যা করতে পারে ইরান

মুজতাহিদ ফারুকী | Dec 14, 2021 05:22 pm
যা করতে পারে ইরান

যা করতে পারে ইরান - ছবি সংগৃহীত

 

ইরানের পরমাণু সক্ষমতার বিরুদ্ধে একজোট হয়েছে গোটা পাশ্চাত্য। তারা এখন মুখে কূটনীতির কথা বললেও আসলে শক্তির ভাষায় কথা বলতে শুরু করেছে। এ ক্ষেত্রে কোনো রকম যুক্তির পথে তারা হাঁটছে না। চক্ষুলজ্জার ধারও ধারছে না। আলোচনার মধ্য দিয়ে নয়, বরং সব রকমের চাপ প্রয়োগের অপকৌশল নিয়েছে দেশগুলো এবং এটিকেই কূটনীতি হিসেবে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে।

বাস্তবে কোনো এক বা একাধিক দেশ যখন চাপ প্রয়োগকেই লক্ষ্য অর্জনের হাতিয়ারে পরিণত করে তখন সেটিকে কূটনীতি বলার অবকাশ থাকে কিনা সেটিই প্রশ্ন। ভিয়েনায় যখন ইরানের পরমাণু কর্মসূচি বিষয়ে ছয় জাতির চুক্তি আবারও পুনরুজ্জীবিত করার প্রসঙ্গে আলোচনা চলছে তখন এই নতুন ব্যাপারটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সময়ে ২০১৫ সালে জাতিসঙ্ঘের উদ্যোগে ইরানের সঙ্গে চুক্তি করে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া, চীন ও জার্মানি। পাঁচটি দেশের মধ্যে শুধু জার্মানি জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য নয়। চুক্তিতে ইরানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বহু বছরের অর্থনৈতিক ও অন্যান্য নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। ইরান শর্তসাপেক্ষে তার পরমাণু কর্মসূচি নির্দিষ্ট মাত্রায় কমিয়ে আনতে সম্মত হয়।

ইরান যে সেই চুক্তির শর্ত পুরোপুরি মেনে চলেছে সেই রিপোর্ট বহুবার দিয়েছে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা আইএইএ। কিন্তু তার পরও ইরানের বিরুদ্ধে অপপ্রচার বন্ধ হয়নি। নিষেধাজ্ঞাও কখনোই পুরো প্রত্যাহার করেনি যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা। কিছুটা শিথিল করেছিলো শুধু। ২০১৮ সালে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কোনোরকম যৌক্তিক কারণ ছাড়াই ওই চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নেন। সে সময় তিনি ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার জন্য উপদেষ্টাদের সঙ্গে আলোচনা করেন বলে পরে খবর বেরিয়েছে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায়। উপদেষ্টারা যুদ্ধের ব্যাপারে সায় দেননি। তখন যুক্তরাষ্ট্রের ইউরোপীয় মিত্রবর্গ চুক্তি মেনে চলার অঙ্গীকার করে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র চুক্তিভঙ্গ করলেও ইরান তা বাতিল করে দেয়নি। তবে তার পরমাণু কর্মসূচি এগিয়ে নেয়ার ঘোষণা দেয়। দেশটি ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ শুরু করে।

পরে জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট হলে তিনি ইরান চুক্তিতে ফিরে আসার উদ্যোগ নেন। এজন্য তিনি প্রথমে ইরানকে সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় বসতে বাধ্য করার চেষ্টা করেন। কিন্তু চুক্তি ভঙ্গকারী দেশের সঙ্গে আলোচনায় বসার চাপ সরাসরি নাকচ করে দেন ইরানের নেতৃত্ব। চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার বিষয়টি ইউরোপীয় মিত্ররাও পছন্দ করেনি। তারা যুক্তরাষ্ট্রকে বাদ দিয়েই ইরান চুক্তি এগিয়ে নেয়ার কথা জানায়। এভাবে আমেরিকা অনেকটাই একঘরে হয়ে পড়ে। এখন যুক্তরাষ্ট্রকে পরোক্ষভাবেই মিত্রদের সহায়তায় অর্থাৎ চুক্তির অন্যান্য পক্ষের সহায়তায় ইরানের সঙ্গে আলোচনা চালাতে হচ্ছে। এটি হলো এ ধরনের সপ্তম দফা আলোচনা। করোনা মহামারীর পর গত ২৯ নভেম্বর ভিয়েনায় আলোচনা শুরু হয়। সেখানে ইরানের পক্ষ থেকে দুটি খসড়া প্রস্তাব তুলে ধরা হয়।

