পড়ন্ত বিকেলে আলসিরার হাহাকার

রহমান মৃধা | Dec 23, 2021 06:11 pm
পড়ন্ত বিকেলে আলসিরার হাহাকার

পড়ন্ত বিকেলে আলসিরার হাহাকার - ছবি : সংগ্রহ

 

হতাশা আর হতাশা। স্পন্সরের অপেক্ষায় দিনের পর দিন পার করে চলছে সে। তার চেষ্টার ত্রুটি ছিলো না কোনো দিন। সে প্রাক্টিস করেছে প্রতিদিন মাঝেমধ্যে সারাদিন।

গানের ভুবনে দিয়েছে জলাঞ্জলি তার জীবনের ১৮টি বছর। গিয়েছে শত দুয়ারে, করেছে গান অনেকবার কিন্তু হিট করেনি কখনও। বাবা হারা মায়ের একমাত্র কন্যা সে, নাম দোলোরেস।

বাড়ি স্পেনের ভ্যালেন্সিয়ার অদূরে ছোট্ট একটি শহর নাম আলসিরা। আমার স্ত্রী মারিয়ার বাবার বাড়ি সেখানে বিধায় ছোটবেলায় তার অনেক সময় কেটেছে এই শহরে দোলোরেসের সঙ্গে।

দোলোরেস মারিয়ার স্কুলজীবনের বান্ধবী। সে পড়াশোনার পাশাপাশি গানের ওপর চর্চা করেছে ছোটবেলা থেকেই। হতাশা যখন গ্রাস করতে চলেছে, ঠিক তেমন একটি সময় নাইটক্লাবে ছদ্মবেশী হয়ে মাঝেমধ্যে দোলোরেস গান করে এবং দিনে কাজ করে ফার্মাসিউটিক্যালস ইন্ডাস্ট্রিতে।

দোলোরেস তার প্রশিক্ষণে একজন কেমিস্ট সত্ত্বেও গানই তার হৃদয়ে স্বপ্নের জাল বুনেছিল। শুক্রবার রাতে নাইটক্লাবে দোলোরেসের গানের শেষে হঠাৎ একজন হ্যান্ডসাম যুবক সামনে এসে বলে গেল চমৎকার।
জীবনে প্রথম চমৎকার কথাটি শুনতে পারা এবং তা রূপের কারণে নয়; দোলোরেসের গানের ওপর মুগ্ধ হয়ে বলে গেল আজ এ শ্রোতা।

কে এই যুবক? চেনা চেনা লাগছে, কোথায় যেন তাকে দেখেছি এর আগে! ভাবছে বসে দোলোরেস। পরের শুক্রবার রাতে এসেছে ফিরে সে যুবক শুনতে দোলোরেসের গান আবারও।
দোলোরেসের আজ চিনতে সমস্যা হয়নি। এত সেই মাদ্রিদের নামকরা আন্টোনিও যে তার গিটারের সঙ্গে গানের ভুবনে মুগ্ধ করে শ্রোতাদের। আজও একই কথা চমৎকার।

আন্টোনিও এসেছে মাদ্রিদ থেকে ভ্যালেন্সিয়ায় তার একটি কনসার্টে। দোলোরেস সেই কনসার্টে গিয়েছে কিন্তু ভাবতে পারেনি কখনও আন্টোনিওর সঙ্গে তার পরিচয় হবে। আন্টোনিও দোলোরেসকে পছন্দ করেছে প্রথম দর্শনে। দোলোরেসের ভাবনায় ঢুকেছে পছন্দ কি শুধু তাকে? নাকি তার গানকে? আন্টোনিওর জীবনে সব হয়েছে, সব পেয়েছে কিন্তু তার নেই কোনো সঙ্গিনী। এতদিন সে তার জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছে ড্রাগস এবং অ্যালকোহলকে। তাই সে কিছুটা ছদ্মবেশী হয়ে বিভিন্ন নাইটক্লাব বা বারে তার নিঃসঙ্গ জীবনের সময় ব্যয় করে।
হঠাৎ দোলোরেস কি এসেছে তার জীবনের পড়ন্ত বিকেলে যেখানে সন্ধ্যা হয়নি এখনও! স্বল্প সময়ে অল্প দেখায় দুটি ভিন্ন মন খুঁজে পেয়েছে একে অপরকে। স্পেনের মাদ্রিদে জন্ম এ আন্টোনিওর। সে গানের ভুবনের এক উদীয়মান তারকা। তার পরবর্তী পারফরম্যান্সে সে গান গাইবে তার নিজের শহরে। দোলোরেসকে ধরেছে আন্টোনিও তার সে কনসার্টে যোগ দেয়ার জন্য। প্রথমে না বলেছে দোলোরেস, পরে হয়েছে সে রাজি।

মাদ্রিদের মঞ্চে হাজারও মানুষের সামনে আন্টোনিও পরিচয় করিয়ে দিতে ডেকেছে দোলোরেসকে। সে কিছুতেই তার সাহসে বা বিশ্বাসে কুলিয়ে উঠতে পারছে না। শেষে আন্টোনিও তার হাত ধরে মঞ্চে এনে সংক্ষিপ্ত পরিচয় শেষে দোলোরেসের সেই আলসিরার নাইটক্লাবের গান গাইতে শুরু করে এবং একই সঙ্গে তুলে দেয় দোলোরেসের হাতে মাইক্রোফোন, আন্টোনিওর সঙ্গে গান গাওয়ার জন্য। সে এক অবিস্ময়কর মুহূর্ত, সে এক ভালোবাসার বিশ্বমঞ্চ। আজ প্রথম এ শুভলগ্নে হলো হৃদয়ের মিলন দুজনে দুজনার। একই সঙ্গে দোলোরেসের জীবনে ঘটে গেল গান গাওয়ার সুযোগ কনসার্টে যা সে স্বপ্ন দেখেছে ছোটবেলায়। আজ হঠাৎ তাও বাস্তবে রূপান্তরিত হয়ে গেল! এ শুধু মিরাকেল নয়, এ এক ভালোবাসা, গানের ভুবনে আন্টোনিওর সঙ্গে।

