ইউক্রেনে কেন আগ্রাসী হতে চাইছে রাশিয়া?
ইউক্রেনে কেন আগ্রাসী হতে চাইছে রাশিয়া? - ছবি : সংগ্রহ
ইউক্রেন নিয়ে সম্প্রতি দেয়া রাশিয়ার নিরাপত্তা প্রস্তাবে বোঝা যায় দেশটি তার নিরাপত্তা নিয়ে যথেষ্ট উদ্বেগের মধ্যে রয়েছে। এই প্রসঙ্গে বিশ্ব খ্যাত নিরাপত্তা বিশ্লেষক জর্জ ফ্রিডম্যান মনে করেন, রাশিয়াকে একটি বিশ্বস্ত দেশ মনে না করার সঙ্গত কারণ রয়েছে। বিংশ শতকে জার্মানি দুইবার দেশটিকে আক্রমণ করেছিল। ফ্রান্স ঊনবিংশ শতকে একবার এবং সুইডেন অষ্টাদশ শতকে একবার রাশিয়া আক্রমণ করেছিল। এ ধরনের ঘটনায় ইউরোপ অভ্যস্ত ছিল। এমন অনুপ্রবেশ আকস্মিকও ছিল না। তবে গভীর অনুপ্রবেশের অর্থ ছিল রাশিয়ার কেন্দ্রস্থল দখল করা এবং এটিকে স্থায়ীভাবে অধীনে নিয়ে আসা।
জর্জ ফ্রিডম্যান বলেন, এই যে প্রতি শতাব্দীতে রাশিয়ার ওপর তার অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলার মতো আক্রমণ হয়েছে তার প্রভাব পড়েছে রুশ নিরাপত্তা ভাবনায়। এরকম কিছু ভুলে যাওয়া তাদের জন্য কঠিন আর রাশিয়ার জন্য তার পরিধির মধ্যে অন্যদের চলাফেরা নিয়ে সন্দেহ না করাটাও হয়তোবা কঠিন। রাশিয়ান ইতিহাসে এমন কিছু নেই যা এর নেতাদের অন্য কিছু ভাবাতে পারে। এই মনোভাবই রাশিয়াকে তার প্রতিবেশীদের জন্য হুমকিস্বরূপ করে তোলে।’
এই আমেরিকান নিরাপত্তা বিশ্লেষকের মতে, পশ্চিমারা সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনে কেবল বাইরের দেশগুলোকে স্বাধীন হতে দেখেছিল। রাশিয়ানরা তা হতে দিয়েছে বলে বাস্তবে সেটি ঘটেছিল। কিন্তু পরবর্তী ঘটনা পরম্পরায় রাশিয়ানরা হতবাক হয়ে পড়ে, তারা এটাকে এইভাবে দেখার জন্য প্রস্তুত ছিল না। মস্কো পশ্চিম থেকে সেরাটি আশা করেছিল। তারা ধরে নিয়েছিল, সদ্য স্বাধীন দেশগুলো নিরপেক্ষ হবে এবং সেসব দেশ রাশিয়ার জন্য হুমকি হবে না। পরবর্তী গতিশীলতা আসলে সেভাবে সুশৃঙ্খল ও সরলরৈখিক হয়নি। সময়ের সাথে সাথে ইউক্রেনীয় সরকার আর রাশিয়া কাছাকাছি চলে আসে। আর এটি সোভিয়েত-পরবর্তী বিশ্বের পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গি, সেইসাথে অনেক ইউক্রেনীয়ের প্রত্যাশাকে হতাশ করে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মাত্র ২৪ বছর পরে ইউক্রেনে বিপ্লব করে পশ্চিমপন্থীরা দেশটির রাশিয়াপন্থী সরকারের পতন ঘটায়।
জর্জ ফ্রিডম্যান উল্লেখ করেন, পশ্চিমা বা আমেরিকান দৃষ্টিকোণ থেকে, ইউক্রেন একটি স্বাধীন জাতি ছিল। এর বিষয়গুলোর সাথে রাশিয়ার কোনো সম্পর্ক ছিল না। আর রাশিয়ায় ছিল একটি দুর্নীতিগ্রস্ত এবং দমনমূলক শাসন। আমেরিকান নৈতিক প্রকল্পের অংশ হিসাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেই শাসনের বিরুদ্ধে জেগে উঠে গণতান্ত্রিক অধিকার দাবিকারীদের সমর্থন করেছিল। অথচ রাশিয়া জিনিসগুলোকে দেখে ভিন্নভাবে। রুশ দৃষ্টিকোণ থেকে, উৎখাত করা সরকার ছিল ইউক্রেনের বৈধভাবে নির্বাচিত সরকার। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমাপন্থী সরকার এটি চাপিয়ে দেওয়ার জন্য একটি অভ্যুত্থানের আয়োজন করেছিল। এভাবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণ নিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনকে পুঁজি করে। অথচ এই পোল্টাভা, ইউক্রেনে রাশিয়ানরা অষ্টাদশ শতকে সুইডিশ অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দিয়েছিল, মস্কো থেকে যা মাত্র ৮০০ কিলোমিটার দূরে।
ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে আমেরিকানরা যা করছে তা নিয়ে পশ্চিমারা যাই ভাবুক না কেন রাশিয়ানরা এটিকে রাশিয়ার ওপর হুমকি হিসাবে দেখে। গণতন্ত্রকে উৎসাহিত করার অজুহাত দেখিয়ে রাশিয়ার জাতীয় নিরাপত্তার অধিকার লঙ্ঘন হিসাবেই রুশরা এটিকে দেখে। আমেরিকান দৃষ্টিকোণ থেকে, ইউক্রেনের জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ছিল। রাশিয়ান দৃষ্টিকোণ থেকে, রাশিয়ার জন্য অস্তিত্বের হুমকি সৃষ্টি করার অধিকার তারা রাখে না। ভূ-রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে, একটি আমেরিকাপন্থী ইউক্রেন ছিল নিছক রাশিয়ান নিরাপত্তাহীনতার এক দীর্ঘ গল্পের নতুন অধ্যায়।
ফ্রিডম্যানের পর্যবেক্ষণ অনুসারে, রাশিয়া পূর্ববর্তী আক্রমণ থেকে বেঁচে গিয়েছিল আক্রমণকারী এবং মস্কোর মধ্যে দূরত্ব তৈরি করে। পূর্ববর্তী শতাব্দীর সব আক্রমণ ব্যর্থ হয়েছিল কারণ আক্রমণকারীদের এত বেশি অঞ্চল অতিক্রম করতে হয়েছিল যে, গ্রীষ্মের আক্রমণ শেষ হতে রাশিয়ার শীতকাল এসে যায়। ইউক্রেনে একটি আমেরিকান ‘পুতুল’ সরকার রাশিয়ার জন্য সেই দূরত্ব নাটকীয়ভাবে কমিয়ে ফেলে, বাফার জোনটি আর থাকে না। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে যা রাশিয়াকে পাহারা দিয়েছিল তা আর রক্ষিত থাকে না ইউক্রেনে নিয়ন্ত্রণ হারালে।
জর্জ ফ্রিডম্যানের বিশ্লেষণ অনুসারে, রাশিয়ার জন্য, এটি ছিল সোভিয়েত-পরবর্তী যুগের উল্টে যাওয়া একটি নিরাপত্তা ইস্যু। ইউক্রেন রাশিয়ার প্রতিরক্ষার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। অবশ্য, এটি একমাত্র উপাদান নয়। রাশিয়ায় বাইরের আক্রমণের প্রধান লাইন হল উত্তর ইউরোপীয় সমভূমি, যা ফ্রান্স থেকে প্রায় মস্কো পর্যন্ত বিস্তৃত। সোভিয়েত ইউনিয়নের পশ্চিম সীমান্ত ছিল বেলারুস এবং পোল্যান্ডের সাথে নোঙর করা। রাশিয়ায় আক্রমণের দ্বিতীয় এবং আরো কঠিন লাইন হলো ককেশাস, যা রাশিয়াকে তুরস্ক, ইরান এবং তাদের মিত্রদের থেকে আলাদা করে। সোভিয়েতরা চেচনিয়া এবং দাগেস্তানসহ বিশাল উত্তর ককেশাস পর্বত নিয়ন্ত্রণ করেছিল। দক্ষিণ ককেশাসে আজারবাইজান, জর্জিয়া এবং আর্মেনিয়া আগে ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ আর সে সাথে রাশিয়ার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বাফার অঞ্চল।
মধ্য এশিয়া ছিল আক্রমণের তৃতীয় লাইন। এই অঞ্চলের দেশগুলো রাশিয়ার জন্য নিজেরা কোনো হুমকি নয়, কিন্তু আফগানিস্তান থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাহার পানিকে নতুন করে ঘোলা করেছে। তালেবান ধরনের ইসলামপন্থীদের কাছ থেকে সহিংসতা ছড়ানোর সত্যিকারের হুমকি রয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে তার তৎপরতাকে সমর্থন করার জন্য এই অঞ্চলে বিমান ঘাঁটি খুঁজছে। এর ফলে রাশিয়ার জন্য মধ্য এশিয়াকে নিরাপদ করাও গুরুত্বপূর্ণ।
এক কথায়, রাশিয়া নানা ধরনের নিরাপত্তা দুর্বলতা দ্বারা বেষ্টিত। তারা তাদের সামনে থাকা হুমকি মোকাবেলার জন্য একটি নরম পন্থা গড়ে তুলেছে। তারা ট্যাংক পাঠায় না; তার প্রভাব বৃদ্ধির জন্য রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যাকে ব্যবহার করে। এটি বেলারুসের ক্ষেত্রে হয়েছে। সেখানে রাষ্ট্রপতি আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কোর অধীনে অস্থিতিশীলতা রাশিয়াকে তার শক্তি বাড়াতে সহায়তা এবং পোল্যান্ডের সাথে সীমান্তকে অস্থিতিশীল করে। মধ্য এশিয়ায়, এটি অর্থনৈতিক সম্পর্ক এবং মধ্য এশিয়ার রাজ্যগুলোর মধ্যে উত্তেজনাকে তার প্রভাব বাড়াতে ব্যবহার করে। দক্ষিণ ককেশাসে, এটি আজারবাইজান এবং আর্মেনিয়ার মধ্যে একটি যুদ্ধবিরতি বজায় রাখার জন্য শান্তিরক্ষীদের সন্নিবেশ করেছে, এটিকে সুবিধার জন্য বিভিন্ন উপায় দিয়েছে। রাশিয়া অবশ্যই চীনের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখে, তবে উভয়ই একে অপরের ব্যাপারে সতর্ক থাকে।
উত্তর ইউরোপীয় সমভূমি, ককেশাস, মধ্য এশিয়া এবং চীনা সীমান্ত সবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে রাশিয়ার জন্য কেন্দ্রীয় ইস্যু এখন ইউক্রেন। রাশিয়ার দৃষ্টিকোণ থেকে ইউক্রেনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার নখর ডুবিয়েছে। রাশিয়া বেলারুসকে পরিচালনা করতে পারে, কিন্তু আমেরিকান হস্তক্ষেপের সম্ভাবনার কারণে ইউক্রেনে নরম শক্তি প্রয়োগ করতে পারে না। আগামী সপ্তাহগুলোতে সেখানে রাশিয়ান আক্রমণের গুজব রয়েছে। তবে প্রকৃত আক্রমণ কখন হবে তা ঘোষণা করা হয়নি। অন্যদিকে, তারা যে আক্রমণ করতে চায় না সেটি ঘোষণা করা উচিত হলেও তা করা হয়নি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এটা মনে রাখা উচিত যে, রাশিয়া তার সীমান্তে একগুচ্ছ জটিল এবং বিপজ্জনক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে। তাদের যে কোনো একটি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। আর অন্য সব দেশের মতো, রাশিয়ার করণীয়ও এক রকম সীমিত। মস্কো স্পষ্টতই একযোগে না গিয়ে ক্রমানুসারে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎপর হওয়ার সম্ভাবনা যতক্ষণ কম থাকবে ততক্ষণ সময় মস্কোর পক্ষে থাকতে পারে। রাশিয়াকে তার দৃষ্টিকোণ থেকে অন্তত সোভিয়েত যুগের হুমকি প্রশমিত করতে হবে। ফলে রাশিয়ার ওপর চাপ অনেক। এই চাপকে পশ্চিমারা ঠিকভাবে উপলব্ধি করতে না পারলে, যে হুমকি ক্রেমলিন থেকে দেয়া হয়েছে তা ঘটে যাওয়া অসম্ভব কিছু নয়। আর এটি থেকে আরেক মহাযুদ্ধের সূত্রপাত যে হতে পারে, তা নিয়ে আশঙ্কার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
mrkmmb@gmail.com