মুসা আল হাফিজের দর্শনচূর্ণ ট্রিলজি
মুসা আল হাফিজের দর্শনচূর্ণ ট্রিলজি - ছবি : সংগ্রহ
মুসা আল হাফিজ বহুমাত্রিক ও বহুপ্রজ। তিনি তার অন্তর্সত্তার আত্মপ্রকাশে অনেক পরিসর ও পরিচয়ে স্বাচ্ছন্দ্য। তিনি যেমন একজন প্রাজ্ঞ আলেম, তেমনই কাব্যকলায় আপন স্বাক্ষর ও চিহ্নের অধিকারী একজন মৌলিক কবি। একজন গদ্যলেখক, পর্যালোচক ও কুশলী অনুবাদক হিসেবেও অনেক বই তিনি প্রকাশ করেছেন। প্রাচ্যবাদ, ধর্মতত্ত্ব, ইতিহাস ও দর্শনের একজন একনিষ্ঠ গবেষক। সেই গবেষণার একজন সঞ্চারী রচয়িতা হিসেবে তার ভূমিকা ও অবদান ইতোমধ্যে বিদগ্ধজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। পাঠকপ্রিয়তার দিক থেকে তিনি তালিবে ইলম মহলে যথেষ্ট সমাদর অর্জন করেছেন। সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত পাঠক মহলেও তার আবেদন ও আকর্ষণ ব্যাপকতর। তার সাহিত্য, ভাষা ও ভাষ্যের মাধ্যমে তিনি জেনারেল ও দ্বীনি শিক্ষার দুর্ভেদ্য বিভাজনরেখা অনেকটাই অতিক্রম করতে পারছেন বলে মনে হচ্ছে।
মুসা আল হাফিজের লেখালেখির একটি প্রিয় প্রকরণ বা জেনার হচ্ছে তার নিজের ভাষায় ‘জীবন ও জগতে দার্শনিক দৃষ্টিপাত’। অর্থাৎ তিনি জীবন ও জগতের বিভিন্ন ও বিচিত্র অনুষঙ্গ সম্পর্কে তার দার্শনিক ভাবনা ও উপলব্ধিকে সঙ্কলিত করে গ্রন্থের রূপ দিয়ে থাকেন। এ ক্ষেত্রে তিনি ক্ষুদ্র ও মাঝারি পরিসরের গদ্য ও পদ্য আঙ্গিকে তার রচনা উপস্থাপন করে থাকেন। তার ইতোমধ্যে প্রকাশিত ‘নক্ষত্রচূর্ণ’ এবং ‘বিষগোলাপের বন’ বই দু’টি এই আঙ্গিকেই রচিত। বই দু’টি পাঠক মহলে যথেষ্ট উদযাপিত হয়েছে। ‘হৃদয়াস্ত্র’ তার এই আঙ্গিকে লেখা তৃতীয় ও সর্বসাম্প্রতিক গ্রন্থ। বিষয় ও প্রকরণগত সাযুজ্যের পরিপ্রেক্ষিতে এই বই তিনটির পরম্পরাকে মুসা আল হাফিজের দর্শনচূর্ণের ট্রিলজি বলা যেতে পারে।
২.
বাংলা সাহিত্যে এই আঙ্গিকটি খুব বেশি চর্চিত হয়েছে তা বলা যাবে না। তবে কয়েকটি উজ্জ্বল উদাহরণ যে নেই তাও নয়। আমরা জানি বাংলা সাহিত্যে ‘খনার বচন’ বলে একটা অত্যন্ত স্বতন্ত্র প্রকরণই রয়েছে। সেখানে এই বঙ্গীয় জনপদের একজন বিদগ্ধ নারী মনীষার কৃষিভিত্তিক সমাজ, সভ্যতা ও সংস্কৃতি-বিষয়ক প্রবচনগুচ্ছ সঙ্কলিত রয়েছে। এ ছাড়া অনেক অনামিক বচন ও বুদ্ধিদীপ্ত রসরঞ্জিত উক্তি বাংলা ভাষার মৌখিক পরম্পরায় প্রচলিত আছে। যার কিছু লিখিত রূপকল্পও পরবর্তীকালে বিভিন্ন সঙ্কলনে সংগৃহীত হয়েছে।
তবে আধুনিক বাংলা সাহিত্যে এই আঙ্গিকটি খুব বেশি অনুসৃত হয়নি বলা যায়। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের যারা দিকপাল, যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কিংবা কাজী নজরুল ইসলাম কিংবা জীবনানন্দ দাশ- এরা কেউই খুব সম্ভবত এই প্রকরণের বা আঙ্গিকের গ্রন্থ রচনা করেননি। তবে বাংলাদেশের আধুনিক সাহিত্যে সাম্প্রতিক কালের লেখক হুমায়ূন আজাদ এই প্রকরণটি বেশ গুরুত্বের সাথে চর্চা করেছেন। বিশেষ করে তার ‘হুমায়ূন আজাদের প্রবচনগুচ্ছ’ গ্রন্থটির কথা এই প্রসঙ্গে বলতেই হয়। তিনি একজন প্রান্তিক সেক্যুলার ও আধুনিকতাবাদী লেখক হিসেবে তার প্রথাবিরোধী রচনা ও বক্তব্যের জন্য বিতর্কিত। ফলে তার লেখাগুলো ক্রমে তার সমবিশ্বাসীদের মধ্যেই কেবল পঠিত ও চর্চিত হচ্ছে। তার জীবদ্দশায় তার এই প্রকরণের গ্রন্থাবলী দেশের আধুনিক সাহিত্যে যে আবেদন তৈরি করে তা বোধকরি ক্রমে ক্ষয়ে আসছে।
মুসলিম ঐতিহ্যে এই প্রকরণের কথা যদি বলি তাহলে বলা যায় মওলানা জালালউদ্দীন রুমীর ‘মসনভি’র কথা। সেখানে সুফি কাব্যদিয়ে যেমন, তেমনি কাব্যধারার মধ্যেই বিভিন্ন বিরতিতে বিভিন্ন আখ্যান স্থাপন করে মওলানা রুমী তার দার্শনিক বিশ্ববীক্ষা উপস্থাপন করেছেন। এ ছাড়া ফারসি ও উর্দু কাব্যের শের রচনার আঙ্গিকে স্বল্প পরিসর ব্যবহার করে অত্যধিক ব্যঞ্জনা ও দ্যোতনা সৃষ্টির একটি প্রবহমান ঐতিহ্য অনেক বছর ধরেই রয়েছে। এই ঐতিহ্যে বাকচতুর ও ক্ষিপ্রগতির সঞ্চারী পদরচনা করে কাব্যরসজ্ঞদের রসবোধকে গভীর অথচ মোহনীয়-জাদুকরী অনুভূতি ও বোধে নিমজ্জিত করে ফেলা হয়। এসব গদ্য ও পদ্য কলাশৈলীর মননশীল ও সৃজনশীল প্রতিফলন ও অনুরণন আমরা মুসা আল হাফিজের এই গ্রন্থ ট্রিলজিতেও দেখি। নিঃসন্দেহে তিনি মুসলিম বিশ্ব ও বাংলা সাহিত্যের এই অনতিপ্রচলিত প্রকরণশৈলীর নবজীবনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন।
