মাদরাসার ছাত্ররা কেন এত ভালো ফলাফল করছে?

মাদরাসা ছাত্র - ছবি সংগৃহীত
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা ছাড়াও কর্মজীবনে প্রবেশের বিভিন্ন পরীক্ষাতেও মাদরাসা ছাত্ররা নিদারুণ সব রেকর্ড তৈরি করছেন এবং প্রায় প্রতি বছরই নিজেদের পূর্বেকার রেকর্ড ভঙ্গ করে চলতি বছরে নিত্যনতুন রেকর্ড তৈরি করে চলেছেন। বিসিএসসহ সরকারি কর্ম কমিশনের অধীনে প্রথম শ্রেণীর সরকারি কর্মকর্তা নিয়োগে যেসব প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা হচ্ছে সেখানে মাদরাসা ছাত্ররা ক্রমবর্ধমান হারে নিয়োগ পাচ্ছেন এবং অনেক ক্ষেত্রে সম্মিলিত মেধায় প্রথম স্থানটি দখল করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিচ্ছেন। সরকারি কর্ম কমিশনের বাইরে ব্যাংক, বীমা, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানেও মাদরাসা ছাত্রদের বিনা ঘুষে নিয়োগ লাভের হার এবং পরবর্তী কর্মজীবনে বিনা ঘুষে দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে তারা যে বিশ্বাস ও আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করে চলেছেন তাতে একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবীর বুদ্ধির কারখানায় মহামারীর আক্রমণ শুরু হয়ে গেছে।
মাদরাসা ছাত্রদের ইদানীংকালের সফলতা তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের মতো আমাকে আহত করেনি বটে তবে আমি নিশ্চিতভাবে আশ্চর্য হয়েছি। নিজে কোনোকালে মাদরাসায় পড়িনি। কিন্তু সমালোচকরা যখন দশমুখে বলত, আমি মাদরাসার ছাত্র ছিলাম এবং তখন থেকেই জামায়াত শিবিরের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলাম, তাদের সমালোচনায় প্রথম দিকে খুব কষ্ট পেতাম এবং আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য নিজের ছাত্রজীবনের ইতিহাস ও পরিবারের রাজনীতির ইতিহাস বর্ণনা করতাম। কিন্তু আমার আত্মপক্ষ সমর্থনে কোনো শুভ ফল তো এলোই না বরং হিতেবিপরীত হতে থাকল। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য আমি উপায় খুঁজতে গিয়ে যা জানলাম তা শেষ অবধি সমালোচকদের মুখে চুনকালি মাখিয়ে দিলো এবং আমার সম্পর্কে তাদের অন্তরে এক ধরনের ভয় সৃষ্টি হলো। অনেকের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন হলো এবং কেউ কেউ সমালোচনার পরিবর্তে শ্রদ্ধা করতে আরম্ভ করল।
আপনি যদি প্রশ্ন করেন, কী উপায়ে সমালোচকদের কবল থেকে রক্ষা পেয়েছিলাম? সে ক্ষেত্রে বলবো, প্রথমত নিজের কর্মের প্রতি বিশ্বস্ত, আস্থাশীল ও যত্নবান হওয়া শুরু করেছিলাম। আমার ব্যক্তিগত ধর্মাচার- ধর্মীয় শিক্ষার আলোকে কথাবার্তার কারণে যারা সমালোচনা করত তাদের কথার জবাব না দিয়ে আমার কর্ম অর্থাৎ ধর্মাচারের বিষয়ে যত্নশীল হয়েছি। আধুনিক জীবনে ধর্ম কিভাবে মানুষকে বিজ্ঞানমনস্ক করতে পারে, সাহসী বানাতে পারে এবং ধর্মাচারের ফলে বাস্তব জীবনের অর্থনৈতিক-সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সফলতা অর্জন করা যেতে পারে তা নিজের জীবনে দৃশ্যমান করার জন্য চেষ্টা চালাতে চালাতে এক সময় লক্ষ করলাম, এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে গেছি যেখানে সমালোচকদের বাহাদুরি নেই বললেই চলে।
