ইংল্যান্ডের সাদাম্পটন থেকে আমেরিকার নিউইয়র্ক যাওয়ার পথে উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরে ১৯১২ খ্রিস্টাব্দের ১৪ এপ্রিল গভীর রাত থেকে ডুবতে শুরু করেছিল সময়ের তুলনায় অত্যাধুনিক টাইটানিক। হিমশৈলে ধাক্কা লেগে একটু একটু করে তলিয়ে যায় জাহাজটি। মানুষের নৌযানের ইতিহাসে টাইটানিকের নাম মাইলফলক হয়ে রয়েছে। বিলাসিতা এবং অত্যাধুনিকতার চরম নিদর্শন ছিল এই জাহাজ।

বিশাল টাইটানিক সম্পর্কে আমাদের যেটুকু ধারণা তার সিকি ভাগেরই জন্ম দিয়েছে জেমস ক্যামেরনের সিনেমা। ১৯৯৭-এর এই সিনেমার পর থেকে অনেকেরই টাইটানিক নিয়ে আগ্রহ তৈরি হয়। কিন্তু সিনেমার সেই টাইটানিক আসল ছিল না। পুরোটাই সাজানো। ১৯১১ সালে দাঁড়িয়ে পৃথিবীর বুকে ও রকম একটা জাহাজ তৈরি করাই ছিল একটা ব্যাপার। টাইটানিকের বহু সত্য আজও অনেকেরই অজানা রয়ে গেছে।

টাইটানিকের প্রসঙ্গ উঠলেই জাহাজের ডুবে যাওয়া এবং ওই ঘটনার সঙ্গে মৃত্যুর দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে ওঠে। এই জাহাজের সাথে মৃত্যুর সম্পর্ক কিন্তু তারও অনেক আগে থেকে। জাহাজ পানি ভাসার আগে থেকেই একাধিক মৃত্যুর সাক্ষী হতে হয়েছিল এই জাহাজকে। ২৬ মাস লেগেছিল টাইটানিক বানাতে। এই ২৬ মাসে একাধিক দুর্ঘটনা ঘটেছে। মৃত্যু হয়েছিল অন্তত আট শ্রমিকের। হয় উঁচু থেকে পড়ে গিয়ে কিংবা কোথাও পিষে মারা গিয়েছিলেন তারা। টাইটানিক সমুদ্রে ভাসার ঠিক আগের মুহূর্তে জেমস ডবিন নামে এক ব্যক্তি জাহাজের তলায় পিষে মারা গিয়েছিলেন। টাইটানিককে দাঁড় করিয়ে রাখার জন্য অনেক কাঠের গুড়ি রাখা ছিল তার সামনে। জাহাজ ভাসার আগে সেগুলো সরাতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটেছিল।

১৯১২ সালে টাইটানিক যখন ডুবে যায় সে সময় মোট দু’হাজার ২০০ জন যাত্রী ছিলেন। এর বাইরে শুধুমাত্র জাহাজের কর্মীই ছিলেন এক হাজার জন।

টাইটানিকের সবচেয়ে ধনী যাত্রী ছিলেন চতুর্থ জন জেকব অ্যাস্টর। ওই সময় বিশ্বেরও অন্যতম ধনী ব্যক্তি ছিলেন তিনি। স্ত্রীর সাথে টাইটানিকে যাত্রা করছিলেন জন। ডুবন্ত টাইটানিক থেকে লাইফবোটে উঠে আসার সুযোগ প্রথমে মহিলা এবং শিশুদের দেয়া হয়েছিল। ধনী হওয়া সত্ত্বেও ওই নিয়মকে মান্যতা দিয়ে স্ত্রীকে লাইফবোটে তুলে দিয়েছিলেন জন। কিন্তু জাহাজের সাথে ডুবে যান তিনি।

টাইটানিকে প্রথম শ্রেণির যাত্রীদের জন্য চারটি রেস্তরাঁ ছিল। দু’টি লাইব্রেরি, একটি ছবি তোলার ঘর, একটি উষ্ণ পানির সুইমিং পুলও ছিল। রেস্তরাঁয় খাবার পরিবেশনের জন্য ছিল বোন চায়নার ৫০ হাজার বহুমূল্য বাসন।

টাইটানিকের নিজস্ব ‘অতলান্তিক ডেইলি ব্যুলেটিন’ প্রকাশিত হতো। জাহাজে বসেই দেশ-বিদেশের খবর জানতে পারতেন যাত্রীরা। বোর্ডে ফুটে উঠত সে দিনের সমস্ত খাবারের নামও। প্রথম শ্রেণির একটি সাধারণ ঘরের ভাড়া ছিল ৩০ পাউন্ড, পার্লার সুইটের ভাড়া ছিল ৮৭৫ পাউন্ড। তবে বেশির ভাগ যাত্রীই তিন থেকে আট পাউন্ড ভাড়া দিয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে থাকতেন।

ঐতিহাসিক ওই জাহাজডুবির ঘটনায় যে কয়েকজন প্রাণে বেঁচেছিলেন, তাদেরই অন্যতম ছিলেন টাইটানিকের রেস্তরাঁয় বেকিংয়ের মূল দায়িত্বে থাকা চার্লস জোঘিন। অনেকের মতে, তিনিই শেষ ব্যক্তি যিনি টাইটানিক থেকে ঝাঁপ দিয়েছিলেন নিকষ মহাসাগরে। টাইটানিকের গায়ে যখন হিমশৈলের আঘাত প্রথম লাগে তখন নাকি নেশার ঘোরে ঘুমোচ্ছিলেন চার্লস। ধাক্কার চোটে জাহাজ কেঁপে উঠতেই ঘুম ভেঙে যায় চার্লসের।

আটলান্টিক মহাসাগরের তিন হাজার ৭০০ মিটার গভীরে এর ধ্বংসাবশেষ উদ্ধার হয়েছিল ১৯৮৫ সালে। তার পরই নিশ্চিত হওয়া গিয়েছিল যে ডোবার আগে দু’ভাগ হয়ে গিয়েছিল জাহাজটি। রবার্ট ব্যালার্ডের নেতৃত্বে একটি দল টাইটানিকের এই ধ্বংসাবশেষ খুঁজে বার করার পর থেকেই এই কিংবদন্তি প্রমোদতরীকে নিয়ে নতুন করে আগ্রহ বাড়ে।

তার পরে পর্দায় লিওনার্দো দিক্যাপ্রিও আর কেট উইনস্লেটের প্রেমকাহিনি দেখার পরে টাইটানিক নিয়ে রাতারাতি উন্মাদনা তৈরি হয়। তারই জেরে ১৯৯৮ থেকে শুরু হয়েছিল সমুদ্রের গভীরে টাইটানিক ভ্রমণের ব্যবস্থা। কিন্তু মাঝে টাইটানিককে বাঁচানোর খাতিরেই তা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত হয়। বাণিজ্যের হাতছানি অবশ্য সে সিদ্ধান্তকে টিকিয়ে রাখতে দেয়নি। কয়েক লাখ ডলারের বিনিময়ে আটলান্টিকের অতলে টাইটানিকের রহস্য ভেদে আজও ঘুরে আসার সুযোগ রয়েছে। না জানি উঠে আসবে আরো কত অজানা সত্য।

সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা