হার্ট অ্যাটাক না হার্টবার্ন, বোঝা যাবে কিভাবে?
হার্ট অ্যাটাক না হার্টবার্ন, বোঝা যাবে কিভাবে? - ছবি সংগৃহীত
আচমকা বুকের কাছে এমন প্রদাহ হয় যে, তাতে অনেকেই ভাবেন হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। ব্যাপারটা কি আদৌ তা-ই? আসলে হার্ট অ্যাটাক আর হার্টবার্ন বা বুকের কাছে প্রদাহ এই দুইয়ের উপসর্গ মোটামুটি একই ধরনের হয়। মণিপাল হসপিটালস্ হোয়াইটফিল্ড-এর কার্ডিওলজি এবং ইলেকট্রোফিজিওলজি কনসালট্যান্ট ড. সন্দেশ প্রভু এই দুইয়ের পার্থক্য ভালো করে বুঝিয়ে দিয়েছেন। দেখে নেয়া যাক, কী কী জানিয়েছেন তিনি। তবে সবার আগে জেনে নেব যে হার্ট অ্যাটাক ও হার্টবার্ন কী।
হার্ট অ্যাটাক কী?
করোনারি ধমনী হলো, রক্তবাহী নালী যেগুলি হৃদযন্ত্রের পেশিতে রক্ত সঞ্চালন করে। এই করোনারি ধমনী সঙ্কীর্ণ হয়ে যায় এবং অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। কারণ সেখানে কোলেস্টেরল জমতে থাকে। ফলে রক্ত খুবই কম পরিমাণে হৃদযন্ত্রে পৌঁছয়। এই কারণে যে সব জায়গার রক্তথলি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সেই সব জায়গার হৃদযন্ত্রের কলাকোষ নষ্ট হয়ে যায়।
হার্টবার্ন কী?
হার্টবার্ন আসলে হৃদযন্ত্রের কাছে প্রদাহ। এটা আসলে অ্যাসিড রিফ্লাক্সের উপসর্গ। আর এটা তখনই হয়, যখন পাকস্থলী থেকে উৎপন্ন অ্যাসিড খাদ্যনালীতে চলে আসে, তাতে বুকে প্রদাহ শুরু হয়। বা আরো সহজভাবে বলা যায় যে বুকের কাছে জ্বালা জ্বালা অনুভূতি হয়। কখনো কখনো ভারী খাবার খাওয়ার পর হার্টবার্নের মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে।
আচমকা বুকে ব্যথা উঠলে কী ভাবে বুঝব যে, সেটা হার্টবার্ন না হার্ট অ্যাটাক?
এই দু’টি সাধারণ ভাবে বোঝা একটু কঠিন। কারণ এই দুইয়ের ক্ষেত্রে উপসর্গ মোটামুটি একই রকম।
হার্ট বার্নের উপসর্গ :
অনেক সময় দেখা যায়, বুকে ব্যথা হচ্ছে। এবার সেই বুকে ব্যথা যদি ধীরে ধীরে পুরো বুকে, কাঁধে, গলায় এবং চোয়ালে ছড়িয়ে পড়ছে, তা হলে বুঝতে হবে সেটা হার্টবার্ন। সাধারণত ভারী খাবার খাওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর থেকে এই ব্যথা হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়।
হার্ট অ্যাটাকের উপসর্গ :
