ইউক্রেন নিয়ে রাশিয়ার হুঁশিয়ারি
ইউক্রেন নিয়ে রাশিয়ার হুঁশিয়ারি - ছবি : সংগ্রহ
ইউক্রেন নিয়ে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের হুমকি পাল্টা হুমকিতে একটি সর্বব্যাপী মহাযুদ্ধের আশঙ্কা করছেন অনেকে। আসলেই কি তেমন কোনো পরিস্থিতি দেখা দেবে? এ ক্ষেত্রে নতুন করে সৃষ্ট শীতল যুদ্ধ নিয়ে অনেক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ হচ্ছে। বিশ্ব রাজনীতির নতুন মেরুকরণে গুরুত্বপূর্ণ একটি বছর ২০২২ সালে তাৎপর্যপূর্ণ অনেক ঘটনা ঘটতে পারে বলে বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের সামনে রুশ-চীন অক্ষ একটি শক্ত অবস্থান নিয়ে মুখোমুখি অবস্থায় এখন। রাশিয়া ও চীনের মধ্যে স্বার্থের টানাপড়েনে অনেক বিরোধের ক্ষেত্র থাকলেও আমেরিকান হুমকির সামনে দু’পক্ষই নিজেদের বিরোধকে এক পাশে ঠেলে রেখেছে। আর ইউক্রেন নিয়ে যেমন উদ্বেগে রয়েছে রাশিয়া, তেমনিভাবে তাইওয়ান ও দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে চরম এক উত্তেজনা চলছে বেইজিং এবং ওয়াশিংটনের মধ্যে। এর মধ্যে মিত্রদের নিয়ে ‘কোয়াড’ ও ‘অকাস’ নামে দুটি নিরাপত্তা জোট গঠন করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এগুলোর ঘোষিত লক্ষ্য হলো চীন।
সবকিছু ছাড়িয়ে এখন ইউক্রেন নিয়ে উত্তাপ উত্তেজনা বৈশ্বিক মিডিয়ার সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। ট্রাম্প আমলে মার্কিন প্রশাসনের সাথে যে বোঝাপড়া ছিল তা সম্ভবত এখন বাইডেন প্রশাসনের সাথে নেই। তবে বাইডেন আফগানিস্তান থেকে প্রত্যাহারের পর নতুন কোনো যুদ্ধে জড়াবেন কিনা সেটি নিয়ে নানা সংশয় রয়েছে। তবে ইউক্রেনকে কিভাবে নিরাপত্তা দেবেন তিনি সেই প্রশ্নও রয়ে গেছে। রাশিয়া এই ইউক্রেনকে মনে করে তার ‘নিরাপত্তা দেয়াল।’ দেশটি কোনোভাবেই চায় না, ইউক্রেন ন্যাটোর অংশ হোক। এ জন্যই আমেরিকার কাছে নতুন চুক্তি ও নিশ্চয়তা চাইছে মস্কো। সেটি না হলে রাশিয়া খানিকটা আগ্রাসী হবার ইঙ্গিতও এর মধ্যে দিয়েছে। এই আগ্রাসী হবার অর্থ হলো, ভূখণ্ড দখল অথবা প্রক্সি চালিয়ে ইউক্রেনে অস্থিরতা তৈরি করা। রাশিয়ার সর্বশেষ প্রস্তাবের মধ্যে পুতিনের সুপ্ত চিন্তা কিছুটা পাঠ করা যায়।
রাশিয়ার যমজ প্রস্তাব
গত ১৭ নভেম্বর রাশিয়ান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তার ওয়েবসাইটে রাশিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটোর মধ্যে নিরাপত্তা গ্যারান্টি সংক্রান্ত দু’টি খসড়া চুক্তি প্রকাশ করে। এটি ১৫ ডিসেম্বর মস্কোতে একটি বৈঠকে মার্কিন কর্মকর্তাদের কাছে হস্তান্তর করা হয় বলে জানানো হলো।
