ডেঙ্গু পুনঃসংক্রমণ কি বেশি মারাত্মক?
ডেঙ্গু পুনঃসংক্রমণ কি বেশি মারাত্মক? - ছবি সংগৃহীত
ডেঙ্গু (Dengue) সংক্রমণের সংখ্যা বৃদ্ধি উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। বহু লোক প্রতি দিন অসুস্থ হয়ে পড়ছে। কাউকে কাউকে হাসপাতালে পর্যন্ত ভর্তি করতে হচ্ছে। স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা সমস্ত প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা মেনে চলার জন্য বারে বারে বলছেন। কিন্তু ডেঙ্গুর ভাইরাসের বিরুদ্ধে কোনো নিরাপদ এবং কার্যকরী টিকা এখনো নেই। তা ছাড়া যেটা আরো খারাপ করে তোলে তা হল ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার পরও একজন ব্যক্তি একাধিকবার ভাইরাসজনিত রোগে আক্রান্ত হতে পারে। ডেঙ্গু ফ্ল্যাভিভিরিডে পরিবারের একটি ভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট হয়।
চারটি ভাইরাস রয়েছে যেগুলো সেরোটাইপস জাতীয়। সেগুলো হলো ডিইএনভি ১ (DEN-1), ডিইএনভি ২ (DEN-2), ডিইএনভি ৩ (DEN-3) এবং ডিইএনভি ৪ (DEN-4)। এই ভাইরাসগুলিই প্রধানত ডেঙ্গুর জন্য দায়ী। ভাইরাসটির একটি সেরোটাইপে সংক্রমণ হলে সেই সেরোটাইপের বিরুদ্ধে রোগী আজীবন প্রতিরোধী ক্ষমতা অর্জন করে। কিন্তু অন্য সেরোটাইপের বিরুদ্ধে সাময়িক প্রতিরোধী ক্ষমতা অর্জন করে। পরে ভিন্ন সেরোটাইপের ডেঙ্গু ভাইরাস সংক্রমিত হলে রোগীর মারাত্মক জটিলতা দেখা দিতে পারে। এর মানে হলো যে ডেঙ্গু ব্যক্তিকে চারবার আক্রান্ত করতে পারে। যদিও একবার একটি স্ট্রেনে সংক্রমিত হলে সাধারণত সেই স্ট্রেনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য অনাক্রম্যতা অর্থাৎ ইমিউনিটি তৈরি হয়। তবুও বাকি তিনটি স্ট্রেইনে সংক্রমিত হওয়া সম্ভব।
ডেঙ্গু জ্বর উদ্বেগ বাড়াচ্ছে কেন?
প্রায় সব অসুস্থতার ক্ষেত্রে জ্বর প্রথম উপসর্গ হতে পারে, যা শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি করে। ডেঙ্গু এবং একটি সাধারণ ভাইরাল সংক্রমণের কারণে জ্বর আসতে পারে। সাম্প্রতিক অতীতে ডেঙ্গুর ঘটনা বেড়েছে এবং প্রাথমিক পর্যায়ে এটি সনাক্ত করা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তাই ডেঙ্গু দ্বারা সৃষ্ট জ্বর এবং ভাইরাল জ্বরের মধ্যে পার্থক্য করতে জানতে হবে। যদিও ভাইরাসজনিত জ্বর বাতাসের মাধ্যমে ছড়ায়, সংক্রমিত ব্যক্তির ড্রপলেটের মাধ্যমে এই আরও ছড়িয়ে পড়ে। ডেঙ্গু জ্বর হল মশার কামড়ের (এডিস ইজিপ্টি) ফলাফল। একটি ভাইরাল জ্বর ৩-৫ দিন স্থায়ী হতে পারে, যেখানে ডেঙ্গু জ্বর ২-৭ দিন স্থায়ী হতে পারে। সময়মতো চিকিৎসা না করা হলে তা বাড়তে পারে। বেশ কিছু ক্ষেত্রে পরিস্থিতি মারাত্মক রূপ ধারণ করে। এই বছর, মশাবাহিত রোগে সংক্রমণের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। স্বাস্থ্য আধিকারিকদের মতে, আর এ সবই হচ্ছে ডেঙ্গু ভাইরাসের নতুন ডি-২ স্ট্রেনের (D2 Strain) কারণে। যা ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি সেরোটাইপের মধ্যে একটি। বাকিগুলো হলো- ডিইএনভি ১ (DENV-1), ডিইএনভি ৩ (DENV-3) ও ডিইএনভি ৪ (DENV-4)। বিশেষজ্ঞরা বিশ্বাস করেন যে নতুন এই ডি-২ স্ট্রেন জ্বর, বমি, জয়েন্টে ব্যথা ও গুরুতর জটিলতার কারণ হতে পারে। যার ফলে ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বর এবং ডেঙ্গু শক সিন্ড্রোম হতে পারে।
সংশ্লিষ্ট উপসর্গ থেকে সাবধানতা
ডেঙ্গু ভাইরাসের শরীরে প্রভাব ফেলতে প্রায় ৪-১০ দিন সময় লাগে। যাই হোক, বিশেষজ্ঞদের মতে, এর পরে যেকোনো নির্দিষ্ট সময়ে উপসর্গ দেখা দিতে পারে। হালকা ডেঙ্গু সংক্রমণ হলে জ্বর, তীব্র মাথাব্যথা, পেশি বা জয়েন্টে ব্যথা, বমি বমি ভাব, গ্রন্থি ফুলে যাওয়া এবং ফুসকুড়ি হতে পারে। যখন সংক্রমণটি গুরুতর আকার নেয়, তখন শ্বাসকষ্ট, ত্বকের উপরিভাগের নিচে রক্ত পড়া, রক্ত জমাট বাঁধা, পেটে ব্যথা, রক্তের প্লেটলেট কমে যাওয়া, জ্ঞান হারানো ইত্যাদি হয়।
কত ঘন ঘন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হতে পারেন একজন ব্যক্তি?
পুনঃসংক্রমণ হলো যখন একজন ব্যক্তি দু'বার বা একাধিকবার অসুস্থতায় আক্রান্ত হন। এটি একাধিকবার সংক্রামক ভাইরাসে সৃষ্ট একটি রোগ সংক্রামিত হওয়ার আশঙ্কা। এই পরিভাষাটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয় কোভিডের (Covid-19) ক্ষেত্রে। কারণ, একবার সেরে ওঠার পরেও একজন কোভিডে দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হতে পারে, সেটা টিকা নিলেও। ডেঙ্গুর পরিপ্রেক্ষিতে, এটি বিশ্বাস করা হয় যে কোনো ব্যক্তি একাধিকবার সংক্রমিত হতে পারে। এক্ষেত্রে বয়স, জীবনযাত্রা ইত্যাদি প্রভাব ফেলে না। একজন ব্যক্তি জীবনে চারবার পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হতে পারে।
কেন ডেঙ্গু পুনঃসংক্রমণের আশঙ্কা থেকে যায়?
কোভিডের পুনঃসংক্রমণের হার কম বলে মনে করা হয়। তবে তার ঠিক বিপরীত হলো ডেঙ্গু ভাইরাস। যেহেতু ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি সেরোটাইপ আছে, যদি একজন ব্যক্তি এক ধরনের ডেঙ্গু স্ট্রেনে আক্রান্ত হয়, তা থেকে সেরে ওঠে, তাহলে সে শুধুমাত্র একটি স্বতন্ত্র সেরোটাইপের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে। এর মানে হলো যে ব্যক্তিটি অন্য তিনটি স্ট্রেনের জন্য অরক্ষিত এবং যেকোনো সময় আবার সংক্রমিত হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে প্রতিটি সেরোটাইপে বিভিন্ন সাবস্ট্রেন রয়েছে, যা বিভিন্ন যৌগ বহন করে, যা প্রতিরোধ ক্ষমতাকে ফাঁকি দিতে পারে বা শরীরকে শক্তিশালী রোগ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে বাধা দিতে পারে। এই বছর, ডেঙ্গুর D2 স্ট্রেন মারাত্মক আকার নিয়েছে, যা ক্রমবর্ধমান।
ডেঙ্গু পুনঃসংক্রমণ কি বেশি মারাত্মক?
ডেঙ্গু জ্বর একজন ব্যক্তির শরীরে মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে। জয়েন্ট এবং পেশিতে এর প্রভাবের কারণে প্রচণ্ড ক্লান্তির কারণ হতে পারে, জ্বর আসতে পারে। এছাড়াও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের নড়াচড়াকে ব্যাহত করতে পারে। পুনরায় সংক্রমণ আরো গুরুতর এবং মারাত্মক হতে পারে। বর্তমানে, ডি ২ স্ট্রেনের কারণে পুনরায় সংক্রমণের ঘটনা বাড়ছে এবং আগের চেয়ে আরো গুরুতর হয়ে উঠছে। যারা আগে ডেঙ্গুতে সংক্রমিত হয়েছিল, তাদের ডি ২ স্ট্রেনে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বেশি। ডি-২ স্ট্রেন ডেঙ্গু-শক সিনড্রোম বা ডেঙ্গু-হেমোরেজিক জ্বর সৃষ্টি করে, যা গুরুতর ডেঙ্গুর সঙ্গে সম্পর্কিত উপসর্গ। এছাড়াও, বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে যারা পুনরায় সংক্রমিত হয়েছে, তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতায় জটিলতা তৈরি হতে পারে।
সতর্কতাই সুরক্ষিত থাকার পথ
যেহেতু একটি নিরাপদ এবং কার্যকর ডেঙ্গু ভ্যাকসিন তৈরির অনুসন্ধান এখনও চলছে, তাই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা মেনে চলা এবং প্রতিরোধমূলক প্রোটোকল মেনে চলা সর্বোত্তম উপায়। এটি মনে রাখা উচিত যে ডেঙ্গু একটি সংক্রমণ হিসেবে রয়ে গেছে যা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে নির্মূল করা যায়। যতক্ষণ পর্যন্ত ভালো স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করা হয় ততক্ষণ পর্যন্ত এটি সম্পূর্ণ রূপে এড়ানো যায়। দরজা, জানালার পর্দা, প্রতিষেধক, কীটনাশক সামগ্রী, কয়েলের ব্যবহার করতে হবে। ত্বকের সংস্পর্শে যাতে মশা কম আসতে পারে এমন পোশাক অবশ্যই পরতে হবে। প্রাদুর্ভাবের সময় স্প্রে হিসাবে কীটনাশক প্রয়োগ করা যেতে পারে। মশা ডিম পাড়তে পারে এমন জায়গায় নিয়মিত নজরদারি চালাতে হবে। খোলা পাত্রে পানি জমতে দিলে হবে না। এজন্য নিয়মিত নজরদারি করতে হবে।
সূত্র : নিউজ ১৮