এত অস্ত্র কেন কিনছে মিয়ানমার
এত অস্ত্র কেন কিনছে মিয়ানমার - ছবি সংগৃহীত
মিয়ানমারের সশস্ত্রবাহিনী একসময় ছিল স্বাধীনতার প্রতীক। এখন এই বাহিনীই দেশটির বেসামরিক নাগরিকদের নির্বিচারে হত্যা করছে। ‘গণতন্ত্র হত্যাকারী’ হিসেবে বিশ্বের কাছে চিহ্নিত এই বাহিনী। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় চলতি বছর ২১ মার্চ সশস্ত্রবাহিনী দিবসেও পাঁচ বছরের শিশু ও তিন তরুণসহ ৯০ জন বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করা হয়েছে। বারবার গণতান্ত্রিক অধিকার হত্যার কারণে মিয়ানমার ইউরোপ-আমেরিকার নিধোজ্ঞার আওতায় ছিল দীর্ঘদিন, এখনো আছে। গত কয়েক বছরে মিয়ানমার আধুনিক সমরাস্ত্র আমদানিতে ২.৪ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। এই অস্ত্রগুলোর বেশির ভাগই চীন ও রাশিয়ার তৈরি। অন্য দিকে, মধ্যপ্রাচ্যের ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইলের সাথেও সামরিক সখ্য গড়ে তুলেছে মিয়ানমারের তাতমাদু বা সেনাবাহিনী। মিয়ানমার এশীয় দরিদ্র দেশগুলোর অন্যতম হলেও দেশটি শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের চেয়ে দ্বিগুণ অর্থ ব্যয় করে প্রতিরক্ষা খাতে। এই বাহিনীতে পাঁচ লাখ সদস্য রয়েছে। গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার র্যাংকিং অনুসারে মিয়ানমার বিশ্বের ১৪০টি দেশের মধ্যে ৩৮তম শক্তিশালী দেশ।
কিন্তু এত সমরাস্ত্র কার জন্য? মিয়ামনমারের প্রতিবেশী দেশ থাইল্যান্ড, লাওস, চীন, ভারত ও বাংলাদেশ। আগে থাইল্যান্ডকে লক্ষ করে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী সাজানো হতো। এখন থাইল্যান্ড থেকে এদের নজর সরে এসেছে। থাইল্যান্ডের পাশেই রয়েছে ছোট অথচ অনুন্নত দেশ লাওস। কিন্তু এই দেশটি চীনের খুবই কাছের। চীনকে চটিয়ে মিয়ানমার লাওসে যাবে না। এর বাইরে রয়েছে চীন ও ভারত। এই দুই দেশ থেকে মিয়ানমার অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম কেনে। এদেরকে আক্রমণ করার প্রশ্নই আসে না। অবশিষ্ট রয়েছে বাংলাদেশ। মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের ১৯৩ কিলোমিটার (১২০ মাইল) স্থল ও পানি সীমান্ত রয়েছে। ২০১৬ সালে মিয়ানমার রোহিঙ্গা মুসলমানদের তাড়িয়ে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিয়েছে। রোহিঙ্গাদের ফেরত না নিতে মিয়ানমারের কুচেষ্টার অন্ত নেই। দেশটির অস্ত্রসম্ভার এখন বাংলাদেশকে কেন্দ্র করেই। বঙ্গোপসাগরের নীল পানির প্রতিও লোভ রয়েছে দেশটির। সম্প্রতি মিয়ানমার নৌশক্তি বাড়ানোর পাশাপাশি বিমান শক্তি বাড়ানোরও জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
