ডায়াবেটিস থাকলে চোখের যত্ন নেবেন কিভাবে?
ডায়াবেটিস থাকলে চোখের যত্ন নেবেন কিভাবে? - ছবি : সংগ্রহ
ডায়াবেটিসকে এত গুরুত্ব কেন?
ডায়াবেটিস আজকের দিনে আমাদের জীবনের নিত্যসঙ্গী। এখন জীবনধারাও এমন, সঠিক খাদ্যাভ্যাস ও ব্যায়ামের অভাবে অনেকেই ডায়াবেটিসের শিকার হয়ে পড়ি। অথচ সময়ে রোগ নির্ণয়ের অভাবে রোগী জানতেও পারেন না, সুগার ধরেছে। যখন জানা যায়, সুগারের বাড়াবাড়ির জন্য অনেককেই ওষুধ, এমনকি ইনসুলিন চালু করতে হয়। তত দিনে নিশ্চুপে ডায়াবেটিস শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের ক্ষতিসাধন করে দেয়।
আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান বলে, সুগার প্রায় প্রতিটি অভ্যন্তরীণ অঙ্গে ছাপ রেখে যায়। সবচেয়ে বেশি যে সব জায়গার ক্ষতি করে, তাদের মধ্যে অন্যতম হলো আমাদের চোখ। অনেকেই জানেন না, ডায়াবেটিস চোখের পর্দার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। এমনকি সময়ে চিকিৎসা না হলে অন্ধত্ব ডেকে আনতে পারে।
ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি
চোখের পর্দার ওপর ডায়াবেটিসের প্রভাবকেই ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি বলা হয়। আমাদের চোখের রেটিনা (তথাকথিত ভাষায় চোখের পর্দা) হচ্ছে চোখের এমন একটি অংশ, যেখানে আলো পড়ে ছবি তৈরি হয়। চোখের পর্দা হলো একটি অত্যন্ত সংবেদনশীল অংশ। এখানে কোনো ক্ষতি হলে চিকিৎসার পরও সারা জীবনের মতো রেশ থেকে যেতে পারে। মনে রাখবেন, চোখের পর্দার কোনও রোগের চিকিৎসা করা যায়, কিন্তু একবার ক্ষতি হয়ে গেলে পর্দা পাল্টানো যায় না।
কোন ধরনের রোগীর সমস্যা হয়?
মনে রাখতে হবে, চোখের উপর ডায়াবেটিসের প্রভাব একদিনে হয় না। যারা ৪ থেকে ৫ বছর বা তার থেকে বেশি সময় ধরে সুগারে ভুগছেন, ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি হওয়ার আশঙ্কা তাদের বেশি। সময় যত গড়ায়, এই রোগের আশঙ্কাও তত বাড়ে।
একটু সহজ ভাষায় বোঝানো যাক। ডায়াবেটিসে আমাদের চোখের পর্দার রক্তবাহী শিরা ফেটে নতুন কিছু রক্তবাহী শিরা তৈরি হয়। একে বলা হয় নিও ভাসকুলারাইজেশন। ভাসকুলার এন্ডোথেলিয়ান গ্রোথ ফ্যাক্টর নামের একটি বিষয়ের জন্যে এই সমস্যা হয়। নতুন রক্তবাহী শিরাগুলিও খুব সহজে ফেটে যায় ও চোখের পর্দায় রক্তপাত হতে থাকে।
প্রাথমিক পর্যায়ে রোগী বুঝতেও পারেন না যে তার চোখের ভিতর ধীরে ধীরে এতবড় ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। ভুললে চলবে না, ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি ক্ষীণ দৃষ্টিশক্তির অন্যতম কারণ। যতদিনে রোগী বোঝেন তার দেখতে অসুবিধা হচ্ছে, ততদিনে রেটিনোপ্যাথি আরও বেড়ে যায়। চোখের পর্দার রক্তবাহী শিরায় লিকেজের কারণে পর্দার স্তরের মাঝখানে ফ্লুইড জমে যায়। ম্যাকুলার এরিয়ার থিকনেস বেড়ে যাওয়ায় দৃষ্টিশক্তি কমে যায়।
চিকিৎসা
১. দ্রুত চিকিৎসাই একমাত্র ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির কারণে দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হওয়া আটকাতে পারে।
২. এর চিকিৎসায় প্রধানত ইন্টাভিট্রিয়াল ব্যবহার করা যেতে পারে।
৩. কিছু দীর্ঘস্থায়ী রোগের ক্ষেত্রে ইন্টাভিট্রিয়ান স্টেরয়েড ইঞ্জেকশন বা ইমপ্ল্যান্ট ব্যবহার করা যেতে পারে।
৪. লেজারের মাধ্যমেও রক্তবাহী শিরার রক্তক্ষরণ বন্ধ করা যেতে পারে।
৫. কম ও মাঝারি স্তরের রোগে লেজার ও ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে চিকিৎসা সম্ভব। কিন্তু রোগ বাড়লে এবং খুব বেশি মাত্রায় রক্ত ক্ষরণ হলে তখন দৃষ্টিশক্তি বাঁচাতে অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হয়।
শিক্ষা
এর থেকে আমাদের শিক্ষণীয় হলো যে ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি এমন একটি রোগ, যার থেকে আপনাকে বাঁচাতে পারে দু’টি বিষয়। সুগার হওয়া আটকানো এবং যথাসময়ে চেকআপ। সবার মধ্যে এই সচেতনতা আনতে হবে যে ডায়াবেটিস থাকলে চোখের পর্দার চেকআপ মাস্ট!
দুঃখের বিষয়, আমাদের আশপাশের বহু মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। কিন্তু তারা ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি সম্পর্কে কিছুই জানেন না। চশমার চেকআপ করেন। কিন্তু রেটিনার চেকআপ অনেক করেন না।
জেনে রাখা জরুরি
আমাদের এখানকার মানুষের কম দৃষ্টিশক্তির বড় কারণ এখন পর্যন্ত ছানি। কিন্তু, মানুষ জানেনও না, অনেকের ক্ষীণদৃষ্টি এমনকি অন্ধত্বের কারণ ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথিও বটে।
দুভার্গ্যের বিষয়, এই রোগের উন্নত পর্যায়ে সঠিক ও আধুনিক উন্নতমানের চিকিৎসা সত্ত্বেও বহু মানুষ ভালোভাবে চোখে দেখতে পান না।
১. তাই খুব দরকার, সুগার লেভেল নিয়ন্ত্রণে রাখা। এইচবিএওয়ানসি-র এর মাত্রা সাতের নীচে রাখা।
২. প্রতি ৩ মাস অন্তর এই পরীক্ষা করা।
৩. সুগার কন্ট্রোলে থাকলে চোখের পর্দার রক্তক্ষরণের আশঙ্কা অনেক কমে যায়।
তাই সকলের কাছে বিনীত অনুরোধ, নিজেদের ব্লাড সুগার লেভেল চেক করান। সুগার ধরলে রেটিনা বিশেষজ্ঞকে দিয়ে চোখের পর্দার চেকআপ করান। পুষ্টিকর খাদ্য ও সুস্থ জীবনধারা আমাদের এই ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির হাত থেকে বাঁচাতে পারে। সুস্থ থাকুন ভালো থাকুন।
লেখক : চক্ষু বিশেষজ্ঞ, শঙ্কর জ্যোতি আই ইনস্টিটিউট
সূত্র : বর্তমান