ইসরাইল থেকে কি সরে যাবেন পুতিন
পুতিন - ছবি সংগৃহীত
মধ্যপ্রাচ্যের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাশিয়ান ভূমিকায় কি কোনো পরিবর্তন আসবে। বিগত হামাস-ইসরাইল যুদ্ধের সময় জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদ ও অন্যান্য ফোরামে রাশিয়া-চীন ইসরাইলের পক্ষ সমর্থন করেনি। বরং যুদ্ধ বন্ধে চাপ তৈরি করেছে। দেশ দুটি এ ভূমিকা এমন এক সময় নেয় যখন বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসনের সাথে চীন-রাশিয়া স্নায়ুদ্বন্দ্ব নতুন করে চাঙ্গা হয়। আর এ সময় ওয়াশিংটন কৌশলগত ও নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট সব ধরনের সম্পর্ক রাশিয়া ও চীনের সাথে বিচ্ছিন্ন করতে চাপ দেয় ইসরাইলকে। এ চাপের মুখে বেশ কিছু চুক্তি ও সমঝোতা থেকে ইসরাইল সরে আসে।
এখনো চীন-রাশিয়ার সাথে ইসরাইলের সম্পর্কের মধ্যে টানাপড়েনের কিছু উপাদান রয়ে গেছে। তবে এই উপাদানগুলো ফিলিস্তিনিদের সাথে সম্পর্ককে কিছুটা উষ্ণ করলেও ইসরাইলের সাথে বড় ধরনের দূরত্ব সৃষ্টির মতো কখনো হবে না। এর কারণ হলো দু’দেশের মধ্যে রয়েছে অদ্ভুত একটা সম্পর্ক। ইসরাইলের রাশিয়ার প্রতি খুব বেশি ভালোবাসা নেই, তবে ইসরাইলে রাশিয়ান বংশোদ্ভূত কমপক্ষে ২৫ শতাংশ ইহুদি রয়েছে। বেশ কিছু ইসরাইলি বিখ্যাত ব্যক্তিও এই রাশিয়ান ইহুদিদের বংশধর।
দৃশ্যত রাশিয়া ও ইসরাইলের মধ্যে খুব বেশি শত্রুতা না থাকলেও তারা খুব একটা ঘনিষ্ঠ নয় বলে মনে হয়। সহজ কথায় বলা যায়, ইসরাইল রাশিয়ার তুলনায় ভিন্ন এক নীতি অনুসরণ করে। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো, রাশিয়ারও অনেক আরব মিত্র রয়েছে আর এই মিত্ররা রাশিয়ার সাথে সংযুক্ত থাকলে তারা ইসরাইলের সাথে রাশিয়ানদের বিশেষ সম্পর্কের কারণে তেলআবিবের স্বার্থের বিশেষ ক্ষতি করার সাহস করবে না বলে বিশ্বাস করে তেলআবিব।
পুতিন ইসরাইলকে সবচেয়ে শক্তিশালী রুশবাসীদের বসবাসের দেশ হিসাবে বর্ণনা করেছেন। রাশিয়া যখন অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে তখন রাশিয়ার অর্থনীতিকে রক্ষা ও উন্নয়ন-অর্থায়নে সহায়তা করার জন্য অনেক ইসরাইলি রাশিয়ায় ফিরে যায়। তাদের মধ্যকার সম্পর্ক এমন যে, একজন রাশিয়ান ইহুদি ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসলেও আশ্চর্য হবার কিছু থাকবে না বলে মনে করা হয়।