পাশ্চাত্যে আধুনিক কালে জার্নাল আকারে সমধর্মী প্রকরণের উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত হলো ফরাসি ধ্রুপদী লেখক লা রশেফুকো (১৬১৩-১৬৮০)-র জার্নাল। যেখানে এই প্রকরণ ইউরোপীয় সাহিত্যে একটি চিরায়ত রূপের মর্যাদা অর্জন করেছে। রশেফুকোর বিদগ্ধ লেখনীতে ফরাসি এই ম্যাক্সিম (গধীরসব) প্রকরণ বিশ্ব সাহিত্যের একটি আদর্শ আঙ্গিকে পরিণত হয়েছে। ফরাসি ভাষার এই ম্যাক্সিম ইংরেজি ভাষায় এপিগ্রাম (বঢ়রমৎধস) বা এফরিজম (অঢ়যড়ৎরংস) বলে পরিচিত। এপিগ্রাম আদিতে বিভিন্ন স্মৃতিসৌধে খচিত হতো। ‘গ্রিক এন্থোলজি’ বলে একটি গ্রিক এপিগ্রামের সংকলন আছে যেটির সময়কাল ৭০০ খ্রিষ্টপূর্ব থেকে ১০০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। এই সংকলনের প্রভাবে এপিগ্রামের একটি সংজ্ঞা দাঁড়িয়ে গেছে। তা হলো এমন সংক্ষিপ্ত অথচ ভাবগর্ভ বচন যা কিছুটা তিক্ত অথচ শিক্ষণীয় অভিজ্ঞান সৃষ্টি করে। ক্যাটালাস (আনুমানিক ৮৪ খ্রিষ্টপূর্ব থেকে ৫৪ খ্রিষ্টপূর্ব) লাতিন এপিগ্রামের জনক। আর মার্শাল (৪০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১০৩ খ্রিষ্টাব্দ) এপিগ্রামের পরিণত রূপ দিয়েছিলেন। তার হাতে কৃত পরিণত এপিগ্রামের প্রকরণই সতেরো ও আঠারো শতকের আধুনিক ফরাসি ও ইংরেজি এপিগ্রাম লেখকরা অনুসরণ করেছেন।
ফরাসি লেখক লা রশেফুকোর ‘ম্যাক্সিম’ (১৬৬৫) এপিগ্রাম রচনার ইউরোপীয় ধারায় একটি উত্তুঙ্গ মুহূর্ত। তার এই শিল্পসাফল্য পরবর্তীকালে ফরাসি লেখক ভলতেয়ারকেও (১৬৯৪-১৭৭৮) প্রভাবিত করেছিল। লা রশেফুকোকে গ্রিক দার্শনিক এপিকিউরাস (খ্রিষ্টপূর্ব ৩৪১-খ্রিষ্টপূর্ব ২৭০)-এর অনুসারী বলে মনে করা হয়। মিশেল দ্য মতাইয়ঁ (১৫৩৩-১৫৯২) এবং ব্লেইজ পাসকাল (১৬২৩-১৬৬২)-এর মতো তিনি জানতেন যে মানব এক রহস্যময় সত্তা যার সমগ্র প্রচেষ্টাও তার জন্য অকিঞ্চিৎকর এবং যার জ্ঞান তাকে প্রায়শই উপহাস করে। মানুষ তার নিজের সম্পর্কে অনেক কিছুই জানে না; মানুষ তার ধারণায় তার সত্তার সব কিছুই ধারণ করতে পারে না। মানুষ যা এবং সে যা করে তার মধ্যে রয়েছে বিস্তর ফারাক। লা রশেফুকোর কিছু ম্যাক্সিমে প্রকাশ পেয়েছে শ্রমবিমুখ এক বিলাসিতা; আবার অন্য কিছুতে প্রকাশ পেয়েছে তার উত্তরকালের জার্মান দার্শনিক ফ্র্রিডরিখ নীটশে (১৮৪৪-১৯০০)-এর মতো শক্তিমত্তার উপাসনা। তার এসব প্রবণতাই তার ফরাসি ধ্রুপদী অনুসারীদের মধ্যে লক্ষ করা গেছে।
ইংল্যান্ডে এপিগ্রাম প্রসিদ্ধি অর্জন করে বেন জনসন (১৫৭২-১৬৩৭) এবং তার অনুসারীদের মাধ্যমে। ইংরেজ শ্রেষ্ঠ এপিগ্রামাটিস্টদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন জন ড্রাইডেন (১৬৩১-১৭০০), আলেকজান্ডার পোপ (১৬৮৮-১৭৪৪) এবং জনাথন সুইফট (১৬৬৭-১৭৪৫)। ইংরেজ কবি স্যামুয়েল টেইলর কোলরিজ (১৭৭২-১৮৩৪) উনিশ শতকের শুরুর দিকে এপিগ্রাম সম্পর্কে একটি এপিগ্রাম লেখেন যা এর সংজ্ঞা হিশেবে খুব প্রসিদ্ধ:
ডযধঃ রং ধহ ঊঢ়রমৎধস? অ ফধিৎভরংয যিড়ষব,
ওঃং নড়ফু নৎবারঃু, ধহফ রিঃ রঃং ংড়ঁষ.
