কত সম্পদ ছিল জগৎ শেঠের!

অন্য এক দিগন্ত ডেস্ক | Dec 12, 2021 01:17 pm
জগৎ শেঠ

জগৎ শেঠ - ছবি সংগৃহীত

 

অষ্টাদশ শতকে বাংলার ইতিহাসে বিখ্যাত ধনী ‘জগৎ শেঠ’ কোনো একজন ব্যক্তি নন। ‘জগৎ শেঠ’ একটি পারিবারিক উপাধি। বিপুল ধনসম্পদ ও সেই সুবাদে প্রভূত রাজনৈতিক ক্ষমতা ভোগকারী এই পরিবারটির আবাস ছিল সেই সময়কার সুবা বাংলার রাজধানী মুর্শিদাবাদে।

জগৎ শেঠরা আদতে বাংলার মানুষ নন। তাদের আদি নিবাস রাজস্থানের জোধপুরের নাগোর অঞ্চলে। প্রথমে তারা শ্বেতাম্বর জৈন ধর্মাবলম্বী ছিলেন। পরে বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করেন। আরও পরে তারা আবার জৈনধর্ম নেন।

এই বংশে প্রাচীন ইতিহাস ঘাঁটতে বসলে দেখা যায়, হীরানন্দ সাহু নামে এক ব্যক্তি জোধপুর থকে ভাগ্য অন্বেষণে পটনায় আসেন। অসম্ভব দরিদ্র হীরানন্দ মনের দুঃখে দিন কাটাতেন। এমন সময়ে একদিন তিনি পটনা শহরের কাছে একটি জঙ্গলে প্রবেশ করেন। সেখানে কারো আর্তনাদ শুনতে পেয়ে তা অনুসরণ করে একটি ভাঙা প্রাসাদে পৌঁছন। তার ভিতর থেকেই সেই আওয়াজ আসছিল। সেখানে দেখেন এক মৃত্যুপথযাত্রী বৃদ্ধ যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। হীরানন্দ তার যথাসাধ্য সেবা করলেও সেই বৃদ্ধ মারা যান। মৃত্যুর আগে তিনি হীরানন্দকে এক গুপ্তধনের সন্ধান দিয়ে যান।

সেই গুপ্তধনের মধ্য নাকি ছিল প্রচুর স্বর্ণমুদ্রা। এই সোনাই হীরানন্দের বংশকে ধনী করে তোলে। হীরানন্দ তার সাত ছেলেকে ভারতের সাতটি জায়গায় গদিয়ান করে দেন। কনিষ্ঠ পুত্র মানিকচাঁদ আসেন মুর্শিদাবাদে। তিনিই জগৎ শেঠ বংশের প্রতিষ্ঠাতা।

এক সময়ে বাংলার রাজধানী ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়। মানিকচাঁদ ঢাকাতেও তার গদি স্থাপন করেন। মূলত তেজারতি বা বলা ভালো, ব্যাংকিং ছিল মানিকচাঁদের ব্যবসা। তখন বাংলা মোগল শাসনাধীন। নবাব পদে আসীন মোগল বংশীয় আজিম-উস-শান। মুর্শিদকুলি খান তার দেওয়ান মাত্র। এই সময় নবাবের সাথে দেওয়ানের মনোমালিন্য হয়। মুর্শিদকুলি মুর্শিদাবাদে চলে আসেন। মানিকচাঁদও তার সাথে চলে আসেন।

ক্রমে মানিকচাঁদ মুর্শিদকুলির অন্যতম প্রধান পরামর্শদাতা হয়ে ওঠেন। সাথে সাথে তারও শ্রীবৃদ্ধি ঘটতে থাকে। কথিত আছে, মুর্শিদকুলি বাংলা-বিহার উড়িষ্যার নিজামতি পদ লাভ করে মুর্শিদাবাদে টাঁকশাল স্থাপন করেছিলেন। সেই টাঁকশালের প্রধান পরামর্শদাতা ছিলেন মানিকচাঁদ।

