ইসলামি বিশ্বব্যবস্থায় চিন্তা ও কাজের ব্যাপকতা
ইসলামি বিশ্বব্যবস্থায় চিন্তা ও কাজের ব্যাপকতা - ছবি : সংগ্রহ
ইসলাম মানে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করা। আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণের অর্থ এই নয় যে নিজের সমস্ত চিন্তা, আকল ও শৈল্পিক মানস, শিল্পকর্ম, নান্দনিকতা ও সৃজনশীলতা বিসর্জন দেয়া। বরং এই আত্মসমর্পণের অর্থ নিজের আকলকে আড়ষ্টতা থেকে মুক্তি দেওয়া এবং একটি সৃজনশীল জ্ঞানভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থা নির্মাণের কর্মী হিসেবে নিজেকে পেশ করা। কাজেই নিজের আকলকে আরো বেশি শাণিত করা, চিন্তা শক্তির আরো বিকাশ ঘটানো, শৈল্পিক মানসের শিল্পনৈপুণ্য প্রদর্শন, নান্দনিকতার সর্বোচ্চ প্রকাশ আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণের ছাপরেখার প্রকাশই বটে। এ বিশ্বজাহানের রব আল্লাহ নিজেই একজন শিল্পী (আহসানুল খালিকিন)। একজন মানুষ যখন নিজের শিল্পকর্ম (আর্ট) দুনিয়াবাসীর সামনে হাজির করে সে তো মূলত আল্লাহ তায়ালার নিদর্শনকেই হাজির করে।
অনেকেই বলে গন্ডির ভেতর থেকে একজন মুসলমান সব কিছু করতে পারে। এই গন্ডির ভেতর থেকে সব কিছু করার ধারণাটি সঠিক নয়। বরং প্রকৃত ব্যাপার হলো এই যে, কেউ যখন ইসলাম গ্রহণ করে তখন সে দুনিয়ার সমস্ত গন্ডিকে ছিন্ন করে পদতলে ফেলে একটি বিস্তৃর্ণ দুনিয়ায় প্রবেশ করে। কেননা ইসলামে সবকিছু সাধারণভাবে হালাল কেবল কতিপয় হারাম ব্যতীত।
এখানে হালাল বিস্তৃত, হারাম নির্দিষ্ট ও সীমাবদ্ধ।
হিফজুন নফসের ক্ষেত্রে আবার সাময়িকের জন্য হারামের পর্দাও তুলে দেয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
ইসলামি শরিয়ত শুধু হুদুদ কায়েম নয়। এই শরিয়ত অনেক ব্যাপক। মহাবিশ্ব যতো বিস্তৃত ইসলাম ও ইসলামি শরিয়ত ততো বিস্তৃত। শরিয়াহ শব্দের আক্ষরিক অর্থই হলো এমন জলাধার যেখান থেকে পশুপাখি পানি পান করে তৃষ্ণা নিবারণ করে। অর্থাৎ এর মর্মার্থ হলো এই শরিয়ত থেকেই মুসলিম উম্মাহ যাবতীয় তৃষ্ণা নিবারণ করবে। শরিয়তের ভেতরেই সমস্ত মানুষের সমস্ত চাহিদা পূরণ করবে। ভালোভাবে জেনে নেওয়া দরকার যে আসমান জমিনের যেসব বস্তুর সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক ইসলামি শরিয়তের সম্পর্কও ঠিক সে সকল বস্তুর সঙ্গে।
মুসলিমদের চিন্তার পরিধি থাকবে সবচেয়ে বিস্তৃত।
কেননা তারা এমন এক দ্বীনের অনুসারী যা সমগ্র মহাবিশ্ব তথা প্রকৃতির দ্বীন। তারা এমন এক রবের ইবাদতকারী যিনি বিশ্বজাহান ও মহাবিশ্বের এবং তার মধ্যকার সমস্ত প্রাণিজগত ও নিষ্প্রাণ জগতের রব ।