উল্লিখিত কারণে মাদরাসা পড়ুয়া ছাত্রদের সফলতা দেখে আমি বেশ আশ্চর্য বোধ করছি এ কারণে যে, তারাও হয়তো নিজেদের মধ্যে আমারই মতো অনন্ত কোনো আদর্শ ধারণ করে কর্তব্য ও নিষ্ঠার পরাকাষ্ঠা, কঠোর পরিশ্রম এবং সাধনা করে যার যার কর্মক্ষেত্রে সফল হয়েছেন। ফলে যারা তাদের সমালোচনা করছেন তারা কেবল নিরাপদ দূরত্বে থেকে সমালোচনাই করতে পারবেন কিন্তু কোনো মেধাবী মাদরাসা পড়–য়ার আসনে দাঁড়িয়ে বুক উঁচু করে তার সাথে মেধার প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের দুঃসাহস দেখাতে পারবেন না। এ ব্যাপারে নিজের একটি অভিজ্ঞতা বর্ণনা না করে পারছি না। একবার জনৈক ইসলামবিদ্বেষী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আলোচিত শিক্ষকের সাথে আমার একটি টকশো অনুষ্ঠিত হলো। ভদ্রলোক তার বক্তব্যের শুরুতে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে কথা বলা শুরু করলেন। যখন আমার পালা এলো তখন আমি ধীরস্থিরভাবে বললামÑ ওভাবে বলছেন কেনো? মানুষকে সম্মান দিতে শিখুন। আপনি ছাত্র হিসাবে পাবলিক পরীক্ষাতে যে ফলাফল করেছেন তার চেয়ে আমার ফলাফল ভালো। অধিকন্তু আপনি যে বিষয়ে অধ্যাপনা করছেন সেই বিষয়ে আমি আপনাকে অনেক দিন পড়াতে পারব। আমার কথা শুনে ভদ্রলোক এতটাই ভয় পেয়ে গেলেন যে, বাকি সময়ে তিনি খুবই সংযত ভাষায় কথা বললেন এবং পরবর্তীকালে আমাদের মধ্যে যতবার সাক্ষাৎ হয়েছে ততবারই তিনি বিনয় ও সৌজন্য প্রদর্শনে কার্পণ্য করেননি।
আলোচনার এই পর্যায়ে আমরা মাদরাসা ছাত্রদের সফলতার কারণ ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করব। আমার মতেÑ মাদরাসা পড়–য়া মেধাবীরা সাধারণত আমাদের সমাজের নিম্নবিত্ত অথবা দরিদ্র পরিবারগুলো থেকে উঠে আসেন। ফলে তাদের দু’চোখ ভরা স্বপ্ন থাকে এবং শরীরের প্রতিটি কোষের মধ্যে যুদ্ধ করে বড় হওয়ার বাসনা লুক্কায়িত থাকে। তাদের পারিবারিক চাহিদা, পারিবারিক বন্ধন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নীতি নৈতিকতার কঠোরতা, ধর্মাচার এবং পাঠ্যক্রমের গুণগত মান তাদের মানুষ হিসেবে বড় হওয়ার জন্য অনুপ্রেরণা জোগাতে থাকে। অন্যদিকে, পৃথিবীর প্রাচীনতম শিক্ষাব্যবস্থা হিসেবে মাদ্রাসাগুলোতে যে শিক্ষার পরিবেশ থাকে তা অন্য কোনো দেশের কোনো পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই আজ অবধি চালু করতে পারেনি।
