পানিকে ভেঙে অক্সিজেন-হাইড্রোজেনের ব্যবহার শিখতে হবে
পানিকে ভেঙে অক্সিজেন-হাইড্রোজেনের ব্যবহার শিখতে হবে - ছবি : সংগৃহীত
২০২০ সালে কোভিড-১৯ এর কারণে পৃথিবীতে লকডাউন থেকে শুরু করে শাটডাউন হয়েছে। সবকিছু চলেছে ধীরগতিতে। বিশ্বের বাজারগুলোতে আগের মতো ভিড় নেই, কারও তাড়াহুড়া নেই বাজারে গিয়ে বাজার করার। বাংলাদেশের মতো পৃথিবীর অনেক দেশের বড় লোকদের যা দরকার সেগুলো ঘরের দুয়ারেই অনলাইনে অর্ডারের মাধ্যমে পেয়ে যাচ্ছেন। স্কুল-কলেজ নতুন করে খুলছে, মানুষ সাধারণ জীবনযাপন করতে শুরু করেছে।
প্রথমদিকে পর্যাপ্ত পরিমাণে পণ্যদ্রব্য মজুদ ছিল বিধায় কেনাকাটা করতে শপিংমল, বাজার বা দেশ-বিদেশে যাবার দরকার পড়েনি। ঘরে বসেই অনলাইনে যার যা পছন্দের তা কিনতে পেরেছে। এতে করে নতুন চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছে সবার মাথায় আর তা হলো অনলাইন বিজনেস। কোনো কোনো দেশ যেমন জাপান শুরু করেছে মানুষের পরিবর্তে রোবটের ব্যবহার। কারণ বেচারা গরিবদের যদি করোনায় আক্রমণ করে তাহলে কে পণ্যদ্রব্য বড় লোকদের দরজায় পৌঁছে দেবে? সমস্যা এসেছে আর মানুষ তার সমাধান করছে, দারুণ।
এখন যদি মহামারি বা বড় বিপদের কারণে পণ্যদ্রব্য শেষ হয়ে যায় বা মজুদ না থাকে তবে তো তা উৎপাদন করতে হবে। যেমন বাংলাদেশের গার্মেন্টস সেক্টর বিশ্বের মানুষের চাহিদানুযায়ী নানা ডিজাইনের পোশাক তৈরি করে আসছে কয়েক যুগ ধরে। এখন অনলাইনে অর্ডার দিয়ে কিনতে হলে তো তা তৈরি করতে হবে। সেটাও না হয় রোবট দিয়ে তৈরি করা সম্ভব হবে।
নানা ধরণের পোশাক তৈরি করতে দরকার র-ম্যাটেরিয়ালসের এবং তার জন্য কৃষিকাজে লোকের দরকার। তাও অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি এবং রোবট দিয়ে ম্যানেজ করা সম্ভব হচ্ছে/ হবে। আবার রোবট তৈরি করতে রোবট কাজে লাগছে। এখন প্রশ্ন তাহলে অভাগা মানুষ জাতি, আমাদের হবে কী? আমরা কী করব? ঘরে শুয়ে বসে সময় কাটাবো আর অনলাইনে সব কিছু অর্ডার দেব?
বাইরে গিয়ে পার্কে ঘুরতে পারব না। মলে গিয়ে শপিং করতে পারব না। গাড়িতে করে কোথাও যেতে পারব না। প্লেনে করে দেশ-বিদেশ ভ্রমণ করে সুন্দর পৃথিবীকে দেখতে পারব না। সাগরে হই হুল্লোড় করতে পারব না। স্ত্রী বা বান্ধবীর হাত ধরে ঘুরতে পারব না।
এ কেমন অবিচার? এত সুন্দর পৃথিবী হঠাৎ অনলাইনে ঢুকে গেল? ভাবনার বিষয়!
এদিকে অতীতের মতো দুর্নীতিও করা সম্ভব হবে না। কারণ অনলাইনে কার্ড দিয়ে বিল পরিশোধ করতে হয়, ক্যাশ টাকার ব্যবহার কমতে শুরু করেছে। আমি দুই বছর আগে লিখেছিলাম দুর্নীতিমুক্ত সমাজ পেতে কাগজের টাকা বন্ধ করতে হবে। অনেকেই বিষয়টি পছন্দ করেনি তখন। কিন্তু এখন কী হবে? কী করা যেতে পারে অনলাইন থেকে পৃথিবীকে মুক্ত করতে হলে? সম্ভব নয়। কারণ বিশ্ব বাজার অলরেডি প্লান করতে শুরু করছে, শেয়ার বাজার থেকে শুরু করে ডিজিটাল মুদ্রার ব্যবহার। বর্তমানে যে হারে দুর্নীতি চলছে সেটা বন্ধ করতে ডিজিটাল মুদ্রার ব্যবহার দরকার। সিস্টেম চেঞ্জ না করলে নতুন সিস্টেম চালু হবে না। যতক্ষণ পর্যন্ত দুর্নীতির নতুন পদ্ধতি চালু না হবে পুরনো পদ্ধতিতেই মানুষ দুর্নীতি করবে। বাংলায় একটি প্রবাদবাক্য ছোটবেলায় গ্রামে শুনেছি “ছ্যাপ দিয়ে কাশ ঢাকা।” আমার মনে হচ্ছে আমরা একটি সমস্যাকে আরেকটি সমস্যা দিয়ে ম্যানেজ করে চলছি মাত্র।
আকাশে পাখি উড়তে দেখে যেমন একদিন রাইট ব্রাদার্সদের মনে ভাবনা এসেছিল কিভাবে মানুষও আকাশে উড়তে পারে। ওই ভাবনাকে তারা বাস্তবে রূপ দিতে পেরেছিল। কোভিড-১৯ আমাদের চাপ সৃষ্টি করছে নতুন করে ভাবতে। কেন যেন মনে হচ্ছে প্রযুক্তির যুগ হয়তো শেষের পথে এবং নতুন কিছু আবিষ্কারের সময় এসেছে! প্রযুক্তিগত সমাধান বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে বড় ধরনের প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা দিচ্ছে, যার মধ্যে রয়েছে পোশাকশিল্পও। সেক্ষেত্রে ব্যবসায়ের সফলতা ধরে রাখার জন্য একটি প্রতিযোগিতামূলক পটভূমি তৈরি অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। কারণ কোভিড-১৯-এর মতো দুর্যোগের সময় প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন হলো দুটি প্রধান শক্তি, যা বাংলাদেশের পোশাক খাতের কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। এত দিন ধরে যে প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি অনুযায়ী বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতকে পরিচালনা করা হয়েছে, ভবিষ্যতে একইভাবে কার্যক্রমগুলো চালিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না।
এক্ষেত্রে তৈরি পোশাকপ্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের ব্যবসায়িক রূপান্তরের ক্ষেত্রে নতুন পন্থার উদ্ভাবন করতে হবে। উৎপাদন প্রক্রিয়ার উন্নয়ন, উৎপাদনের অচলাবস্থা কাটিয়ে ওঠা, সরবরাহের ক্ষেত্রে বিলম্ব দূর করা, সামগ্রিক ব্যয় হ্রাস এবং গুণগত মান উন্নয়নের দিকে কড়া নজর দিতে হবে। কারণ যেকোনো কোম্পানির দীর্ঘমেয়াদি সাফল্য নির্ভর করে ধারাবাহিকভাবে ক্রেতাদের প্রত্যাশা পূরণের সক্ষমতার ওপর। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত মূলত বড় ধরনের রফতানি-নির্ভর শিল্প। এর গ্রাহকদের একটি বড় অংশই খুচরা বিক্রেতা। এদের বেশির ভাগই ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা এবং এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে সীমাবদ্ধ। এর পাশাপাশি লাতিন আমেরিকা এবং অতি সম্প্রতি তৈরি হওয়া বেশ কিছু উদীয়মান বাজারগুলোয় বৃহত্তর রিটেইল চেইনের মাধ্যমে তাদের পণ্য বিক্রি করছে। সেক্ষেত্রে সেরা সব সরঞ্জাম যেমন সততা, কাইজেন, লিন, সিক্স সিগমা, টোটাল প্রোডাক্টিভিটি ম্যানেজমেন্ট (টিপিএম), থিওরি অব কনস্ট্রেইন্টস (টিওসি), অ্যাডজাস্ট-ইন-টাইম (এআইটি) পদ্ধতিগুলো ব্যবহারের মাধ্যমে শিল্পকারখানার উৎপাদনের মান আরো উন্নত করা দরকার।
