প্রধানমন্ত্রী হতে মমতার কৌশল কি বুমেরাং হবে?

অন্য এক দিগন্ত ডেস্ক | Dec 02, 2021 04:35 pm
মমতা ও মোদি

মমতা ও মোদি - ছবি সংগৃহীত

 

ভারতের সাবেক ক্ষমতাসীন দল কংগ্রেসের পরলোকগত নেতা ভি এন গ্যাডগিল একটা কথা প্রায়ই বলতেন। প্রায় ২৬ বছর ধরে এমপি, দীর্ঘদিন ধরে কংগ্রেসের প্রধান মুখপাত্র ছিলেন গ্যাডগিল। সাংবাদিকদের সাথে খোশগল্প করার সময় তিনি বলতেন, ভারতের যেকোনো প্রত্যন্ত গ্রামে চলে যাও, দেখবে একটা পোস্ট অফিস আছে, আর কংগ্রেসের পতাকা ও তা বহন করার জন্য অন্তত একজন মানুষ আছেন। এই সব নেতা-নেত্রী আসবে যাবে, কংগ্রেস কখনো ওপরে উঠবে, নিচে নামবে, কিন্তু প্রতিটি গ্রামে অন্তত একজন পতাকাবাহক সমর্থক থাকবেই।

গ্যাডগিল যখন কথাগুলো বলছেন, তখন বাজপেয়ীর নেতৃত্বে এনডিএ সরকার। কংগ্রেসের অবস্থা খুবই খারাপ। একের পর এক রাজ্যে ক্ষমতা হারাচ্ছে তারা। জনপ্রিয়তা কমছে। একের পর এক দল এনডিএ-তে যোগ দিচ্ছে। কংগ্রেস জায়গা হারাচ্ছে ভারতীয় রাজনীতিতে। গ্যাডগিল ২০০১ সালে চলে গেছেন। তাকে এখন কংগ্রেসের বেহাল অবস্থা দেখতে হয়নি। পরপর দুটি লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস ৫০টি আসনের গণ্ডি পার করতে পারেনি। এখনো কি একই দাবি করতেন গ্যাডগিল? সম্ভবত করতেন।

গ্যাডগিলের কথাগুলো মনে হলো, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির সাম্প্রতিক প্রয়াস ও কথা শোনার পর। তৃণমূল নেত্রীর আপাতত লক্ষ্য হলো, নিজের জোরে নয়, বরং কংগ্রেস ভাঙিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বাইরের রাজ্যগুলোতে প্রভাব বিস্তার করা। যেমন তারা মেঘালয়ে কংগ্রেসের ১২ জন বিধায়ককে ভাঙিয়ে এনে রাতারাতি প্রধান বিরোধী দলে পরিণত হয়েছে। গোয়াতে কংগ্রেসের সাবেক মুখ্যমন্ত্রীকে ভাঙিয়ে এনে সেখানে ভোটে লড়ছে। হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, আসাম সহ একাধিক রাজ্যে তিনি কংগ্রেসের নেতাদের ভাঙিয়েছেন।

এবার তার লক্ষ্য কংগ্রেসের শরিক দলগুলিকে ভাঙানো। দক্ষিণে ডিএমকে, পশ্চিমে শিবসেনা, এনসিপিসহ কংগ্রেসের শরিকদের নিজেদের দিকে নিয়ে এসে সোনিয়া গান্ধীর দলকে বাদ দিয়ে একটা আঞ্চলিক জোট করা। তিনি যাতে প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন তার চেষ্টা করে যাওয়া। কোনো রাজনীতিক প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখতেই পারেন। লালুপ্রসাদ একবার বলেছিলেন, কেন্দ্রীয় স্তরে রাজনীতি করলে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন তো রাজনৈতিক নেতা দেখবেনই। তাতে দোষের কিছু নেই। প্রশ্নটা হলো, কীভাবে তিনি প্রধানমন্ত্রী হতে চাইছেন, আর তিনি এই কাজ করতে গিয়ে আদতে বিজেপি-র সুবিধা করে দিচ্ছেন না তো?

মমতা যতক্ষণ পর্যন্ত ত্রিপুরাতে তৃণমূলকে প্রাসঙ্গিক করার চেষ্টা করছিলেন, সেটাও বোঝা যাচ্ছিল। বাংলাভাষী রাজ্য। তৃণমূল সেখানে প্রভাব বিস্তার করতেই পরে। অন্তত চেষ্টা করতে পারে। কিন্তু মুশকিল হলো, রাতারাতি পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রচুর নেতাকে উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে, ত্রিপুরায় ঘাঁটি গেড়ে পুরভোটের আগে বসে থেকে তৃণমূল ত্রিপুরাতেও খুব বেশিদূর এগোতে পারবে কি? পশ্চিমবঙ্গে যখন বিজেপি নেতারা এই কাজটা করছিলেন, তখন মমতাই তো তাদের বহিরাগত তকমা দিয়ে, তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। সেই যুক্তিতে ত্রিপুরাতেও তৃণমূলের এই নেতা-নেত্রীর বাহিনী বহিরাগত। তাছাড়া নির্বাচনের আগে হাই-ভোল্টেজ প্রচার করে কিছু ভোট পাওয়া যায়, ত্রিপুরায় সিপিএমের যাত্রাভঙ্গ করা যায়, কিন্তু ভোটে জেতা যায় না। বিরোধী ভোট ভাগ হয়ে গেলে শেষ পর্যন্ত যে বিজেপি-র সুবিধা হবে, এটা বোঝার জন্য বড় কোনো রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ হতে হয় না।

