কী হচ্ছে লিবিয়ায়?

মাসুম খলিলী | Nov 23, 2021 03:51 pm
কী হচ্ছে লিবিয়ায়?

কী হচ্ছে লিবিয়ায়? - ছবি সংগৃহীত

 

লিবিয়াকে নিয়ে ভেতরে বাইরে যত টানাপড়েন বাড়ছে ততই বাড়ছে নির্বাচন ও স্থিতি নিয়ে ভয় ও উদ্বেগ। নির্বাচন নিয়ে সৃষ্ট সঙ্কট জটিলতার নতুন এক অধ্যায় হয়ে দেখা দেয়ার ভয়ও বাড়ছে। লিবিয়ান এবং অ-লিবিয়ান একাধিক পক্ষই তাদের এই আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। লিবিয়ায় নিযুক্ত সাবেক আন্তর্জাতিক দূত তারেক মিত্রির কথাটি লিবিয়ার সঙ্কটের প্রকৃত প্রতিধ্বনি বলে মনে হয়। তিনি বলেন, ‘সবাই লিবিয়াতে নির্বাচন চায় বা দাবি করে, কিন্তু ক্ষমতা ভাগাভাগি ও শুধুমাত্র নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে সমঝোতা দেশের ঐক্য ও শান্তির নিশ্চয়তা দেয় না। কারণ কোটারি প্রতিরোধকারী জাতীয় লক্ষ্য একটি নতুন সামাজিক চুক্তি এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান নির্মাণের চুক্তির জাতীয় ঐকমত্যের প্রতিস্থাপন করে না।’
লিবিয়ায় নিযুক্ত অন্য এক দূত ঘাসান সালামেহ বলেছেন যে, ‘নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করা এবং সহিংসতার মাধ্যমে তা ক্ষুণœ করার চেষ্টার চেয়ে গণতন্ত্রের জন্য খারাপ আর কিছু নেই। এর উদাহরণ আজ ইরাক এবং ইথিওপিয়া। আর এর আগে এমন অনেক দেশের দৃষ্টান্ত রয়েছে, যাদের ব্যালট বাক্সে পরাজিতরা শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল আর এতে সৃষ্ট গৃহযুদ্ধে তাদের দেশ ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে অথবা বিভক্ত শাসনে ছিটকে পড়েছে। এতে স্টেডিয়াম ধ্বংসের মাধ্যমে শেষ হওয়া ম্যাচে সবাই হেরে গেছে।’

লিবিয়ার রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ২০২১ সালের ২৪ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হওয়ার বর্তমান সূচি নির্ধারণের আগে ২০১৯ সালের প্রথম দিকে এর জন্য পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কিন্তু ‘যুদ্ধবাজ’ হিসাবে পরিচিত খলিফা হাফতার পশ্চিম লিবিয়া দখলের অভিযান চালানোর কারণে এটি বিলম্বিত হয়। ২০১৮ সালের মে মাসে এ সংক্রান্ত মূল চুক্তিতে সম্মত হওয়া চারজন হলেন: ফয়েজ আল সাররাজ (ন্যাশনাল অ্যাকর্ড সরকারের প্রধান), খলিফা হাফতার (লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মির প্রধান), আকুলা সালেহ ঈসা (হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভসের প্রধান), এবং খালিদ আল মিসরি (হাইকাউন্সিল অব স্টেটের প্রধান)। এটি সমর্থিত হয়েছিল লিবিয়ার জাতীয় সম্মেলনের প্রস্তুতিমূলক পর্বের জন্য সেন্টার ফর হিউম্যানিটারিয়ান ডায়ালগের চূড়ান্ত প্রতিবেদন দ্বারা, যেখানে বলা হয় যে, পরামর্শমূলক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী লিবিয়ানরা বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে ক্লান্তি এবং হতাশা প্রকাশ করেছে। আর তারা একটি অথবা অন্যান্য বৃহত্তর পরিসরের নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহ্বান জানিয়েছে।

লিবিয়ান নির্বাচন নিয়ে হতাশার কারণ শুধুমাত্র পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে লিবিয়ার রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানে অব্যাহত বিভাজনই নয়, নির্বাচনে যাওয়ার প্রস্তুতির জন্য বিবদমান লিবিয়ার দলগুলোর মধ্যে ন্যূনতম রাজনৈতিক ঐকমত্যের অনুপস্থিতিও এর কারণ। আইনগতভাবে এই নির্বাচনগুলির জন্য একটি সাংবিধানিক ভিত্তির অনুপস্থিতিও রয়েছে, সেইসাথে এই নির্বাচন নিয়ে এখনো বহু কঠিন প্রশ্ন রয়ে গেছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর লিবিয়ান বিষয়ক বিশেষজ্ঞ হানান সালাহ এই প্রশ্নগুলির মধ্যে কয়েকটির কথা উল্লেখ করেন। এর মধ্যে রয়েছে, লিবিয়ান কর্তৃপক্ষ কি ভোটার, প্রার্থী এবং রাজনৈতিক দলগুলির জন্য জবরদস্তি, বৈষম্য ও ভয়ভীতি মুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে পেরেছে? যেহেতু নির্বাচনের নিয়ম নির্বিচারে সম্ভাব্য ভোটার বা প্রার্থীদের বাদ দিতে পারে, কর্তৃপক্ষ কিভাবে ভোটকে অন্তর্ভুক্তিমূলক করার বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারে? ভোটকেন্দ্রের জন্য কি একটি শক্তিশালী নিরাপত্তা পরিকল্পনা কর্তৃপক্ষের রয়েছে? বিচার বিভাগ কি নির্বাচন সংক্রান্ত বিরোধ দ্রুত ও সুষ্ঠুভাবে মোকাবেলা করতে সক্ষম? নির্বাচনের সংগঠকরা কি নিশ্চিত করতে পারেন যে, স্বাধীন পর্যবেক্ষক নিবাচনে থাকবে? এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ভোটদানের জায়গায় প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা যাবে কি? উচ্চ জাতীয় নির্বাচন কমিশন কি ভোটার রেজিস্টারের একটি স্বাধীন ও বাইরের নীরিক্ষার ব্যবস্থা করেছে? তিনি এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, লিবিয়ার এখনকার পরিস্থিতি বিবেচনা করা হলে এর সবই প্রশ্নবিদ্ধ বলে মনে হবে।

প্রয়োজন বিদেশি পক্ষের আন্তরিকতা
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, লিবিয়ার পরিস্থিতির পেছনে যেহেতু বাইরের দেশের ব্যাপক হস্তক্ষেপ রয়েছে তাই নির্বাচনের একটি অনুকূল পরিস্থিতি নিশ্চিত করার জন্য বিদেশী পক্ষগুলোর আন্তরিক হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। জাতিসঙ্ঘ আন্তরিকভাবে লিবিয়ার পরিস্থিতির একটি সমাধান চাইছে বলে মনে হয়। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, তুরস্ক, ইতালি বা জার্মানি লিবিয়ার সঙ্কটের একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান প্রত্যাশা করে বলে মনে হয়। কিন্তু লিবিয়ায় অন্য যে সব পক্ষ এর সাথে যুক্ত তার মধ্যে বিশেষভাবে রাশিয়া ফ্রান্স মিসর বা ইসরাইল-আমিরাত তাদের স্বার্থ নিশ্চিতভাবে পূরণের গ্যারান্টি চায়। নতুন সরকার যদি ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়ার নিশ্চয়তা দেয় তাহলে ইসরাইল লিবিয়ার শান্তিপূর্ণ রূপান্তরকে সমর্থন করবে। আর মুসলিম বিশ্বে ইসরাইলের নীতি বাস্তবায়নের টুলস-দেশ হিসেবে আমিরাতের এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। মিসর তার নিকট প্রতিবেশী এই দেশে বিশেষত লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলে তার স্বার্থের গ্যারান্টি চায়। এটি প্রত্যাশিত ছিল যে, মিসরীয় পৃষ্ঠপোষকতায় দাবাইবা এবং হাফতার মিলিত হবেন, তবে হাফতার সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়ার ভয়ে সরকারকে স্বীকৃতি দেয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। দাবাইবার উত্থানে হাফতারের প্রভাবের ক্ষেত্রগুলোতে তার জনপ্রিয়তা হ্রাস পাচ্ছে। আর মিসর যে বৈঠকের আয়োজন করতে চেয়েছিল তা যদি হয় তবে হাফতার সরকারকে বেনগাজিতে স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেরা করতে বাধা দিতে পারবে না। তবে দাবাইবা সরকারের সাথে মিসরের অর্থনৈতিক সুবিধার বেশ কয়েকটি চুক্তি লিবিয়ার সঙ্কটের প্রতি মিসরীয় দৃষ্টিভঙ্গির একটি উল্লেখযোগ্য উন্নয়নের ইঙ্গিত দেয়।

