আজারবাইজানে তুরস্কের সাফল্যের তাৎপর্য
আজারবাইজানে তুরস্কের সাফল্যের তাৎপর্য - ছবি : সংগ্রহ
তুর্কিভাষী রাষ্ট্রগুলোর সহযোগিতা পরিষদ তুর্কি কাউন্সিল নামে পরিচিত। গত ১২ নভেম্বর ২০২১ ইস্তাম্বুলে এই সংগঠনের অষ্টম শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে তুর্কি রাষ্ট্রগুলোর সংগঠনের নাম পরিবর্তনসহ বেশ কয়েকটি সাফল্যজনক সিদ্ধান্ত অনুমোদন করে। কাউন্সিলের বিভিন্ন নামের মধ্যে ইউনাইটেড স্টেটেস অব টার্কিক ওয়ার্ল্ড বা সংক্ষেপে ইউনাইটেড স্টেটস অব টার্কি নামটিও উঠে আসে।
শীর্ষ সম্মেলনের আগে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান এবং অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রের নেতারা ইস্তাম্বুলের ঐতিহাসিক সুলতান আহমেদ এলাকায় তুর্কি কাউন্সিলের সচিবালয় উদ্বোধন করেন। এটি ছিল নতুন সংগঠনটিকে ইস্তাম্বুলের সাথে যুক্ত করার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এক সময় এখানেই উসমানীয় সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল।
২০০৯ সালের অক্টোবরে তুরস্ক, আজারবাইজান, কাজাখস্তান এবং কিরগিজস্তান নাখচিভান চুক্তি স্বাক্ষর করে তুর্কি কাউন্সিল প্রতিষ্ঠিত করে। উজবেকিস্তান ১৫ অক্টোবর ২০১৯ তারিখে বাকুতে যোগ দেয়। হাঙ্গেরিকে ২০১৮ সালে পর্যবেক্ষকের মর্যাদা দেয়া হয়, এবার তুর্কমেনিস্তানও। আজারবাইজানের রাষ্ট্রপতি ইলহাম আলিয়েভ এবার শীর্ষ সম্মেলনের সময় এরদোগানের কাছে সংগঠনের সভাপতিত্ব হস্তান্তর করেন।
কাজাখ প্রেসিডেন্ট নুরসুলতান নাজারবায়েভ ২০০৬ সালে তুর্কি জনগণকে এক ছাতার তলায় আনার প্রস্তাব করেছিলেন। ২০০৯ সালে সংস্থা বাস্তব রূপলাভ করলে, তুরস্কের অবসরপ্রাপ্ত কূটনীতিক হালিল আকিনসিকে প্রথম সেক্রেটারি জেনারেল নির্বাচিত করা হয়। তিনি ঘোষণা করেন, ‘তুর্কি কাউন্সিল’ ইতিহাসে তুর্কি রাষ্ট্রগুলোর প্রথম স্বেচ্ছাসেবী জোটে পরিণত হয়েছে।’
এখন এটি তুর্কি রাষ্ট্রের সংগঠন নামে পরিচিত, এখানে ছয়টি নির্বাহী সংস্থা রয়েছে যেগেুলো নির্দিষ্ট কাজ সম্পাদন এবং গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়ন পর্যবেক্ষণ করে, যার মধ্যে একটি হলো আন্তর্জাতিক তুর্কি সংস্কৃতি সংস্থা, ঞন্ধজকঝঙণ, আঙ্কারায় অবস্থিত, কাউন্সিল ১৬ বছর আগে ১৯৯৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যার আদল ইউনেস্কোর অনুরূপ।
তুর্কিভাষী দেশগুলোর সংসদীয় পরিষদও, ঞটজকচঅ এই সংগঠনের অংশ। এটি ২০০৮ সালের ইস্তাম্বুল চুক্তির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই পরিষদের অবস্থান বাকুতে। সমাবেশে তুর্কি সংসদগুলোর মধ্যে সহযোগিতা জোরদার করার আকাক্সক্ষা জানানো হয়। তুরস্কের বিজনেস কাউন্সিল, অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়াতে চায়, যা ২০১১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আন্তর্জাতিক তুর্কি একাডেমি, তুরস্কের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস এবং নৃতাত্ত্বিক গবেষণা সমন্বয় এবং সমর্থন করে। তুর্কি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তহবিলও ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। দুই বছর আগে প্রতিষ্ঠিত তুর্কি চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি, টিসিসিআইর পাশাপাশি, তারা ছয়টি নির্বাহী সংস্থা সম্পূর্ণ করে, যাকে এখন সমন্বিত তুর্কি রাষ্ট্রের সংগঠন বলা হচ্ছে।
সংগঠনের সেক্রেটারি জেনারেল বাগদাদ আমরিয়েভ জানান, ‘সাধারণভাবে তুর্কি কাউন্সিল রাজনীতি, অর্থনীতি, বিজ্ঞান, সংস্কৃতি ও শিক্ষার পাশাপাশি সামরিক বিষয়াদি, আইন, পরিবেশ, জ্বালানি, পরিবহন, বিনিয়োগ ও অর্থায়নে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বহুপাক্ষিক সহযোগিতা গড়ে তোলার যথাসাধ্য চেষ্টা করে চলছে।’
সম্প্রতি সমাপ্ত অষ্টম শীর্ষ সম্মেলনে সংস্থাটি তুর্কি ওয়ার্ল্ড ভিশন-২০৪০ গ্রহণ করেছে, যা ‘উন্নয়ন এবং সদস্য রাষ্ট্রগুলোর একীকরণ প্রচেষ্টার দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচি প্রণয়ন করবে।’ আমরিয়েভ উল্লেখ করেন যে, এটি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বিষয়ে একক ভিত্তি হিসাবে কাজ করার জন্য রাজনৈতিক সংহতি বিকাশের ওপর নির্ভর করছে। ‘অর্থনৈতিক নীতি এবং সব প্রাসঙ্গিক নিয়ন্ত্রক কাঠামোর সমন্বয়ের ভিত্তিতে তুর্কি কাউন্সিলের ছত্রছায়ায় আরো গতিশীল সহযোগিতার ক্ষেত্র রচনা করবে; পূর্ণ বাণিজ্য ‘সংহতকরণ’ অর্জন; একটি একক তুর্কি বিনিয়োগ ক্ষেত্র স্থাপন; ডিজিটাল ইন্টিগ্রেশন, পরিবহন ও জ্বালানি সংযোগের উন্নয়ন এবং আন্তঃ-আঞ্চলিক গতিশীলতা আরো সক্ষম করে তোলার কাজ চলমান রয়েছে।
প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে, সংস্থাটি এবার তুর্কি কাউন্সিল স্ট্র্যাটেজি ২০২১-২০২৬ গ্রহণ করেছে, যা প্রেক্ষাপট নির্ধারণ এবং সহযোগিতার লক্ষ্যগুলো চিহ্নিত করবে। এই কৌশলগুলো সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে একটি নতুন এবং আরো গতিশীল অংশীদারিত্ব চিহ্নিত করেছে যেখানে তারা সদস্য রাষ্ট্রের সম্পর্ককে সহযোগিতা থেকে ধীরে ধীরে অর্থনৈতিক সংহতকরণে স্থানান্তরিত করবে। সদস্য দেশগুলো মনে করে অর্থনীতি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রাধিকার। ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহযোগিতা ছাড়া বাজার একীকরণ সম্ভব নয় এই ধারণা এখানে কাজে লাগানো হয়েছে।
তুর্কি জনগণ হলো ইউরো এশীয় জনগণ যারা ইউরেশিয়ার উত্তর, মধ্য এবং পশ্চিমে বাস করে। এরা তুর্কি ভাষায় কথা বলে এবং তুর্কি পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। তাদের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তুরস্ক প্রজাতন্ত্রে তাতার, কিরঘিজ, উজবেক, তুর্কমেন এবং তুর্কিসহ এসব জাতিগত জাতিগোষ্ঠীর সাথে মিশে একাকার হয়ে যাওয়া আরো অনেক জাতির বর্ণনা দিতে তুর্কি শব্দটি ব্যবহার করা হয়।