তারা এমন এক রসূলের অনুসারী যিনি বিশ্বজগতের জন্য করুণার মহাসমুদ্র। মুসলিম উম্মাহ এমন এক উম্মাহ যাদেরকে সচেতনভাবে ইসলাম অনুসরণের তাকিদ দেয়া হয়েছে ।
মানুষের সৃজনশীলতা ও শিল্পের জ্ঞানের ভেতরেই তার স্বাতন্ত্রিক বৈশিষ্ট্য প্রতিভাত হয়েছে। এ সৃজনশীল ও উদ্ভাবনী শক্তিই ডারউনের বিবর্তনবাদকে বাতিল করে দিয়েছে এবং আল্লাহর মহত্বকে স্বতস্ফূর্তভাবে প্রকাশ করেছে । সুতরাং সৃজনশীলতার পথ ছেড়ে দিয়ে কতিপয় রসম রেওয়াজের মধ্যেই পড়ে থাকার নাম ইসলাম নয়। ইসলাম হলো পৃুর্ণ সৃজনশীলতার দ্বীন।
যেখানে আসমান জমিন নিয়ে চিন্তা করার উদাত্ত আহ্বান জানানো হয়েছে। মূলত তানজিলি ও তাকিভিনি আয়াতকে সমন্বিতভাবে বিশ্লেষণের মাধ্যমে জ্ঞানের যে ধারাটি পরিস্ফূট হয়ে ওঠে তাকেই বলা হয় ইসলাম।
এজন্য আদমকে সর্বপ্রথম তথ্য ও তত্ত্ব সহকারে বস্তুজগতের সমস্ত নাম শিখিয়ে দেওয়া হয়েছিলো।
তানজিলি এবং তাকভিনি জ্ঞানের সমন্বিত স্রোতধারা থাকার কারণেই ইসলাম একটি সভ্যতা এবং এটিই একমাত্র সত্যিকারের সভ্যতা ও বিশ্বব্যবস্থা । মদিনা কেন্দ্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নবি করিম (সা.) থেকে সূচিত হয়ে খোলাফায়ে রাশিদিন,উমাইয়া,আব্বাসীয়,ফাতিমি, সেলজুক,মোগল, উসমানীয় খলিফারা ১২০০ বছর পৃথিবীর বুকে একটি ন্যায়ভিত্তিক সভ্যতা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এ বিশ্বব্যবস্থার প্রাণশক্তি ছিলো আদালত, সাদাকাত ও আখলাক।
এই সভত্যায় জন্ম নিয়েছিলো ইমাম আবু হানিফ, ইমাম শাফেয়ি,ইমাম মালিক,ইমাম আহমদ বিন হাম্বল, জাবির বিন হাইয়ান, আল-খাওয়ারিজমি, আল-বাত্তানি, ইমাম বুখারি, ইমাম জুইয়াইনি, ইমাম সারাখসি, ইমাম আশারি, ইবনে সিনা, আল-রাজি, আল-জাহরাবি,আল-বিরুনি, আল-ইদরিসি, ইবনে ফিরনাস,আল-ফারাবি, আল-আরাবি, ইবনে রুশদ, জালালুদ্দিন রুমি, ইমাম গাজালি, ইবনে খালদুন প্রভৃতির ন্যায় কালজয়ী মনীষীরা।
তারা একই সঙ্গে উসূলশাস্র, তাফসির, উলুমুল হাদিস, রিজাল শাস্র, ফিকহ, ইতিহাস, ভূগোল, জ্যোতির্বিদ্যা,
মিউজিক, গণিত, পদার্থ, রসায়ন, জীববিজ্ঞান, চিকিৎসাবিজ্ঞান,অপটিক্স, প্রকৌশল ও স্থাপত্য খনিজবিদ্যা, ভাষাবিজ্ঞান, ব্যাকরণ, অলঙ্কার বিদ্যা, মানতিক, সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞানসহ জ্ঞানের সমস্ত শাখার উদ্ভাবন ও বিকাশ ঘটিয়েছিলেন।
সমগ্র সাম্রাজ্যে তারা পরিকল্পিত নগরব্যবস্থা ও নান্দনিক স্থাপত্য নির্মাণ করেছিলেন। তারা কৃষি ও শিল্পে বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন। উন্নত সেচব্যবস্থা প্রণয়ন করেছিলেন। এজন্য তারা প্রচুর পরিমাণ খাল খনন করেছিলেন। ঐতিহাসিক ইসতাখারীর বর্ণনামতে শুধুমাত্র বিলাল ইবনে আবি বুরদার সময় বসরায় ও তার আশেপাশে ১০ লক্ষ ২০ হাজার খাল ছিলো।
