রাশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে নতুন খেলা
পুতিন - ছবি সংগৃহীত
রাশিয়ান ফেডারেশন ক্রমেই মধ্যপ্রাচ্যে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হয়ে উঠছে। গত এক দশকে মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-কৌশলগত পরিস্থিতি পাল্টে দেয়ার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে রাশিয়া আর এ দেশটার দীর্ঘ সময়ের নেতা ভ্লাদিমির পুতিন। ফলে রাশিয়ার সাথে ইসরাইলের সম্পর্ক, গতি প্রকৃতি ও গভীরতা অনুধাবন মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনাবলির গতি উপলব্ধি করার জন্য বিশেষ প্রয়োজন।
ইসরাইলের সৃষ্টি এবং এর নিরাপত্তার ব্যাপারে সব সময় কৌশলগত মিত্র ছিল ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলো। স্নায়ুযুদ্ধের সময়ও ইসরাইল আমেরিকান বলয়ের অংশ ছিল। কিন্তু ইসরাইলি সমাজ ও রাষ্ট্রে রয়েছে রুশ বংশোদ্ভূতদের প্রভূত প্রভাব। ইসরাইলে হিব্রু ও আরবির পর প্রধান ভাষা হলো রুশ। দেশটির নির্বাচনেও রুশ ভাষাভাষীদের রয়েছে নিয়ন্ত্রক প্রভাব। ইসরাইলের এক চতুর্থাংশ নাগরিক রুশ বংশোদ্ভূত। ইসরাইল ও রাশিয়ার দ্বৈত নাগরিকদের প্রভাব বিস্তার করার মতো ভূমিকা রয়েছে দুই দেশেই।
মধ্যপ্রাচ্যে বহু বছর ধরে, ইসরাইল রাশিয়ান ইহুদিদের গুরুত্বপূর্ণ বসতিকেন্দ্র হিসেবে কাজ করেছে। স্নায়ুযুদ্ধের সময় ইসরাইল ও রাশিয়া পরস্পরবিরোধী পক্ষ ছিল। তবে ২০০০-এর দশকের গোড়ার দিকে ইসরাইল ও রাশিয়ার মধ্যে সম্পর্ক উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত হতে শুরু করে। এটি বিশেষভাবে হয়েছে দু’দেশের নেতৃত্বে ভøাদিমির পুতিন ও অ্যারিয়েল শ্যারনের নির্বাচনের মাধ্যমে।
ইসরাইল হল রুসোফোন বা রুশ বংশোদ্ভূতদের বসবাসের রাষ্ট্রগুলোর একটি। আর প্রাক্তন সোভিয়েত রাষ্ট্রগুলোর বাইরে বিশ্বের একমাত্র রুসোফোন দেশ হিসাবে বিবেচিত। রুশ ভাষা হিব্রু এবং আরবির পরে ইসরাইলে তৃতীয় সর্বাধিক ব্যবহৃত ভাষা। এক লাখেরও বেশি ইসরাইলি নাগরিক রাশিয়ায় বাস করে, এর মধ্যে ৮০ হাজার ইসরাইলি মস্কোতে বসবাস করে, অন্য দিকে ১৫ লাখের মতো স্থানীয় রুশভাষী ইসরাইলে বসবাস করে।
সম্পর্কে সাম্প্রতিক উন্নয়ন
সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্তরাধিকার রাষ্ট্র রাশিয়ান ফেডারেশনের রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বে ভ্লাদিমির পুতিন অধিষ্ঠিত হওয়ার পর দু’দেশের সম্পর্কে তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন আসে। পুতিনকে মনে করা হয় রাশিয়ার নেতাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ইসরাইলবান্ধব। অন্য দিকে অ্যারিয়াল শ্যারনকে মনে করা হতো সবচেয়ে রুশবান্ধব ইসরাইলি নেতা। এই দুই নেতার আমলে রাশিয়া ও ইসরাইলের মধ্যে যে গভীর সম্পর্ক তৈরি হয় সেটিকে ‘অনন্য এক উচ্চতায়’ নিয়ে যান ইসরাইলের দীর্ঘকালের ক্ষমতায় থাকা প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু।
এর ফলস্বরূপ বিগত বছরগুলোতে মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার ভূমিকার সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তন হয়েছে। ইরান ও ইরাক সম্পর্কে রাশিয়ার এখনো নিজস্ব অ্যাজেন্ডা রয়েছে। এটা বিশ্বাসযোগ্যভাবে যুক্তিযুক্ত যে, ইরানের ক্ষেত্রে, রাশিয়ার প্রেরণা যতটা অর্থনৈতিকভাবে চালিত, ততটাই কৌশলগত দিক থেকে পরিচালিত। তবে রুশ-ইরান সম্পর্কের যদি একটি একটি কৌশলগত দিক থেকে থাকে, তবে অবশ্যই এর মূলে মধ্যপ্রাচ্যের পরিবর্তে মধ্য এশিয়ার বিবেচনা রয়েছে মুখ্যভাবে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর বৈশ্বিক পর্যায়ে আমেরিকার সাথে যে গভীর বোঝাপড়া হয় তার নেপথ্য স্থপতি মনে করা হয় নেতানিয়াহুকে। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলি প্রভাবকে সর্বাত্মক রূপ দিতে যে সহযোগিতা ট্রাম্প প্রশাসন করেছে তা নিকট অতীতে কোনো মার্কিন প্রশাসনের ক্ষেত্রে দেখা যায়নি। নেতানিয়াহুর সাথে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তার ইহুদি জামাতা জ্যারেড কুশনারের যেমন গভীর সখ্য ছিল, তেমনি ছিল পুতিনের সাথেও। নেতানিয়াহুর এই সম্পর্ক দুই বিপরীত বলয়ের নেতার ওপর এতটা গভীর ছিল যে, বৈশ্বিক পর্যায়ে কোনো টানাপড়েন হলে নেতানিয়াহু ট্রাম্প ও পুতিন এর মধ্যে মধ্যস্থতাও করতেন। তার আমলে ইসরাইল কোনো দিনই রাশিয়ার ওপর বিধিনিষেধকে মান্য করেনি। ইউক্রেনের ক্রিমিয়া দখলের পর রাশিয়ার ওপর ওবামা প্রশাসনের আরোপিত নিষেধাজ্ঞা নমনীয় করার ক্ষেত্রেও ট্রাম্প প্রশাসনে গোপন প্রভাব বিস্তার করেছিলেন নেতানিয়াহু।
এর প্রতিদান পুতিনের কাছ থেকে এসেছে তাৎপর্যপূর্ণভাবে। ইসরাইলের প্রতিটি নির্বাচনে নেতানিয়াহুর পক্ষে রুশ বংশোদ্ভূতদের প্রভাবিত করেন পুতিন। অন্য দিকে, পুতিনের নির্বাচনে ইসরাইলের রুশ দ্বৈত নাগরিকদের যে ভোট গ্রহণ করা হয় তার ৮০ শতাংশই পান ভøাদিমির পুতিন। পুতিন ইসরাইলে তার দূতাবাসকে তেলআবিবে এবং কনস্যুলেট হাইফাতে রেখে দিয়েছেন এ কথা সত্যি, কিন্তু তিনি পশ্চিম জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসাবে স্বীকৃতি দেন। পুতিনের আমলে ভিসামুক্ত ভ্রমণ থেকে শুরু করে বিমান ও প্রযুক্তি সহযোগিতা চুক্তি সর্বত্র দু’দেশের সহযোগিতা উল্লেখযোগ্য পর্যায়ে উন্নীত হয়। পুতিনের আমলে রাশিয়ার যে সন্ত্রাসবাদী তালিকা রয়েছে তার মধ্যে আল কায়েদা আইএস-এর সাথে মুসলিম ব্রাদারহুড ও তালেবানের নামও রয়েছে।
সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় ইসরাইল-রাশিয়া সম্পর্কের তাৎপর্যপূর্ণ উন্নয়ন লক্ষ করা যায়। ২০২১ সালের ২১ জানুয়ারি রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ইসরাইলকে সিরিয়ায় বোমাবর্ষণের পরিবর্তে সম্ভাব্য হুমকি সম্পর্কে রাশিয়াকে অবহিত করা উচিত এবং রাশিয়া ইরানের উপস্থিতি থেকে ইসরাইল যে হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে তাকে নিবৃত্ত করার জন্য সিরিয়ায় পদক্ষেপ নেবে।
এরপর ২০২১ সালের জুনে ইসরাইলের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে আইজ্যাক হারজোগের বিজয়ের পরে এক অভিনন্দন বার্তায় পুতিন রাশিয়া ও ইসরাইলের মধ্যে ‘বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক’ রয়েছে বলে উল্লেখ করে বলেন, ‘দুই দেশের জনগণের মৌলিক স্বার্থে আন্তর্জাতিক বিষয়ে মিথস্ক্রিয়াসহ বহুমুখী ও গঠনমূলক দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার আরো উন্নয়ন করার ইচ্ছা আমাদের রয়েছে।’
২০২১ সালের জুনে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেয়াদ শুরু হওয়ার পর পুতিন নাফতালি বেনেতকে অভিনন্দন বার্তায় একই ধরনের অনুভূতি প্রকাশ করেন। পুতিন বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকেও একটি ধন্যবাদপত্র পাঠান। এতে পুতিন নেতানিয়াহুর প্রশংসা করে বলেন, ‘আমাদের দুই জাতির মধ্যে সম্পর্ক জোরদার করার জন্য (তিনি) অনেক ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করেছেন আর নেতানিয়াহুর ক্ষমতা এবং অভিজ্ঞতা সর্বদা একটি সম্পদ হবে।’ চিঠিটি পাওয়ার পর, নেতানিয়াহু রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত ভিক্টোরভকে বলেছিলেন ‘প্রেসিডেন্ট পুতিনকে বলুন যে, আমি শীঘ্রই ক্ষমতায় ফিরে আসব’। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ দুই নেতার মধ্যে দীর্ঘ সম্পর্কের কথা উল্লেখ করেছেন।