স্বাধীনতার পর মিয়ানমার দেশটি মাত্র এক যুগ ছিল গণতান্ত্রিক শাসনে। তারপর চলেছে সামরিক উর্দিওয়ালাদের রাজত্ব। অং সান সু চি মাত্র পাঁচ বছর ডিফ্যাক্টো লিডার হিসেবে দেশটি চালালেও সামরিক বাহিনী সু চির বেসামরিক প্রশাসনের চেয়ে বেশি শক্তিশালী ছিল। তার মানে ক্ষমতা এদের হাতেই ছিল। এই সুযোগে নিজেদের দুর্নীতি ঢাকতে অস্ত্রভাণ্ডারে মজুদ করছে আধুনিক মারণাস্ত্র। আর দেশটিকে সহায়তা করছে চীন, রাশিয়া, ইসরাইল ও ভারত। পাকিস্তানের সাথে দেশটির সামরিক সম্পর্ক মজবুত হচ্ছে। পাকিস্তানে তৈরি করা জেএফ-১৭ কিনেছে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী।
বিশ্বের একমাত্র ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইলের সাথে মিয়ারমারের গাঁটছড়া দেশটির স্বাধীনতার পর থেকেই। ১৯৫৮ সালে বর্মী প্রেসিডেন্ট জেনারেল নে উইনের ইসরাইল সফরের পর ইসরাইলি সশস্ত্রবাহিনীর তৎকালীন চিফ অব স্টাফ কুখ্যাত জেনারেল মোশে দায়ান (পরে প্রতিরক্ষামন্ত্রী) এবং তৎকালীন প্রতিরক্ষাবাহিনীর মহাপরিচালক শিমন পেরেজের (পরবর্তী ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী ও ফিলিস্তিনের সাথে ‘দুই রাষ্ট্র ভিত্তিক ফর্মুলা’ বাস্তবায়নে চুক্তি করায় ইয়াসির আরাফাতের সাথে যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী) মিয়ানমার সফরের পরের বছর মিয়ানমারের প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষাবাহিনীর প্রধান হিসেবে নে উইন সরকারি সফরে ইসরাইলে যান। অবশ্য পরে কিছু দিনের জন্য মিয়ানমারের সাথে ইসরাইলের সম্পর্ক কিছুটা শীতল হয়ে যায় নে উইনের নেতৃত্বে সশস্ত্রবাহিনী পুরোপুরি মিয়ানমারের ক্ষমতা নেয়ার পর।
আবার ১৯৮৮ সালে নতুন করে সামরিক শাসনের সময় থেকেই নিষেধাজ্ঞার কবলে থাকা মিয়ানমারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সিঙ্গাপুর, পাকিস্তান, পোল্যান্ড, সাবেক যুগোস্লাভিয়া ও রাশিয়ার সাথে সামরিক সম্পর্ক গড়ে তোলে। এই দেশগুলো গোপনে মিয়ানমারকে অস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত রেখেছে। ১৯৮৮ সালে সেনাবাহিনী আবারো ক্ষমতা নেয়ার পর সিঙ্গাপুর থেকে প্রথম জাহাজভর্তি অস্ত্র আসে সেদেশে। ১৯৮৯ সালে ইসরাইল ও বেলজিয়াম থেকে জাহাজভর্তি অ্যামুনিশান আসে। ৫৭ মিলিমিটার অ্যান্টি ট্যাংক গানসহ ৪০ মিমি আরপিজি-২ গ্রেনেড লঞ্চার দিয়েছে ইসরাইল। এ ছাড়া আরো কিছু রিপোর্টে বলা হয়েছে, ইসরাইল মিয়ানমারের বাহিনীকে অস্ত্র দেয়া তো অব্যাহত রেখেছেই, সেই সাথে অস্ত্র তৈরির টেকনোলজিও দিয়েছে।