এর মধ্যে ‘যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ান ফেডারেশনের নিরাপত্তা গ্যারান্টি চুক্তি’ শিরোনামের প্রথম প্রস্তাবে বলা হয়, মস্কো এবং ওয়াশিংটনের দ্বারা আইনত বাধ্যতামূলক প্রতিশ্রুতি স্বাক্ষর করতে হবে যেখানে উভয় পক্ষ অন্য পক্ষের জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে এমন এলাকায় অস্ত্র ও বাহিনী মোতায়েন না করার বিষয়টি নিশ্চিত করবে। উভয় দেশ অন্য পক্ষের আক্রমণাত্মক দূরত্বের মধ্যে বিমান ও যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন থেকে বিরত থাকবে এবং তারা অন্যদের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে পারে এমন এলাকায় মধ্যবর্তী ও স্বল্প-পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপনের সীমা নির্ধারণ করবে। প্রস্তাবিত এই রুশ-মার্কিন চুক্তিতে আরো দাবি করা হয়েছে যে, উভয় পক্ষই বিদেশে পারমাণবিক অস্ত্র স্থাপন করা থেকে বিরত থাকবে এবং ইতোমধ্যেই মোতায়েন করা পারমাণবিক অস্ত্রগুলো তাদের মূল দেশে ফিরিয়ে নেবে।
‘রাশিয়া এবং ন্যাটো সদস্য রাষ্ট্রগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়ে চুক্তি’ শিরোনামের দ্বিতীয় প্রস্তাবে রাশিয়া এবং পশ্চিমা বলয়ের মধ্যে উত্তেজনা স্থায়ীভাবে সমাধান করা যেতে পারে- এমন উপায়গুলোর রূপরেখা দেয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে ন্যাটোর আরো সম্প্রসারণ এবং অন্তর্ভুক্তি নিষিদ্ধ করা, ইউক্রেনকে ন্যাটো জোটে অন্তর্ভুক্ত না করা এবং ১৯৯৭ সালে (পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোর ন্যাটোতে যোগদানের আগে) সীমানার বাইরে জোটের সদস্যদের দ্বারা অতিরিক্ত অস্ত্র ও সৈন্য মোতায়েনের সীমা নির্ধারণ করা।
প্রস্তাবদ্বয়ে মূলত ন্যাটোকে ইউক্রেন, ককেশাস এবং মধ্য এশিয়ায় তাদের সামরিক কার্যক্রম ত্যাগ করতে বলা হয়েছে। ন্যাটো এবং রাশিয়ার এমন অঞ্চলে মধ্যবর্তী এবং স্বল্প-পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করা উচিত নয় যেখানে তারা অপরপক্ষের ভূখণ্ডে আঘাত করতে পারে। উভয় পক্ষকে একটি সম্মত সীমান্ত অঞ্চলের কাছে ব্রিগেড স্তরের উপরে অনুশীলন না করা, একে অপরের সামরিক মহড়ার বিষয়ে নিয়মিত তথ্য আদান-প্রদান করা এবং জরুরি যোগাযোগের জন্য হট লাইন স্থাপন করার কথা বলা হয়। প্রস্তাবিত দলিলে দলগুলোকে আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত করার আহ্বান জানান হয় যে, তারা একে অপরকে প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখে না এবং সচেতনভাবে এমন পরিস্থিতি তৈরি না করার প্রতিশ্রুতি দেয় যা অন্য পক্ষের দ্বারা ‘হুমকি’ হিসাবে বিবেচিত হতে পারে।
ওয়াশিংটনের কর্মকর্তারা এবং ন্যাটো মহাসচিব জেনস স্টলটেনবার্গ নিশ্চিত করেছেন যে তারা রাশিয়ান প্রস্তাবগুলো পেয়েছেন। হোয়াইট হাউজ বলেছে, তারা প্রস্তাবটি স্টাডি করছে এবং শিগগিরই পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করার জন্য মস্কোর সাথে যোগাযোগ করবে। হোয়াইট হাউজের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাকক সুলিভান নিশ্চিত করেছেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘উপযুক্ত বিন্যাসে’ রাশিয়ার সাথে সংলাপের জন্য প্রস্তুত রয়েছে।
রাশিয়ার হুঁশিয়ারি ও ইউক্রেন
