যেভাবে নওয়াব হয়েছিলেন ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী
নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী - ছবি সংগৃহীত
ফয়জুন্নেসা ছিলেন বাংলার প্রথম ও একমাত্র নওয়াব (নবাব)। তৎকালীন বাংলায় আরো কয়েকজন নারী জমিদার হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও নওয়াব উপাধি পাওয়া একমাত্র জমিদার ছিলেন নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী।
নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী নারী শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও জনহিতকর কাজের জন্য ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছেন। এর বাইরে তিনি সাহিত্যচর্চা করতেন। মুসলমান নারীদের লেখা প্রথম বাংলা সাহিত্যকর্ম ‘রূপজালাল’-এর লেখক ছিলেন তিনি। বাংলাদেশ সরকার ২০০৪ সালে নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানীকে মরনোত্তর একুশে পদক প্রদান করে।
বিভিন্ন গবেষণা ও বইপত্র থেকে জানা যায়, তিনি দৃঢ়চেতা নারী ও প্রজা হিতৈষী শাসক ছিলেন। তিনি শাসক হিসেবেও দক্ষ ছিলেন। তার সময়ে স্থানীয়ভাবে কোনো দাঙ্গা বা লোকসানের খবর খবর পাওয়া যায়নি।
নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী ১৮৩৪ সালে কুমিল্লার হোমনাবাদ পরগনার (বর্তমান লাকসাম উপজেলা) পশ্চিমগাঁওয়ে জন্মগ্রহন করেন। তিনি শিক্ষিত ছিলেন এবং বাংলা, আরবি, ফার্সি, সংস্কৃতসহ কয়েকটি ভাষায় লিখতে, পড়তে ও বলতে পারতেন।
নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানীর জমিদারির দায়িত্ব গ্রহনের সময় নিয়ে ভিন্নমত পাওয়া যায়। বাংলাপিডিয়া অনুযায়ী ১৮৮৩ সালে তিনি জমিদারি শুরু করেন। আবার গবেষকদের কেউ কেউ মনে করেন ১৮৭০ সালের পর থেকেই ফয়জুন্নেসা জমিদারি দেখাশোনার কাজটি শুরু করেন।
ফয়জুন্নেসা চৌধুরানীর নবাব উপাধি পাওয়ার পিছনে একটি গল্প রয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক আরিফা সুলতানা বিবিসিকে বলেন, ১৮৮৯ সালে রানী ভিক্টেরিয়া তাকে নওয়াব উপধি প্রদান করেন, কিন্তু তার আগে দুবার ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী তাকে দেওয়া ব্রিটিশ সরকারের ‘বেগম’ উপাধি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
বাংলাপিডিয়ায় বলা হয়েছে, ‘‘ফয়জুন্নেসার জনহিতৈষণার পুরস্কারস্বরূপ মহারানী ভিক্টোরিয়া ১৮৮৯ সালে তাঁকে ‘নবাব’ উপধিতে ভূষিত করেন। তিনিই বাংলার প্রথম মহিলা যিনি এই উপাধি লাভ করেন।’’
রওশন আরা বেগমের লেখা ‘নবাব ফয়জুন্নেসা ও পূর্ববঙ্গের মুসলিম সমাজ’ বইয়ে বলা হয়েছে, ওই সময় ত্রিপুরার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন মি. ডগলাস। স্থানীয় উন্নয়নে সরকারি অর্থ আসতে দেরি হওয়ায় তিনি স্থানীয় ১০জন জমিদারের কাছে ঋণ হিসাবে ১০ হাজার টাকা করে এক লাখ টাকা চেয়েছিলেন। কিন্তু স্বল্প সুদে কেউই যখন তাকে ঋণ ঋণ দেয়নি, সেসময় ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী মি. ডগলাসকে এক লাখ টাকা প্রদান করেন। তিনি জানিয়ে দিয়েছিরেন, এই অর্থ ফেরত দিতে হবে না। বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত ‘নবাব ফয়জুন্নেসা ও পূর্ববঙ্গের মুসলিম সমাজ’ বইটিতে বলা হয়েছে, ফয়জুন্নেসার এই অবদানের কথা ম্যাজিস্ট্রেট রানি ভিক্টেরিয়াকে লেখেন। এরপর জনহিতৈষী কাজের জন্য রানি ভিক্টোরিয়া ফয়জুন্নেসাকে ‘বেগম’ উপধি দেন।
কিন্তু ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী দুবার সেই উপাধি প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি ব্রিটিশ সরকারকে জানিয়েছিলেন, ‘তার প্রজাদের কাছে এমনিতেই তিনি বেগম হিসেবে পরিচিত, সুতরাং নতুন করে ওই উপাধির প্রয়োজন নেই।’
এরপর রানী (কোন বানানটি ঠিক?) ভিক্টোরিয়ার মনোনীত এক প্রতিনিধিদল এসে অনুসন্ধান করে রিপোর্ট পাঠায় ইংল্যান্ডে। তার ওপর ভিত্তি করে ১৮৮৯ সালে রানি ভিক্টোয়িা ফয়জুন্নেসাকে ‘নওয়াব’ উপাধি দেন। সরকারিভাবে এক আড়ম্বরপূর্ণ এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই উপাধি প্রদান করা হয়েছিল। অভিষেক অনুষ্ঠানে তাকে হীরকখচিত পদক, রেশমি চাদর ও সার্টিফিকেট দেয়া হয়েছিল।
বাংলাপিডিয়া থেকে জানা যায়, ১৮৭৩ সালে নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী নারীশিক্ষা প্রসারে কুমিল্লায় একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাফন করেন। এটি উপমহাদেশে বেসরকারিভাবে মেয়েদের জন্য প্রতিষ্ঠিত প্রাচীনতম স্কুলগুলোর অন্যতম। স্কুলটি বেগম রোকেয়ার জন্মের প্রায় সাত বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয়। পরর্তিতে স্কুলটি কলেজে রূপান্তরিত হয়। হোমনাবাদ এবং লাকসামের বিভিন্ন এলাকায় তিনি স্কুল ও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তার জমিদারির অন্তর্ভুক্ত ছিল ১৪টি মৌজা, তার প্রত্যেকটিতে একটি করে মোট ১৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী।
'নবাব ফয়জুন্নেসা ও পূর্ববঙ্গের মুসলিম সমাজ' বইয়ে বলা হয়েছে, নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী মেয়েদের পড়াশোনায় সহায়তা করার জন্য স্থানীয়ভাবে হোস্টেলের ব্যবস্থা করেছিলেন, যার খরচ বহন করা হতো তার জমিদারির আয় থেকে। এছাড়া পড়াশোনায় উৎসাহ দিতে মেয়েদের জন্য মাসিক বৃত্তি দেয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি।
নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী ১৮৯৩ সালে স্থানীয় পর্দানশীন, বিশেষত দরিদ্র মহিলাদের চিকিৎসার জন্য তিনি নিজ গ্রামে একটি দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন করেন। তিনি 'ফয়জুন্নেসা জেনানা হাসপাতাল' নামে একটি চিকিৎসালয়ও স্থাপন করেন। একই বছর নওয়াব বাড়ির কাছেই তিনি মেয়েদের জন্য একটি স্বতন্ত্র হাসপাতাল নির্মাণ করেছিলেন তিনি।
১৯০৩ সালে মারা যাওয়ার আগে নিজের জমিদারির বড় অংশটি ওয়াকফ্ করে দিয়ে যান নওয়াব ফয়জুন্নেসা, যা থেকে কুমিল্লার লাকসামের দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীরা আজও বৃত্তি পায়।
এছাড়া এলাকার রাস্তাঘাট নির্মাণ, দিঘি-জলাশয় খননসহ নানা ধরণের জনহিতকর কাজে তিনি অবদান রেখেছেন। এলাকায় মসজিদ, মাদরাসা ইত্যাদি নির্মাণেও তিনি প্রচুর অর্থ ব্যয় করেন।
১৯০৩ সালে ৬৯ বছর বয়সে তিনি কুমিল্লার লাকসামে মৃত্যুবরণ করেন।
সূত্র : বিবিসি