অনেকে বলবে করোনার ভ্যাকসিন এসেছে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। নতুন করে করোনার চেয়ে ভয়ঙ্কর কিছু যে আসবে না তার কি কোনো নিশ্চয়তা আছে? সমস্যা জীবনে আসবে তার সমাধান এবং তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে সু-শিক্ষা, আত্মবিশ্বাস এবং দক্ষতা অর্জন করতে হবে।
আমি মনে করি শুধু পোশাকশিল্প, রোবট বা অনলাইন বিজনেস নয়; প্রযুক্তি যেন আরো ভালো তথ্য ব্যবস্থাপনার দিকনির্দেশনা প্রদান করতে পারে তা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। যেমন এত সুন্দর করে বড় বড় নামীদামী শপিং মল তৈরি করা হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায়। কী হবে সেগুলোর যখন সবকিছুর কেনাবেচা চলছে অনলাইনে? লকডাউনের কারণে আমরা ঘরে বসে অর্ডার দিলেই সব হুড় হুড় করে চলে আসছে দরজার সামনে। কে জানত আজ থেকে ১০ বা ১৫ বছর আগে এমনটি হবে? কে বলতে পারবে আগামী ১০ বা ১৫ বছর পরে পৃথিবীর মোড় কোন দিকে ঘুরবে? আমি যদি বলি আগামীতে আমাদের রান্নাবাড়া করার প্রয়োজন হবে না; ভাত, মাছ, শাকসব্জি, গোশত খাওয়া ছেড়ে দেব; ভিটামিন, মিনারল, কার্বহাইডসহ যা শরীরের জন্য দরকার তার সবকিছুই লিকুইড বা ট্যাবলেট ফর্ম হিসাবে খাবো তাহলে কি তা অলীক কল্পনা হবে? না, মোটেই তা নয়।
অনেকে অলরেডি শুরু করেছে এ ধরনের খাবার। যেমন মহশন্য গমনকারীরা বেশির ভাগ খাবার ড্রাই ফর্মে ব্যবহার করছে। যদি এভাবে চলতে থাকে কি হবে এত সুন্দর দুনিয়ার? মনে এমনটি ভাবনা আসতেই পারে। ফুল থেকে যেমন ফল হয়, ভাবনা থেকে নতুনত্বের উদ্ভাবন হয়। এখনই অফিস, আদালত বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে না গিয়ে আমরা জুমের মাধ্যমে ফোনালাপ, ভিডিওর মাধ্যমে পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তের সমস্যার সমাধান করছি। সবকিছুই ম্যানেজ হয়ে যাচ্ছে ফিজিক্যাল মুভমেন্ট ছাড়াই।
এত যুগ ধরে এত কিছু তৈরি করা হলো, সবকিছু কি তাহলে পড়ে থাকবে? না মানুষ জাতি নতুন করে নতুন পৃথিবী গড়বে। আমার ভাবনা সেই মানুষ জাতি আমরা বাংলাদেশীরা কবে হবো? নাকি অন্যের উপর নির্ভর হয়ে যেমন চলছি তেমনি করে ভবিষ্যতেও চলব? দেশ স্বাধীন করেছি শুধু লুঙ্গি, গেঞ্জি বা শার্ট, প্যান্ট তৈরি করে বিশ্ব দরবারে পরিচিত হতে? আমরা বড় কিছু করতে চাই, হতে পারে ইনোভেটিভ পদ্ধতিতে যেমন পানিকে ভেঙে অক্সিজেন এবং হাইড্রোজেনের ব্যবহার করতে শেখা। কেন সম্ভব হবে না? অতীতে এধরনের অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করা হয়েছে। বিশ্বের অন্যেরা যখন পারে আমরা কেন পারব না? জাগো বাংলাদেশ জাগো, নতুন করে ভাবো।
লেখক : সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন থেকে, rahman.mridha@gmail.com