মধ্য এশিয়াকে তুর্কি জনগণের মূল মাতৃভূমি বিবেচনা করা হয়। জানা যাচ্ছে যে, তুর্কি জনগণ মধ্য এশিয়া থেকে সাইবেরিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে বসবাস করত, তাদের অনেকে ঐতিহাসিকভাবে চীনেও বাস করত।
তুর্কি ভাষা এবং সাংস্কৃতিক পটভূমির লোকেরা পূর্ব রাশিয়ার সাইবেরিয়া থেকে মধ্য এশিয়া এবং পূর্ব ইউরোপ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। এসব জনসমাবেশ মধ্য এশিয়ায় কেন্দ্রীভূত হয়েছে; তন্মধ্যে রয়েছে কাজাখস্তান, তুর্কমেনিস্তান, কিরঘিজস্থান, আজারবাইজান, উজবেকিস্তান এবং তুরস্ক। তুর্কি জনগণ ইউক্রেনের ক্রিমিয়া এবং চীন, উত্তর ইরাক, ইরান, ইসরায়েল, রাশিয়া, আফগানিস্তান, সাইপ্রাস, বুলগেরিয়া, রোমানিয়া এবং আরো অনেক এলাকায় বসবাস শুরু করে। তুর্কিরা ছয়টি প্রধান উপজাতি নিয়ে গঠিত: ওঘুজ, কিপচাক, কার্লুকস, গুয়াশ ইয়াকুট এবং সাইবেরিয়ান।
পুরনো উসমানীয় অঞ্চলগুলো আজ ৪১টি রাজ্য নিয়ে গঠিত, যার মধ্যে ৩৫টি গ্রামীণ অঞ্চলে অবস্থিত। আঞ্চলিক রাজনীতি, কৃষ্টি ও সমাজকে বুঝতে হলে উসমানীয় সাম্রাজ্যের ইতিহাসে ফিরে আসা প্রয়োজন।
সংগঠন সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে কৌশলগত, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সহযোগিতার কারণে ‘অনেক ক্ষমতা’ প্রদান করেছে। তুর্কি বিশ্বের জন্য একটি ঐক্যবদ্ধ সংস্থা গঠন করে সদস্য দেশগুলো তাদের আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আরো রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিক শক্তির অধিকারী হবে এটিই মূল ধারণা। সদস্য রাষ্ট্রগুলোর কণ্ঠস্বর অন্যরা ‘একা দাঁড়ানোর’ চেয়ে ‘সবাই মিলে’ দাঁড়ানোর চেষ্টা করবে।
আজারবাইজানের রাষ্ট্রপতি আলিয়েভ উল্লেখ করেছেন, নাগর্নো-কারাবাখ যুদ্ধ এই সহযোগিতার একটি বাস্তব পরীক্ষা ছিল। প্রথম দিন থেকেই সংস্থাটি ‘তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া’ জানিয়েছে এবং তার দেশকে ‘শক্তিশালী’ সমর্থন দিয়েছে। তুরস্কের পরে সংস্থাটি দ্বিতীয় শক্তি হিসেবে কাজ করেছিল। তিনি আরো বলেন, এই ধরনের সমর্থন ‘তুর্কি বিশ্বকে’ শক্তিশালী করেছে। যুদ্ধের পর পর গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য হলো পর্যবেক্ষক রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে একটি ‘গ্রিন করিডোর’ স্থাপনের চুক্তি যাতে সদস্য রাষ্ট্রের মানুষগুলো প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য, ওষুধ এবং চিকিৎসা সরঞ্জাম সহজে সীমানা অতিক্রম করতে পারছে।
তুরস্কের প্রধান বিরোধী দল রিপাবলিকান পিপলস পার্টির, সিএইচপি এই শান্তি চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছে এবং আজারবাইজানের বিজয়কে আন্তরিকভাবে অভিনন্দন জানিয়েছেন। তুরস্ক কেন আজারবাইজানের সাথে দাঁড়িয়ে ছিল এবং দলমত নির্বিশেষে তুর্কিরা কেন এত উল্লসিত?
