আফগানিস্তানে যেভাবে ব্যর্থ হলো ভারত
আফগানিস্তানে যেভাবে ব্যর্থ হলো ভারত - ছবি সংগৃহীত
‘যেকোনো দেশের পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারিত হয়ে থাকে সে দেশের ভৌগোলিক অবস্থার নিরিখে।’ দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর ক্ষেত্রেও পররাষ্ট্র নীতি এবং অভ্যন্তরীণ নীতি ভৌগোলিক অবস্থার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে। আফগানিস্তানের ঘটনাগুলো উন্মোচিত হওয়া এবং আগস্ট মাসে তালেবানদের ক্ষমতায় ফিরে আসার পরিপ্রেক্ষিতে দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশের বিশেষভাবে ভারত ও পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক গতি প্রকৃতিতে পরিবর্তন এসেছে। আফগানিস্তানে তালেবানদের উত্থান পাকিস্তানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ-সুবিধার দ্বার উন্মোচিত করেছে। অন্য দিকে এতে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা মারাত্মক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। কাবুলে তালেবানের ক্ষমতাসীন হওয়াকে ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্বের লেন্স দিয়ে ভারতে দেখা হচ্ছে এবং দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রভাব বৃদ্ধিকেও ভারত একই দৃষ্টিতে দেখছে। বেইজিং ও ইসলামাবাদের সাথে নয়াদিল্লির ভঙ্গুর সম্পর্ক আফগানিস্তানের পটপরিবর্তনে মারাত্মকভাবে প্রভাব ফেলেছে।
বর্তমানে ভারত এই অঞ্চলের অত্যন্ত সুবিধাবঞ্চিত খেলোয়াড়দের অন্যতম। আমেরিকা-পরবর্তী আফগানিস্তানকে কেন্দ্র করে এশিয়ায় যে ভূরাজনীতি শুরু করে হয়েছে তাতে তালেবান, চীন ও পাকিস্তান অনানুষ্ঠানিক জোট গঠন করে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করছে। চীন এবং পাকিস্তান উভয়ে তালেবানদের ক্ষমতায় ফিরে আসাকে স্বাগত জানিয়েছে। কাবুলে তালেবানদের ক্ষমতা গ্রহণ বিরোধপূর্ণ কাশ্মির অঞ্চলে দীর্ঘদিনের বিদ্রোহকে আরো শক্তিশালী করতে পারে। ভারত সরকারের মধ্যে একটি পাকাপোক্ত ধারণা জন্মেছে যে, কাশ্মিরে হামলা চালানোর জন্যে মিলিট্যান্টদের সংগঠিত করতে তালেবানদের প্রক্সি হিসেবে ব্যবহার করা হতে পারে। তালেবান পরিচালিত আফগানিস্তানে চীন ও পাকিস্তানের নীতি স্পষ্টত একে অপরের সাথে সম্পৃক্ত। কিন্তু একটি ক্ষেত্রে তাদের স্বার্থে সঙ্ঘাত বা দ্বন্দ্ব হতে পারে। তাদের মতে, তালেবান আফগানিস্তানকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের প্লাটফর্ম হওয়ার অনুমতি দিতে পারে। চীনের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন বিশেষত জিনজিয়াং-এ সেটা বেশ জোরদার হয়ে উঠতে পারে। এটা চীন ও পাকিস্তানের মধ্যকার দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে একটি পরীক্ষা হিসেবে দেখা দিতে পারে। উল্লেখ্য, উভয় দেশের বন্ধুত্বকে সব সময় পর্বতের চেয়ে উচ্চ এবং সাগরের চেয়ে গভীর হিসেবে উল্লেখ করা হয়ে থাকে। কিন্তু তালেবান তাদের মৌলিক আদর্শ পরিবর্তন করার কোনো ইঙ্গিত দেয়নি।
এদিকে, সম্প্রতি দক্ষিণ এশিয়ায় সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে। সম্প্রতি কাশ্মিরে হামলার ঘটনা বেড়ে গেছে; বিশেষভাবে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা বৃদ্ধি পেয়েছে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে একটি বৃহত্তর ভূমিকা পালন করে আসছে ভারত। কিন্তু আফগানিস্তানে তালেবানদের ক্ষমতা দখল দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের প্রভাবের ব্যাপারে মারাত্মক প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। এজন্য অবশ্যই ভারতের শীর্ষ নেতৃত্ব এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে দায়ী করতে হবে। তারা দ্রুত পরিস্থিতি মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছে।
আফগান পরিস্থিতি স্পষ্ট হলেও ভারত অনেক মূল্যবান সময় নষ্ট করেছে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের তালেবানদের সাথে আলোচনা শুরু করা এবং মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার করার মাঝামাঝি একটি উল্লেখযোগ্য সময় ছিল। এমনকি তালেবানরা দেশটির বিভিন্ন অংশ জয় করতে শুরু করা সত্ত্বেও তারা যে দেশটির একটি বৈধ স্টেকহোল্ডার ভারত সে ব্যাপারে উদাসীন ছিল এবং বাস্তবতা মেনে নেবার ব্যাপারেও তাদের মধ্যে ছিল অনীহা।
ভারতের ‘অপেক্ষা করো ও পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করো’ নীতি অনুসরণ করার কারণে পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপ হয়েছে এবং কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ শেষ হয়ে গেছে। ভারতের জন্য বর্তমানে বৃহত্তম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেবে নাকি বর্তমান অবস্থায় স্বীকৃতি দেবে না, তা নির্ধারণ করা।
ভারত ইতোমধ্যে আফগানিস্তানে প্রায় তিন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। দেশটির অবকাঠামো উন্নয়ন, ক্যাপাসিটি বিল্ডিং এবং আরো বহু খাতে এই অর্থ বিনিয়োগ করা হয়েছে। তাই ভারতের নিরাপত্তা এবং এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্য আফগানিস্তানের সাথে সম্পৃক্ত না হওয়ার কোনো অপশন সম্ভবত আলোচনার টেবিলে নেই। আফগানদের মধ্যে প্রভাব বিস্তার এবং কল্যাণকর ধারণা ছড়িয়ে দেয়ার একমাত্র পথ হবে ক্যাপাসিটি বিল্ডিং এবং উন্নয়ন কাজ অব্যাহত রাখা। তাই আফগানিস্তানের বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার জন্যে নতুন কর্মপন্থা কী হতে পারে?
ভারতের একটি আত্মরক্ষামূলক এবং আক্রমণাত্মক নীতি গ্রহণ করার বিষয়টি পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করবে। অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, নয়াদিল্লির একটি সক্রিয় দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা প্রয়োজন। কালপরিক্রমায় ভবিষ্যতে ভারতকে এগিয়ে নেয়ার জন্য তিন ফ্রন্টে যুদ্ধসহ বিভিন্ন অপশনভিত্তিক নীতি গ্রহণ করা প্রয়োজন।
লেখক : কারিগরি ও অর্থনৈতিক বিষয়ে গভীরভাবে আগ্রহী। তবে আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও সাইবার সিকিউরিটি বিষয়ও কাভার করেন। মূলত অর্থনীতি তথা আর্থিক বিষয়ের একজন লেখক।
এশিয়া টাইমসের সৌজন্যে
ভাষান্তর : মুহাম্মদ খায়রুল বাশার