ন্যাটো যদি নিরাপত্তা গ্যারান্টির জন্য মস্কোর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে তাহলে রাশিয়াও পাল্টা হুমকি তৈরি করবে বলে জানিয়ে দিয়েছেন দেশটির উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলেকজান্ডার গ্রুশকো। তিনি বলেন, ‘আমরা সুস্পষ্টভাবে জানাচ্ছি যে, আমরা সামরিক বা সামরিক প্রযুক্তিগত বিষয়ের পরিবর্তে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করতে প্রস্তুত যা ওসিএসই জোট, ইউরো-আটলান্টিক ও ইউরেশিয়া অঞ্চলের সব দেশের নিরাপত্তা জোরদার করবে। যদি তা করা না হয়, আমরা পাল্টা হুমকি তৈরির পথে এগিয়ে যাবো। আমরা কেন এই সিদ্ধান্তগুলো নিয়েছি এবং কেন আমরা এই সিস্টেমগুলো মোতায়েন করেছি তা আমাদের জিজ্ঞাসা করার জন্য তখন অনেক দেরি হয়ে যাবে।
আলেকজান্ডার গ্রুশকো বলেন, ইউরোপীয়দের অবশ্যই এই মহাদেশটিকে সামরিক সংঘর্ষের ক্ষেত্রে পরিণত করার প্রতিক্রিয়া নিয়ে ভাবতে হবে। প্রকৃতপক্ষে, আমরা একটি বিপজ্জনক লাইনে পৌঁছেছি এবং আমাদের প্রস্তাবগুলো এই বিপজ্জনক লাইন থেকে দূরে সরে যাওয়া এবং স্বাভাবিক সংলাপের দিকে যাওয়ার লক্ষ্যে রয়েছে, যার অগ্রভাগে থাকবে নিরাপত্তা স্বার্থ। রাশিয়া ন্যাটোর সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে এমন এক পর্যায়ে এসেছে যেখানে রাশিয়ার নিরাপত্তা উদ্বেগগুলোকে কেবল ‘একপাশে সরিয়ে দেওয়া’ বা ‘আলোচনা’ করা আর সম্ভব নয়। গ্রুশকোর মতে, পশ্চিমের কাছে এখন দু’টি পথ রয়েছে : ‘প্রথমত, আমরা টেবিলে যা রেখেছি তা গুরুত্বসহকারে নেওয়া’, দ্বিতীয়ত সামরিক প্রযুক্তিগত বিকল্পের মুখোমুখি হওয়া।’
ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি আন্দ্রেই ইয়ারমাক ‘ফরেন পলিসি’কে বলেন, রাশিয়ার দাবি জানানোর কয়েক ঘণ্টা পর, ইউক্রেন পশ্চিমা কর্মকর্তাদের কাছে তাদের প্রতিশ্রুতি প্রকাশের জন্য সম্ভাব্য আক্রমণের বিষয়ে তাদের প্রতিক্রিয়া স্পষ্ট করার জন্য অনুরোধ করে। কিয়েভ তার মিত্রদের কাছ থেকে ‘অভূতপূর্ব সমর্থন’ অনুভব করেছে কিন্তু, এটিকে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপে পরিণত করা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
যেহেতু ইউক্রেন ন্যাটো সদস্য নয়, ফলে যে কেউ রাশিয়াকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য ইউক্রেনে সৈন্য পাঠাবে এমন নিশ্চয়তা নেই। এ কারণে, ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা সচিব বেন ওয়ালেস বলেছিলেন যে, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাগুলো সম্ভবত সবচেয়ে ব্যবহৃত হাতিয়ার হবে। এর আগে ক্রিমিয়া দখলের পর ওবামা প্রশাসন সেটিই করেছিলেন।
বাইডেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলেছেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার নিরাপত্তা প্রস্তাব নিয়ে রাশিয়ার সাথে জড়িত হতে প্রস্তুত- তবে ইউরোপীয় মিত্র ও অংশীদার ছাড়া ইউরোপীয় নিরাপত্তা নিয়ে কোনো আলোচনা হবে না। যুক্তরাষ্ট্র মূল নীতিগুলোর সাথে আপস করবে না যেগুলোর ওপর ‘ইউরোপীয় নিরাপত্তা’ তৈরি করা হয়েছে।
ইউক্রেনে কেন আগ্রাসী হতে চাইছে রাশিয়া?
