ওমিক্রন করোনা : যেভাবে রক্ষা পাওয়া সম্ভব
ওমিক্রন করোনা : যেভাবে রক্ষা পাওয়া সম্ভব - ছবি সংগৃহীত
বিশ্বজুড়ে এখন সাউথ আফ্রিকায় পাওয়া ই.১.১.৫২৯ নামক করোনাভীতি শুরু হয়েছে। গত সপ্তাহে ২৬ নভেম্বর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই করোনার নাম দিয়েছে ওমিক্রন। ওমিক্রন ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনে ৩০টির অধিক জিনগত পরিবর্তন পরিলক্ষিত হওয়ায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ওমিক্রন করোনাকে Variant of Concern হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। অর্থাৎ, আলফা, বেটা, গামা, ডেল্টার পর এবার যুক্ত হলো পঞ্চম Variant of Concern -ওমিক্রন।
একটি বিষয় জেনে রাখা প্রয়োজন যে, ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টে অনেক নতুন জিনগত পরিবর্তন দেখা গেলেও কিছু কিছু জিনগত পরিবর্তন ডেল্টা ও আলফা ভ্যারিয়েন্টেও দেখা গিয়েছিল। ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টে প্রথমবার একসাথে এতগুলো জিনগত পরিবর্তন দেখা গেল।
যদিও এতগুলো জিনগত পরিবর্তন থাকা মানেই এই নয় যে, এটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে অথবা ভয়ঙ্কর ক্ষতির কারণ হবে, তবুও কিছু বিষয় বিজ্ঞানীদের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রথমত, দক্ষিণ আফ্রিকায় ওমিক্রন ধরা পড়ার এক সপ্তাহের মধ্যে সেখানে করোনা আক্রান্তের হার প্রায় পাঁচগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, যার মধ্যে ৮০ শতাংশ মানুষ গোউটেং প্রদেশে বসবাস করে। যেহেতু গোউটেং প্রদেশেই প্রথম ওমিক্রন ধরা পরে, তাই ধারণা করা হচ্ছে, এর সংক্রমণ ক্ষমতা অনেক বেশি। উপরন্তু, ওমিক্রন ধরা পড়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতসহ পৃথিবীর ২০টিরও অধিক দেশে ছড়িয়ে পড়েছে।
ইতোমধ্যেই ইসরাইল ও জাপান বিদেশী ভ্রমণকারীদের জন্য বর্ডার বন্ধ করে দিয়েছে। এ ছাড়া, ইংল্যান্ডসহ ইউরোপের অনেক দেশ দক্ষিণ আফ্রিকা ও তার আশেপাশের দেশ থেকে আসা ভ্রমণকারীদের জন্য বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিন ঘোষণা করেছে।
দ্বিতীয়ত, দক্ষিণ আফ্রিকায় সংক্রমণগুলো হয়েছে মূলত স্কুলগামী শিশু ও অল্পবয়স্কদের মধ্যে। যদিও এখন পর্যন্ত ওমিক্রনের কারণে কোনো মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি তবুও এত অল্প সময়ে ওমিক্রনের ভয়াবহতা সম্পর্কে কিছু বলা সম্ভব নয়। যেহেতু অল্পবয়স্কদের মধ্যে করোনার ভয়াবহতা সাধারণত এতটা তীব্র হয় না তাই বয়স্ক অথবা করোনার ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিদের ওপর নিবিড় পর্যবেক্ষণ করলে ওমিক্রনের ভয়াবহতা সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে বলা যাবে।
তৃতীয়ত, দক্ষিণ আফ্রিকার National Institute for Communicable Disease (NICD)-এর একদল বিজ্ঞানী ওমিক্রনের জিনগত পরিবর্তন পর্যালোচনা করে অনুমাণ করছে যে, এটি ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট থেকে তিন থেকে ছয়গুণ বেশি সংক্রমণ করতে পারে।
চতুর্থত, করোনা আক্রান্ত হওয়ার ৯০ দিনের মাথায় সাধারণত দ্বিতীয়বার করোনা আক্রান্ত হওয়ার প্রমাণ নেই। এর মূল কারণ হচ্ছে, প্রাকৃতিকভাবে করোনা সংক্রমণের ফলে শরীরে যে পরিমাণ এন্টিবডি তৈরি হয় সেই পরিমাণ এন্টিবডি দ্বিতীয়বার করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে পারে। করোনার বেটা অথবা ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের ক্ষেত্রেও এই তত্ত্বটি প্রযোজ্য। কিন্তু গত ২ ডিসেম্বর প্রকাশিত একটি গবেষণায় ওমিক্রন করোনা নিয়ে ভিন্ন চিত্র পরিলক্ষিত হয়। দক্ষিণ আফ্রিকার ঘওঈউ-এর বিজ্ঞানীদের করা ওই গবেষণায় ৩৫ হাজার ৬৭০ জন রোগী যাদের ৯০ দিনের মধ্যে দু’বার করোনা আক্রান্ত হয়েছে বলে সন্দেহ করা হয়েছে তাদের আক্রান্ত ভাইরাসের ভ্যারিয়েন্ট পরীক্ষা করে দেখা যায়, সেগুলো মূলত ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট। ওই গবেষণার ফলাফলটি এটি ইঙ্গিত দেয় যে, কোনো ব্যক্তির শরীরে প্রাকৃতিকভাবে করোনা সংক্রমণের কারণে অথবা ভ্যাকসিনের মাধ্যমে তৈরি হওয়া এন্টিবডিকে ওমিক্রন করোনা ফাঁকি দিয়ে নতুন করে আবার সংক্রমিত করতে পারে।
তাই বিজ্ঞানীরা সাধারণ মানুষের মনে উঁকি দেয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে তা হলো- করোনার ভ্যাকসিনগুলো ওমিক্রন প্রতিরোধে কার্যকরী হবে কি না?
সারা পৃথিবী যেখানে ভ্যাকসিনের কারণে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছিল ঠিক এমন সময় ওমিক্রন হঠাৎ একটু সংশয়ের জন্ম দিলো।
এই সংশয়ের অবশ্য কিছু কারণ আছে। দক্ষিণ আফ্রিকার ২৫ শতাংশ মানুষ করোনা ভ্যাকসিন গ্রহণ করেছে এবং ফাইজার, অ্যাস্ট্রাজেনেকা অথবা জনসন অ্যান্ড জনসনের টিকা নেয়া ব্যক্তিদের মাঝেও ওমিক্রন সংক্রমণ দেখা গেছে। তবুও এখন পর্যন্ত এটি ধারণা করা হচ্ছে যে, এই ভ্যাকসিনগুলো ওমিক্রনের বিরুদ্ধে কিছুটা হলেও কার্যকর হবে। ওই কার্যকারিতা পর্যাপ্ত না হলে করোনার আরেকটি ঢেউ মোকাবেলা করতে হবে।
বাংলাদেশে ১ শতাংশ করোনা রোগীরও ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্স করা হয় না। যেহেতু, ইন্ডিয়াতেও ওমিক্রন পৌঁছে গেছে তাই এখন জিনোম সিকোয়েন্সের সংখ্যা বাড়াতে পারলে ওমিক্রনের প্রাদুর্ভাব বোঝা এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া সহজ হবে।
লেখক : স্টাফ সায়েন্টিস্ট অ্যান্ড ইমিউনোলজিস্ট ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ, যুক্তরাষ্ট্র