ইসলামি সভ্যতায় নিরাপদ সড়কব্যবস্থা
ইসলামি সভ্যতায় নিরাপদ সড়কব্যবস্থা - ছবি : সংগৃহীত
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। ইসলামের দৃষ্টিতে নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থার গুরুত্ব অপরিসীম। নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থার উপর নির্ভর করে মানুষের জীবন-জীবিকার সংরক্ষণ। শরিয়াহর অন্যতম মাকসাদ হলো 'হিফজুন নফস' তথা জীবন সংরক্ষণ বা জীবনের নিরাপত্তা।
ইসলামি সভ্যতার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে নিরাপদ সড়কব্যবস্থার বিষয়টি আমাদের কাছে নতুন ভাবনার সৃষ্টি করে। ইসলামি খিলাফতের খলিফা, আমির ও সুলতানরা নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থাকে একটি অপরিহার্য কাজরূপে গ্রহণ করেছিলেন এবং সড়কব্যবস্থার নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছিলেন।
১২০০ বছর ধরে বিশ্বব্যাপী শাসনকারী ইসলামি সভ্যতা সড়ক নিরাপত্তায় শুধু দুর্ঘটনা থেকে মানুষকে হেফাজত করার জন্য কাজ করেনি, বা এটি ইসলামের নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থারও পূর্ণ প্রতিচ্ছবি নয়। ইসলামে নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থার ধারণা বা পরিসর অনেক বিস্তৃত।
ইসলামি সভ্যতার সড়ক ব্যবস্থায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নিম্নরূপ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছিলো-
১. নির্বিঘ্ন ও পরিকল্পিত সড়কব্যবস্থা নির্মাণ করা হয়েছিলো।
২. মহাসড়ক থেকে রাষ্ট্রীয় ফরমান অনুযায়ী নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে আবাসন নির্মাণ করা হতো।
৩. সড়কের দুই পাশে সাড়ি সাড়ি বৃক্ষরোপণ করা হতো।
৪. পরিবেশ বান্ধব ও উপযুক্ত যানবাহন চলাচলের নির্দেশনা জারি ছিলো এবং ফিটনেসবিহীন যাববাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা ছিলো।
৫. নান্দনিক স্থাপত্য নির্মাণ করা হয়েছিলো ও কৃত্রিম ঝরনা পথের দু'পাশে প্রবহমান ছিলো। এতে ক্লান্তিহীনভাবে যাত্রীরা দূরের পথ চলতে পারতো।
৬. পয়ঃপ্রণালী নির্মাণ করে সড়কের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছিলো।
৭.পথিকদের জন্য পথ ছাউনি, বিশ্রামাগার এবং পানিসরবরাহের ব্যবস্থা ছিলো।
৮. সড়কে তল্লাশি চৌকি বসানোর ব্যবস্থা বিদ্যমান ছিলো। শহরের সড়কে সড়কে পুলিশি নিরাপত্তা প্রদান করা হতো।
৯. পরিকল্পিত নগর ও পরিকল্পিত পল্লী নির্মাণ করা হয়েছিলো। এতে স্থাপত্যবিদদের ছক অনুসরণ করা হতো
১০. নিরাপদ সড়ক আইন বাস্তবায়নে সঠিক ভূমিকা পালন করা হতো।
১১. অগণিত মসজিদ ও লঙ্গরখানা সড়কের পাশে নির্মিত হয়েছিলো।
১২ সড়ক পর্যবেক্ষণের জন্য ওয়াচ টাওয়ার নির্মিত হয়েছিলো।
১৩. প্রত্যেকটা শহরে নারী ও পুরুষের জন্য উপযুক্ত শত শত স্নানাগার (হাম্মামখানা) নির্মাণ করা হয়েছিলো ।
১৪. দ্রুত তথ্য আদান প্রদানের সুব্যবস্থা ছিলো।
১৫. যাতায়াতের সুবিধার জন্য নদীর ওপর সেতু নির্মাণ করা হয়েছিলো।
এসব কিছুই ছিলো ইসলামি সভ্যতার নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য । এসব বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান
থাকার কারণে খুব কমই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা সংঘটিত হতো। যাত্রীরা অনেক দূরের পথ নির্বিঘ্নে সফর করতে পারতো। সুদূর আফ্রিকার একজন মুসাফির হিন্দুস্তান এবং দূরপ্রাচ্যে ভ্রমণ করতো কোনো রকম সমস্যা ছাড়াই। মুসলিম স্পেন, হেজাজ,উত্তর আফ্রিকা, ট্রান্সঅক্সিয়ানা, ভারতবর্ষ, আনাতোলিয়া অঞ্চলসহ সমগ্র মুসলিম জাহানে উন্নত ও নিরাপদ সড়কের অসাধারণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছিলো। এসব অঞ্চলে বাণিজ্যের পথ ছিলো নিরাপদ ও প্রশস্ত।
হযরত উমর [রা.]-এর শাসনকালে নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থার জন্য যথেষ্ট কাজ করা হয়েছিলো। রাস্তাঘাট ও সেতু নির্মাণের ব্যবস্থা উমর [রা.]-এর সময় উন্নত ধরনের ছিলো। তিনি সড়ক ও সেতু নির্মাণে এতো বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন যে, বিজিত দেশগুলোর সাথে সন্ধি চুক্তি করার সময় সড়ক ও সেতু নির্মাণের শর্তারোপ করা হতো। হযরত আবু উবায়দার সিরিয়া বিজয়ের সময় সন্ধিপত্রে উপরিউক্ত শর্তারোপ করা হয়েছিলো। (ইসলামের ইতিহাস, মুহাম্মদ উমর ফারুক, পৃ. ১৬৭)
নগরীর সড়কসমূহে বিভিন্ন পাথর দিয়ে তৈরি করা হতো এবং কারুকাজ করা হতো। আন্দালুসিয়ার শাসক দ্বিতীয় আব্দুর রহমানের সময় কর্ডোভায় মার্বেল পাথরের তৈরি রাস্তা ও ঝরনাগুলি সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতো। নতুন নতুন সড়কপথ নির্মাণ করা হয় এবং পুরনো সড়ক সংস্কার করা হয়। রাজধানী থেকে প্রত্যন্ত সীমা পর্যন্ত যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি সাধিত হয়। (মুসলিম স্পেনের রাজনৈতিক ইতিহাস, এস.এম. ইমামউদ্দিন, পৃ. ১১৬)
তৃতীয় আব্দুর রহমানের শাসনকালে নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থায় অসাধারণ বিপ্লব সাধিত হয়। সেনাবাহিনী
ও পণ্যসামগ্রির দ্রুত গমনাগমন এবং সহজ যোগাযোগের জন্য আব্দুর রহমান শুধু মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ করেই ক্ষান্ত হন নি; বরং দেশের সর্বত্র নতুন সড়ক পথ নির্মাণ করেন। পর্যটক ও ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তার জন্য মহাসড়কের জায়গায় জায়গায় ফাঁড়িতে পাহারাদার নিযুক্ত করেন। সুদক্ষ পুলিশ ব্যবস্থার দরুন পথিক ও ব্যবসায়ীগণ তাদের মূল্যবান দ্রব্য সামগ্রী নিয়ে বিপদ সংকুল যাত্রাপথে নিরাপদে যাতায়াত করতে পারতো।
দ্রুত খবরাখবর প্রেরণের ব্যবস্থা ছিলো।
অশ্বারোহী সংবাদ বাহককে বিভিন্ন জায়গায় মোতায়েন করা হতো। শত্রুর গতিবিধি সম্পর্কে সরকারকে অবহিত করার উদ্দেশ্যে এবং শহর বন্দরকে পাহারা দেওয়ার জন্য উপকূল বরাবর ও পাহাড়ের উপরে ওয়াচ টাওয়ার (Watch Tower) নির্মিত হয়। (মুসলিম স্পেনের রাজনৈতিক ইতিহাস, এস. এম. ইমামউদ্দিন, পৃ.
