সেলেনিয়াম মূত্রাশয়ের ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়
সেলেনিয়াম মূত্রাশয়ের ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায় - ছবি সংগৃহীত
সেলেনিয়াম একটি মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট। যেসব উপাদান শরীরে খুব অল্প পরিমাণে প্রয়োজন হয়। সাধারণত প্রতিদিন ১০০ মাইক্রোগ্রামের কম লাগে তাদেরকে মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট বলা হয়। সম্প্রতি ডারমাউথ মেডিক্যাল স্কুলের একদল গবেষক পরিচালিত গবেষণা থেকে জানা যায়, সেলেনিয়াম স্বাভাবিকের চেয়ে উচ্চমাত্রায় থাকলে তা স্ত্রীলোক এবং স্বল্পমাত্রার ধূমপায়ীদের মূত্রাশয়ের ক্যান্সার প্রতিরোধে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। এ গবেষণার কাজে প্রায় ১০ হাজার জনকে বাছাই করা হয়।
এর মধ্যে এক গ্র“পকে প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত সেলেনিয়াম দেয়া হয়। আর অন্য গ্র“পকে দেয়া হয় দৈনিক সেলেনিয়ামের যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু। কয়েক বছর পর দেখা গেল যে, যারা বেশি পরিমাণে সেলেনিয়াম গ্রহণ করেছেন তাদের মধ্যে মূত্রাশয়ের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা কম ঘটেছে। গবেষকরা বলেন, টিউমার রোধকারী জিন পি-৫৩ -এর মিউটেশনের ফলে সৃষ্টি হয় অনেক ক্যান্সার। সেলেনিয়াম এ ক্যান্সারগুলো হ্রাস করতে পারে।
এটিই প্রথম গবেষণা যার মাধ্যমে সেলেনিয়াম ও পি-৫৩ -জিনের মিউটেশনজনিত মূত্রাশয়ের ক্যান্সারের ঝুঁকি হ্রাসের বিষয়টি প্রমাণ করা হয়েছে। আমাদের চার পাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে সেলেনিয়াম সমৃদ্ধ খাদ্যোপাদান। সেলেনিয়ামের প্রাকৃতিক উৎসগুলো হচ্ছেÑ খেজুর, মাশরুম, সরিষা বীজ, সূর্যমুখীর বীজ, যব বা বার্লি, রসুন, বাছুরের কলিজা, মুরগির গোশত, টুনা মাছ প্রভৃতি। এ খাবারগুলো বেশি পরিমাণে খেলে কিন্তু শরীরে সেলেনিয়ামের মাত্রা বৃদ্ধি পাবে।
রিসার্চ অফিসার, আইসিডিডিআর-বি, মহাখালী
ডায়াবেটিসে অন্ধত্ব প্রতিরোধযোগ্য
ডা: নুরে আলম
গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার আবদুল জলিল (৫৫) ঢাকার শান্তিনগর এলাকায় থাকেন। ছয়জনের সংসার টানতে হয় রিকশা চালিয়ে। সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো দেখা দিয়েছে ডায়াবেটিস। প্রায় ১০ বছর ধরে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। চিকিৎসক ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য ওষুধ দিলেও টাকার অভাবে নিয়মিত সেবন করতে পারেন না। কোনো দিন আয় বেশি হলে সে দিন ওষুধ কিনে সেবন করেন। রক্তের সুগার পরীক্ষাও করা হয় না নিয়মিত। বছর দুয়েক ধরে তার চোখে সমস্যা দেখা দেয়। চোখের সামনে কালো কালো দাগ ঘোরাফেরা করে, চোখে আবছা আবছা দেখেন, কয়েক হাত দূরের জিনিসও দেখেন না। এ জন্য বেশ কয়েকবার এক্সিডেন্টও করেন। ভাগ্যের জোরে যাত্রীসহ বেঁচে যান। এখন আগের মতো রিকশা টানতে পারেন না।
প্রতিদিন দোয়া দরূদ পড়ে বাসা থেকে বের হন। চোখের সমস্যার ব্যাপারে এক প্রতিবেশীর সাথে আলোচনা করলে তাকে সাইল্ড সাইট ফাউন্ডেশন (সিএসএফ) পরিচালিত শান্তিনগরের একটি হাসপাতালে যোগাযোগ করতে বলেন। চিকিৎসকরা পরীক্ষা করে তাকে জানান, ডায়াবেটিসের কারণে তার চোখে ছানি পড়েছে ও রেটিনা নামে চোখের অংশে হাল্কা সমস্যা দেখা দিয়েছে। চিকিৎসকরা আরো জানিয়েছেন, এ রোগ নির্ণয়ে দেরি হলে রেটিনার সমস্যা আরো জটিল আকার ধারণ করত, এমনকি তিনি অন্ধ হতেন। ওই হাসপাতালে চোখে ছানি অপারেশনের পর এখন আবদুুল জলিল ভালো দেখতে পাচ্ছেন। চিকিৎসকের শিখিয়ে দেয়া মতো ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করছেন। এখন তিনি ভালো আছেন।