কেননা এই বিজয়ের অর্থ হচ্ছে আজারবাইজানজুড়ে তুরস্কের সরাসরি স্থলপথ থাকবে এবং এইভাবে আজারবাইজান, কাজাখস্তান, কিরঘিজস্তান, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান এবং উজবেকিস্তানের সব তুর্কি জাতিগোষ্ঠীর সাথে ঐতিহাসিক সামঞ্জস্য ফিরে আসবে। তুরস্ক এখন এজিয়ান সাগর থেকে চীন পর্যন্ত জাতিগত তুর্কিদের আধিপত্যে খুব বড় এক অঞ্চলজুড়ে রয়েছে। এই অঞ্চলের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ তুরস্কের জন্য এর অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং কৌশলগত সুবিধা রয়েছে যা দিন দিন ঔৎকর্ষ অর্জন করছে।
তুরস্ক আর্মেনিয়ান দখলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আজারবাইজানকে সামরিক, গোয়েন্দা, তথ্য এবং প্রচার মাধ্যমের সহায়তা প্রদান করেছে। এটি তুরস্কের রাজনীতি, স্বার্থ, লক্ষ্য এবং কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গির দৃষ্টিকোণ থেকে একটি বিজয়। এই সহযোগিতা মধ্য-এশিয়ার অন্যান্য দেশের জন্যও একটি আশাব্যঞ্জক উদাহরণ হিসাবে ভবিষ্যতে কাজ করবে।
তুরস্ক ইরানের মধ্য দিয়ে না গিয়ে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের সাথে স্থল সংযোগে আগ্রহী। ব্রিটেনের টেলিগ্রাফ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, তুরস্ক ইতোমধ্যে এই অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলোকে প্রভাবিত করেছে। জেমস কিলনার লিখেছেন, ‘আঙ্কারা মধ্য-এশিয়ার সরকারগুলোকে, তাদের তুর্কি এবং ইসলামিক সংযোগ দিয়ে, আজারবাইজানকে সমর্থন করার জন্য চাপ দিয়েছে।’ ফরাসি দৈনিক এল’ ওপিনিয়ন বিশ্বাস করে যে, এটি ফ্রান্সের বিরুদ্ধে তুরস্কের বিজয়। পত্রিকা আরো শক্ত কথা বলেছে, যেমন, তুরস্কের প্রতিরক্ষা প্রযুক্তির মুখে রাশিয়ার সামরিক সরঞ্জামগুলো যুদ্ধে দুর্বল প্রমাণিত হয়েছে। বিশ্বশক্তি তুরস্ককে নিষ্ক্রিয় করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু পারেনি।
তুরস্ক লক্ষ্য অর্জন না করা পর্যন্ত তার মিত্রদের পাশে দাঁড়িয়েছে, এটা সবার কাছে একটি বার্তা। বিশ্বকে ভালোভাবে বোঝা উচিত যে, ভূমধ্যসাগরীয় বা অন্য কোথাও তুরস্ককে তার অধিকার ত্যাগ করার জন্য চাপ দেওয়া অত সহজ নয়।
এরদোগানের কাছে সংগঠনের সভাপতিত্ব হস্তান্তর করে আলিয়েভ তার আস্থা ব্যক্ত করেন যে, তুরস্কের রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে ঐক্য, সংহতি এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধার ভিত্তিতে তুর্কি দেশগুলোর ঐক্য, ইউনাইটেড স্টেটেস অব তুর্কির মধ্যে সম্পর্ক আরো শক্তিশালী হবে। তিনি বলেন, ‘এতে কোনো সন্দেহ নেই যে সম্মানিত রাষ্ট্রপতি, তুর্কি বিশ্বের নেতা, এতে সফল হবেন।’ জনাব এরদোগান বলেন, ‘এই অঞ্চল আবারও সব মানবতার জন্য আকর্ষণ এবং জ্ঞানের কেন্দ্র হয়ে উঠবে। ভিশন-৪০ তুর্কি বিশ্বে অনন্ত ভ্রাতৃত্বের নতুন লক্ষণ হিসেবে পরিগণিত হবে।’
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট বিশ্বকে আশ্বস্ত করে বলেছেন, ‘তুর্কি কাউন্সিল কাউকে বিরক্ত করার জন্য গঠিত হয়নি এবং এই সংস্থার বিপক্ষেও কারো কার্যক্রম শুরু করা উচিত নয়।’ ‘এর পেছনে রয়েছে প্রাচীন ইতিহাস ও মানব সম্পর্কের ভিত্তি।’ জানা যায়, এখন পর্যন্ত কমপক্ষে পনেরটি দেশ ইউনাইটেড স্টেটেস অব তুর্কি, যা এখনো একটি সংগঠন, তার পর্যবেক্ষকের মর্যাদা চাইছে! বিশ্লেষকরা বলছেন, অচিরেই এটি ‘তুর্কি বিশ্বের যুক্তরাষ্ট্র’ হিসাবে বিকাশ লাভ করবে।
তুরস্ক এবং পশ্চিমের মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে কূটনৈতিক অবক্ষয় দেখে বেশিরভাগ পর্যবেক্ষক বিস্মিত হয়েছেন। প্রেসিডেন্ট এরদোগান ১০ জন পশ্চিমা রাষ্ট্রদূতকে পারসোনা নন গ্রাটা ঘোষণা করে দেশত্যাগ করার নির্দেশও দিয়েছেন। পশ্চিমারা সম্ভবত ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করে যে, তারা তুরস্কের বিরুদ্ধে মার্কিন নেতৃত্বাধীন হাইব্রিড যুদ্ধের অংশ হিসাবে কূটনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক আক্রমণ করে মেধার স্ফুরণকে পরখ করতে চেয়েছিল!