হঠাৎ করে বুকে ব্যথা শুরু হলে সেটাকে সাধারণত হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ বলেই গণ্য করা হয়। বুকে ব্যথা ছাড়াও কিছু কিছু উপসর্গ রয়েছে। সেগুলি হলো-
খুবই ক্লান্ত হয়ে পড়া
বুকে চাপ অনুভূত হওয়া
প্রচণ্ড ঘাম
শ্বাস নিতে সমস্যা
বুকে ব্যথা শুরু হয়ে ধীরে ধীরে তা চোয়াল, পিঠ এবং হাতে ছড়িয়ে পড়া
বমি-বমি ভাব
বমি হওয়া
মাথা হালকা হয়ে আসা অথবা মাথা ঘোরানো
বিভ্রান্তি
হার্ট অ্যাটাক যে কারওরই হতে পারে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বেশি হয়। সেই বিষয়ে আলোচনা করে নেওয়া যাক।
ওবেসিটিতে আক্রান্তদের
ধূমপান করেন যারা
পরিবারের কারোর ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন, হাই কোলস্টেরলের সমস্যা থাকলে অথবা হৃদযন্ত্রের সমস্যা থাকলে
পরিবারের হার্ট অ্যাটাকের ইতিহাস থাকলে
আগেও হার্ট অ্যাটাক হয়ে থাকলে
মানসিক চাপ অথবা ঘুমে সমস্যা
এই ধরনের ক্ষেত্রে বুকে সামান্য অস্বস্তি বা ব্যথা অনুভূত হলে সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।
হার্টবার্ন আর হার্ট অ্যাটাকের উপসর্গের সাদৃশ্য :
বুকে ব্যথা
বুকে প্রদাহ বা জ্বালা-জ্বালা ভাব
বমি-বমি ভাব
বমি হওয়া
বদহজম
হার্টবার্ন আর হার্ট অ্যাটাকের উপসর্গের পার্থক্য :
হার্টবার্ন হলো অ্যাসিড রিফ্লাক্সের উপসর্গ। সেখানে করোনারি ধমনী অবরুদ্ধ হয়ে পড়লে হার্ট অ্যাটাক হয়। কারণ করোনারি ধমনী অবরুদ্ধ হলে হৃদযন্ত্রে ঠিকভাবে রক্ত পৌঁছতে পারে না।
ভারী খাবার খাওয়ার পরেই সাধারণত হার্টবার্ন হয়। কিন্তু হার্ট অ্যাটাক যেকোনো সময়ে হতে পারে।
হার্টবার্নের কারণে গলা-বুক জ্বালা করে, সেইসাথে গলায় টক-টক স্বাদ অনুভূত হয়। বিশেষ করে ঝুঁকলে এবং শুলে এটা বাড়ে। আবার অন্য দিকে হার্ট অ্যাটাকের ক্ষেত্রে বুকে চাপ অনুভূত হয় এবং ব্যথাও করে। সেই ব্যথা ধীরে ধীরে কাঁধে, গলায় ছড়িয়ে পড়ে। সাথে থাকে মারাত্মক ক্লান্তি, ঠাণ্ডা ঘাম আর আচমকা মাথা ঘোরানো।
হার্টবার্নের বুকে ব্যথার ক্ষেত্রে একটা অ্যান্টাসিড খেয়ে নিলেই ব্যথা কমে যায়। কিন্তু হার্ট অ্যাটাকের ক্ষেত্রে অ্যান্টাসিড খেলেও বুকে ব্যথা কমবে না।
হার্টবার্ন সেভাবে মারণ বা ঘাতক নয়। সেখানে হার্ট অ্যাটাকে জীবন সংশয়ও হতে পারে, তাই সাথে সাথে চিকিৎসা শুরু করতে হবে।
হার্টবার্নের ক্ষেত্রে কখন ডাক্তার দেখানো উচিত?