ডায়াবেটিস চোখের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। ডায়াবেটিস আক্রান্তরা ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি, ছানি পড়া, গ্লোকোমায় আক্রান্ত হয়ে অন্ধ হতে পারেন। গবেষণায় দেখা গেছে, শুধু ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির কারণে প্রায় চার কোটি লোক চিরকালীন অন্ধ হয়ে যায়। মোট ডায়াবেটিস আক্রান্তের প্রায় ৬০ শতাংশ রেটিনার সমস্যায় আক্রান্ত। এ ছাড়া গ্লোকোমা ও ছানি পড়ার জন্য আরো কয়েক লাখ লোক অন্ধত্ব বরণ করেন। বাংলাদেশে এ ধরনের সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও বিশেষজ্ঞদের মতে, অন্ধত্বের প্রধান কারণগুলোর একটি কিন্তু ডায়াবেটিস। অথচ শুধু ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে অন্ধত্ব সহজেই প্রতিরোধ করা যায়। কিন্তু অজ্ঞতা ও অবহেলার কারণে অন্ধত্বের নির্মম পরিণতির শিকার হতে হয়। ছানিজনিত কারণে অন্ধত্ব ছোটখাটো অপারেশনের মাধ্যমে ভালো করা গেলেও ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির কারণে চিরতরে অন্ধ হতে হয়। চিকিৎসা করালেও খুব এটা লাভ হয় না। তবে এ রোগের শুরুতে নির্ণয় করে চিকিৎসা শুরু করলে অন্ধত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি মেলে।
জাতীয় চক্ষু ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা: মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘চোখের গুরুত্বপূর্ণ অংশ রেটিনা। এটি একটি সংবেদনশীল পর্দা যা চক্ষুগোলকের ভেতরের দিকে থাকে, যার উপর আমরা যা দেখি তার ছবি প্রতিফলিত হয়। অতঃপর তা বিভিন্ন নিউরো কেমিক্যাল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মুহূর্তে মস্তিষ্কে পৌঁছে এবং আমরা ছবি দেখি। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের কারণে রেটিনায় সূক্ষ্ম রক্তনালীগুলো বন্ধ হয়ে আসে। এতে একরকম রক্তশূন্যতা অথবা অক্সিজেন স্বল্পতা দেখা দেয়। এর ফলে কেন্দ্রীয় রেটিনাতে পানি ও তৈলজাতীয় পদার্র্থ জমে ফুলে যায় অথবা রেটিনার বিভিন্ন স্থানে নতুন রক্তনালীর সৃষ্টি হয়, রেটিনায় অক্সিজেন সরবরাহ বাড়ানোর জন্য। এসব রক্তনালী স্বাভাবিক রক্তনালীর মতো পরিপক্ব হয় না। এসব নতুন অপরিপক্ব রক্তনালী খুব সহজেই ভঙ্গুর হয়। এতে করে চোখের ভেতর রক্তক্ষরণ হয় ফলে দৃষ্টিশক্তি একেবারেই চলে যায়। তখন কিছুই করার থাকে না। তবে রোগের শুরুতে চিকিৎসা শুরু করতে পারলে দৃষ্টিশক্তি ধরে রাখা সম্ভব।
আবার অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের কারণে চোখের লেন্স অস্বচ্ছ হয়ে যায়। এটাকে বলে ছানি পড়া। এর কারণেও দৃষ্টিশক্তি কমে যায়। দীর্ঘদিনের ছানির কারণে পুরোপুরি অন্ধ হয়ে যান অনেকেই। অথচ মাত্র ২০-৩০ মিনিটের ছোট একটি অপারেশন পারে এ অন্ধত্ব দূর করতে। ডায়াবেটিসের কারণে চোখের চাপ বেড়ে যাওয়ায় দেখা দেয় গ্লোকোমা। এটিও রেটিনায় সমস্যা করে চিরতরে অন্ধ করে দিতে পারে।
ডায়াবেটিসের কারণে অন্ধত্ব বরণ করতে হয় এ সত্যটি এখনো দেশের বেশির ভাগ মানুষই জানেন না। অথচ এ অন্ধত্ব প্রতিরোধযোগ্য। শুধু ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে অন্ধত্ব প্রতিরোধ করা যায়। চিকিৎসকের পরামর্শমতো ওষুধ সেবন, নিয়মিত ব্যায়াম ও নিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। বছরে দু’বার চোখ পরীক্ষা করান। একটু সচেতন হলে দেশ মুক্তি পাবে অন্ধত্বের অভিশাপ থেকে।