মধ্যপ্রাচ্যে নতুন সমীকরণ
মধ্যপ্রাচ্যে নতুন সমীকরণ - ছবি সংগৃহীত
ইসরাইলের সাথে রাশিয়ার সম্পর্কের ক্রমউন্নতির একই সময়ে সৌদি আরব, মিসর ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাথে ইসরাইলের বিশেষ বোঝাপড়ার জোট তৈরি হয়। তারা তুরস্কের রাষ্ট্রপতি এরদোগানের সূচিত পদক্ষেপের অভিন্নভাবে বিরোধিতা করে। উভয় দেশ তুরস্কের সাথে প্রক্সি লড়াই করছে ককেশাস, উত্তর আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তুরস্কের বিরুদ্ধে ইসরাইল মূলত রাশিয়ার পক্ষ নিয়েছে, বিশেষ করে তুরস্ক-সমর্থিত জাতীয় চুক্তি সরকারের বিরুদ্ধে রাশিয়া ও ইসরাইল কিভাবে খলিফা হাফতারকে সমর্থন করেছে, তা দেখা গেছে। তুরস্কের বিরোধিতার পরও সিরিয়ায় রাশিয়ার হস্তক্ষেপের প্রতি ইসরাইলের নীরব সমর্থন ছিল; যদিও ইসরাইল শক্তিশালী তুর্কি মিত্র আজারবাইজানের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখে।
২০১৮ সালে, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের পাশাপাশি ইসরাইলও পরামর্শ দিয়েছিল, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উচিত রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক উন্নত করা এবং ইউক্রেন সঙ্কট সংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে পুনর্বিবেচনা করা, কারণ ইউক্রেন তুরস্কের মিত্র যদিও পুতিন এরদোগানের সাথে ইতিবাচক সম্পর্ক অব্যাহত রেখেছেন।
২০২০ সালে যখন সার্বিয়া এবং কসোভোর মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, তখন রাশিয়া এবং ইসরাইল খোলাখুলিভাবে এই চুক্তিকে সমর্থন করে যার সাথে সার্বিয়া জেরুসালেমে দূতাবাস স্থানান্তর এবং কসোভোর ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের শর্ত থাকে। ২০২০ সালের আগস্টে ‘আব্রাহাম চুক্তি’র পর ইসরাইল আরব আমিরাত এবং বাহরাইনের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করলে রাশিয়া চুক্তিটিকে প্রকাশ্যে সমর্থন করেনি তবে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য ইসরাইলের প্রচেষ্টাকে নীরবে অনুমোদন করে; যদিও তুরস্ক উভয় পদক্ষেপের বিরোধিতা করেছে।
ইরান এবং তুরস্ক উভয়ের সাথেই রাশিয়ার শক্তিশালী অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক অব্যাহত রয়েছে আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ইসরাইলের বিশেষ সম্পর্কের বিষয়ে রাশিয়া সন্দেহ পোষণ করে চলেছে। রাশিয়া ইসরাইল-ফিলিস্তিন সঙ্ঘাতের জন্য দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান সমর্থন করে এবং বেশ কয়েকটি ফিলিস্তিনি রাজনৈতিক দলের সাথেও সম্পর্ক রাখে। রাশিয়া হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে বিবেচনা করে না এবং তাদের সাথে কূটনৈতিকভাবে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। ইরান, রাশিয়া এবং তুরস্ক সবাই জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের একটি প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছে যাতে জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে ‘অকার্যকর’ ঘোষণা করা হয়। রাশিয়া তার কৌশলের অংশ হিসাবে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলের মিত্র ও প্রতিদ্বন্দ্বী উভয়ের সাথেই বহুপাক্ষিক সম্পর্কের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এর অংশ হিসাবে এটি করে থাকতে পারে।
সিরিয়ায় রাশিয়ার সামরিক হস্তক্ষেপ ও অব্যাহত উপস্থিতিকে মধ্যপ্রাচ্যের ‘গেম চেঞ্জার ঘটনা’ হিসাবে উল্লেখ করা হয়। রাশিয়ান বিমান হামলায় যত সিরিয়ান বেসামরিক নাগরিক নিহত ও স্থাপনা ধ্বংস হয় তার নজির নিকট ইতিহাসে বিরল। কিন্তু রহস্যজনক বিষয় হলো, রাশিয়ার সিরিয়ায় এই সামরিক হস্তক্ষেপের ব্যাপারে ইরান ও আসাদ সরকারের আমন্ত্রণের পাশাপাশি সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইসরাইল ও সৌদি আরবের সবুজ সঙ্কেতের কথা জানা যায়। দৃশ্যত মধ্যপ্রাচ্যের পরস্পরবিরোধী এ শক্তিগুলো কেন সিরিয়ায় রাশিয়ান হস্তক্ষেপকে স্বাগত জানাল সে এক জটিল রহস্যের বিষয়।
ইরান মধ্যপ্রাচ্যে তার প্রভাব বিস্তারের যে কৌশলগত রোডম্যাপ তৈরি করেছে তার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো সিরিয়ার বাশার আল আসাদের সরকার। সিরিয়ায় ইরানপন্থী সরকার থাকলে লেবাবনে হিজবুল্লাহ ও ফিলিস্তিনের মিত্রদের সাথে সামরিক ও কৌশলগত সংযোগ রক্ষা করা যায়। ইয়েমেনে হুথি আনসারুল্লাহর সাথে সংযোগ রক্ষার ক্ষেত্রেও এটি পরোক্ষভাবে সহায়তা করে। এ কারণে যে কোনো কিছুর বিনিময়ে ইরান সিরিয়ায় তার মিত্র সরকারকে রক্ষায় রাশিয়ার ভূমিকাকে স্বাগত জানিয়েছে।
সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরব সিরিয়ার আসাদ বিরোধীদের রাস্তায় নামানো ও সশস্ত্র করার ক্ষেত্রে ইন্ধন দিলেও এক পর্যায়ে তারা মধ্যপ্রাচ্যে রাজতন্ত্রের ক্ষমতার সামনে ব্রাদারহুডকে প্রধান প্রতিপক্ষ হিসাবে গ্রহণ করে। জানা যাচ্ছে, এই বিবেচনাতেই ইসলামিস্টদের দমনের জন্য সিরিয়ায় তারা সবুজ সঙ্কেত দেয় ক্রেমলিনকে।
প্রশ্ন হলো, ইসরাইল কেন তার দোরগোড়ায় রাশিয়ার সামরিক উপস্থিতিকে কাম্য মনে করল? যারা আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতির ভেতরের খবরাখবর রাখেন তারা জানেন, ইসরাইলের সার্বভৌম ও ভৌগোলিক অস্তিত্বের ব্যাপারে সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট নেতাদের বিশেষ কমিটমেন্ট সব সময় ছিল। এ কারণে ১৯৬৭ বা ১৯৭৩ সালে যখন আরব ইসরাইল যুদ্ধ হয় তখন মিসর ও সিরিয়া সোভিয়েত বলয়ে থাকার পরও সর্বাত্মক সামরিক সহায়তা ক্রেমলিন থেকে পায়নি। ফলে এসব যুদ্ধে ইসরাইল জয়ী হয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার পর রাশিয়ান নেতাদের আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে আদর্শবাদের পরিবর্তে জাতিবাদী স্বার্থ মুখ্য বিবেচিত হয়। এছাড়া বৈশ্বিকভাবেও দুই দশক রাশিয়ার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত সঙ্ঘাত দেখা যায়নি। এ সময়টাতে ইসরাইল-রাশিয়া সম্পর্ক উল্লেখযোগ্যভাবে জোরদার হয়।
দুই দেশের ক্ষমতার শীর্ষে থাকা ব্যক্তিবর্গের রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ডের বাইরে ব্যক্তিগত বোঝাপড়াও তৈরি হয়। এই বোঝাপড়ার কারণে প্রকাশ্যে ইসরাইলের সাথে ইরানের বৈরিতা যতই বাড়তে দেখা যাক না কেন, এ ব্যাপারে রাশ টেনে ধরতে মস্কো ইরানের ওপর তার প্রভাবকে কাজে লাগায়। ইসরাইলের সাথে হিজবুল্লাহর উত্তেজনা মাঝে মধ্যে বাড়তে দেখা গেলেও তা যুদ্ধের পর্যায়ে যায়নি রাশিয়ার হস্তক্ষেপে। ইসরাইল অভিযোগ করে যে, হিজবুল্লাহ রাশিয়ার তৈরি অস্ত্রসজ্জিত হয়েছে। এই অভিযোগের পর রাশিয়ান কর্মকর্তারা সিরিয়ার সমরাস্ত্র মজুত পরীক্ষা করে এটি নিশ্চিত করেন যে, রাশিয়ান অস্ত্র ইসরাইলের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে না।
ইসরাইল ও রুশ নেতৃত্বের মধ্যে এই ব্যক্তিগত বোঝাপড়ার কিছুটা ব্যত্যয় হয় বেনইয়ামিন নেতানিয়াহুর ইসরাইলে সরকার গঠনে ব্যর্থ হওয়ার পর। নেতানিয়াহু পুতিনের কাছে বার্তা দিয়েছেন যে, তিনি স্বল্প সময়ের মধ্যে ইসরাইলের ক্ষমতায় ফিরে আসছেন। কিন্তু বাইডেন প্রশাসনের কারণে সেটি এখনো বাস্তব হয়ে ওঠেনি। এ ব্যাপারে কিছুটা অনিশ্চয়তা দেখা দেয়ার কারণে ইসরাইলের নতুন প্রধানমন্ত্রী নাফতালির সাথে পুতিন বৈঠকে বসেন। অবশ্য ইসরাইলের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নাফতালি নেতানিয়াহুর মন্ত্রিসভারই সদস্য ছিলেন। তিনি সামগ্রিকভাবে নেতানিয়াহুর অ্যাজেন্ডাগুলোকে সামনে এগিয়ে নিতে চাইছেন। বর্তমান সরকার অব্যাহত থাকলে তার মেয়াদের দুই বছর ইসরাইলি নীতিতে বড় কোনো পরিবর্তন নাও আসতে পারে।