হার্টবার্ন খুবই সাধারণ। আর ঘরোয়া টোটকা অথবা অ্যান্টাসিড জাতীয় ওষুধের মাধ্যমে এর চিকিৎসা করা যায়। মারাত্মক এবং মাঝে মাঝে হার্টবার্ন হলে গুরুতর শারীরিক সমস্যা হতে পারে। খাদ্যনালীর সমস্যা, গ্যাস্ট্রোসোফেজিল রিফ্লাক্স ডিজিজ (Gastroesophageal Reflux Disease) বা GERD, শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা, ক্রমাগত কাশি এমনকী খাদ্যনালি ক্যানসার পর্যন্ত হতে পারে।
তাই জেনে নেয়া যাক, হার্টবার্ন কোন পর্যায়ে গেলে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
হার্টবার্ন মারাত্মক আকার ধারণ করলে
খাবার গিলতে অসুবিধা হলে
কোনো চেষ্টা ছাড়াই ওজন কমে যেতে শুরু করলে
অ্যান্টাসিড খাওয়ার পরেও দু’সপ্তাহ বা তার বেশি সময় ধরে হার্টবার্ন না-কমলে
হার্টবার্নে বুকের ব্যথায় কাজ করতে অসুবিধা হলে
কার্ডিয়াক বনাম নন-কার্ডিয়াক চেস্ট পেইন :
হৃদযন্ত্রের সমস্যার জেরে কার্ডিয়াক চেস্ট পেইন হয়। হৃদযন্ত্রের বিভিন্ন রকম রোগই এর কারণ, যেমন-
হার্ট অ্যাটাক
অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিস
করোনারি হার্ট ডিজিজ
নন-কার্ডিয়াক চেস্ট পেইনের ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলি দায়ী, সেগুলি হল-
খাদ্যনালির সমস্যা (গ্যাস্ট্রোসোফেজিল রিফ্লাক্স ডিজিজ, এসোফেজিল মোটিলিটি ডিজঅর্ডার ইত্যাদি)
ফুসফুসের অবস্থা
পেটের গোলমাল
মানসিক চাপ, উত্তেজনা এবং ডিপ্রেশনের মতো মানসিক সমস্যা
গ্যাস্ট্রোইন্টেস্টিনাল সমস্যা কী ভাবে হৃদযন্ত্রের উপর প্রভাব ফেলে?
ইন্টেস্টিনাল এস্কেমিয়া : প্লাক তৈরি হয়ে অন্ত্রের ধমনী অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে।
ক্রোনিক আট্রিয়াল এবং ইন্টেস্টিনাল ডিসরিদমিয়া (CAID) নামে এক ধরনের ডিজঅর্ডার।
অন্ত্রের মাইক্রোবিয়াল কমিউনিটিতে পরিবর্তনের সঙ্গে অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিস, হার্ট ফেলিওর এবং অন্যান্য কার্ডিওভাসকুলার রোগের যোগসূত্র রয়েছে।
খাদ্যনালীর পেশিতে খিঁচ ধরা এবং গল ব্লাডারে ব্যথার কারণে বুকে ব্যথা হতে পারে।
পেটের উপরের অংশে ব্যথা বা অস্বস্তিকে এপিগ্যাসট্রিক ব্যথা বলে গণ্য করা হয়। হজমের সমস্যা, পেপটিক আলসার রোগ, গ্যাসট্রাইটিস, অ্যাসিড রিফ্লাক্স ইত্যাদি কারণে এপিগ্যাস্ট্রিক ব্যথা হতে পারে। এটা আবার আসন্ন হার্ট অ্যাটাকেরও লক্ষণ হতে পারে।
রোগ নির্ণয় :
হার্টবার্ন রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে ডাক্তাররা নিম্নোক্ত পরীক্ষাগুলো করাতে বলবেন-
এন্ডোস্কোপি, খাদ্যনালিতে সমস্যা রয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখার জন্যই এই পরীক্ষা করা হয়।
অ্যাসিড রিফ্লাক্স রয়েছে কি না, তা দেখতে অ্যাম্বুলেটরি অ্যাসিড প্রোব।
খাদ্যনালির উপর কতটা চাপ রয়েছে, তা দেখার জন্য এসোফেজিল মোটিলিটি টেস্টিং।
হার্ট অ্যাটাক নির্ণয়ের ক্ষেত্রে ডাক্তারবাবু প্রথমে পুরো পরিবারের রোগের ইতিহাস জানতে চাইবেন। সেইসাথে ঝুঁকি সংক্রান্ত বিষয়গুলোরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাবেন। যে পরীক্ষাগুলো করানো হয়, সেগুলো নিচে উল্লেখ করা হলো -
ইলেকট্রোকার্ডিওগ্রাম (ইসিজি)
রক্ত পরীক্ষা
ইকোকার্ডিওগ্রাম
করোনারি ক্যাথিটারাইজেশন (অ্যাঞ্জিওগ্রাম)
সূত্র :নিউজ ১৮