এই যুক্তি মমতাও দিতে পারেন। কংগ্রেস এখন অভিযোগ করছে, যেভাবে মমতা কংগ্রেস ভাঙাচ্ছেন, তাতে বিজেপি-র হাতই শক্ত হচ্ছে। তার জবাবে মমতা বলতেই পারেন, তিনি নিজের বিস্তার ঘটাতে চাইলে কার কী বলার আছে। তিনি অবশ্য বলছেন, অন্যরা যদি মাঠে নেমে লড়াই না করে তো তিনি কী করবেন। তিনিই লড়াই করছেন। মুশকিল হলো, তিনি লড়াইটা করতে চাইছেন, কংগ্রেসকে আরো দুর্বল করে, তাদের ভাঙিয়ে। তিনিও মোদী-শাহের কৌশল নিয়ে কংগ্রসের শক্তি কমিয়ে তৃণমূলকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করছেন। কংগ্রেসের শক্তি কমলে আদতে লাভ তো বিজেপি-রই। রাজনীতি কথাটার মধ্যে নীতি আছে ঠিকই, কিন্তু সেই মহাভারতের সময় থেকে আমরা দেখে যাচ্ছি, বাস্তবে তার মধ্যে কোনো নীতি নেই। যেন-তেন-প্রকারেন ক্ষমতা দখলই সার কথা। রাজনীতিতে ইমানুয়েল কান্টের দর্শন একেবারেই অচল, যিনি মনে করতেন, শেষ পর্যন্ত ভালো কাজের জন্য কোনো অসাধু উপায় নেয়া যায় না। সেটা অনৈতিক।

মমতা সম্প্রতি গোয়ায় গেছিলেন। সমুদ্রতীরের এই ছোট রাজ্যে বিজেপি এবার খুব একটা সুবিধাজনক অবস্থায় নেই। মনোহর পারিকর মারা যাওয়ার পর দলে গোলমাল ও প্রভাবশালী নেতা না থাকায় সেখানে বিজেপি-র অবস্থা খারাপ হচ্ছে। কংগ্রেসের অবস্থাও যে খুব ভালো এমন নয়। কয়েকটি আঞ্চলিক দল চেষ্টা করছে। গোয়ায় প্রায় সাড়ে আট শতাংশ মুসলিম ও ২৫ শতাংশ খ্রিস্টান আছেন। এই সংখ্যালঘু ভোট ভাগ হলে বিজেপি-র জিততে সুবিধা হবে।

উত্তর প্রদেশ, হরিয়ানা, মধ্যপ্রদেশের মতো জায়গায় কয়েকজন মাঝারি মাপের নেতাকে দলে এনে কী করতে পারবেন মমতা? খুব বেশি হলে কংগ্রেসের কিছু ভোট কাটতে পারবেন। এমন তো নয়, পশ্চিমবঙ্গের বাইরের রাজ্যের মানুষও তাকে প্রধানমন্ত্রী দেখবেন বলে হুড়মুড় করে ভোট দেবেন। জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই করে জয়প্রকাশ নারায়ণ জনতা পার্টিকে ক্ষমতায় নিয়ে আসতে পেরেছিলেন। একসময় বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং বফর্সকে হাতিয়ার করে সারা দেশে আলোড়ন তুলেছিলেন। দিল্লিতে অরবিন্দ কেজরিওয়াল দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা বলে হাওয়া উঠিয়ে বিধানসভা নির্বাচনে জিততে পেরেছিলেন। তাদের কাছে একটা করে বিষয় ছিল, যা দিয়ে তারা মানুষের ভাবাবেগ উসকে দিতে পেরেছিলেন। নরেন্দ্র মোদিও ইউপিএ আমলের দুর্নীতিকে হাতিয়ার করে ঝড় তুলতে পেরেছিলেন। কিন্তু এখনো পর্যন্ত শুধু বিজেপি বা মোদি হঠাও স্লোগান ছাড়া মমতার হাতে আর কিছু নেই। আর সেটা করতে গিয়ে তিনি শেষ পর্যন্ত কংগ্রেসকে শেষ করার ব্রত নিয়েছেন।

আর তৃণমূল নেত্রী যা করছেন, তাতে আদতে বিজেপি-র হাতই শক্ত হবে। কারণ, এই মৃতপ্রায় কংগ্রেসই এখন জাতীয় স্তরে বিজেপি-র প্রধান বিরোধী দল। এখনো বেশ কয়েকটি রাজ্যে তারা নিজের জোরে বা শরিকদের সঙ্গে ক্ষমতায় আছে। আজকের বাস্তবতা হলো, বিরোধীদের সরকার বানাতে গেলে কংগ্রেসকে নিয়েই বানাতে হবে। কিন্তু কংগ্রেস-মুক্ত বিরোধীর যে লক্ষ্য নিয়ে তিনি এগোচ্ছেন, তাতে শেষপর্যন্ত বিরোধীদের শক্তিই কমবে।
সূত্র : ডয়চে ভেলে


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us