রাশিয়ার নিরাপত্তা প্রস্তাবে বোঝা যায় দেশটি তার নিরাপত্তা নিয়ে যথেষ্ট উদ্বেগের মধ্যে রয়েছে। এই প্রসঙ্গে বিশ্ব খ্যাত নিরাপত্তা বিশ্লেষক জর্জ ফ্রিডম্যান মনে করেন, রাশিয়াকে একটি বিশ্বস্ত দেশ মনে না করার সঙ্গত কারণ রয়েছে। বিংশ শতকে জার্মানি দুইবার দেশটিকে আক্রমণ করেছিল। ফ্রান্স ঊনবিংশ শতকে একবার এবং সুইডেন অষ্টাদশ শতকে একবার রাশিয়া আক্রমণ করেছিল। এ ধরনের ঘটনায় ইউরোপ অভ্যস্ত ছিল। এমন অনুপ্রবেশ আকস্মিকও ছিল না। তবে গভীর অনুপ্রবেশের অর্থ ছিল রাশিয়ার কেন্দ্রস্থল দখল করা এবং এটিকে স্থায়ীভাবে অধীনে নিয়ে আসা।
জর্জ ফ্রিডম্যান বলেন, এই যে প্রতি শতাব্দীতে রাশিয়ার ওপর তার অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলার মতো আক্রমণ হয়েছে তার প্রভাব পড়েছে রুশ নিরাপত্তা ভাবনায়। এরকম কিছু ভুলে যাওয়া তাদের জন্য কঠিন আর রাশিয়ার জন্য তার পরিধির মধ্যে অন্যদের চলাফেরা নিয়ে সন্দেহ না করাটাও হয়তোবা কঠিন। রাশিয়ান ইতিহাসে এমন কিছু নেই যা এর নেতাদের অন্য কিছু ভাবাতে পারে। এই মনোভাবই রাশিয়াকে তার প্রতিবেশীদের জন্য হুমকিস্বরূপ করে তোলে।’
এই আমেরিকান নিরাপত্তা বিশ্লেষকের মতে, পশ্চিমারা সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনে কেবল বাইরের দেশগুলোকে স্বাধীন হতে দেখেছিল। রাশিয়ানরা তা হতে দিয়েছে বলে বাস্তবে সেটি ঘটেছিল। কিন্তু পরবর্তী ঘটনা পরম্পরায় রাশিয়ানরা হতবাক হয়ে পড়ে, তারা এটাকে এইভাবে দেখার জন্য প্রস্তুত ছিল না। মস্কো পশ্চিম থেকে সেরাটি আশা করেছিল। তারা ধরে নিয়েছিল, সদ্য স্বাধীন দেশগুলো নিরপেক্ষ হবে এবং সেসব দেশ রাশিয়ার জন্য হুমকি হবে না। পরবর্তী গতিশীলতা আসলে সেভাবে সুশৃঙ্খল ও সরলরৈখিক হয়নি। সময়ের সাথে সাথে ইউক্রেনীয় সরকার আর রাশিয়া কাছাকাছি চলে আসে। আর এটি সোভিয়েত-পরবর্তী বিশ্বের পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গি, সেইসাথে অনেক ইউক্রেনীয়ের প্রত্যাশাকে হতাশ করে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মাত্র ২৪ বছর পরে ইউক্রেনে বিপ্লব করে পশ্চিমপন্থীরা দেশটির রাশিয়াপন্থী সরকারের পতন ঘটায়।
জর্জ ফ্রিডম্যান উল্লেখ করেন, পশ্চিমা বা আমেরিকান দৃষ্টিকোণ থেকে, ইউক্রেন একটি স্বাধীন জাতি ছিল। এর বিষয়গুলোর সাথে রাশিয়ার কোনো সম্পর্ক ছিল না। আর রাশিয়ায় ছিল একটি দুর্নীতিগ্রস্ত এবং দমনমূলক শাসন। আমেরিকান নৈতিক প্রকল্পের অংশ হিসাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেই শাসনের বিরুদ্ধে জেগে উঠে গণতান্ত্রিক অধিকার দাবিকারীদের সমর্থন করেছিল। অথচ রাশিয়া জিনিসগুলোকে দেখে ভিন্নভাবে। রুশ দৃষ্টিকোণ থেকে, উৎখাত করা সরকার ছিল ইউক্রেনের বৈধভাবে নির্বাচিত সরকার। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমাপন্থী সরকার এটি চাপিয়ে দেওয়ার জন্য একটি অভ্যুত্থানের আয়োজন করেছিল। এভাবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণ নিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনকে পুঁজি করে। অথচ এই পোল্টাভা, ইউক্রেনে রাশিয়ানরা অষ্টাদশ শতকে সুইডিশ অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দিয়েছিল, মস্কো থেকে যা মাত্র ৮০০ কিলোমিটার দূরে।
ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে আমেরিকানরা যা করছে তা নিয়ে পশ্চিমারা যাই ভাবুক না কেন রাশিয়ানরা এটিকে রাশিয়ার ওপর হুমকি হিসাবে দেখে। গণতন্ত্রকে উৎসাহিত করার অজুহাত দেখিয়ে রাশিয়ার জাতীয় নিরাপত্তার অধিকার লঙ্ঘন হিসাবেই রুশরা এটিকে দেখে। আমেরিকান দৃষ্টিকোণ থেকে, ইউক্রেনের জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ছিল। রাশিয়ান দৃষ্টিকোণ থেকে, রাশিয়ার জন্য অস্তিত্বের হুমকি সৃষ্টি করার অধিকার তারা রাখে না। ভূ-রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে, একটি আমেরিকাপন্থী ইউক্রেন ছিল নিছক রাশিয়ান নিরাপত্তাহীনতার এক দীর্ঘ গল্পের নতুন অধ্যায়।
ফ্রিডম্যানের পর্যবেক্ষণ অনুসারে, রাশিয়া পূর্ববর্তী আক্রমণ থেকে বেঁচে গিয়েছিল আক্রমণকারী এবং মস্কোর মধ্যে দূরত্ব তৈরি করে। পূর্ববর্তী শতাব্দীর সব আক্রমণ ব্যর্থ হয়েছিল কারণ আক্রমণকারীদের এত বেশি অঞ্চল অতিক্রম করতে হয়েছিল যে, গ্রীষ্মের আক্রমণ শেষ হতে রাশিয়ার শীতকাল এসে যায়। ইউক্রেনে একটি আমেরিকান ‘পুতুল’ সরকার রাশিয়ার জন্য সেই দূরত্ব নাটকীয়ভাবে কমিয়ে ফেলে, বাফার জোনটি আর থাকে না। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে যা রাশিয়াকে পাহারা দিয়েছিল তা আর রক্ষিত থাকে না ইউক্রেনে নিয়ন্ত্রণ হারালে।
জর্জ ফ্রিডম্যানের বিশ্লেষণ অনুসারে, রাশিয়ার জন্য, এটি ছিল সোভিয়েত-পরবর্তী যুগের উল্টে যাওয়া একটি নিরাপত্তা ইস্যু। ইউক্রেন রাশিয়ার প্রতিরক্ষার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। অবশ্য, এটি একমাত্র উপাদান নয়। রাশিয়ায় বাইরের আক্রমণের প্রধান লাইন হল উত্তর ইউরোপীয় সমভূমি, যা ফ্রান্স থেকে প্রায় মস্কো পর্যন্ত বিস্তৃত। সোভিয়েত ইউনিয়নের পশ্চিম সীমান্ত ছিল বেলারুস এবং পোল্যান্ডের সাথে নোঙর করা। রাশিয়ায় আক্রমণের দ্বিতীয় এবং আরো কঠিন লাইন হলো ককেশাস, যা রাশিয়াকে তুরস্ক, ইরান এবং তাদের মিত্রদের থেকে আলাদা করে। সোভিয়েতরা চেচনিয়া এবং দাগেস্তানসহ বিশাল উত্তর ককেশাস পর্বত নিয়ন্ত্রণ করেছিল। দক্ষিণ ককেশাসে আজারবাইজান, জর্জিয়া এবং আর্মেনিয়া আগে ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ আর সে সাথে রাশিয়ার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বাফার অঞ্চল।
মধ্য এশিয়া ছিল আক্রমণের তৃতীয় লাইন। এই অঞ্চলের দেশগুলো রাশিয়ার জন্য নিজেরা কোনো হুমকি নয়, কিন্তু আফগানিস্তান থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাহার পানিকে নতুন করে ঘোলা করেছে। তালেবান ধরনের ইসলামপন্থীদের কাছ থেকে সহিংসতা ছড়ানোর সত্যিকারের হুমকি রয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে তার তৎপরতাকে সমর্থন করার জন্য এই অঞ্চলে বিমান ঘাঁটি খুঁজছে। এর ফলে রাশিয়ার জন্য মধ্য এশিয়াকে নিরাপদ করাও গুরুত্বপূর্ণ।