ইরানের প্রস্তাবে স্পষ্ট করে বলা হয়, নতুন কোনো চুক্তির আগে তার বিরুদ্ধে আমেরিকান অবরোধ তুলে নিতে হবে। কোন প্রক্রিয়ায় তা প্রত্যাহার করা হবে সে বিষয়ে আগে চুক্তি করা হলেই কেবল ইরান তার পরমাণু কর্মসূচি ২০১৫-এর চুক্তিতে যে পর্যায়ে ছিল সেই পর্যায়ে নামিয়ে আনবে। চুক্তিভঙ্গকারীকে আর বিশ্বাস করতে চায় না ইরান । কিন্তু পাশ্চাত্য মানতে চাইছে না। যুক্তরাষ্ট্র এখন চাপ দিচ্ছে, আগে ইরানকে পরমাণু গবেষণা আগের পর্যায়ে নামিয়ে আনতে হবে তারপর অবরোধ তুলে নেয়ার বিষয়ে কথা হবে। এখানেই আটকে যায় আলোচনা। ইরান বলেছে, অবরোধ তুলে নিতে আমেরিকার অনাগ্রহই নতুন চুক্তির ক্ষেত্রে প্রধান বাধা। ইউরোপীয়রা কোনো প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে আসেনি। কিন্তু ইরানবিরোধী কূটনীতিক তৎপরতা শুরু করেছে। চলছে ধ্বংসাত্মক প্রচারণাও।

ইসরাইলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঝটিকা সফরে ফ্রান্স ও ব্রিটেনে গেছেন। সেখানে ব্রিটেন ও ইসরাইল ঘোষণা করেছে, ইরানের পরমাণু সক্ষমতা অর্জন যে কোনো উপায়ে বন্ধ করতে দুই দেশ ‘রাতদিন’ কাজ করে যাবে। ফ্রান্সও একই রকম মন্তব্য করে। এর পর ব্রিটেনের লিভারপুলে শুরু হয় সাত জাতি গ্রুপ বা জি-৭ এর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলন। সেখানে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লিজ ট্রাস ইরানকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ভিয়েনায় চলমান সংলাপ হচ্ছে একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর শেষ সুযোগ। তিনি তার ভাষায় সংলাপে আন্তরিক হতে ইরানি কর্মকর্তাদের প্রতি আহ্বান জানান। লিজ ট্রাসের শরীরী ভাষা রিংয়ে লাফানো কুস্তিগিরের মতো। জি-৭ এর ঘোষণা আরো কঠিন। তাতে বলা হচ্ছে, চুক্তি করতে রাজি হওয়ার জন্য তেহরানের হাত থেকে সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। অথচ ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বা জি সেভেনের অন্য কেউ সমঝোতা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা বেরিয়ে যাওয়া কিংবা এটির শর্ত বাস্তবায়নে ইউরোপীয় দেশগুলোর ব্যর্থতার বিষয়টি ভুলেও উচ্চারণ করেননি। তারা তাদের অপরাধের দায় নেবেন না। ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রকেও যে পরমাণু সমঝোতা মেনে নিয়ে ইরানের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে হবে তার কোনো উল্লেখও তারা করেননি। তাহলে আন্তরিকতা কার আছে আর কার নেই সেটি বোঝার তেমন বাকি থাকে কি?

আমেরিকার ভাষা আরেক কাঠি সরেস। তারা ভিয়েনা আলোচনা শুরুর আগেই বলে দিচ্ছে, আলোচনা ব্যর্থ হলে যে বিকল্প তার হাতে আছে সেই প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে। এটি যুদ্ধের ইঙ্গিত তুলে ধরে। ইসরাইলকে একটি যুদ্ধের দিকে এগিয়ে দেয়ার আশঙ্কাও নাকচ করে দেয়া যায় না। দেশটি তো মুখিয়ে আছে ইরানে হামলা করতে। সম্প্রতি আমেরিকা, ইসরাইল সামরিক মহড়াও সম্পন্ন করেছে। যাতে ইসরায়েলের নতুন মিত্র সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং আবুধাবিও শরিক ছিল। এমনকি উসকানিমূলক কাজ আরো করেছে যুক্তরাষ্ট্র। আলোচনা শুরুর মুহূর্তেই গত ১০ ডিসেম্বর ইরানের ড্রোন কর্মসূচির ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এটাই তাদের সদিচ্ছার নমুনা।

একই যুদ্ধের হুমকি সৃষ্টি করছে জি-৭ দেশগুলো। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি ও জাপান নিয়ে গঠিত গ্রুপটি সম্মেলনে তিনটি দেশকে শত্রু বলে ঘোষণা করেছে এবং তাদের বৈরি কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে নিজেদের সুরক্ষার অঙ্গীকার করেছে। বলা হয়েছে, তিন আগ্রাসী, যারা স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক বিশ্বের সীমা খর্ব করতে চায় তাদের বিরুদ্ধে আমাদের দৃঢ়তার সঙ্গে পরস্পরের কাছে এগিয়ে আসতে হবে। ওই তিন আগ্রাসী কারা? তারা হলো, রাশিয়া, চীন ও ইরান। ইউক্রেনে রাশিয়ার কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে জি-৭। সামরিক সহায়তাও দিতে শুরু করেছে ইউক্রেনকে। চীনের বিরুদ্ধে তো গোটা বিশ্বেই তোলপাড় করার জোগাড় করেছে আমেরিকা। আর ইরানকে চাপের মুখে নতি স্বীকারে বাধ্য করতে চাচ্ছে। এক্ষেত্রে ইরানকে কিছুটা হলেও নমনীয় হতে হবে বলে মনে হয়। কারণ, ইরানের সাথে সুসম্পর্কের কারণে রাশিয়া ও চীনকে দিয়েও একই কথা বলা হচ্ছে ইরানকে।