তারা নতুন ফুল ফলের চাষ করেছিলেন। লক্ষ লক্ষ বাগান তৈরি করেছিলেন। চাষাবাদে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করেছিলেন। তারা কাগজ শিল্প, চিনি শিল্প, খাদ্যশিল্প, ধাতব শিল্প, পোশাক শিল্প, অলঙ্কার, তৈজসপত্র, অস্ত্রশিল্প প্রভৃতির বিকাশ ঘটিয়েছিলেন।
তৎকালিন জাহাজ শিল্প ছিল দুনিয়ার সেরা নির্মাণ শিল্প। ইসলামি সভ্যতার নির্মাণকাজের ইঞ্জনিয়ার ছিলেন আলেমগণ এবং সেই নির্মাণ কাজের রাজমিস্ত্রি ছিলেন খলিফা, সুলতান ও আমীরগণ। খলিফাগণ নিরাপদ সড়কব্যবস্থা নির্মাণে রোড লাইট ও ওয়াচ টাওয়ারের ব্যবস্থা করেছিলেন। তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় মুসলিম বিজ্ঞানীরা সমুদ্রে জাহাজ চলার জন্য উন্নত ম্যাপ, মেরিন কম্পাস উদ্ভাবন করেছিলেন। উন্নত মানের বাতিঘর ছিলো এই সভ্যতার গৌরব।
ইসলামি সভ্যতার শাসকরা জগতের সবচেয়ে শক্তিশালী সেনাবাহিনী, সীমান্তরক্ষী বাহিনী ও নৌবাহিনী তৈরি করেছিলেন। তারিক বিন জিয়াদ, মুসা বিন নুসাইর, কুতায়বা বিন মুসলিম, মুহাম্মদ বিন কাসিম, ইখতিয়ার উদ্দীন এ সভ্যতার জন্ম দেওয়া সমরনায়ক।
সর্বশেষ উসমানি খিলাফতের পতনের মাধ্যমে উত্থান ঘটে অভিশপ্ত পাশ্চাত্য সভ্যতার। বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় পাশ্চাত্যরা নিজেদের এবং পৃথিবীবাসীর ওপর জুলুম চাপিয়ে দিয়েছে । তারা সর্বত্র বেইনসাফী ব্যবস্থা কায়েম করে রেখেছে। তারা কৃত্রিম খাদ্য সংকট তৈরি করেছে। তারা কৃষিতে জিএমও প্রবর্তনের মাধ্যমে খাদ্যনিরাপত্তা বিনষ্ট করেছে এবং বাস্তুসংস্থান ও জীববৈচিত্র ধ্বংসকারী কৃষিব্যবস্থা প্রণয়ন করেছে। তারা মেডিসিনের ভেতর প্রাণঘাতী রোগ ঢুকিয়েছে । অর্থনৈতিকভাবে তারা সমগ্র বিশ্বকে শোষণ করছে। রাজনৈতিকভাবে গোটা বিশ্বে জায়োনিস্টদের সিক্রেট কিংডম প্রতিষ্ঠা করে রেখেছে।
তাদের এই জুলুম থেকে দুনিয়াবাসীকে হেফাজত করতে হলে ইসলামি সভ্যতার পুনর্জাগরণ অত্যাবশ্যক। সুতরাং
পাশ্চাত্য সভ্যতার দানবীয় আগ্রাসনকে রুখতে হলে একটি নতুন বিশ্বব্যবস্থা নির্মাণ করতে হবে এবং পাশ্চাত্য সভ্যতাকে ধাক্কা দিয়ে মিসমার করার জন্য একটি সত্যনিষ্ঠ দল তৈরি করতে হবে। যেখানে থাকবে এ যুগের ফারাবি, ইবনে সিনা, খাওয়ারিজমি, ইবনে খালদুন, গাজালি, সারাখসি, মিমার সিনান প্রভৃতি।
এজন্য প্রথমেই যেটি প্রয়োজন তা হলো ইসলামি বিশ্বব্যবস্থার চিন্তা ও কাজের ব্যাপকতা সম্পর্কে স্বচ্ছ জ্ঞান রাখা।