আধুনিক শিক্ষার নামে আমরা যা কিছু পাঠ করছি তার বয়স বড়জোর ৩০০ বছর। এই ৩০০ বছরে বিভিন্ন দেশে অন্তত ৫০ বার শিক্ষাব্যবস্থায় পরস্পরবিরোধী পরিবর্তন করা হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে আমাদের দেশের জেএসসি, পিইসি, এসএসসি, এইচএসসি, বিএ, এমএ ইত্যাদি ডিগ্রির কথা যদি বলি তাহলে দেখবেন, গত ১০০ বছরে কতবার এই পরীক্ষাগুলোর নাম এবং সিলেবাস পরিবর্তন হয়েছে। এর ফলে তথাকথিত আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ছাত্র-শিক্ষক, পিতা-পুত্র অথবা মা-কন্যার মধ্যে চিন্তা চেতনা তথা শিক্ষাদীক্ষার মধ্যে যে বিস্তর অমিল পয়দা হয়েছে তার কারণে পারিবারিক, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক অমিল-অশ্রদ্ধা, ভিন্নমত ও অস্থিরতা রীতিমতো দিনকে দিন দানব আকার ধারণ করেছে। অন্য দিকে, আমরা যদি মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থার দিকে তাকাই তবে দেখব যে, গত চৌদ্দশত বছর ধরে এই শিক্ষাব্যবস্থার মূল কাঠামো একই ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত রয়েছে এবং যুগ যুগান্তরের আইন-বিজ্ঞান, ভুগোল, অংক, জ্যামিতি বা শিল্পসাহিত্যের নিত্যনতুন ধারা আদি কাঠামোর সাথে সংযুক্ত হয়েছে। ফলে এই শিক্ষার ভিত্তিমূলে কোনো পরিবর্তন না ঘটিয়ে অবকাঠামোকে যুগোপযোগী এবং আধুনিক বানিয়েছে।
এবার মাদরাসা শিক্ষার গুণগত মান নিয়ে সংক্ষেপে কিছু বলে নিবন্ধের ইতি টানব। মাদরাসা শিক্ষার ক্ষেত্রে মূল ভাষা হিসেবে আরবি ও ফারসি ব্যবহার করা হয়। অন্য দিকে আধুনিক শিক্ষার ক্ষেত্রে ইংরেজিকে মূল ভাষা রেখে বেশির ভাগ দেশ নিজ নিজ মাতৃভাষায় পাঠ্যক্রম রচনা করে থাকে। কাজেই ভাষা হিসেবে আরবি ও ফারসির গুণগত মান, ঐতিহ্য এবং এই দুই ভাষায় রচিত মানবসভ্যতার সব উপকরণের সাথে যদি ইংরেজির তুলনা করি তবে ইংরেজিকে নিতান্ত নাবালক, অসম্পূর্ণ, দুর্বল এবং ক্ষেত্র বিশেষে বিভ্রান্তিকর বলে মনে হবে। আমার এই কথায় যারা আশ্চর্য হচ্ছেন তাদের বলছি- ভাষা হিসেবে ইংরেজি কিন্তু বাংলার চেয়েও দুর্বল ও নবীন। অন্য দিকে ইংরেজি সাহিত্য বা বাংলা সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, অংকশাস্ত্র, ভূগোল ইত্যাদি বিষয়ে যাদের রচনা দিয়ে পাঠ্যক্রম সাজানো হয় তাদের সাথে যদি আরবি ও ফারসি ভাষার পাঠ্যক্রমের রচয়িতাদের বয়স, যোগ্যতা, মেধা, জনপ্রিয়তা, জ্ঞানের গভীরতা এবং জ্ঞান বিজ্ঞানের রাজ্যের প্রভাব প্রতিশ্রুতির তুলনা করা হয় তাহলে কী ফলাফল আসবে তা অনুধাবন করার জন্য সাধারণ যোগ বিয়োগের জ্ঞানই যথেষ্ট। যারা বার্ট্রান্ড রাসেল, মিশেল ফুকো প্রমুখের দর্শনতত্ত্ব পড়ে পৃথিবীর সবকিছু বুঝে ফেলেছেন তারা ইবনে খালদুন, জাবের ইবনে হাইয়ান, আলরাজি, প্রমুখ রচিত দর্শনশাস্ত্রগুলোর কয়েকটি পৃষ্ঠা অধ্যয়ন করুন। তারপর বুকে হাত দিয়ে বলুন, আপনার পক্ষে অনন্ত পৃথিবীর কতটুকু জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব!
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য