বর্তমান বিশ্বে কোনো দেশের পক্ষেই সম্পূর্ণ বন্ধুহীন অবস্থায় টিকে থাকা অসম্ভব। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর দেশের বিরুদ্ধে তো নয়ই। বৈশ্বিক পর্যায়ে ইরানের প্রকৃত বন্ধু নেই। রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে কিছুটা সুসম্পর্ক আছে এটুকুই। মধ্যপ্রাচ্যেও শক্তিশালী কোনো বন্ধু নেই ইরানের। ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া ধ্বংসপ্রাপ্ত। সৌদি আরবসহ উপসাগরীয় জোটের দেশগুলো শত্রু। তুরস্কের অবস্থা ভালো নয়। অর্থনৈতিক টালমাটাল অবস্থা চলছে দেশটির। উত্তরে আজারবাইজানের সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক ভালো নয়। এদিকে আমেরিকার আয়োজনে ইসরাইলের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধছে আরব দেশগুলো। ভবিষ্যতে পুরো মধ্যপ্রাচ্যের আর্থ-রাজনৈতিক-সামরিক নিয়ন্ত্রণ ইহুদিদের হাতে চলে গেলেও এসব আরব নেতাদের কিছু এসে যাবে বলে মনে হয় না।

এই মুহূর্তে আমেরিকার নেতৃত্বে বিশ্বজুড়ে নতুন মেরুকরণ চলছে। চীনের উত্থান এবং পাশ্চাত্যের প্রভাব ধরে রাখার প্রক্রিয়ায় এই নতুন মেরুকরণের পাশাপাশি বিশ্বে একটি যুদ্ধংদেহী আবহ তৈরি করা হচ্ছে। রাশিয়া ইউক্রেনে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি করেছে। চীন করেছে তাইওয়ান ও দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে। যুক্তরাষ্ট্র অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে চুক্তি করে পারমাণবিক সাবমেরিন দিচ্ছে। কোয়াড, অকুস জোট গড়ে প্রশান্ত ও ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নজিরবিহীন তৎপরতা শুরু করেছে। আর এই সব কর্মকাণ্ডের তথা নয়া শীতল যুদ্ধের জের পড়ছে ইরানের সঙ্গে আলোচনায়। সংযুক্ত আরব আমিরাতে প্রথমবারের মতো সফরে গেছেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেট। তার সফরের সময়ই দেশটিতে চীনের নির্মাণ প্রকল্প বন্ধ করে দেয়ার ঘোষণা এসেছে। ফলত আরব দেশগুলোর ওপর ইসরায়েল ও আমেরিকারপ্রভাব কতদূর পর্যন্ত প্রসারিত ও গভীরতর হচ্ছে তার প্রমাণ মিলছে।

ইসরায়েলের লক্ষ্য ছিল ভিয়েনা আলোচনার আগে যেন ইরানের ওপর থেকে অবরোধ তুলে নেয়া না হয়। সে লক্ষ্যে জয়ী হতে যাচ্ছে দেশটি। কারণ রাশিয়া ও চীনের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে ইরানকে পরামর্শ দেয়া হয়েছে, তারা যেন দাবি থেকে সরে আসে এবং নমনীয়তা প্রদর্শন করে। ইরান সে পরামর্শ সম্ভবত মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে।

এমনই এক পরিস্থিতিতে ইরানের টিকে থাকার স্বার্থেই কিছুটা নমনীয় হতে হবে। ইতিহাস সাক্ষী, রাজনীতিতে অনেক সময় ইচ্ছে করেই পিছিয়ে আসতে হয়। শত্রুর অন্যায় দাবি মেনে নিতে হয়। কিন্তু সেটি আসলে পিছিয়ে পড়া নয়। সেটি হলো কৌশল বা হেকমত। পাঁচ জাতির সঙ্গে প্রথম চুক্তি সম্পাদনে ইরান যে, ধৈর্য ও সহনশীলতার পরিচয় দিয়েছিল এবার শত উসকানি ও অন্যায় চাপের মুখেও সেই ধৈর্য রক্ষা করে এগুতে হবে। কারণ, চীনের উত্থানে আমেরিকা এখন ভীত ও সন্ত্রস্ত। আর অস্তিত্ব হারানোর ভয়ে সন্ত্রস্ত যে শক্তিধর তার হাতের অস্ত্র যে কোনো সময় গর্জে উঠতে পারে। এই মুহূর্তে ইরানের পক্ষে কোনোভাবেই যুদ্ধে জড়ানোর ঝুঁকি নেয়া সম্ভব নয়।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us