মুর্শিদকুলিই মানিকচাঁদের জন্য ‘শেঠ’ উপাধি জোগাড় করে দেন তৎকালীন দিল্লির বাদশা ফারুখশিয়রের কাছ থেকে। বিনিময়ে মানিকচাঁদ মুর্শিদকুলিকে বিপুল অর্থ দিয়েছিলেন বলে কথিত আছে। তিনিই ভাগীরথীর পূর্ব তীরে প্রাসাদ নির্মাণ করেন, যা আজও একটি দ্রষ্টব্য স্থান।

মানিকচাঁদ অপুত্রক ছিলেন। তাই তিনি নিজের ভাগ্নে ফতেচাঁদকে দত্তক নেন। ফতেচাঁদই প্রথম ‘জগৎ শেঠ’ নামে পরিচিত হন। ইতিমধ্যে মুর্শিদকুলির মৃত্যু হলে তার জামাতা সুজাউদ্দিন বাংলার সুবেদার হন। জগৎ শেঠ ফতেচাঁদ তার প্রধান পরামর্শদাতাদের অন্যতম হয়ে ওঠেন। ফতেচাঁদের সহায়তাতেই সুজাউদ্দিন দেড় কোটি টাকা রাজস্ব হিসেবে দিল্লিতে পাঠাতে পেরেছিলেন। বোঝাই যাচ্ছে, জগৎ শেঠ এর মধ্যেই কী পরিমাণ আর্থিক সম্পদের মালিক হয়ে উঠেছিলেন।

মৃত্যুর আগে সুজাউদ্দিন তার ছেলে সরফরাজ খানকে জগৎ শেঠের পরামর্শ মেনে চলার উপদেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু ভোগবিলাসে আসক্ত সরফরাজ তা মানেননি। উলটে জগৎ শেঠ ও অন্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের তিনি জনসমক্ষে অপমান করতে শুরু করেন। অপমানিতদের মধ্যে আজিমাবাদের শাসনকর্তা আলিবর্দি খানও ছিলেন। আলিবর্দি তার ভাই হাজি আহমদ ও জগৎ শেঠের সাথে ষড়যন্ত্র করে সরফরাজকে সিংহাসনচ্যুত করেন।

১৭৪৪ সালে ফতেচাঁদ মারা যান। তার তিন ছেলে আনন্দচাঁদ, দয়াচাঁদ ও মহাচাঁদ। আনন্দচাঁদ ও দয়াচাঁদ অল্প বয়সেই মারা গিয়েছিলেন। ফলে বিপুল ধন-সম্পত্তির উত্তরাধিকার এসে পড়ে পৌত্র মাহতাবচাঁদ ও স্বরূপচাঁদের ওপর। দিল্লির বাদশাহের কাছ থেকে মাহতাব ‘জগৎ শেঠ’ উপাধি লাভ করেন। স্বরূপচাঁদ লাভ করেন ‘মহারাজ’ উপাধি।

এই সময়েই জগৎ শেঠদের আর্থিক প্রতিপত্তি বিশেষ পর্যায়ে ওঠে। তাদের গদিতে সর্বদাই ১০ কোটি টাকার কারবার চলত, উল্লেখ করেছেন ‘মুর্শিদাবাদ কাহিনী’-র লেখক নিখিলনাথ রায়। শুধু নবাব নন, তাদের খাতক ছিলেন বড় বড় জমিদার, মহাজন ও অন্য ব্যবসায়ীরাও।

ক্রমে ইংরেজ ও ফরসি বণিকরাও জগৎ শেঠের কাছ থেকে টাকা ধার নিতে শুরু করেন। জগৎ শেঠের নিয়মিত আনাগোনা শুরু হয় কলকাতা ও চন্দননগরে। ইংরেজ ও ফরাসি বণিকদের বিলাসবহুল জীবন যাপনের জন্য অনেক ধার দিতেন মহতাবচাঁদ। বলাই বাহুল্য, সেটা ঘটত চড়া সুদের বিনিময়ে।