রাশিয়ার সাবেক প্রোপাগান্ডা এক্সিকিউটিভ দিমা ভোরোবিভের বক্তব্যটি এ প্রসঙ্গে বেশ তাৎপর্যপূণ মনে হয়। তিনি বলেছেন, ‘ওভারল্যাপিং রাজনৈতিক স্বার্থের কারণে ইরান ও সিরিয়া আমাদের বন্ধু। তাদের বহুবর্ষব্যাপী অ্যান্টি-আমেরিকানবাদ তাদেরকে আমাদের অস্ত্রের ক্রেতা এবং জাতিসঙ্ঘে আমাদের সমর্থক করে তোলে। কিন্তু ইসরাইলের মতো তাদের সঙ্গে আমাদের বন্ধন খুব বেশি গভীর নয়। তারা সাংস্কৃতিকভাবে আমাদের থেকে অনেক দূরে। পিটার দ্য গ্রেটের যুগ থেকে, আমাদের অভিজাতরা তাদের উত্তরাধিকারী ইসলাম ধর্ম এবং মধ্যপ্রাচ্যের রীতিনীতিকে বিশেষভাবে মঙ্গলকর নয় বলে মনে করেছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘ইতোমধ্যে, ইসরাইল মধ্যপ্রাচ্যে স্ট্যালিনের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী নীতির শিশুতে পরিণত হয়েছে। আমাদের প্রচ্ছন্ন সমর্থন না থাকলে ইসরাইলিরা শুরুতেই তাদের আরব প্রতিবেশীদের দ্বারা পরাস্ত হতে পারত। তাদের মধ্যে অনেকেই সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে আসা অভিবাসী বা এই অভিবাসীদের সন্তান। রাশিয়ান ভাষা এবং সংস্কৃতি তারা ধারণ করে। অন্য দিকে, গত ১০০ বছরে ইহুদিরা আমাদের সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, গণমাধ্যমে স্থায়ী প্রভাব ফেলেছে।’
বলা হয়ে থাকে ইসরাইল-রাশিয়া সম্পর্ক এমন এক গভীর বন্ধন যদি কোনো কারণে সরকারি পর্যায়ে রাশিয়া এবং ইসরাইলের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে তবুও শক্তিশালী সম্পর্ক পারস্পরিক দৈনন্দিন আকর্ষণ স্তরে বজায় থাকবে। সিরিয়া এবং ইরানের সাথে রাশিয়ার সম্পর্কে এই জৈব গভীরতা নেই।
১৫ জানুয়ারি ২০২০-এ, এশিয়া টাইমসের একটি প্রতিবেদনে ইসরাইলি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে বলা হয় যে, রাশিয়া সিরিয়ায় ইসরাইলি বিমান হামলা চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেয়ার বিনিময়ে সিরিয়ার সরকারের ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার অবসান ঘটাতে ইসরাইলি কূটনৈতিক সহায়তা আশা করেছিল। টাইমস অব ইসরাইলের মতে, একটি ইসরাইলি সংস্থা হাদাসাহ এমন একটি প্রচেষ্টার সাথে জড়িত ছিল যার ফলে কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাবের সময় রাশিয়ার ভ্যাকসিন তৈরি হয়েছিল, পুতিন রাশিয়াকে প্রথম দেশ হিসেবে সফল অ্যান্টি-কোভিড ভ্যাকসিন তৈরির ঘোষণা করার পরপরই এটি হয়। ২০২০ সালের নভেম্বরে, ইসরাইলের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু রাশিয়ার তৈরি করা স্পুটনিক ভি ভ্যাকসিন কেনার সম্ভাবনার কথা বলেছিলেন। হাদ্দাসাহ মেডিক্যাল সেন্টার তারপর ১৫ থেকে ৩০ লাখ ডোজ টিকার জন্য একটি বাণিজ্যিক স্মারক স্বাক্ষর করে।
এদিকে ২০২০ সালের ১৫ ডিসেম্বর রাশিয়ান পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ ২০২০ সালে ইসরাইল ও বেশ কয়েকটি আরব রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কের স্বাভাবিকীকরণের প্রশংসা এবং এটিকে "ইতিবাচক ঘটনা" হিসাবে তিনি বর্ণনা করেন। একই মাসে, ইসরাইলে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আনাতোলি ভিক্টোরভ ইসরাইলের ‘ইসরাইল-আরব এবং ইসরাইল-ফিলিস্তিন সঙ্ঘাতে জাতিসঙ্ঘের প্রস্তাবে অসম্মতি’ এবং হিজবুল্লাহ লেবানন থেকে ভূগর্ভস্থ টানেল তৈরি করেছে বলে ইসরাইলি দাবির বিরোধিতা করার পরে সম্পর্কের কিছুটা অবনতি ঘটে। রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা এ ব্যাপারে ইসরাইলের প্রতিক্রিয়াকে ‘অতি সংবেদনশীল’ বলে বর্ণনা করেন। তবে তিনি নিশ্চিত করেন যে, রাশিয়া ‘সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় ইসরাইলের নিরাপত্তা উদ্বেগকে বিবেচনায় নিয়ে চলতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন, আরব-ইসরাইল দ্বন্দ্বের বিষয়ে রাশিয়া আজ মধ্যপ্রাচ্যে একটি স্থিতাবস্থার শক্তি, স্থিতিশীলতায় আগ্রহী, অচলাবস্থায় নয়। বর্তমানে ইসরাইলে কেউ কেউ ইরান এবং ইরাকে রাশিয়ার জড়িত থাকা নিয়ে উদ্বিগ্ন; যদিও ইসরাইল-আরব শান্তি প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে রাশিয়ার লেভারেজ সীমিত, তবে রাশিয়ার জন্য অস্থিতিশীলতার সম্ভাবনা এখনো যথেষ্টভাবে কম বলে মনে করা হয়। গত দশকেও রাশিয়ার নীতি ধারাবাহিকভাবে স্থিতিশীলতা এবং মার্কিন শান্তি প্রচেষ্টাকে সমর্থন করেছে।
বর্তমান রাশিয়ান নীতিগুলো আরবদের আপেক্ষিক দুর্বলতা এবং ইসরাইলের আপেক্ষিক শক্তির একটি নিরপেক্ষ মূল্যায়নও প্রতিফলিত করে। সোভিয়েত নীতিগুলো একদিকে দৃশ্যত আরবের সামরিক শক্তিকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি ইসরাইলের শক্তিকে আমেরিকান শক্তির আউটপোস্ট এবং সম্প্রসারণের জন্য দায়ী হিসাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছিল। বর্তমান রাশিয়ান চিন্তাধারা আরব সামরিক বিকল্পগুলোর জন্য যেকোনো সমর্থন থেকে সরে যায় এবং ইসরাইলের সামরিক, প্রযুক্তিগত ও অর্থনৈতিক প্রান্তের তথ্যগুলোকে তার অস্তিত্বের একটি অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য হিসাবে স্বীকৃতি দেয়।
একটি ভিন্ন স্তরে, যৌথ ইসরাইল-রাশিয়ান প্রতিরক্ষা এবং শিল্প সহযোগিতার দিকগুলো পশ্চিমা প্রযুক্তি এবং বাজারগুলোর পথ খুলে দিয়েছে যেখানে রাশিয়ার সহজ অ্যাক্সে ছিল না। একটি নতুন অ্যাটাক হেলিকপ্টার (রাশিয়ান হার্ডওয়্যার, ইসরাইলি এভিওনিক্স) এর যৌথ বিকাশ উন্নয়নশীল সাধারণ কৌশলগত অ্যাজেন্ডার একটি উদাহরণ মাত্র। এ ধরনের পরিস্থিতিতে এবং এই স্বার্থের কথা মাথায় রেখে, রাশিয়ার যেকোনো ঘোষণামূলক অবস্থান যা ইসরাইলের সমালোচনামূলক বলে মনে হয় তা অবশ্যই আসলে বিপরীতমুখীই হবে।
২০০০ সালের গ্রীষ্মের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী এহুদ বারাকের মস্কো সফরের সময়, পুতিন তাকে ইসলামী মৌলবাদের বিরুদ্ধে একটি যৌথ বিবৃতি জারি করতে রাজি করার চেষ্টা করেছিলেন। বারাক নিরুৎসাহিত হয়ে পুতিনকে একান্তে বলেছিলেন যে ইসলামিক-অনুপ্রাণিত সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে অপারেশনাল সহযোগিতা ইসরাইল ও রাশিয়ার (এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) মধ্যে একটি সুস্পষ্ট যৌথ অ্যাজেন্ডা হলেও, চেচনিয়া একটি রুশ অভ্যন্তরীণ বিষয় যা একটি জাতীয় সংঘাত থেকে বেড়েছে। চেচনিয়ায় উত্তেজনা সৃষ্টির ব্যাপারে আমেরিকান অ্যাজেন্ডা থাকার বিষয়টি জানা ছিল বলেই হয়তো বারাক এ ব্যাপারে সাড়া দেননি। আর চেচনিয়ার যুদ্ধ রাশিয়ার নীতিকে পরবর্তীতে অনেক বেশি ইসরাইলমুখী হতে সহায়তাই করেছে। সিরিয়ায় রাশিয়ার নির্মম সামরিক হস্তক্ষেপের পেছনেও পুতিনকে চেচনিয়ার ভয় তাড়া করেছে বলে অনেক মনে করেন।
বলাবাহুল্য, চেচেন যুদ্ধ অবশ্যই আরব ও ইসলামিক অবস্থানের সমর্থনে রাশিয়ার আগ্রহকে হ্রাস করেছে এবং আরব জনমতের তীব্র সমালোচনার মুখে ফেলেছে রাশিয়াকে। তার চেচনিয়া নীতির একটি অপ্রত্যাশিত পরিণতি হিসাবে, রাশিয়াকে এখন আরব এবং ইসলাম বিশ্বে অনেক ক্ষেত্রে শত্রু হিসাবে দেখার ভারী মূল্যও দিতে হচ্ছে মস্কোকে। এই উন্নয়ন মধ্যপ্রাচ্য সংঘাতে রাশিয়ার সহানুভূতিকে আরো ভিন্ন দিকে সরিয়ে দিচ্ছে।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, প্রায় ১০ লাখ রুশ-ভাষী গত ১২ বছরে অভিবাসী হয়েছেন ইসরাইলে। তারা ইসরাইলের ইহুদি জনসংখ্যার প্রায় ২০ শতাংশ এবং তারা দেশের একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক শক্তি। তাদের প্রভাব শুধুমাত্র দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তাৎপর্যপূর্ণ নয়, বরং ইসরাইল সম্পর্কে রাশিয়ার ধারণা এবং তাই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এবং পারস্পরিক উপলব্ধিও পরিবর্তন করেছে।
ফলে পুতিনের রাশিয়া আরবদের সাথে যত ধরনের সম্পর্কই বজায় রাখুক না কেন ইসরাইলের নিরাপত্তার ব্যাপারে পুরোনো অঙ্গীকারের কোনো ব্যত্যয় করবে না। মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার সমর্থনের উপর ভিত্তি করে কোনো পরিবর্তনের চিন্তা করা অবাস্তব ভাবনাই হবে। বরং সিরিয়ায় যেভাবে রাশিয়া নির্বিচারে সামরিক শক্তি ব্যবহার করেছে তেমন ব্যবহার মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য অঞ্চলেও ঘটে থাকলে বিস্মিত হবার কিছু থাকবে না। এ ধরনের কিছু আমেরিকার সাথে বোঝাপড়ার মাধ্যমে হলে বিপদের মাত্রা আরো বেড়ে যাবে। এক্ষেত্রে কলকাঠি নাড়া তথা আগুনে ফুঁ দেয়ার কাজটি করতে পারে ইসরাইল। রাশিয়ার উপর প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা ইরানের মতো দেশের চেয়ে রাশিয়ার অনেক বেশি।
mrkmmb@gmail.com