জার্মান সাহিত্যে এপিগ্রাম প্রভাব বিস্তার করে আঠারো ও উনিশ শতকে। এর চূড়ান্ত ঔৎকর্ষ পরিলক্ষিত হয় ইয়োহান উলফগ্যাং ফন গ্যেটে (১৭৪৯-১৮৩২)-র রচনা ‘তধযসব ঢবহরবহ’ (১৮২০, “এবহঃষব ঊঢ়রমৎধসং”)-এ। ইংরেজি সাহিত্যের আরো সাম্প্রতিক লেখক যারা এপিগ্রাম রচনায় প্রসিদ্ধি অর্জন করেছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- অস্কার ওয়াইল্ড (১৮৫৪-১৯০০) এবং জর্জ বার্নার্ড শ (১৮৫৬-১৯৫০)। ওয়াইল্ড যেমন লিখেছিলেন : “অ পুহরপ রং ধ সধহ যিড় শহড়ংি ঃযব ঢ়ৎরপব ড়ভ বাবৎুঃযরহম ধহফ ঃযব াধষঁব ড়ভ হড়ঃযরহম.” অন্যদিকে বার্নার্ড শ উক্তি করেছিলেন : “অষষ মৎবধঃ ঃৎঁঃযং নবমরহ ধং নষধংঢ়যবসরবং.”
বাংলা ভাষায় সম্প্রতি কিছু ম্যাক্সিমগ্রন্থ রচিত হয়, জনপ্রিয় হয়। মুসা আল হাফিজের ট্টিলজিকে ঠিক ম্যাক্সিম বা এপিগ্রাম বলা যাবে না। তিনি ম্যাক্সিম-এপিগ্রাম প্রকরণে আটকে না থেকে স্বাতন্ত্র্যপ্রয়াসী হয়েছেন। এ স্বাতন্ত্র্য যে পরিকল্পিত, তার স্বাক্ষর স্পষ্ট করেছেন আপন গ্রন্থত্রয়ীতে।
৩.