আলিবর্দি খান নবাব হওয়ার পর বাংলায় মারাঠি বর্গীদের আক্রমণ ঘটে। নিরন্তর যুদ্ধ চালাতে হয় নবাবকে। এই যুদ্ধের খরচও অনেকাংশে ঋণ হিসেবে দিয়েছিলেন জগৎ শেঠ মহাতাব। বর্গীদের আক্রমণ আলিবর্দি সাফল্যের সঙ্গেই রুখতে পেরেছিলেন। তবে এর পিছনে যে জগৎ শেঠের একটা বড় ভূমিকা রয়েছে, তা সুবে বাংলায় কারো জানতে বাকি ছিল না। এই সময় বাংলার অভ্যন্তরীণ বাজারেরও নিয়ন্তা হয়ে ওঠেন জগৎ শেঠ।

জগৎ শেঠ এই সময় থেকে বাংলার অনেক জমিদারকে তার খাতকে পরিণত করেন। বাংলার নবাবের রাজস্ব নীতি ছিল ভয়ানক কড়া। রাজস্ব অনাদায়ে আলিবর্দী জমিদারদের কঠোর শাস্তি দিয়েছেন, এমন নজিরও প্রচুর। এই কারণে দ্রুত টাকা জোগাড় করতে জমিদাররা জগৎ শেঠের দ্বারস্থ হতে শুরু করেন। জগৎ শেঠও তার চড়া সুদের বিনিময়ে ঋণ দেন। অনেক সময়ে তাদের জামিনদার হয়ে নবাবের সাথে বিবাদের মীমাংসা করেন।

এই সময়েই জগৎ শেঠ পরিবারের বৈভব বাড়তে থাকে। কিন্তু আলিবর্দির পর যখন সিরাজউদ্দৌলা নবাব হন, তখন জগৎ শেঠদের ভাগ্যের চাকা অন্য দিকে ঘুরতে শুরু করেছে। মোহনলালকে দেওয়ান হিসবে নিয়োগ করেন সিরাজ। মোহনলালের সাথে জগৎ শেঠের সম্পর্ক ভালো ছিল না। ও দিকে ইংরেজদের হয়ে সাফাই গাইতে গিয়ে জগৎ শেঠ সিরাজের কাছে অপমানিত হন। সিরাজ নাকি জনসমক্ষে তাকে একটি চড় মারেন।

আহত বাঘ জগৎ শেঠ এ বার লিপ্ত হন সিরাজ-বিরোধী ষড়যন্ত্রে। লর্ড ক্লাইভের সাথে সেই ষড়যন্ত্রে অংশ নেন সিরাজের স্বেচ্ছাচারিতার কারণে বিরক্ত বাংলার বেশ কিছু বিখ্যাত জমিদারও। জানা যায়, মিরজাফর ও ঘসেটি বেগমও জগৎ শেঠের উদ্যোগেই এই ষড়যন্ত্রের অংশীদার হয়ে ওঠেন।

পলাশীর যুদ্ধে সিরাজের পরাজয়ের পরে জগৎ শেঠ ইংরেজদের আসল রূপ বুঝতে পারেন। কিন্তু তত দিনে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। মিরজাফরের পরে বাংলার নবাবি তখতে বসেন মিরকাশিম। স্বাধীনচেতা নবাবের সাথে ইংরেজদের সঙ্ঘাত বাধে। ১৭৬৪-এ বক্সারের যুদ্ধে পরাজিত মিরকাশিম জগৎ শেঠ মহাতাবচাঁদ ও স্বরূপচাঁদকে বন্দি করে মুঙ্গেরে নিয়ে যান এবং পরবর্তী সময়ে তাদের হত্যা করেন।

বাংলার এই ব্যাংকার পরিবারকে ঘিরে অনেক কিংবদন্তি, অনেক রহস্য। বহু আলোছায়া ঘিরে রয়েছে মুর্শিদাবাদে অবস্থিত জগৎ শেঠদের প্রাসাদকে ঘিরেও। পল্লবিত রয়েছে গুপ্তধন সংক্রান্ত নানা কাহিনিও। আজ এই প্রাসাদ একটি সংগ্রহশালা।

জগৎ শেঠের প্রাসাদে রয়েছে এমন কিছু জিনিস যা তাদের বৈভবের সাক্ষ্য বহন করে। বহুমূল্য আসবাব, অস্ত্রশস্ত্র ইত্যাদি ছড়িয়ে রয়েছে সারা বাড়িতেই। কিন্তু সেই সঙ্গে রয়েছে কিছু রহস্যও। প্রাসাদে ঢকার মুখেই রয়েছে এক গোপন সুড়ঙ্গের প্রবেশমুখ। যে সুড়ঙ্গটি কাঠগোলা বাগানের সঙ্গে যুক্ত। মনে রাখা দরকার, জগৎ শেঠরা ছিলেন জৈন ধর্মাবলম্বী। আর কাঠগোলা বাগান আসলে জিয়াগঞ্জের ধনী ব্যবসায়ী জৈন ধর্মাবলম্বী দুগার পরিবারের প্রাসাদ।

জগৎ শেঠের প্রাসাদে রয়েছে ভূগর্ভস্থ কক্ষ। মাটির নিচের এই ঘরগুলিতেই নাকি সঞ্চিত থাকত জগৎ শেঠ পরিবারের টাকা-পয়সা, সোনা-দানা।

বিশ শতকের গোড়ার দিক পর্যন্ত এই পরিবারের উপাধি হিসেবে ‘জগৎ শেঠ’ ব্যবহৃত হয়েছে। ১৯ শতকে লর্ড বেন্টিঙ্কের সময়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তৎকালীন জগৎ শেঠ ইন্দ্রচাঁদকে বছরে ১২০০ পাউন্ড পেনশন দিত বলে জানা যায়। সে কালের হিসেবে অঙ্কটা খুব কম নয়।

ঠিক কী পরিমাণ সম্পদের অধিকারী ছিল এই পরিবার, তা আজ আর জানা যায় না। জগৎ শেঠের প্রাসাদে রাখা জিনিসপত্র এবং সেই প্রাসাদ ও বাগানের সৌন্দর্য থেকে খানিক আন্দাজ পাওয়া যায় মাত্র। কোথায় গেল সেই বিপুল সম্পদ? উত্তর মেলে না।

জগৎ শেঠ প্রাসাদে রাখা রয়েছে কৌতূহল জাগানো বেশ কিছু জিনিস। তার মধ্যে রয়েছে লর্ড ক্লাইভের পোশাক। রয়েছে বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য এক অতি উচ্চমানের মসলিন কাপড়ও। কিন্তু এর কোনোটিই জগৎ শেঠের কিংবদন্তিতুল্য বৈভবের সাক্ষ্য হিসেবে যথেষ্ট নয়।

এই প্রাসাদের অন্যতম রহস্যময় বস্তুটি হলো একটি আয়না। কেউ যদি এই আয়নার সামনে দাঁড়ান, তিনি নিজের মুখ দেখতে পান না। দেহের অন্যান্য অংশ দেখা গেলেও খুব আশ্চর্যজনকভাবে এই মুখ দেখতে না পারার ব্যাপারটা আসলে আয়না নির্মাতাদের কৃৎকৌশল। কিন্তু জগৎ শেঠ পরিবারের ইতিহাসের দিকে তাকালে এই আয়নাকে বড় বেশি প্রতীকী বলে মনে হয়। বাংলার ইতিহাসের অন্যতম প্রধান কলঙ্কের সাথে জড়িত জগৎ শেঠের আয়না যেন লুকিয়ে ফেলতে চায় অনেক কিছু। আয়নার ‘পিছনে’ কী রয়েছে যেমন জানা যায় না, তেমনই আয়নার সামনে দাঁড়ানো মানুষও আত্মপরিচয় হারিয়ে ফেলেন। হারিয়ে যায় বাংলার ইতিহাসের এক অকথিত অধ্যায়।

সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us