চিটাগাং বাইসন : নতুন সম্ভাবনা
চিটাগাং বাইসন : নতুন সম্ভাবনা - ছবি সংগৃহীত
নাম গয়াল হলেও প্রাণীটি পাহাড়ি গরু বা বন গরু হিসেবে হিসাবে স্থানীয়ভাবে পরিচিত। পার্বত্য চট্টগ্রামের বনাঞ্চলের গহীন অরণ্যের এ প্রাণীটির এখন সমতলভূমিতেও লালন-পালন শুরু হয়েছে। অনেকে বাণিজ্যিকভাবে বা খামার আকারেও এক সময়ের বুনো গরুটি পালন করতে শুরু করেছেন।
পাহাড়ি গ্রামগুলোর বাসিন্দারা অবশ্য বহুদিন আগে থেকেই বন থেকে এই গরু ধরে পালন করতেন। পাহাড়িদের কাছে এই প্রাণীর গোস্তের বেশ কদর রয়েছে।
এখন তা ছড়িয়ে পড়েছে বাংলাদেশের সমতল এলাকাতেও। গত কয়েক বছর ধরে কোরবানির সময়ে বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি, চট্টগ্রামের হাটগুলোয় প্রাণীটি দেখা যাচ্ছে।
গয়াল বন্য গরুর একটি প্রজাতি বলে প্রাণীবিদরা বলছেন। চিটাগং বাইসন নামেও এর পরিচিতি রয়েছে। ভারতে একে ডাকা হয় মিথুন নামে। ইংরেজি গাউর নামে যে বনগরুকে বর্ণনা করা হয়,তা থেকে কিছুটা ভিন্ন প্রজাতির গয়াল।
পাহাড়ি বনাঞ্চল, ভারতের উত্তর-পূর্ব এলাকা, মিয়ানমার, চীনের ইয়ুনান প্রদেশে গয়াল দেখা যায়।
ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অফ ন্যাচার (আইইউসিএন) ২০১৫ সালের লাল তালিকা অনুযায়ী, বাংলাদেশের বন থেকে গয়াল বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
তবে বন অধিদফতরের বন সংরক্ষক (বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চল) মোল্যা রেজাউল করিম বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ‘আইইউসিএন বিলুপ্ত বললেও আমি এরপরেও কমপক্ষে দুটা বুনো গয়াল দেখেছি। আমাদের হিসেবে বাংলাদেশের বনে কমপক্ষে ২৫টি বুনো গয়াল রয়েছে।’
তিনি জানান, গয়ালের পরিবেশ ও খাবার নষ্ট, ফাঁদ পেতে অবৈধ শিকারের কারণে বাংলাদেশের বন থেকে এই প্রজাতি বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে।
বুনো প্রাণী থেকে গৃহপালিত গরু
১৯৬৪ সালেও এটি বন্য প্রাণীর তালিকাভুক্ত একটি প্রাণী ছিল। তবে এর আগে থেকেই পাহাড়ি বাসিন্দারা গোস্তের জন্য গয়াল শিকার করতেন। অনেক গ্রামের বাসিন্দারা গয়াল ধরে লালনপালনও করতেন।
গয়াল লবণাক্ত মাটি খেতে পছন্দ করে। এটি ফাঁদ হিসেবে ব্যবহার করে বন থেকে গয়াল ধরা হতো।
১৯৬৪ সাল থেকে গয়ালকে বুনো প্রাণীর তালিকা থেকে সরিয়ে গবাদি পশু হিসেবে গণ্য করা হয়।
প্রাণীবিদ ড. মোঃ হারুন উর রশিদ বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ‘সেই সময় পার্বত্য অঞ্চলে গয়ালের ভালো বিচরণ ছিল। কিন্তু তখন ফাঁদ পেতে গয়াল ধরে চোরাই পথে বিক্রি হতো। এরপর পরিবেশ অধিদফতর এটিতে গৃহপালিত পশু হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু বন থেকে ওই ভাবে গয়াল নিয়ে এসে লালন-পালন করার খুব বেশি প্রচলন ছিল না। পাহাড়ি জেলাগুলোর কিছু গ্রামের বাসিন্দারা নিজেদের জন্য গয়াল পালন করতেন। তবে সমতলে এ প্রাণীটি খুব একটা আসতো না।’
তিনি জানান, সেখানেও এলে গয়ালগুলো বনে-পাহাড়ে ছাড়া থাকে, শুধু এগুলোর গলায় কিছু ঘণ্টা বাঁধা থাকে।
গয়াল ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, পার্বত্য এলাকার গভীরে বিভিন্ন পাড়ার আশেপাশে একেকজন বাসিন্দা পাঁচ থেকে ১০টা করে গয়াল পালন করেন। এগুলো সেখানে মুক্ত অবস্থায় ঘুরে বেড়ায়। তবে কে কোনটার মালিক, তার চিহ্ন দেয়া থাকে। মুক্ত অবস্থায় ঘুরে বেড়ানোর কারণে এগুলোর বুনো স্বভাব থেকে যায়, পুরোপুরি গৃহপালিত হয় না।
বিক্রির উপযোগী হলে লবণের ফাঁদ দিয়ে গয়াল ধরে বিক্রি করা হয়। ব্যবসায়ীরা কয়েকদিন ধরে নানা পাহাড় ডিঙিয়ে জনপদে নিয়ে এসে গয়াল বিক্রি করেন।
খামারে গয়ালের পালন
দুই দশক ধরে কয়েকজন খামারি নিজেদের উদ্যোগে পাহাড়ি গ্রাম থেকে গয়াল নিয়ে এসে পালন করতে শুরু করেন।
এরকম একটি খামারের মালিক চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার এরশাদ মাহমুদ। সুখ বিলাস নামের এই খামারে ১৫ বছর আগে তিনিই প্রথম বাণিজ্যিক আকারে গয়ালের পালন করতে শুরু করেন। তিনটি গয়াল দিয়ে তিনি শুরু করেছিলেন, বর্তমানে তার খামারে শতাধিক গয়াল রয়েছে।
এরশাদ মাহমুদ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, ‘শুনছিলাম গয়াল নাকি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। তাই ২০০৭ সালে পাহাড়ি গ্রাম থেকে তিনটা গয়াল আমার খামারে নিয়ে এসে পালন করতে শুরু করি। এরপর সেগুলোর বাচ্চাকাচ্চা হয়েছে। পরে আরো গয়াল সংগ্রহ করেছি। এখন সবমিলিয়ে এক শ’র বেশি গয়াল আমার খামারে রয়েছে।’
তিনি জানান, তার কাছ থেকে কিনে গিয়ে সারা দেশে কমপক্ষে ২০টি খামারে এখন গয়াল লালনপালন করা হচ্ছে। আট শ’ কেজি ওজনের একেকটি গয়াল ন্যূনতম ছয় লাখ টাকা দামে বিক্রি হয়।
চট্টগ্রাম এলাকায় মূলত ওরস, মেজবানি বা বড় অনুষ্ঠানে গয়াল খাওয়ানো হয়ে থাকে।
‘গয়ালের গোস্তে গরুর মতো অতো চর্বি থাকে না। গোস্তও বেশ সুস্বাদু,’ এরশাদ মাহমুদ জানান।
পাহাড় থেকে আনার পর এসব গয়াল পোষ মানাতে বেশ সময় লাগে। তবে ধীরে ধীরে অন্য পোষা গয়াল ও গরুগুলোর সাথে মিশে সেগুলো শান্ত হয়ে ওঠে।
প্রাণীবিদ ড. মোঃ হারুন উর রশিদ বলছিলেন, ‘আমি যখন প্রথম ২০১৭ সালে একটি খামারে গিয়ে গয়াল দেখি, তখন দূর থেকেই আমাকে দেখে গয়ালগুলো ফোঁসফোঁস শব্দ করতে শুরু করে। তারা যে বন্য, সেটা বুঝতে পারা যাচ্ছিল। কিন্তু গত পাঁচ বছর ধরে বিভিন্ন কাজের সুবাদে এগুলোর কাছাকাছি যাওয়ার ফলে এখন বলা যায় যে, ৮০ শতাংশের বেশি এগুলো গৃহপালিত হয়ে উঠেছে।’
সারা দেশেই গয়ালের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ছে বলে জানান প্রাণীবিদ ড. রশিদ।
‘আমার কাছে এখন অনেক ফোন আসে। দিনাজপুর থেকে, রাজশাহী থেকে, অনেক দূরের জেলা থেকে অনেকে ফোন করেন যে, তারা গয়াল কিনতে চান, লালনপালন করতে চান। ফলে বোঝা যাচ্ছে, গয়ালের প্রতি মানুষজনের আগ্রহ বেশ বাড়ছে।’
এখন কুমিল্লা, ফেনী, ঢাকা, গাজীপুর, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রামে অনেক খামারি ব্যক্তি উদ্যোগে গয়াল পালন করতে শুরু করেছেন।
বন সংরক্ষক মোল্যা রেজাউল করিম বলছেন, ‘আটক অবস্থায় হয়তো এটার (গয়ালের) সংখ্যা বাড়বে। কিন্তু বন্য প্রাণীর বন্যতা মানব সমাজ, সভ্যতা এবং পৃথিবীর ইকো-সিস্টেমের জন্য জরুরি। আটকে রাখা প্রাণী থেকে বাণিজ্যিক সুবিধা হয়তো পাওয়া যাবে, কিন্তু সেই ইকো-সিস্টেমের উপকারিতা পাওয়া যাবে না।’
বন বিভাগের কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন, এখনো বনে যেসব বুনো গয়াল রয়েছে, সেগুলো রক্ষায় সচেতনতা বৃদ্ধির চেষ্টা করছেন তারা।
গরু-মহিষের সাথে গয়ালের পার্থক্য
অনেকটা গরুর মতো দেখতে হলেও সাধারণ সমতলের গরু বা মহিষের সাথে গয়ালের অনেক পার্থক্য রয়েছে। সবচেয়ে বড় পার্থক্য এ প্রাণীটি আকারে অনেক বড় হয়, মাংসের পরিমাণ অনেক হয়। তবে গয়াল থেকে দুধ দোয়ানো যায় না।
ড. মোঃ হারুন উর রশিদ বলছেন, ‘গরুর একটি প্রজাতি বলা যায় গয়ালকে। তবে গরু-মহিষের চেয়ে গয়ালের ওজন অনেক বেশি হয়ে থাকে।’
দেশি গরুর ওজন সাধারণত দুই শ’ থেকে চার শ’ কেজির মধ্যে থাকে, মহিষের ওজন হয় পাঁচ শ’ বা ছয় শ’ কেজি পর্যন্ত। কিন্তু একেকটি গয়ালের ওজন হতে পারে চার শ’ থেকে আট শ’- নয় শ’ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে।
গয়ালের গজ বা কুজের জায়গাটা গয়ালের ক্ষেত্রে অনেক প্রশস্ত হয়।
গঠনের দিক থেকে শিং গোড়া থেকে অনেক মোটা, লম্বা হয়। পিওর ব্রিড গয়ালের পুরো শরীর কালো বা বাদামি হলেও পায়ের নিচের অংশে সাদা দাগ থাকে।
গয়ালের প্রজননে ১০ থেকে ১১ মাস লাগে। একেকটি গয়াল ১৫ থেকে ১৬ বছর বাঁচে। ঘাস, পাতা, খড় ইত্যাদি খেয়ে থাকে।
তবে গয়াল থেকে দুধ পাওয়া যায় না। কারণ সাধারণ গাভীর মতো স্ত্রী গয়ালের ওলান থাকে না। ফলে শুধুমাত্র গোস্তের জন্যই গয়ালের লালন-পালন করা হয়ে থাকে।
সূত্র : বিবিসি