আন্টোনিও দোলোরেসের মধ্যে খুঁজে পেয়েছে নতুনত্ব, যা অন্য কেউ পায়নি। আন্টোনিও জানত যে দোলোরেসের মধ্যে রয়েছে অসাধারণ ন্যাচারাল প্রতিভা। প্রতিভা খুঁজতে বা প্রতিভা বুঝতে হলে নিজেকে প্রতিভাবান হতে হয়, যা আন্টোনিও প্রমাণ করেছে। তাই তো সেদিন আন্টোনিওর হাত ধরে একজন নতুন তারকার (দোলোরেসের) আবির্ভাব হয়েছিল মাদ্রিদের জনসমুদ্রে।

দোলোরেস শুরু থেকেই তার চাকরি ছেড়ে আন্টোনিওর সঙ্গে ট্যুরে গানের জগতে জড়িয়ে পড়ে। তাদের মাঝে যে ভালোবাসার সেতু তৈরি হয় তা শেষ হয়েছিল পরে প্রণয়ে, কিন্তু দুর্ভাগ্য যে সে সুখের বন্ধন দিনে দিনে ভাঙন ধরতে শুরু করে।

দোলোরেস দিনের পর দিন ব্যস্ত হয়ে পড়ে তার গানের জগতে। আর আন্টোনিওর নিঃসঙ্গতা এবং নির্জনতা তাকে ঘিরে ধরে ড্রাগস এবং অ্যালকোহলে। দোলোরেস গানের ভুবনে শীর্ষে উঠেছে বটে, তবে হারাতে চলেছে তার ভালোবাসা, সঙ্গে ধরে বসেছে তাকেও অ্যালকোহলে। একদিন যে আন্টোনিও এ দোলোরেসকে খুঁজে পেয়েছিল, যে দিয়েছিল দোলোরেসের হৃদয়ে জ্বেলে আলোর প্রদীপ পৃথিবীর সংগীতজগতে। সেই আন্টোনিও একসময় অতিরিক্ত ড্রাগস ওভারডোজের কারণে দোলোরেসকে ছেড়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়। দোলোরেসের জীবনের উচ্চ আকাঙ্ক্ষা, যা হয়তো তার মনের অজান্তে তৈরি হয়েছিল, তাই তো ভুলে গিয়েছিল ক্ষণিকের তরে তার ভালোবাসার আন্টোনিওকে। তাদের মনের এবং দেহের দূরত্ব হয়েছিল দূর হতে বহুদূরে।

দোলোরেস মানসিক অসুস্থতায় ভুগতে থাকে, শেষে হারিয়ে ফেলে তার ভারসাম্য এবং হয়ে যায় সাথীহারা। পরে কোনো একসময় দোলোরেসের শরীরে ক্যানসার ধরা পড়ে এবং তার আকস্মিক মৃত্যু ঘটে।
অনেক বছর আগের কথা, আমি মারিয়ার সঙ্গে গিয়েছিলাম দোলোরেসের বাড়িতে। দোলোরেস ও আন্টোনিও এসেছিল একসময় বেড়াতে সুইডেনে আমাদের বাড়িতে তাদের ব্যস্ত জীবনের মাঝে। এ পৃথিবীতে প্রতিদিন হাজার হাজার দোলোরেস ও আন্টোনিওর মতো স্টার যারা অঙ্কুরে বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কেউবা মাঝপথে, কেউবা শেষের পথে হারিয়ে যাচ্ছে জানা-অজানার মধ্য দিয়ে।

আবার আমাদের জীবনে এমন করে হঠাৎ আকস্মিকভাবে কিছু ঘটনা ঘটে এবং তার শেষও হয় অনেকটা আকস্মিকভাবেই। যেমন মাইকেল জ্যাকসন, আভিসিই, কুইন আরও কত জানা-অজানা স্টার ড্রাগসের সঙ্গে জড়িত হয়ে জীবনকে শেষ করে দিয়েছে। কী কারণ থাকতে পারে এর পেছনে তা আমি জানিনে। তবে যেদিন তারা এ জীবন শুরু করেছিল ভেবেছিল কি এর শেষ এমন করে হবে? হাজারও মানুষের ভিড়ে এরা উজাড় করে দিয়েছে এদের প্রতিভা মানুষকে বিনোদন দেওয়ার জন্য।

এরা পেয়েছে মানুষের ভালোবাসা, তারপরও কেন তারা ঝরে পড়েছে বা পড়ছে? মোটিভেশন বা ডেডিকেশন যখন শেষ হয়ে যায়, জীবনে ঘটে কি তখন এমনটি? নাকি জীবনের শুরুতে সেই স্বপ্নের ইচ্ছেগুলো যখন বাস্তবে রূপ নেয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এমনটি হয়? নাকি অন্য কোনো কারণে এ ট্র্যাজেডি?
মানবজাতির জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা তা হলে কি সীমারেখার মধ্যে নিয়ন্ত্রিত? এবং সে সীমারেখা লঙ্ঘন করা কি অসম্ভব? নিয়তির পরিণতি কি এটাই? হাজারও প্রশ্ন রেখে গেলাম আজকের লেখায়!

লেখক : সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন, rahman.mridha@gmail.com


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us