এক কথায়, রাশিয়া নানা ধরনের নিরাপত্তা দুর্বলতা দ্বারা বেষ্টিত। তারা তাদের সামনে থাকা হুমকি মোকাবেলার জন্য একটি নরম পন্থা গড়ে তুলেছে। তারা ট্যাংক পাঠায় না; তার প্রভাব বৃদ্ধির জন্য রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যাকে ব্যবহার করে। এটি বেলারুসের ক্ষেত্রে হয়েছে। সেখানে রাষ্ট্রপতি আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কোর অধীনে অস্থিতিশীলতা রাশিয়াকে তার শক্তি বাড়াতে সহায়তা এবং পোল্যান্ডের সাথে সীমান্তকে অস্থিতিশীল করে। মধ্য এশিয়ায়, এটি অর্থনৈতিক সম্পর্ক এবং মধ্য এশিয়ার রাজ্যগুলোর মধ্যে উত্তেজনাকে তার প্রভাব বাড়াতে ব্যবহার করে। দক্ষিণ ককেশাসে, এটি আজারবাইজান এবং আর্মেনিয়ার মধ্যে একটি যুদ্ধবিরতি বজায় রাখার জন্য শান্তিরক্ষীদের সন্নিবেশ করেছে, এটিকে সুবিধার জন্য বিভিন্ন উপায় দিয়েছে। রাশিয়া অবশ্যই চীনের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখে, তবে উভয়ই একে অপরের ব্যাপারে সতর্ক থাকে।
উত্তর ইউরোপীয় সমভূমি, ককেশাস, মধ্য এশিয়া এবং চীনা সীমান্ত সবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে রাশিয়ার জন্য কেন্দ্রীয় ইস্যু এখন ইউক্রেন। রাশিয়ার দৃষ্টিকোণ থেকে ইউক্রেনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার নখর ডুবিয়েছে। রাশিয়া বেলারুসকে পরিচালনা করতে পারে, কিন্তু আমেরিকান হস্তক্ষেপের সম্ভাবনার কারণে ইউক্রেনে নরম শক্তি প্রয়োগ করতে পারে না। আগামী সপ্তাহগুলোতে সেখানে রাশিয়ান আক্রমণের গুজব রয়েছে। তবে প্রকৃত আক্রমণ কখন হবে তা ঘোষণা করা হয়নি। অন্যদিকে, তারা যে আক্রমণ করতে চায় না সেটি ঘোষণা করা উচিত হলেও তা করা হয়নি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এটা মনে রাখা উচিত যে, রাশিয়া তার সীমান্তে একগুচ্ছ জটিল এবং বিপজ্জনক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে। তাদের যে কোনো একটি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। আর অন্য সব দেশের মতো, রাশিয়ার করণীয়ও এক রকম সীমিত। মস্কো স্পষ্টতই একযোগে না গিয়ে ক্রমানুসারে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎপর হওয়ার সম্ভাবনা যতক্ষণ কম থাকবে ততক্ষণ সময় মস্কোর পক্ষে থাকতে পারে। রাশিয়াকে তার দৃষ্টিকোণ থেকে অন্তত সোভিয়েত যুগের হুমকি প্রশমিত করতে হবে। ফলে রাশিয়ার ওপর চাপ অনেক। এই চাপকে পশ্চিমারা ঠিকভাবে উপলব্ধি করতে না পারলে, যে হুমকি ক্রেমলিন থেকে দেয়া হয়েছে তা ঘটে যাওয়া অসম্ভব কিছু নয়। আর এটি থেকে আরেক মহাযুদ্ধের সূত্রপাত যে হতে পারে, তা নিয়ে আশঙ্কার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
mrkmmb@gmail.com