১৯৯১ সালে ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর একটি টিম আবারো মিয়ানমার সফরের পর থেকেই দেশটি ইসরাইলের নতুন নতুন অস্ত্র পেয়ে আসছে। এমনকি ইসরাইলি অস্ত্রের প্রযুক্তি হস্তান্তরের ফলে মিয়ানমার এখন ৫.৫৬ মিমি ইনফ্যান্ট্রি উইপনস, অ্যাসল্ট রাইফেলস, লাইট মেশিনগান এবং ৫.৫৬ মিঃমিটারের অ্যাসল্ট রাইফেল উৎপাদন করছে নিজেদের কারখানায়। মিয়ানমার শুধু যে, ইসরাইলি অস্ত্র পাচ্ছে তা নয়, ইহুদিদের কুখ্যাত গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের ট্রেনিং, প্রযুক্তিগত সুবিধাও পাচ্ছে। ইতোমধ্যে মিয়ানমারের গোয়েন্দা সংস্থা এমন কিছু অপারেশন পরিচালনা করেছে যেখানে ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থার ছাপ রয়েছে বলে বিভিন্ন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। আড়িপাতার বিশেষায়িত যন্ত্র ও গোয়েন্দা কোড উদ্ধার করার বিশেষ যন্ত্র ইসরাইল মিয়ানমারের গোয়েন্দা সংস্থাকে সরবরাহ করেছে বলে আন্তর্জাতিক সংবাদও হয়েছে। মিয়ানমারের এলিট কাউন্টার টেররিস্ট স্কোয়াডকে ইসরাইলের সাবেক গোয়েন্দা বিশেষজ্ঞরা বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছেন। মিয়ানমার ও ইসরাইল উভয় দেশই এসব তথ্যকে অস্বীকার করছে। তা সত্ত্বেও নিরপেক্ষ সংবাদ মাধ্যম নিশ্চিত করেই নিউজ করছে এসব বিষয়ে। ১৯৯৭ সালে ইসরাইলের সামরিক অস্ত্র উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এনবিট মিয়ানমারে চীনে তৈরি এফ-৭ ফাইটার্স (রাশিয়ান মিগ ২১-এর চীনা আপগ্রেড ভার্সন), এফটি-৭ ট্রেইনার্স উন্নয়নের কাজ পেয়েছে। ইতোমধ্যে ইসরাইলি বিশেষজ্ঞরা তাদের হাতে থাকা ৩৬টি এফ-৭ ফাইটার্স আপগ্রেড করে দিয়েছে এলটা ইএল/এ-২০৩২ এয়ার টু এরায়ার রাডার দিয়ে; ইনফ্রারেড যন্ত্রপাতি, শর্ট রেঞ্জ এএমএম এবং লাইটেনিং লেজার ডেজিগনেটর পডও দিয়েছে। ইসরাইল এক স্কোয়াড্রন এফ-৭ ফাইটার্স বিমান অপারেশনের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত করে দিয়েছে। এর বাইরেও ইসরাইল মিয়ানমারের কাছে এক জাহাজভর্তি লেজার গাইডেড বোমা বিক্রি করার চুক্তির কথা শোনা যায়। এভাবে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ইসরাইলের কাছ থেকে লাভবান হয়ে আসছে।
ইউরোপিয়ান কমিউনিটির অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ২০১৩ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত মিয়ানমারের ৬৮ শতাংশ অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ ছিল তারাই (ডয়েচে ভেলে)। মিয়ানমার চীন থেকে ৭৫ মিটার লম্বা ও এক হাজার ২০০ টনের তিনটি করভেট তৈরি করে দিয়েছে। ইতালি থেকে ৭৬ মিমিটারের ‘অটো মেলারা কমপ্যাক্ট গান’ আমদানি করেছে থার্ড পার্টির মাধ্যমে। এই তিনটি করভেটে অ্যান্টি সাবমেরিন গান ফিট করেছে ইসরাইলের সহায়তায়। সন্দেহ করা হচ্ছে, এই তিন করভেটে সারফেস টু সারফেস মিসাইলও সংযুক্ত করে থাকতে পারে। এতে আরো থাকবে সারফেস সার্চ রাডার, ফায়ার কন্ট্র্রোল রাডার, নেভিগেশন রাডার ও হুইল মাউন্টেড সোনার। আন্তর্জাতিকভাবে একঘরে দেশ মিয়ানমারের সাথে সামরিক সখ্য ইহুদি রাষ্ট্রটি স্বীকার করতে পারছে না।
