নারী জলদস্যূ চিং : তার ভয়ে কাঁপত চীন সাগর
নারী জলদস্যূ চিং - ছবি সংগৃহীত
১৬৪৪ থেকে ১৯১২ পর্যন্ত চীনে ছিল কুইং সাম্রাজ্য। ১৮ শতকের প্রথমার্থে এক নারী ঘুম উড়িয়ে দিয়েছিল এই কুইং সাম্রাজ্যের। দক্ষিণ চিন সাগরে কার্যত একাধিপত্ব বিস্তার করে ফেলেছিলেন তিনি। শোনা যায়, তার এক কথায় ৮০ হাজার পুরুষ জীবন বাজি রাখতে তৈরি ছিল।
কুইং রাজপরিবারের অংশ তিনি ছিলেন না। সমাজের নিচু শ্রেণি থেকে উঠে আসা এই নারীকে বাগে আনতে বেগ পেতে হয়েছিল কুইং রাজাদের। ১৮০৭ থেকে ১৮১০— এই তিন বছর তিনি দাপিয়ে বেড়িয়েছিলেন দক্ষিণ চিন সাগরে।
তার প্রকৃত নাম জেং ওয়াই সাও। বিশ্বদরবারে পরিচিত কুখ্যাত নারী জলদস্যু চিং শি নামে। চিনের জিনহুই প্রদেশের গুয়াংদঙের একটি ভাসমান পতিতালয়ে ১৭৭৫ সালে জন্ম তার। পরবর্তীকাল তিনি নিজেও এই কাজ করতেন। পতিতালয়েই তার পরিচয় হয়েছিল চেং ওয়াইয়ের সাথে।
চেং ওয়ান ছিলেন জলদস্যুদের নেতা। ওই সময় তিনি দাপিয়ে বেড়াতেন দক্ষিণ চীন সাগরে। তাঁর অধীনে ৮০ হাজার জলদস্যু এবং ১৮০০ দস্যু জাহাজ ছিল। জেং ওয়াইয়ের প্রেমে পাগল হয়ে ১৮০১ সালে তাকে বিয়ে করেছিলেন জলদস্যু চেং। স্বামীর হাত ধরে সেই থেকেই দস্যু রানি হয়ে ওঠেন জেং ওয়াই। পরে স্বামীর মৃত্যুর পর এই বিশাল দস্যু সাম্রাজ্য একা হাতে পরিচালনা করতেন। বিশ্ব ইতিহাসে অন্যতম কুখ্যাত দস্যু তিনি।
ইতিহাসবিদদের মতে, ক্ষমতা হাতে পাওয়ার জন্য সৎ ছেলের সাথে নাকি ছক কষে স্বামীকে খুন করেছিলেন তিনিই। বিয়ের ছয় বছর পর মাত্র ৪২ বছর বয়সে মৃত্যু হয় স্বামী চেংয়ের। তার মৃত্যুর পরই জলদস্যুদের রানি হয়ে ওঠেন। রাজত্ব করতে শুরু করেন দক্ষিণ চীন সাগরে। স্বামীর গড়ে তোলা ৮০ হাজার দস্যুর সেনা এবং ১৮০০ জাহাজ তার নির্দেশ মেনে চলত। নারী পরিচালিত এত বড় বাহিনীর নজির বিরল।
স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি চিং শি নামেই পরিচিত হয়েছিলেন। চিং শি অর্থাৎ চেংয়ের বিধবা। বিশেষজ্ঞদের মতে, চেংয়ের দত্তক নেয়া ছেলে চিয়াং পো সাইয়ের সাথে মিলিতভাবে ষড়যন্ত্র করেই স্বামীকে রাস্তা থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন তিনি।
তিনি ভালোভাবেই জানতেন, স্বামীর মৃত্যুর পর তার দত্তক নেয়া ছেলের হাতেই দস্যু সম্রাজ্যের ধ্বজা উঠবে। তাই আগেই সৎ ছেলেকে প্রেমের জালে ফাঁসিয়েছিলেন। সিংহাসন নিজের দখলে রাখার শর্তে বিয়েও করেছিলেন।
দত্তক নেয়া ছেলে চিয়াং পো-এর সাথে তার স্বামীর সম্পর্ক নিয়েও বিভিন্ন মত রয়েছে বিশেষজ্ঞদের। অনেকের মতে, চিয়াং পো আসলে জেলে ছিলেন। তাকে বন্দি করা হয়েছিল। পরে তাকেই দত্তক নিয়েছিলেন চেং। কিন্তু তাদের মধ্যে সে অর্থে পিতা-পুত্রের সম্পর্ক ছিল না।
ক্ষমতা পুরোপুরি নিজের হাতে পাওয়ার পর বেশ কিছু নিয়ম চালু করেছিলেন জেং ওয়াই। তার অধীনে থাকা কোনো জলদস্যু যদি উচ্চপদস্থ কানো আদেশ অমান্য করতেন, তা হলে তৎক্ষণাৎ তার শিরোচ্ছেদ করা হতো। কোনো নারী বন্দিকে ধর্ষণ করলেও ওই দস্যুর মৃত্যু ছিল অনিবার্য।
কুইং রাজাদের প্রচুর চেষ্টা সত্ত্বেও অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছিলেন জেং ওয়াই। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং পর্তুগীজ নৌসেনাও তাকে থামাতে ব্যর্থ হচ্ছিল। স্বামীর মৃত্যুর পর ১৮০৭ থেকে ১৮১০- এই তিন বছর একা সমুদ্র-শাসন করার পর চীন সরকারের সাথে শান্তিপূর্ণভাবে নিজের সাম্রাজ্য ছেড়ে দেয়ার বিষয়ে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন। তার এক কথায় সমস্ত দস্যু অস্ত্র ত্যাগ করেছিল।
তাকে মনে করেই বিখ্যাত ছবি ‘দ্য পাইরেটস অব দ্য ক্যারিবিয়ান’-এর একটি পার্ট তৈরি হয়েছিল। সমুদ্রের একচেটিয়া সাম্রাজ্য ছেড়ে দেয়ার পর কোথায়, কিভাবে তিনি বাকি জীবন কাটিয়েছিলেন তা অজানাই রয়ে গিয়েছে। শোনা যায় ১৮৪৪ সালে ৬৯ বছর বয়সে তার মৃত্যু হয়।
সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা