ভারতের সামরিক হেলিকপ্টার বারবার কেন বিধ্স্ত হয়
ভারতের সামরিক হেলিকপ্টার বারবার কেন বিধ্স্ত হয় - ছবি সংগৃহীত
ভারতের প্রতিরক্ষাপ্রধান বিপিন রাওয়াত ও তার স্ত্রীকে বহনকারী একটি সামরিক হেলিকপ্টার বিধস্ত হয়েছে দেশটির তামিলনাড়ু রাজ্যের বনে।
রাশিয়ায় তৈরি এই এমআই-১৭-ভি-৫ সেনা কপ্টার এমআই-৮-এর উন্নততর সংস্করণ। এই কপ্টারের বিশেষত্ব হলো এর ইঞ্জিন অনেক বেশি শক্তিশালী। অধিক ভার বহনে সক্ষম। রাতের অন্ধকারে অনায়াস গতিবিধি এবং উন্নততর নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য সুনাম রয়েছে এই কপ্টারের।
রাওয়াতকে নিয়ে এই বিমান উড়েছিল দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় ওয়েলিংটনের ডিফেন্স স্টাফ কলেজের পরিদর্শনে যাওয়ার জন্য। এমআই-১৭-ভি-৫-এর বৈশিষ্ট্য বলছে, এই বিমান একমাত্র অতি উচ্চতায় উড়তে অসুবিধায় পড়ে। তা ছাড়া যেকোনো ধরনের ভৌগোলিক এলাকায় এর সহজ যাতায়াত। রাওয়াতের কপ্টার যেখানে ভেঙে পড়ে তার উচ্চতা অবশ্য এমন কিছু বেশি ছিল না বলেই জানা গেছে।
রাওয়াতের কপ্টারে মোট ১৪ জন আরোহী ছিলেন। সাধারণ কপ্টারের হিসেবে সংখ্যাটা বেশি। তবে ‘ভি ৫’ সর্বাধিক ২৪ জন আরোহীকে বহন করতে পারে। এর ওজন বহন করার মোট ক্ষমতা সাত হাজার কেজি। এর মধ্যে ভিতরে চার হাজার কেজি। বাইরে ঝুলিয়ে নিতে পারে আরো তিন হাজার কেজি।
এই ধরনের কপ্টারে ক্রু সদস্য থাকেন তিনজন। পাইলট, কো-পাইলট এবং ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার। এ ছাড়া অতিরিক্ত নিরাপত্তার কথা ভেবে অটো পাইলট সিস্টেমের ব্যবস্থাও থাকে ‘ভি-৫’-এ। যদিও কী ধরনের প্রযুক্তিগত গোলযোগে রাওয়াতের কপ্টার ভেঙে পড়েছে বা অটো পাইলট সিস্টেম কাজ করেনি কেন, সে সব প্রশ্নের উত্তর এখনো অজানা।
২০১৩ সাল থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে রয়েছে এই রুশ কপ্টার। তবে তারও অনেক আগে থেকে ভি-৫ এর পূর্বতন সংস্করণ এমআই-৮ ভারতীয় বায়ুসেনাবাহিনীর কমব্যাট ফোর্সের ভরসা। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তৈরি হওয়া সামরিক কপ্টার এমআই-৮। তারই আধুনিক রূপ এমআই ১৭। মাওবাদী দমন অভিযান অপরেশন গ্রিন হান্টে ২০০৯ সালে এই কপ্টারই ব্যবহার করা হয়েছিল।
বহুমুখী কাজে সক্ষম এই কপ্টারকে প্রয়োজনে সশস্ত্রও বানানো যেতে পারে। ভি৫ এর বাইরে দেড় হাজার কেজি ওজনের অস্ত্র লাগানো যেতে পারে। এমনকি ট্যাঙ্ক ধ্বংসকারী আকাশ থেকে আকাশে ছোড়ার ক্ষেপণাস্ত্রও বহন করতে পারে এই কপ্টার। এ ছাড়া এমআই১৭ ভি৫ কপ্টারে থাকে সাটার্ন ভি ক্ষেপণাস্ত্র, এস৮ রকেট, ২৩ এম এম মেশিনগান, পিকেটি মেশিন গান, একেএম সাব মেশিনগান।
যুদ্ধের ভারী অস্ত্র বহন করার পাশাপাশি সেনার জন্য গাড়িও উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে। ভারতীয় সেনা তাই বারবার ভরসা করেছে এমআই ১৭-ভি-৫ এর উপর।
২০০৮ সালে রাশিয়ার কাজান হেলিকপ্টার সংস্থা এই কপ্টার তৈরির বরাত পায়। ২০১১ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে ভারতে মোট ৩৬টি কপ্টার সরবরাহ করে এই রুশ সংস্থা। ২০১৩ সালে অপারেশন গ্রিন হান্টে কাজ লাগানো হয় ভি৫।
এর ককপিটটি সম্পূর্ণ কাচের তৈরি। রাতের দৃশ্যমানতার জন্য রয়েছে বিশেষ নাইট ভিশন প্রযুক্তি। এ ছাড়া আবহাওয়ার আগাম খবর পাওয়ার জন্য অনবোর্ড র্যাডার, বিশেষ অ্যাভিয়নিক স্যুট, এমনকি আগাম বিপদ সঙ্কেত পাঠানোর কিউয়িং সিস্টেমও রয়েছে এতে।
মূলত পরিবহণ কপ্টার হিসেবে পরিচিত ভি৫ এ বজ্র আঁটুনি রয়েছে নিরাপত্তাতেও। এই কপ্টারের পুরোটাই বর্মে মোড়া। এমনকি এর জ্বালানি ট্যাঙ্কের চারপাশেও রয়েছে সুরক্ষা আবরণী। পলিউরিথেন ফোমে ভরা ওই বহির্সুরক্ষা আবরণী জ্বালানি ট্যাঙ্ককে বিস্ফোরণের হাত থেকে বাঁচায়।
যদিও এই সব আগাম ব্যবস্থা সত্ত্বেও কোনো যান্ত্রিক গোলযোগে দুর্ঘটনাগ্রস্ত হল সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়কের কপ্টার সেটাই আপাতত রহস্য।
বারবার দুর্ঘটনার কবলে পড়েছেহেলিকপ্টার
মর্মান্তিক। তামিলনাড়ুর কুন্নুরে ভেঙে পড়ল সেনার এমআই–১৭ হেলিকপ্টার। মৃত একাধিক। মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। ওই হেলিকপ্টারেই ছিলেন সেনার সর্বাধিনায়ক বিপিন রাওয়াত। অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
এটা ঘটনা, এমআই–১৭ হেলিকপ্টার বারবার দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে। যা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। যার মধ্যে অন্যতম ২০১০ সালে অরুণাচল প্রদেশের দুর্ঘটনা। সেবারও এমআই–১৭ কপ্টার ভেঙে পড়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন চপারে থাকা ১২ জন। জেনে নিন আরও কিছু এরকম দুর্ঘটনার কথা।
৩০ নভেম্বর, ২০২১ : আজারবাইজানের খিজি জেলায় ঘটেছিল দুর্ঘটনা। মারা যান সেদেশের সীমান্ত সেনার ১২ জন কর্মী। আহত হন ২ জন।
২৫ আগস্ট, ২০২১ : মেক্সিকোর নৌবাহিনীর কপ্টার ভেঙে পড়ায় গুরুতর আহত হন ৪ জন।
২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ : জম্মু–কাশ্মীরের বাদগামে ভেঙে পড়েছিল এমআই–১৭ হেলিকপ্টার। কপ্টারে থাকা ৬ জনের পাশাপাশি এক সাধারণ নাগরিকও মারা যান।
৬ অক্টোবর, ২০১৭ : ভারতীয় বায়ুসেনার এমআই–১৭ ভি৫ হেলিকপ্টার ভেঙে পড়ে অরুণাচল প্রদেশে। মারা যান ৭ জন।
২৫ জুন, ২০১৩ : উত্তরাখণ্ডের বন্যাবিধ্বস্ত এলাকায় উদ্ধারকাজ চালানোর সময় বায়ুসেনার একটি এমআই–১৭ ভি৫ কপ্টার ভেঙে পড়েছিল। চপারে থাকা ২০ জনের খোঁজ পাওয়া যায়নি।
১১ জুলাই, ২০১২ : গিলগিট–বালটিস্তানে ভেঙে পড়ে পাক সেনার একটি কপ্টার। মারা যান ৫ জন।
৩০ আগস্ট, ২০১২ : গুজরাটের জামনগরে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয় দু’টি এমআই–১৭ হেলিকপ্টারের। মার যান ৯ জন।
১৯ নভেম্বর, ২০১০ : অরুণাচল প্রদেশের তাওয়াংয়ের কাছে ভেঙে পড়ে বায়ুসেনার এমআই–১৭ হেলিকপ্টার। মারা যান ১২ জন।
সূত্র : আনন্দবাজার ও আজকাল