ত্রিপোলির সাথে সম্পর্ক সুসংহত করা এবং অর্থনৈতিক চুক্তির অনুমোদন দেয়ার বিনিময়ে বিগত বছরগুলোতে মিসর লিবিয়ার পূর্বে তার মিত্রদের যে সমর্থন দিয়েছিল, তার আপেক্ষিক পতন বিভিন্ন পরিবর্তন দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল, যার মধ্যে প্রথমটি ছিল আমেরিকান প্রবণতা। এই অঞ্চলে সঙ্ঘাত শান্ত করার ক্ষেত্রে মিসরীয়-তুর্কি সমঝোতা এবং তুরস্ক ও কাতারের বিরুদ্ধে উপসাগরীয় ফ্রন্টের বিচ্ছিন্নতা, কিন্তু আন্তর্জাতিক এবং আঞ্চলিক অবস্থানে এই উন্নয়ন রাশিয়ার নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার পরে একটি ভিন্ন রুশ অবস্থানের সাথে সাংঘর্ষিক হতে পারে।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে ইসরাইল যেন হয়ে উঠেছে সেই গেটওয়ে যেখান দিয়ে আরব দেশগুলোতে শাসন করতে আগ্রহীদের যেতে হবে। খলিফা হাফতারের ছেলে ইসরাইলের ইহুদিবাদী কর্মকর্তাদের সাথে দেখা করার জন্য তেল আবিবে গিয়েছিলেন ক্ষমতার লড়াইয়ের তার পিতার জন্য সমর্থনের নিশ্চয়তা পেতে। যখন প্রতিশ্রুতি দেয়া হয় যে তিনি ক্ষমতায় পৌঁছানোর পরে ইসরাইলকে লিবিয়ায় পরিচালনা করার জন্য একটি ফাঁকা চেক দেবেন। একই সাথে গাদ্দাফি জুনিয়রের একই পদক্ষেপ নেওয়ার সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেয়া যাবে না যে, কারণ তার পিতার সময় থেকে বেশ কিছু ইসরাইলির সাথে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। তিনি ছিলেন গাদ্দাফি সিনিয়র এবং জায়নবাদীদের মধ্যে যোগসূত্র।

লিবিয়ার জন্য এটা লজ্জাজনক এবং অসম্মানজনক যে প্রত্যেক শাসককে তাদের অবস্থান ধরে রাখতে তেল আবিব যেতে হবে ইসরাইলের আশীর্বাদ পেতে এবং জায়নবাদীদের কাছে নতজানু হতে হবে। ইহুদিবাদী সত্তার প্রতি আনুগত্য ও আনুগত্যের অঙ্গীকার করাই তাদের অবস্থান রক্ষা করা এবং তাদের চেয়ার রাখার একমাত্র উপায় যেন হয়ে উঠেছে।

লিবিয়ায় এখনো দুটি শিবিরের মধ্যে একটি তীক্ষ্ণ বিভাজন রয়ে গেছে। বিদেশী বাহিনী এবং ভাড়াটে সৈন্যরা লিবিয়ার মাটি ছেড়ে যায়নি। বাইরের একটি পক্ষের লক্ষ্যই হলো, মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশে গণতন্ত্র বা নিয়মতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠা বা চলমান থাকতে না দেয়া। গণতন্ত্র সফল হলে তা রাজতন্ত্র বা একনায়কতান্ত্রিক সরকারগুলোর জন্য সঙ্কট নিয়ে আসতে পারে। এই শক্তিটি মিসরে হস্তক্ষেপ করে সামরিক একনায়কত্ব ফিরিয়ে এনেছে। সিরিয়া ইয়ামেনে ক্ষতবিক্ষত পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়াতে ভূমিকা পালন করেছে। তিউনিশিয়ায় গণতান্ত্রিক রূপান্তরকে বাধাগ্রস্ত করে প্রেসিডেন্টকে দিয়ে একনায়কত্ব ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করেছে। সুদানে সামরিক বাহিনীকে দিয়ে আরেক দফা অভ্যুত্থান ঘটানো হয়েছে। লিবিয়া শাসনের জন্য খলিফা হাফতার প্রকল্প তাদেরই নেয়া। এখন গাদ্দাফিপুত্র বা খলিফা হাফতারকে নির্বাচনের দৃশ্যপটে নিয়ে আসা তা থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। তাদের কেউ কেউ একটি ভীতিকর ধারণা ছড়িয়ে দিতে চায় যে, একটি লৌহমুষ্টি ও একনায়ক ধরনের ব্যক্তির নেতৃত্বই লিবিয়ায় স্থিতি আনতে পারে।

 


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us