‘নক্ষত্রচূর্ণ’, ‘বিষগোলাপের বন’ এবং ‘হৃদয়াস্ত্র’ আঙ্গিকের বইগুলোতে রয়েছে অতি সংক্ষিপ্ত বাক্য কিংবা পঙক্তির সমাহার। আরো রয়েছে কয়েক অনুচ্ছেদের মাঝারি আকৃতির আখ্যান বা বর্ণনামূলক ভাষা ও ভাষ্য। আঙ্গিক বা আকৃতি নির্বিশেষে সবক্ষেত্রেই সেখানে রয়েছে অনুভূতি, উপলব্ধি ও বোধের প্রগাঢ়তা ও গভীরতা। সেই সাথে গদ্য আঙ্গিকে রয়েছে মনোহর ও বিস্ময়কর বাকচাতুর্য ও বৈদগ্ধ্য। ভাষাসৌকর্য ও অনন্য ভাবকুশলতা। সংক্ষিপ্ত বাক্যের মধ্যে অর্থঘন ভাবের বুনন ও গ্রন্থন। যা ক্ষিপ্রবেগে চেতনায় সঞ্চারিত হয়। প্রত্যুৎপন্ন বুদ্ধিমত্তার আলোকরশ্মি বিকীরণ করে। তার প্রতিফলন ও প্রতিসরণের স্বাক্ষর রাখে। মাঝারি আকৃতির বা দৈর্ঘ্যরে গদ্য আখ্যান বা বর্ণনামূলক বয়ানের ক্ষেত্রে এমনসব অনুষঙ্গ বা ব্যক্তিত্বের উপস্থাপনা সেখানে থাকে যা কোনো অলোকসামান্য উপলব্ধি ও বোধের আশ্চর্যকর আবিষ্কার বা প্রাপ্তি হয়ে ওঠে।
অনুষঙ্গগুলোকে লেখক কয়েকটি বর্গে বিভক্ত করে নেন। কয়েকটি অর্থপূর্ণ উপশিরোনামে তা বিধৃত হয়। এতে করে আধেয় অনুষঙ্গের অধ্যায় বিন্যাস পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। উপশিরোনাম থেকে অন্তর্ভুক্ত অনুষঙ্গসমূহের থিম সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়। যা পাঠকদের পাঠ ও অনুধাবনে দারুণ সহায়ক হয়ে ওঠে।
বুদ্ধিদীপ্ত ও শিল্পসমৃদ্ধ বচন, উক্তি, আখ্যান ও পদাবলীর স্বদেশীয়, মুসলিম এবং ইউরোপীয় ঐতিহ্যের একটি সংক্ষিপ্ত পরিচিতি আমরা লাভ করেছি। এর ভিত্তিতে মুসা আল হাফিজের এই দর্শনচূর্ণ ট্রিলজি যদি পাঠ করি তাহলে আমরা বুঝতে পারব যে তিনি শিল্প রূপকল্পের দিক থেকে এই সব ঐতিহ্যেই নির্মোহ ও নিরহঙ্কার অবগাহন করেছেন। কিন্তু তার দর্শনচূর্ণের জ্ঞানকাণ্ডিক উৎস ও শিকড় খুঁজলে আমরা তা পাব মহান ইসলামে। তার বিশ্বাস ও প্রতীতির অন্তঃশীলা প্রবাহ তার রচনার রন্ধ্রে রন্ধ্রে অস্তিত্বমান ও দৃশ্যমান। তিনি এই কেন্দ্রবিন্দুতে অবিচলভাবে অবস্থান করেই অন্যসব পরিমণ্ডলে বিহার করেন। তার আত্মপরিচিতি, দার্শনিক ও জ্ঞানতাত্ত্বিক অবয়ব বিনির্মাণে তিনি ইসলামের প্রত্যাদেশীয় মূলসূত্র ও উৎসের প্রতি প্রতিপাদিত বিশ্বাসের সাথে নিবেদিত এবং অঙ্গীকারবদ্ধ।
৪.
মুসা আল হাফিজ যেহেতু একজন ক্রমপ্রসারমান সব্যসাচী সাহিত্যিক সেহেতু তিনি তার এই আঙ্গিকের গ্রন্থাবলীতেও বিন্যস্ত করেছেন গদ্য ও পদ্যের যুগলবন্দী। একজন শক্তিমান ভাষাশিল্পীর পক্ষেই কেবল ভাষার এই উভয় মাধ্যমে তার গহিন তাফাক্কুর ও তাদাব্বুরের এমন ভাব ও শিল্প সমৃদ্ধ উপস্থাপন সম্ভব।
যেখানে খুব অল্প বলে আমাদের অনেক না বলাকে বলে দেয়া হয়েছে। সেই বলার মধ্যে থাকে আমাদের অগ্নিদগ্ধ দিন-রাতের অসুখ ও দাওয়াই। এই বইয়ে তা দেখবেন মনোযোগী পাঠক। ছোট -বড় কথার মধ্যে পাবেন সময়ের সেই দেয়ালিকা, যা বিবেকের ভাষায় লিখিত। যেমন -
আমার লাশ কাঁধে নিয়ে বিচারের আদালতে যাচ্ছিলাম।
পুলিশ আমাকে আটকে বললো, তুমি এ লাশের খুনি!
