যেভাবে শুরু হয়েছিল দ্বিতীয় ইন্তিফাদা : বিবিসির বিশ্লেষণ
উনিশ শতকে আল-আকসা মসজিদ এবং আশপাশের এলাকা - ছবি সংগৃহীত
অ্যারিয়েল শ্যারন ছিলেন ইসরাইলের সবচেয়ে বিতর্কিত এক রাজনীতিক। ২০০০ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি হঠাৎ করে সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি আল আকসা মসজিদ সফরে যাবেন।
জেরুসালেমের পুরনো অংশে অবস্থিত আল-আকসা মসজিদ ইসলামের পবিত্রতম স্থানগুলোর একটি। ফিলিস্তিনিদের কাছে এটি আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
আল-আকসার অবস্থান এমন এক জায়গায়, যার ঠিক পাশেই আবার ইহুদিদের পবিত্রতম এক জায়গা টেম্পল মাউন্টের অবস্থান। এই পুরো কম্পাউন্ডটি মুসলিম, ইহুদি ও খ্রিস্টান- এই তিন ধর্মের মানুষের কাছেই খুব পবিত্র এবং স্পর্শকাতর এক জায়গা।
জেরুসালেম নিয়ে যে শত শত বছরের লড়াই, তার কেন্দ্রে কিন্তু এই ধর্মীয় তীর্থগুলো, কে এগুলো নিয়ন্ত্রণ করবে, সেই প্রশ্ন।
কাজেই, ইসরাইলের বিরোধী দল লিকুদ পার্টির তৎকালীন নেতা শ্যারনের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে মারাত্মক উদ্বেগ তৈরি হলো। সবাই এটিকে খুবই উস্কানিমূলক এক সিদ্ধান্ত বলে বর্ণনা করলেন এবং এটি ফিলিস্তিনিদের মারাত্মকভাবে ক্ষুব্ধ করে তুলল।
এরিয়েল শ্যারন আল-আকসা কম্পাউন্ড সফর করলেন কড়া নিরাপত্তায়। কিন্তু তার এই পদক্ষেপের পর বিক্ষুব্ধ ফিলিস্তিনিরা হাজারে হাজারে রাস্তায় নেমে আসে এবং পুরো ফিলিস্তিনি অঞ্চলজুড়ে ব্যাপক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। এটি ছিল ফিলিস্তিনিদের দ্বিতীয় ইন্তিফাদা।
বলা হয়ে থাকে অ্যারিয়েল শ্যারনের আল-আকসা সফরই আসলে দ্বিতীয় ইন্তিফাদার জন্য দায়ী। তার সফরটি একটি মারাত্মক উস্কানি হিসেবে কাজ করেছে।
একজন ফিলিস্তিনি বিক্ষোভকারী সেদিন বলেছিলেন, 'তিনি হচ্ছেন একজন উস্কানিদাতা। তিনি এবং তার সাথে আর যারা যোগ দিয়েছেন তারা সবাই। তিনি এখানে এসেছেন আমাদের এই এলাকা থেকে নিষিদ্ধ করতে। আল আকসা একটি ইসলামী পবিত্র স্থান। আল আকসা ফিলিস্তিনিদের জায়গা।'
অ্যারিয়েল শ্যারন অবশ্য দাবি করেছিলেন, তিনি সেখানে গিয়েছিলেন শান্তির বার্তা নিয়ে।
তিনি বলেছিলেন, 'ইহুদি জনগণের কাছে খুবই পবিত্র এক স্থানে আমি এসেছি। আমি এসেছি তাদের অনুভূতির কথা জানতে। একথা জানতে, কিভাবে আমরা বর্তমান সমস্যা থেকে সামনে আগাতে পারি। উস্কানি দেয়ার জন্য আমি এখানে আসিনি। উস্কানি যেটা, সেটা অন্যপক্ষ থেকে।'