১৫২)
হাজিব আল মনসুর একজন কল্যাণকামী শাসক ছিলেন। তার রাজত্বকালে স্পেনে সড়ক ব্যবস্থায় বিরল উন্নতি সাধিত হয়। তিনি অসংখ্য নতুন রাস্তা নির্মাণ করেন। ব্যবসা বাণিজ্যের উন্নতি ও সেনা পরিচালনার সুবিধার জন্য বেশ কিছু সেতু নির্মাণ করেন। তিনি চল্লিশ হাজার স্বর্নমুদ্রা ব্যয়ে গোয়াদিলকুইভির নদীর ওপরে
একটি সেতু নির্মাণ করেন। এছাড়া এসিজায় জেনিল নদীর ওপরেও একটি সেতু নির্মাণ করেন। (স্পেনে মুসলমানদের ইতিহাস, ফকির ফারুক আহম্মেদ, পৃ. ২৫৩)
মুসলমানরাই বিশ্বমানবতার কল্যাণার্থে প্রথম সেতু নির্মাণ করেছিলেন। তারাই সেতুর জন্মদাতা। কর্ডোভার বিখ্যাত বিজ্ঞানসম্মত সেতু নির্মাণ করেছিলেন প্রথম হিশাম। (পুস্তক সম্রাট, গোলাম আহমাদ মোর্তজা, পৃ.)
ইসলামি সাম্রাজ্যাধীন প্রধান সড়কগুলি ছিলো আলোকোজ্জ্বল। সর্বত্র সেগুলোতে রোড লাইট ছিলো।
গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড এশিয়ার অন্যতম প্রাচীন ও দীর্ঘতম সড়ক পথ। দুই শতাব্দীরও অধিক সময় এটি উপমহাদেশের পূর্ব ও পশ্চিম অংশকে সংযুক্ত করে রাখে। এটি বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও
থেকে শুরু হয়ে পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া হয়ে পাকিস্তানের
পেশাওয়ারের মধ্য দিয়ে আফগানিস্তানের কাবুল পর্যন্ত পৌছায়। ষোলো শতকে সুলতান শেরশাহ কর্তৃক নির্মিত এ দীর্ঘ সড়ক পরিকল্পনার মূল উদ্দেশ্য ছিলো প্রশাসনিক কাজে গতি সৃষ্টি করা। এ ছাড়া, প্রতিরক্ষার কৌশলগত দিক সামনে রেখে সমগ্র সাম্রাজ্যের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নিতবিধানও এর লক্ষ্য ছিলো। এর মাধ্যমে রাজধানী আগ্রার সঙ্গে সাম্রাজ্যের প্রত্যন্ত অঞ্চলকে যুক্ত করা হয়েছিলো। মূল পরিকল্পনায় রাজধানী আগ্রাকে পূর্বে সোনারগাঁও, পশ্চিমে দিল্লি ও লাহোর হয়ে মূলতান, দক্ষিণে বোরহানপুর এবং দক্ষিণপশ্চিমে যোধপুরের সাথে সংযুক্ত করা হয়েছিলো। সামরিক সুবিধার পাশাপাশি বাণিজ্যিক উন্নতি, ডাক-যোগাযোগে দক্ষতা বৃদ্ধি এবং সেইসাথে কঠোর গুপ্তচর প্রথার মাধ্যমে সাম্রাজ্যের তথ্যাদি সংগ্রহ করাও সুলতানের উদ্দেশ্য ছিলো।
‘সড়ক-ই-আজম’ নামে পরিচিত এ সড়ককে ঘিরে আরো কিছু কর্মতৎপরতার প্রমাণ মেলে। সরকারি কর্মকর্তাদের যাতায়াত সুবিধা প্রদানের সঙ্গে সঙ্গে তাদের ও জনসাধারণের বিশ্রামের জন্য রাস্তার উভয়পার্শ্বে দু’ক্রোশ অন্তর অন্তর বিশ্রামাগার ও সরাইখানা নির্মিত হয়। সরাইখানাগুলোতে খাবার ও উন্নত আবাসিক সুবিধার ব্যবস্থা ছিলো। রাস্তার পার্শ্বে ছায়াদানকারী বৃক্ষও রোপণ করা হয়।
