পুরুষরা কেন স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হন!
পুরুষরা কেন স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হন! - ছবি : সংগৃহীত
সাধারণত নারীদেরই স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হতে দেখা যায়। অর্থাৎ একে নারীদের রোগ বলেই ধরে নেয়া হয়। কিন্তু বেশির ভাগ মানুষই হয় তো জানেন না যে পুরুষরাও স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। যদিও ব্যাপারটা খুবই বিরল, কিন্তু তা-ও ছেলেরাও স্তন ক্যানসারের মতো মারণ রোগের শিকার হতে পারে। ক্লিনিক্যাল তথ্য বলছে, পুরুষদের স্তন ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কা ১ শতাংশেরও কম। আরো ভালোভাবে বুঝিয়ে বলতে গেলে হিসেবটা দাঁড়াবে খানিকটা এই রকম- প্রায় ২৬৫০ জন পুরুষ এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে, আর তার মধ্যে থেকে প্রায় ৫৩০ জন স্তন ক্যানসারে মারা যেতে পারে। ফলে এই হিসাবটা থেকে স্পষ্ট যে পুরুষদের ক্ষেত্রে স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা খুবই কম। তবে এর আশঙ্কা একেবারেই উড়িয়ে দেয়া যায় না, তাই এই ব্যাপারে বিস্তারিত জেনে নেয়া উচিত। এর পাশাপাশি পুরুষদের স্তন ক্যানসারের রোগ লক্ষণ সম্পর্কেও ওয়াকিবহাল থাকা ভালো।
এ ক্ষেত্রে বেশি ঝুঁকি কাদের?
সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের তরফে জানানো হয়েছে যে পুরুষদের ক্ষেত্রে বয়স বাড়ার সাথে সাথে স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, সাধারণত পঞ্চাশোর্ধ্ব পুরুষদেরই স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হতে দেখা যায়। আর স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি কমাতে নিয়মিত ব্রেস্ট স্ক্রিনিং করাতে হবে। তাতে স্তন ক্যানসারের আশঙ্কা অনেকাংশেই কমে যাবে।
পুরুষদের স্তন ক্যানসারের কারণ
পুরুষদের স্তন ক্যানসারের কারণ এখনো স্পষ্ট নয়। চিকিৎসকেরা বলেন যে, যখন পুরুষদের স্তনের কিছু কোষ অন্যান্য সুস্থ কোষের তুলনায় দ্রুত বিভাজিত হতে থাকে, তখনই বুঝতে পারা যায় যে, সেটা স্তন ক্যানসার। এ বার কোষ বিভাজিত হতে হতে একসাথে জমা হয়ে টিউমার সৃষ্টি করে এবং যা ক্রমশ আশপাশের কলাকোষে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। শুধু কলাকোষেই নয়, এই টিউমার লিম্ফ নোড এবং দেহের অন্যান্য অংশেও ছড়িয়ে পড়তে পারে।
পুরুষদের স্তন ক্যানসারের আশঙ্কা কোথা থেকে শুরু হয়?
প্রতিটা মানুষই যখন জন্মায়, তখন তাদের স্তনে খুবই স্বল্প পরিমাণ কলাকোষ থাকে। দুগ্ধ উৎপাদনকারী গ্ল্যান্ড বা লোবিউলস এবং স্তনবৃন্তে দুগ্ধ বহনকারী নালির মাধ্যমেই স্তনের কলাকোষ গঠিত হয়েছে। বয়ঃসন্ধির সময় থেকে মেয়েদের ক্ষেত্রে স্তনের কলাকোষ ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করে, কিন্তু পুরুষদের ক্ষেত্রে সেটা হয় না। আর যে হেতু, পুরুষরাও স্বল্প পরিমাণ স্তন কলাকোষ নিয়ে জন্মায়, তাই তাদেরও স্তন ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়।
পুরুষদের স্তন ক্যানসার কি উপসর্গ দেখে বাইরে থেকে বোঝা যাবে?
পুরুষদের স্তন ক্যানসারের ক্ষেত্রে নানান রকম উপসর্গ দেখা যায়। আমেরিকান ক্যানসার সোসাইটি (ACS)-এর তরফে কয়েকটি উপসর্গের বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
যেকোনো একটা স্তনে কোনো স্ফীত অংশ, যেখানে ব্যথা থাকবে না
স্তনবৃন্তের সঙ্কোচন, অথবা স্তনবৃন্তে আলসারের মতো হয়ে যাওয়া এবং সেখান থেকে ডিসচার্জ বেরোনো
স্তন কুঁচকে যাওয়া
স্তন অথবা স্তনবৃন্তের চামড়া বিবর্ণ হয়ে যাওয়া
যদিও উপরোক্ত উপসর্গগুলো পুরুষদের স্তন ক্যানসারের প্রথম দিকের উপসর্গ। এ ছাড়াও আরো অনেক উপসর্গ আছে, যা থেকে সহজেই বোঝা যাবে যে, ক্যানসার ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে। আর সেই উপসর্গগুলো হলো-
লিম্ফ নোড ফুলে যাওয়া
স্তনের ব্যথা
হাড়ের ব্যথা
এই উপসর্গগুলো দেখলেই বোঝা যাবে যে, বিষয়টা গুরুতর হয়ে উঠছে।
পুরুষদের মধ্যে কী কী ধরনের স্তন ক্যানসার দেখা যায় এবং তা নির্ণয় করা হবে কী ভাবে?