মিয়ানমারের আগ্রহ রয়েছে পারমাণবিক, রাসায়নিক ও জীবাণু অস্ত্র সংগ্রহের। দেশটি বিভিন্ন সময় এ ব্যাপারে বিভিন্ন দেশে অনুসন্ধানও করেছে বলে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় খবর বেরিয়েছে। উত্তর কোরিয়ার সাথে মিয়ানমারের ভালো সম্পর্ক রয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে আরেকটি একঘরে দেশ উত্তর কোরিয়া। বলা হয়ে থাকে, উত্তর কোরিয়ার সহায়তায় মিয়ানমার পারমাণবিক শক্তি অর্জনের চেষ্টা করছে। এখানে লক্ষণীয়, মিয়ানমার অস্ত্র কেনার চুক্তিতে সবসময়, ‘প্রযুক্তি হস্তান্তর করতে হবে’ এমন একটি শর্ত জুড়ে দেয়। ব্যালিস্টিক ও অন্যান্য মিসাইল তৈরির সাথে প্রযুক্তি হস্তান্তরের একটা সুবিধা মিয়ানমার পেয়েছে। চীনের পর ইদানীং ভারতের সাথেও মিয়ানমারের খুব ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠছে। চীন, রাশিয়া, ভারত ও ইসরাইল মিয়ানমারকে অনেক আন্তর্জাতিক চাপ থেকে রক্ষা করে থাকে। এই দেশগুলোর সহায়তায় মিয়ানমার রাসায়নিক ও ব্যালিস্টিক অস্ত্র তৈরির পথে রয়েছে বলে সামরিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এ ব্যাপারে রিপোর্টও হয়েছে।
বিভিন্ন সূত্র থেকে যেসব তথ্য পাওয়া যায় তা থেকে জানা গেছে, মিয়ানমার সবচেয়ে বেশি বিমান কিনেছে চীন থেকে ১২০টি, রাশিয়া থেকে ৬৪টি ও পোল্যান্ড থেকে ৩৫টি। রাশিয়ার অত্যাধুনিক এসইউ ৩০ এসএম ছয়টি ফাইটার জেট মিয়ানমার পেয়েছে অথবা পেতে যাচ্ছে। এদের মিগ-২৯ রয়েছে ২০টি। দেশটির কাছে সবচেয়ে বেশি মিসাইল বিক্রি করেছে রাশিয়া। মিয়ানমারের কাছে রাশিয়ান মিসাইলের সংখ্যা দুই হাজার ৯৭১, চীনা মিসাইল এক হাজার ২৯টি ও বেলারুসের ১০২টি। মিয়ানমারের কাছে নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ বিক্রি করেছে চীন ২১টি, ভারত তিনটি ও সাবেক যুগোস্লাভিয়া তিনটি। ভারত মিয়ানমারের বিমানবাহিনীকে আধুনিকায়ন করে দিতেও চেষ্টা করছে। মিয়ানমারের নৌবাহিনীর দিকে নজর আছে ভারতের। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের চীনা গোলাবারুদ, কামানের (আর্টিলারি) ১২৫টি, সার্বিয়ান ১২০টি ও রাশিয়ার ১০০টি। চীনা অস্ত্রবাহী গাড়ি-ট্যাংক ৬৯৬টি, ইসরাইলি ১২০টি ও ইউক্রেনের ৫০টি। ২০১৭ সালে ৭২টি ইসরাইলি থান্ডার আর্মার্ড গাড়ি পেয়েছে মিয়ানমার। আরো আছে হয়তো অনেক কিছু, সাধারণত কোনো দেশেরই সশস্ত্রবাহিনীর সব খবর বাইরে আসে না। মিয়ানমারের ক্ষেত্রেও এটি সত্য।
কথা হলো- মিয়ানমারের এসব রণসজ্জা কার জন্য? আরাকানে রোহিঙ্গাদের বাড়ি-ঘর বুলডোজার দিয়ে গুড়িয়ে দিয়ে সেখানে ২০১৮ সাল থেকে করা হচ্ছে এয়ারবেজ। সীমান্তে বাঙ্কার খোঁড়া হয়েছে, বাড়ানো হয়েছে সেখানকার সেনাবাহিনীর টহল সংখ্যা। এসবই করা হচ্ছে বাংলাদেশকে ভয় দেখানোর জন্য এবং বাংলাদেশকে উদ্দেশ্য করেই।