নেতানিয়াহু যুগের উষ্ণ রাশিয়া-ইসরাইল সম্পর্কের ধারাবাহিকতার নীতি অনুসরণ করার জন্য বেনেত সরকারকে আহ্বান জানান পুতিন। ২০২১ সালের অক্টোবরে তাদের প্রথম বৈঠকের পর, বেনেত পুতিনকে ‘ইহুদি জনগণের সত্যিকারের বন্ধু’ হিসেবে বর্ণনা করে বলেন যে, তিনি এবং পুতিন ‘ইসলামী মৌলবাদের মোকাবিলা করার উপায়’ নিয়েও আলোচনা করেছেন। এই বৈঠকের সময়, পুতিন সিরিয়ার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার জন্য বেনেতের কূটনৈতিক সহায়তা চান। সিরিয়ায় ইরানের অর্থনৈতিক প্রভাব হ্রাস করার একটি উপায় হিসেবে তিনি এই প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন।
রাশিয়া ও ইসরাইলের মধ্যে জোরালো এই সম্পর্ক হঠাৎ করেই হয়েছে এমনটি মনে হয় না। ইসরাইলের জন্মের পর থেকে দুই দেশের সম্পর্কের ধারাবাহিকতার ওপর নজর রাখলে সেটি স্পষ্ট হবে। সামরিক সহযোগিতা থাকা দুটি দেশের মধ্যে সম্পর্কের গভীরতার একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক। ১৯৯১ সালে, সোভিয়েত ইউনিয়ন ইসরাইলকে তার মিকয়ান মিগ-৩১ বিমান এবং এস-৩০০ ক্ষেপণাস্ত্র সিস্টেম বিক্রি করার প্রস্তাব দেয়, যদিও চুক্তিটি পরে বাস্তবায়িত হয়নি। তবে ২০০৪ সালে, ইসরাইল, রাশিয়া এবং ভারতের মধ্যে একটি ত্রিমুখী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর আওতায় ইসরাইল ভারতীয় বিমানবাহিনীকে ১.১ বিলিয়ন ডলারের রাডার সরবরাহ করে রাশিয়ার ইলিউশিন ইল৭৬ প্ল্যাটফর্মে লাগানোর জন্য। ২০১০ সালের ৬ সেপ্টেম্বর রাশিয়া এবং ইসরাইল পাঁচ বছরের এক সামরিক চুক্তি স্বাক্ষর করে। ডিসেম্বর ২০১৯ সালে, ইসরাইল প্রকাশ করে যে দেশটি রাশিয়ার সাথে ইউক্রেন এবং জর্জিয়ার কাছে অস্ত্র বিক্রি না করার জন্য একটি চুক্তি করেছে। এর বিনিময়ে রাশিয়া ইরানের কাছে অস্ত্র বিক্রি করা থেকে বিরত থাকে।
এপ্রিল ২০০৯ সালে, রাশিয়া ইসরাইল থেকে ড্রোনের প্রথম প্যাকেজ কিনে। এই চুক্তির মূল্য ছিল ৫৩ মিলিয়ন ডলার। একই বছরের শেষে দ্বিতীয় চুক্তিতে রাশিয়া ১০০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের অতিরিক্ত ৩৬টি ড্রোন ক্রয় করে ইসরাইল থেকে। অক্টোবর ২০১০ সালে তৃতীয় চুক্তিতে রাশিয়া ইসরাইল অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ থেকে অতিরিক্ত ৪০০ মিলিয়ন ডলারের ড্রোন ক্রয় করে। ইসরাইলি ড্রোন রাশিয়াতে যৌথভাবে উৎপাদনের ব্যবস্থাও করা হয়। রাশিয়ান-ইসরাইলি ড্রোনের উৎপাদন ২০১২ সালে শুরু হয়, ২০১৪ সালে তা রাশিয়ান সামরিক বাহিনীকে সরবরাহ করা হয়। ২০১৫ সালে, ইউক্রেনের ডোনেতস্ক শহরের কাছে ইউক্রেনীয় সামরিক বাহিনী এ ধরনের একটি ড্রোন গুলি করে ভূপাতিত করেছিল বলে জানা যায়। সেপ্টেম্বর ২০১৫ সালে, রাশিয়ান সেনাবাহিনী ইসরাইল থেকে ড্রোনের আরো ৩০০ মিলিয়ন ডলারের প্যাকেজ ক্রয় করে, এটি ছিল চতুর্থ ইসরাইলি ড্রোন ক্রয়।
সামরিক সহযোগিতা ছাড়াও ২০০৮ সালে, ইসরাইল এবং রাশিয়া ভিসা-মুক্ত চুক্তি স্বাক্ষর করে, যা দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক ভিসামুক্ত ভ্রমণের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। রাশিয়া এবং ইসরাইলে বসবাসরত যৌথ নাগরিকরা তাদের বন্ধুবান্ধব এবং আত্মীয়দের সাথে দেখা করার সহজ সুবিধা ভোগ করে।