, ১৪ এবং ২১ মিলিগ্রাম মাত্রার নিকোটিন প্যাচ পাওয়া যায়। কার কোন মাত্রার নিকোটিন প্যাচ দরকার পড়বে, তা নির্ভর করে আসক্ত ব্যক্তির তামাক সেবনের মাত্রার ওপর।
সাধারণভাবে বলা যায়, যারা দিনে ১০ থেকে ১৫ সিগারেট খান তাদের ক্ষেত্রে ২১ মিলিগ্রাম নিকোটিন প্যাচ ব্যবহার দিয়ে শুরু হয় তামাক ত্যাগের প্রক্রিয়া। ধীরে ধীরে নিম্ন মাত্রার নিকোটিনের প্যাচ ব্যবহার শুরু হয়। একটি প্যাচ ২৪ ঘণ্টার জন্য কার্যকরী। শরীরের রোমহীন জায়গায় প্যাচ লাগাতে হয়। অনেকে অবশ্য তামাকে আসক্তি ছাড়তে প্যাচ লাগানোর সঙ্গে নিকোটিন গামও ব্যবহার করেন।
তামাক ছাড়তে কি নিকোটিন প্যাচ জরুরি?
একটা বিরাট সংখ্যক মানুষ কিন্তু নিকোটিন প্যাচ ছাড়াও তামাক সেবন ছাড়তে সক্ষম হয়েছেন। তবে হ্যাঁ, বাড়তি সহায়তার দরকার পড়লে প্যাচের সাহায্য নিতে পারেন।
তামাক ছাড়া জরুরি কেন?
১. মুখের ক্যান্সার হওয়ার পিছনে সবচেয়ে বড় কারণ হলো মুখগহ্বরে তৈরি হওয়া দীর্ঘদিনের ঘা। চিবানোর তামাক যেমন জর্দা, পান-মশলা, গুটকা, খইনি থেকে মুখে এমন ঘা তৈরি হয়। এমন ধরনের আলসার তৈরি হওয়ার পিছনে শুধু চিবানোর তামাক নয়, দায়ী থাকতে পারে জারিত কাঁচা সুপারি সেবনের অভ্যেসও। কারণ, এই ধরনের নেশাসামগ্রী মুখের অন্দরে একধরনের ক্ষত তৈরি করার ক্ষমতা রাখে। এই ধরনের সুপারি থেকেও তাই ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। এমনকি কৃত্রিম দাঁত (আর্টিফিশিয়াল ডেঞ্চার) সঠিকভাবে লাগানো না হলেও সেখান থেকে মুখে ঘা ও পরবর্তীকালে ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। এমনকী ক্ষয়ে যাওয়া বা ভেঙে যাওয়া দাঁতের তীক্ষ্ণ অংশ থেকে মুখে ঘা হওয়া ও সেখান থেকে ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
২. অন্যদিকে ধূমপানের ফলে ফুসফুসে ঢোকে একাধিক ভয়ঙ্কর ক্ষতিকর পদার্থ। এই ধরনের পদার্থগুলো ফুসফুসের কোষের অন্দরের দেয়ালে, কোষে, শ্বাসনালীতে কুপ্রভাব ফেলে। নিকোটিনের প্রভাবে ফুসফুসের কোষে ফাইব্রোসিস হওয়ার ভয় থেকে যায়। অর্থাৎ কোষের নমনীয়তা হ্রাস পায়। ফুসফুসের কোষগুলি শক্ত হওয়ায় কার্বনডাইঅক্সাইড ত্যাগ ও অক্সিজেন গ্রহণের ক্ষমতা হ্রাস পায়। কোষগুলি স্থিতিস্থাপকতা হারিয়ে দড়ির মতো হয়ে যায়। বাতাস ঢুকলেও ফুসফুস প্রসারিত হতে পারে না। রক্তে অক্সিজেন পৌঁছয় না। তৈরি হয় শ্বাসকষ্টের সমস্যা।
৩. আমাদের নাসাগহ্বর, শ্বাসনালী, ফুসফুস, সাইনাসে থাকে চুলের মতো দেখতে আণুবীক্ষণিক সিলিয়া। সিলিয়া নিজের জায়গায় দাঁড়িয়েই একভাবে দোলে। এই দোলনের ফলে রেসপিরেটরি ট্র্যাক্ট, সাইনাসে জমে থাকা নানা পদার্থ, শ্লেষ্মা দেহের বাইরে বেরিয়ে আসে। শ্বাস নেয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি হয় না। ধূমপানের ফলে সিলিয়াগুলো নষ্ট হতে থাকে। সাইনাস, শ্বাসনালী, ফুসফুসে জমতে থাকে শ্লেষ্মা সহ নানা পদার্থ। ফলে দীর্ঘদিনের ধূমপায়ীর অল্প পরিশ্রমেই শ্বাসকষ্ট হতে থাকে। এমনকী সাইনুসাইটিস, ব্রঙ্কাইটিস, ব্রঙ্কোনিউমোনিয়া হওয়ার আশঙ্কাও থেকে যায়। সর্বক্ষণের সঙ্গী থাকে খুকখুকে কাশি। ধূমপান বাড়ায় লাং ক্যান্সারের আশঙ্কাও।
৪. ক্যান্সার না হলেও দীর্ঘদিনের ধূমপায়ীর একসময়ে শ্বাসের সমস্যায় পড়ার আশঙ্কা নিশ্চিতভাবে থাকে।
৫. যেকোনো জটিল রোগের কবলে পড়ার পর সুস্থ হতে ধূমপান করেন না এমন ব্যক্তিদের তুলনায় ধূমপায়ীদের সময়ও বেশি লাগে।
মনে রাখবেন
বিনা বাক্যব্যয়ে চট করে যেকোনো ধরনের তামাক সেবন ত্যাগ করাই বুদ্ধিমানের কাজ। তাছাড়া, মদ্যপান, ড্রাগ সেবন ছেড়ে দেয়ার পর যে রকম উইথড্রল এফেক্ট হয়, অতটা হয় না তামাক ছেড়ে দিলে। নিকোটিনের জন্য একটু চাহিদা তৈরি হয় ঠিকই, তবে তার সাথে যুঝে নেয়ার ক্ষমতা সকলেরই থাকে। আপনারও আছে।
লেখক : হেড অ্যান্ড নেক সার্জেন, কনসালটেন্ট ইএনটি, পিয়ারলেস হাসপাতাল এবং বি কে রায় রিসার্চ সেন্টার
সূত্র : বর্তমান