কেবল দু’টি লাইন। সময় ও বাস্তবতাকে আসামি করে দিচ্ছে কী অবলীলায়! গোটা কালের দুশ্চরিত্র চিত্রাবলী আদালতে উঠতে থাকবে। এরপর সামনে আসে তদন্ত রিপোর্ট। খুব সংক্ষেপে :
তোমার চোখে কালাচ সাপের বিষের ফেণিল ঘৃণা
দুঃখ হলো, বিষের সাথেই চলছে তোমার যিনা!
সময়ের সাথে এ বোঝাপড়ার মধ্যে বইটি মনে করিয়ে দেয় বুদ্ধিজীবী ও নাগরিকদের দায়িত্ব। সেটাও দুই কথায়। যেমন-
‘বুদ্ধিজীবীর কাজ খুব বেশি না। তিনি উচিত সময়ে উচিত কথাটা বলবেন। যেমন, এই সময়ে তিনি বলবেন, সাপের উন্নয়ন মানেই ব্যাঙের উন্নয়ন নয়!
রাজনীতি একটি খেলা। আপনি খেলাটি খেলুন। নতুবা খেলাটি আপনাকে নিয়ে খেলবে।’
হয়তো ভাবছেন, বইটি তাহলে কী কেবল জীবনের বহিরাবরণ ও সমকালকে নিয়ে মগ্ন? মোটেও নয়। জীবনের গভীর বোধে মূলত বইটি আমাদের নিয়ে যায়। সেখানে চিরকালের গণিতকে উল্টে দিয়ে বইটি আমাদের শেখায় নতুন গণিতসূত্র। একটি কবিতা থেকে তার পরিচয় পেতে পারি। দর্শনঘন কবিতাটি পড়ে আমরা আলোচনার ইতি টানব। কারণ এখানে আমরা পেয়ে যাই আকাঙ্ক্ষিত জীবনরেখা; নতুন ব্যাকরণ -
গণিত
আমি তো গণিতের সমাধান বের করি
কিন্তু গণিতবিদরা আমাকেই একটি সমস্যা মনে করেন।
কারণ যখন খাতা হাজির করা হয়, আমি হাজির করি জীবন!
বলা হয়, যোগ করো! আমি যোগ করি আত্মশক্তিকে।
বলা হয়, বিয়োগ করো! আমি বিয়োগ করি পরাজয়কে।
বলা হয় গুণ করো! আমি গুণ করি ভালোবাসাকে।
বলা হয়, ভাগ করো! আমি ভাগ করি দুঃখকে।
বলা হয়, সমীকরণ দাও! আমি দিই নিজের মধ্যে সবাইকে।
বলা হয়, মান প্রকাশ করো! আমি প্রকাশ করি সফলতাকে।
তারা বলে, এটি আদৌ কোনো গণিত হয়নি,
তুমি অঙ্কের ব্যাকরণ জানো না!
আমি বলি, এটিই মহোত্তম অঙ্ক এবং
এ জন্য ব্যাকরণ লঙ্ঘন করে আমিই হয়ে উঠি নতুন ব্যাকরণ!
কবির এই ব্যাকরণ কি শুধু তার? সেটা কি আমাদেরও নয়? এই ব্যাকরণ তিনি হৃদয়াস্ত্র দিয়ে রচনা করেছেন। সেই অস্ত্রটাও কেবল তার থাকেনি, হয়ে উঠেছে আমাদের সবার। এভাবেই বইটি হাজির করে চৈন্তিক প্রস্তাব।
এই জেনার বা আঙ্গিকে লিখিত তিন গ্রন্থে মুসা আল হাফিজ এই বিষয়ে সফলতার সাথে উত্তীর্ণ হয়েছেন।