ব্রিটিশ আমলে সৈন্য চলাচলের সুবিধা এবং ডাক বিভাগের উন্নতির উদ্দেশ্যে সড়কটি সংস্কার করা হয়। এ সময়ই সড়কটির নাম দেয়া হয় ‘গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড’। যে সকল প্রধান শহর দিয়ে এই সড়ক অতিক্রম করেছে তা হলো- বাংলাদেশের বেনাপোল, ঝিকড়গাছা, যশোর, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, ফেনী, সীতাকুণ্ড, ভাটিয়ারি, চট্টগ্রাম, টাঙ্গাইল, নাটোর, রাজশাহী। ভারতের- কোলকাতা, হাওড়া, বর্ধমান, বিহার, সাসারাম, নয়াদিল্লী, এলাহাবাদ, আওরঙ্গবাদ, আগ্রা, পানিপথ, আমবালা, পাটনা, পূর্নিয়া, অমৃতসর, গুজরাট, হরিয়ানা, তক্ষশীলা, পাটলিপুত্র, লুধিয়ানা, সোনিপাত, জলন্ধর। পাকিস্তানের- লাহোর, ঝিলাম,পাঞ্জাব, রাওয়ালপিণ্ডি ও পোরশা এবং আফগানিস্তানের- খাইবার, জালালাবাদ, তোরখাম ও কাবুল। এশিয়া মহাদেশের সর্ব বৃহৎ এই গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড এর দৈর্ঘ্য ৩৬৭০ কিলোমিটার যা বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।
হেজাজ রেলওয়ে ছিল দামেস্ক থেকে মদিনা পর্যন্ত বিস্তৃত একটি রেলপথ। এটি হেজাজ অঞ্চলের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়। এছাড়াও হাইফার দিকে এর একটি শাখা ছিলো। হেজাজ রেলওয়ে ছিলো উসমানীয় রেলওয়ে নেটওয়ার্কের একটি অংশ। ইস্তাম্বুল থেকে দামেস্ক হয়ে মক্কা পর্যন্ত পৌঁছানোর জন্য এর নির্মাণ করা হয়। এই রেলপথ নির্মাণের মূল উদ্দেশ্য ছিলো উসমানীয় খিলাফতের রাজধানী কনস্টান্টিনোপল থেকে ইসলামের পবিত্রতম শহর মক্কা পর্যন্ত যোগাযোগ সহজ করা। এছাড়াও উসমানীয় সাম্রাজ্যের দূরবর্তী আরব প্রদেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটানো এবং সামরিক বাহিনীর যোগাযোগ সহজ করা এর উদ্দেশ্য হিসেবে কাজ করে।
এভাবে বিশ্বের সর্বত্র মুসলমান নৃপতিরা নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে বিভিন্নমুখী ও সর্বাত্মক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। উমাইয়া, আব্বাসি, উসমানি,ফাতেমি, সেলজুক, আইয়ুবি, মামলুক, মোগল প্রভৃতি সাম্রাজ্যের মুসলিম শাসকরা সড়কব্যবস্থার নিরিপত্তা ও মানুষের জান মালের সংরক্ষণের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছিলেন। তাদের কাজ আজকের দুনিয়ার জন্য মাইল ফলক।
উপরোল্লিখিত ইসলামি সভ্যতার ১৫টি কাজ বাস্তবায়ন করলে আজকের যুগেও নিরাপদ সড়কব্যবস্থা নির্মাণ করা সম্ভব। কিন্তু স্বৈরাচার জালেম শাসকরা কখনো নিরাপদ সড়কব্যবস্থা নির্মাণ করতে চায় না। পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি তাদের মৌলিক কাজ।
এইসব জালেম শাসকগোষ্ঠির অপকর্ম সম্পর্কে কোরআন মাজিদে বলা হয়েছে- 'যখন সে শাসন কর্তৃত্ব লাভ করে, পৃথিবীতে তার সমস্ত প্রচেষ্টা সাধনা নিয়োজিত করে বিপর্যয় সৃষ্টি এবং শস্য ক্ষেত ও বংশ বিস্তার ধ্বংস করার কাজে। অথচ আল্লাহ মোটেই বিপর্যয় পছন্দ করেন না।' (সূরা বাকারা, আয়াত-২০৫)