গোলযোগের আশঙ্কায় সেদিন সকাল থেকেই আল-আকসা মসজিদের চারপাশ ছিল শত শত পুলিশে সয়লাব। পুলিশ কার্যত আল আকসা মসজিদ বন্ধ করে দেয়, এমনকি যারা ফজরের নামাজ পড়তে এসেছিল, তাদেরও মসজিদের ভেতর আটকে রেখেছিল পুলিশ।
খালিদ সিগারি একজন ফিলিস্তিনি ক্যামেরাম্যান, তিনি তখন কাজ করেন রয়টার্স বার্তা সংস্থার সঙ্গে। সেদিন খুব ভোরেই দায়িত্ব পালনের জন্য তিনি চলে যান আল-আকসায়।
'শ্যারন, মসজিদে আসার দু ঘণ্টা আগে থেকে আমি মসজিদের ভবনের ভেতরেই অপেক্ষা করছিলাম। শ্যারনের নিরাপত্তা টিমের সদস্যরা এবং ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনী তখন সব কিছু স্ক্যান করছে, নিরাপত্তা তল্লাশি চালাচ্ছে, শ্যারন যাতে নিরাপদে সেখানে যেতে পারেন তার জন্য সবকিছু ঠিক আছে কিনা দেখছে।'
সারি সারি পুলিশ তখন মসজিদের চারপাশ ঘেরাও করে পাহারা দিচ্ছে। সেখানে যেন কেউ নামাজ পড়তে না পারে, এবং মসজিদ থেকে যেন কেউ বেরুতে না পারে, তারা সেটা দেখছিল।
খালিদ সিগারি পুলিশের সঙ্গে বাদানুবাদের পর মসজিদ থেকে বেরিয়ে আসতে পারলেন। অ্যারিয়েল শ্যারন এবং তার ২০ জন সমর্থক তখন জেরুসালেমের পুরোনো অংশের সরু ঘোরানো রাস্তা ধরে উপরে উঠছেন। তারা ওয়েলিং ওয়াল বা ওয়েস্টার্ন ওয়াল পেরিয়ে এগুতে শুরু করলেন আল-আকসা মসজিদের দিকে।
যালমান শোভাল হচ্ছেন ওয়াশিংটনে ইসরাইলের সাবেক রাষ্ট্রদূত। সেদিন আল-আকসা সফরে তিনি অ্যারিয়েল শ্যারনের সঙ্গী হয়েছিলেন।
'আমরা যখন ওয়েস্টার্ন ওয়ালের কাছে পৌঁছলাম, যেটা আসলে টেম্পল মাউন্ট, তখন সেখানে কয়েকটি প্রার্থনা চলছিল। তারা আমাদের দেখে উল্লাস করছিল, আমাদের করতালি দিয়ে সমর্থন জানাচ্ছিল। অবশ্যই সেখানে কিছুটা উত্তেজনা ছিল, তবে খুব বেশি নয়।'
এর আগের সপ্তাহেই লিকুদ পার্টির এক বৈঠক শেষে আল-আকসা মসজিদে অ্যারিয়েল শ্যারনের এই বিতর্কিত সফরের কথা জানানো হয়েছিল। মিস্টার শোভাল সেই বৈঠকেও ছিলেন। তখনই তিনি মিস্টার শ্যারনের সঙ্গী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
সেদিন লিকুদ পার্টির সভায় নানা গুজব ভেসে বেড়াচ্ছিল। সভার শুরুতে মিস্টার শ্যারন তার আল-আকসা সফর সম্পর্কে কিছুই জানাননি।
যালমান শোভেল জানান, 'হঠাৎ তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, হ্যাঁ, এরকম একটা কাজ আমরা করতে যাচ্ছি। কেউ যদি তার সাথে যোগ দিতে চান, তিনি খুশি হবেন। আমাদের অনেকেই তার সাথে যোগ দিতে চেয়েছি, কিন্তু তিনি কিন্তু বলেননি, আমাদেরকে তার সঙ্গে যেতে হবে। আমরা সবাই স্বেচ্ছায় গিয়েছি।'
অ্যারিয়েল শ্যারনের এই পদক্ষেপ যে ফিলিস্তিনিরা একটা মারাত্মক উস্কানি হিসেবে দেখবে, এটা কি তাদের একবারও মনে হয়নি?