সিবিসি (CBC) জানাচ্ছে, পুরুষদের মধ্যে সাধারণত তিন ধরনের স্তন ক্যানসার দেখা যায়। সেগুলি হলো-
ইনভেসিভ ডাক্টাল কার্সিনোমা :
এই ধরনের স্তন ক্যানসারের ক্ষেত্রে রোগটা শুরু হয় ডাক্ট বা নালির মধ্যে থেকে। তার পর ধীরে ধীরে তা নালির বাইরের দিকে স্তনের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ে।
ইনভেসিভ লোবিউলার কার্সিনোমা :
ক্যানসার কোষ তৈরি হতে থাকে লোবিউলসে এবং তার পর সেটা ছড়িয়ে পড়ে স্তনের বিভিন্ন কলাকোষে।
ডাক্টাল কার্সিনোমা ইন সিটু :
এর থেকে ইনভেসিভ স্তন ক্যানসার হতে পারে। কারণ এটা স্তনের বিভিন্ন নালির উপর আস্তরণ হিসেবে থাকে, আর স্তনের অন্যান্য কলাকোষে ছড়ায় না।
পুরুষ এবং মহিলা উভয়ের ক্ষেত্রে ম্যামোগ্রাম, আল্ট্রাসাউন্ড, নিপল ডিসচার্জ পরীক্ষা এবং বায়োপ্সির মাধ্যমে স্তন ক্যানসার নির্ণয় করা হয়। এ ছাড়াও সকলেরই প্রতিদিন নিজেদের স্তন পরীক্ষা করতে হবে। তাতে রোগ নির্ণয়ে অনেক সুবিধা পাওয়া যাবে।
ছেলেদের স্তন ক্যানসারের ক্ষেত্রে কি জিনের কোনো ভূমিকা থাকে?
স্তন ক্যানসারকে জেনেটিক মিউটেশনের ফলাফল হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। যাদের পরিবারে স্তন ক্যানসারের ইতিহাস রয়েছে, সেই পরিবারের পুরুষদেরও স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই বেড়ে যায়। যে সব পুরুষদের শরীরে বিআরসিএ১ (BRCA1) এবং বিআরসিএ২ (BRCA2) জিন বংশপরম্পরায় থাকে, তাদের স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি সাধারণত বেশি হয়। তবে পুরুষদের স্তন ক্যানসারের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র জেনেটিক মিউটেশনই দায়ী, এমনটা নয়। আরও অনেক বিষয় রয়েছে, যার উপর স্তন ক্যানসারের সম্ভাবনা নির্ভর করে।
চিকিৎসা :
স্তন ক্যানসারের ক্ষেত্রে টিউমারের আকারের উপর ভিত্তি করে চিকিৎসা করা হয়। সার্জারি, কেমোথেরাপি, রেডিয়েশন থেরাপি, হরমোন থেরাপি এবং টার্গেটেড থেরাপির মাধ্যমে স্তন ক্যানসারের চিকিৎসা করা হয়। সাধারণত স্তনের কলাকোষ বাদ দেয়ার জন্য অস্ত্রোপচার বা সার্জারি করা হয়ে থাকে। স্তন ক্যানসার যদি শুরুর দিকে বা প্রথম ধাপেই ধরা পড়ে যায়, তা হলে পুরোপুরি সেরে ওঠার সম্ভাবনা থাকে।
পুরুষদের স্তন ক্যানসারের ক্ষেত্রে ঝুঁকির কিছু কার ণ:
কিছু বিষয় রয়েছে, যেগুলো পুরুষদের স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি অনেকাংশে বাড়িয়ে দেয়। এই বিষয়গুলো হলো-
বয়স :
এ ক্ষেত্রে মূল চিন্তার বিষয় হলো- বয়স। বয়স বাড়ার সাথে সাথে ছেলেদের স্তন ক্যানসারের ঝুঁকিও বাড়তে থাকে। পঞ্চাশ পার করলেই পুরুষদের তাই সচেতন হতে হবে।
ইস্ট্রোজেনের প্রভাব :
যাঁরা ইস্ট্রোজেন সম্পর্কিত ওষুধ খান, তাদের বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। আসলে প্রস্টেট ক্যানসারের চিকিৎসায় ইস্ট্রোজেন থেরাপি (এক ধরনের হরমোন থেরাপি) ব্যবহৃত হয়। তাই এমন থেরাপি চললে স্তন ক্যানসারের সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
বংশগত স্তন ক্যানসার :
যাদের পরিবারে স্তন ক্যানসারের ইতিহাস রয়েছে, তাদের স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি থাকে। ধরা যাক, কোনো ব্যক্তির মা অথবা রক্তের সম্পর্কের কোনো নিকটাত্মীয়ের স্তন ক্যানসার রয়েছে, তা হলে সেই ব্যক্তির স্তন ক্যানসার হতে পারে।
লিভারের রোগ :
লিভারের নির্দিষ্ট কিছু রোগ, যেমন- লিভার সিরোসিস থাকলে তা পুরুষ হরমোন হ্রাস করে এবং মহিলা হরমোনের মাত্রা বৃদ্ধি করে। যা স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে।
ওবেসিটি :
ওবেসিটির সাথে সম্পর্ক রয়েছে দেহের উচ্চমাত্রার ইস্ট্রোজেনের। যা স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়।
শুক্রাশয়ের কোনো রোগ বা সার্জারি :
শুক্রাশয়ে ইনফ্লেমেশন অথবা সার্জারি করে শুক্রাশয় বাদ দেয়া হলে পুরুষদের স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি অনেকাংশে বৃদ্ধি পায়।
সূত্র : নিউজ ১৮