এই ১০টি দেশের দূতাবাস অপ্রত্যাশিতভাবে তাদের সরকারী নীতি পুনরায় নিশ্চিত করে বিবৃতি প্রকাশ করে এক ধাপ পিছিয়ে যায় যে, তারা তাদের আয়োজক রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে না। এর জবাবে প্রেসিডেন্ট এরদোগান বলেন, আপাতত বিষয়টি সমাধান করা হয়েছে, যদি না তারা আবারও কূটনৈতিকভাবে হস্তক্ষেপ করার সিদ্ধান্ত নেয়। এই উদাহরণটি প্রমাণ করে, আপাতত তুরস্ককে উত্তেজিত করা থেকে পশ্চিমাদের সরে আসতে হবে। তবে মনে হয়, তুরস্কের গ্রীষ্মকালীন ২০২৩ সালের নির্বাচনের আগে এ ধরনের আরো উস্কানির উদ্ভব হতে পারে। এটি আরো বোঝায় যে পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তুরস্কের নেতার মানসিকতা সম্পর্কে ততটা গভীর ধারণা নেই যতটা কেউ কেউ ভেবেছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের সাথেও তুরস্কের সম্পর্ক ভালো নেই। এস ৪০০ ডিফেন্স সিস্টেম কেনায় তুরস্কের ওপর যুক্তরোষ্ট্রের অবরোধ ৭ মার্চ ২০২১ থেকে কার্যকর হয়েছে। ট্রাম্প অবরোধের ঘোষণা দিলেও তিনি কার্যকর করেননি। বাইডেন তা কার্যকর করলেন। সিস্টেম কেনার বিষয়ে, তুরস্কের সাথে ২০১৯ থেকে ন্যাটোর সম্পর্কে চিড় ধরতে থাকে এবং যুক্তরাষ্ট্র এফ-৩৫ বিক্রি স্থগিত করে দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্যাট্রিয়টিক মিসাইল কেনার বিষয়ে তুরস্ক জানায় যে, সেটি সম্ভব যদি টেকনলজি ট্রান্সফারসহ তুরস্কের মাটিতে বানানো হয়। ইতোমধ্যে রাশিয়া এস-৪০০, ৫০০ ও ৫৫০ সিরিজের ডিফেন্স সিস্টেম ভারতে সরবরাহ শুরু করেছে কোন প্রকার মার্কিন অবরোধ ছাড়াই। এসব কারণে তুরস্ক পরে রাশিয়া, চীন ও জাপানের দিকে ফিরছে। ফলে মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর সাথে তুরস্ক নিবিড় সম্পর্ক স্থাপনে সুবিধা ভোগ করবে।
তুরস্ক মুসলিম বিশ্বের ঐক্য ও নতুন সংস্থা গঠনের চেষ্টা করে আসছে বহু দিন ধরে। মুসলিম উম্মাহর ঐক্য প্রচেষ্টার অন্যতম তুরস্কের এরদোগান, মালয়েশিয়ার মাহাথির মোহাম্মদ ও পাকিস্তানের ইমরানের খানের প্রচেষ্টার কুয়ালালামপুর সম্মেলন এখনো কোনো ফসল তুলতে সক্ষম হয়নি। এর আগে জনাব এরদোগান ইসলামী সেনাবাহিনী গঠনের ডাক দিয়েছিলেন সেটিও নানা বিরোধিতায় সফল হয়নি। কয়েক দশক আগে ইরান-তুরস্ক-পাকিস্তান আরসিডি জোট গঠন করেছিল, নানা কারণে তার অস্তিত্ব নেই। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ন্যাটো ও পশ্চিমা শক্তির সাথেও তুরস্কের বনিবনা হচ্ছে না। এক্ষণে, এরদোগান নিজের ঘরে নিজ জাতিগোষ্ঠী নিয়ে যে কাউন্সিল করেছেন সেটিকে শক্তিশালী করতে চান। ধীরে সুস্থে নানা আন্তর্জাতিক পটপরিবর্তনের অভিজ্ঞতা নিয়ে জোটের অগ্রযাত্রা ফলপ্রসূ ও শক্তিশালী হবে এমনই মনে করছেন সবাই।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব ও গ্রন্থকার