'এটা হয়তো মনে হয়েছিল। কিন্তু আপনাকে মনে রাখতে হবে, এখানে আরেকটা দিক আছে। কিছু আরব, বা বিশেষ করে কিছু মুসলিমের কাছে তো সেখানে ইহুদীদের উপস্থিতিটাই এক বিরাট উস্কানি। কাজেই এখানে একটা যুক্তি ছিল-সেটা হচ্ছে, দেখ আমরা তোমাদের ধর্মীয় আচারে কোন বাধা দিচ্ছি না, মাথা গলাচ্ছি না, তোমরাও আমাদের ধর্মীয় আচার নিয়ে মাথা গলাতে যেও না। তোমরা যা করছো আমরা তার প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধাশীল।
'ইসরাইলি সরকারতো এমনকি টেম্পল মাউন্টে ইহুদিদের দলবদ্ধ সংগঠিত প্রার্থনা পর্যন্ত নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু আমরা যদি সেই জায়গাটা পরিদর্শনে যাই, সেটাতে হস্তক্ষেপ করতে এসো না।
কিন্তু অ্যারিয়েল শ্যারনের এই কাজটি ছিল একটা রাজনৈতিক চাল। ইসরাইলি এবং ফিলিস্তিনিদের মধ্যে যে শান্তি আলোচনা চলছিল, তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের হস্তক্ষেপ সত্ত্বেও সেটা ভেঙ্গে গিয়েছিল।
ইসরাইলি এবং ফিলিস্তিনিদের সম্পর্কে তখন চরম উত্তেজনা।
এরকম এক অগ্নিগর্ভ সময়ে অ্যারিয়েল শ্যারন আল-আকসা কম্পাউন্ডে ঢুকলেন। ফিলিস্তিনি ক্যামেরাম্যান খালিদ সিগারি তখন তার ছবি ধারণ করার জন্য ক্যামেরা কাঁধে ছোটাছুটি করছেন।
'আমি তখন এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়াচ্ছি, দেখতেই পাচ্ছেন আমার ক্যামেরায় তোলা ভিডিওগুলো বেশ কাঁপা হাতে ধারণ করা। আপনি হয়তো কণ্ঠগুলো শুনতে পাচ্ছেন। আমাকে মাঝে মধ্যে তার দেহরক্ষী এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা এসে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছিল।
'ওরা আমাদেরকে মিস্টার শ্যারনের কাছ থেকে দূরে রাখতে চাইছিল। কারণ তারা ভয় পাচ্ছিল মিস্টার শ্যারনের কিছু একটা হতে পারে। কিছু লোক তার কাছাকাছি পর্যন্ত যেতে পেরেছিল। শ্যারনের বিরুদ্ধে তারা শ্লোগান দিচ্ছিল। উনার মুখের ভিডিও ধারণ করা কঠিন হচ্ছিল। কারণ তাকে ঘিরে রাখা হয়েছিল কড়া নিরাপত্তায়। শ্যারনের যে বিখ্যাত ফ্রেমটি, বিখ্যাত ছবিটি আপনারা দেখেন, সেটি তার একটি ক্লোজ আপ, তবে তার মুখ প্রায় আড়াল করে রেখেছে তার দেহরক্ষী,' বলেন খালিদ সিগারি।
শ্যারন এবং তার দলবল সেদিন বেশ সতর্ক ছিলেন যেন তারা খোদ আল-আকসা মসজিদে না ঢোকেন। ইসরাইলি সরকারের সাথে এক বিষয়ে আগেই তাদের একটা সমঝোতা হয়েছিল। তবে যালমান শোভেলের মতে, ফিলিস্তিনিরা প্রতিবাদ শুরু করার পরেই কেবল বিষয়টা তিক্ততার দিকে গড়িয়েছিল।
'প্রথমে, আমাকে বলতেই হচ্ছে, সবকিছু শান্তিপূর্ণভাবেই হচ্ছিল। সেখানে অবশ্যই কিছু আরব ছিল। কিন্তু আমরা আমাদেরকে নিয়েই ছিলাম, ওরা ওদের মতো ছিল। আমার যতদূর মনে পড়ে, এক আরব লোকের সঙ্গে বেশ একটা হাস্যরসাত্মক সাক্ষাতের ঘটনাও সেখানে ঘটেছিল।
'মোটামুটি বয়স্ক এক আরব লোক, একদম সাদা পোশাক পরা, আমার কাছে এসে বলল, তুমি জানো, আমিও কিন্তু ওয়াশিংটনে থাকতাম, সেখানে তোমার সাথে আমার দেখা হয়েছে। তখন আমরা ওয়াশিংটনে আমাদের অভিজ্ঞতার স্মৃতিচারণ করতে শুরু করলাম। কিন্তু সব কিছু নাটকীয়ভাবে পাল্টে গেল যখন ইসরাইলি পার্লামেন্টের একজন আরব সদস্য বিক্ষোভে উস্কানি দিতে লাগলেন। তিনি অনেক ধরনের উস্কানিমূলক বিবৃতি দিচ্ছিলেন। তখন থেকেই আসলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে শুরু করল।'
অ্যারিয়েল শ্যারন সেদিন আল-আকসা ছেড়ে চলে যাওয়ার সাথে সাথেই গোলযোগ শুরু হয়ে গেল। শত শত মানুষ সেখানে বিক্ষোভ করছিল, তারা ইসরাইলি পুলিশের দিকে পাথর ছুঁড়তে শুরু করলো। ইসরাইলি পুলিশ তখন রাবার বুলেট, সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ার গ্যাস ছুঁড়ে বিক্ষোভ দমনের চেষ্টা করছিল। সেদিনের বিক্ষোভ স্তিমিত হয়ে আসলো।
কিন্তু পরের দিন খালিদ সিগারিকে আবার ফিরে আসতে হলো জেরুসালেমের পুরোনো অংশে। এরিয়েল শ্যারনের কাজে বিক্ষুব্ধ শত শত ফিলিস্তিনি শুক্রবারের জুমার নামাজের পর আল আকসা মসজিদ থেকে বেরিয়ে আসছিল।
খালিদ সিগারির স্পষ্ট মনে আছে সেদিনের বিক্ষোভের কথা।
'খুবই মারাত্মক সংঘর্ষ চলছিল। এর আগে আমি কখনো এরকম তীব্র সংঘর্ষ দেখিনি। সবাই, তরুণ, বৃদ্ধ, শিশু- সবাই পাথরের টুকরো হাতে বা যা পাচ্ছে সেটা নিয়ে ইসরাইলি পুলিশের দিকে ছুঁড়ে মারছে।'
এরপর শুধু জেরুসালেম নয়, খুব দ্রুত এই সংঘর্ষ ছড়িয়ে গেল সব ফিলিস্তিনি এলাকায়। পশ্চিম তীর এবং গাজা এলাকাতেও সংঘর্ষ শুরু হলো। প্রচণ্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়লেন ফিলিস্তিনিরা। বিক্ষোভের আগুনে জ্বলছিল পুরো অঞ্চল।
এই সংঘাত পরে ফিলিস্তিনিদের দ্বিতীয় ইন্তিফাদায় রূপ নিল। এই গণবিক্ষোভে প্রথম বছরেই মারা গেল আট শ'র বেশি মানুষ। ইসরাইলি-ফিলিস্তিনি শান্তি প্রক্রিয়া একেবারে ভণ্ডুল হয়ে গেল। কিন্তু এরিয়েল শ্যারনের আল আকসা মসজিদে যাওয়ার কারণেই যে এটা ঘটেছে, তা মানতে নারাজ যালমান শোভাল।
'এই আল-আকসা ইন্তিফাদা ছিল আসলে পূর্ব-পরিকল্পিত একটি ব্যাপার। ক্যাম্প ডেভিডে ইহুদ বারাক, ইয়াসির আরাফাত এবং বিল ক্লিনটনের মধ্যে যে সম্মেলন হয়, সেটি ব্যর্থ হয়েছিল আরাফাত কোনো ছাড় দিতে অস্বীকৃতি জানানোর জন্য। ইন্তিফাদা শুরুর পরিকল্পনা তাদের আগে থেকেই ছিল, সেটি তারা হাতে রেখেছিলেন। কাজেই আল-আকসা নিয়ে বিক্ষোভ শুরুর পর তারা পরে সেটিকেই ইন্তিফাদা বলা শুরু করলেন। অথচ এরকম একটি ইন্তিফাদার ব্যাপারে তারা আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিলেন।'
ইসরাইলে পরের বছরের নির্বাচনে অ্যারিয়েল শ্যারন বিপুল ভোটে জয়ী হলেন। তিনি ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী হলেন। কিন্তু ২০০৬ সালে তিনি এক ম্যাসিভ স্ট্রোকে অচেতন হয়ে গেলেন, ২০১৪ সালে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি কোমাতেই ছিলেন।
জেরুসালেম নগরীর ভবিষ্যৎ এবং আল-আকসার নিয়ন্ত্রণ কার হাতে থাকবে, সেটি এখনো অমীমাংসিত। এই স্পর্শকাতর বিষয়গুলো এখনো ইসরাইলি-ফিলিস্তিনি বিরোধের একেবারে কেন্দ্রে।
সূত্র : বিবিসি