একটি ঐতিহাসিক ষড়যন্ত্র যেভাবে রুখে দিলেন মওলানা ভাসানী
মওলানা ভাসানী - ছবি সংগৃহীত
বাংলাদেশের টাঙ্গাইল একটি উল্লেখযোগ্য জেলা। এখানে রয়েছে অনেক ঐতিহাসিক ঘটনা। শহর থেকে দুই কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে রয়েছে ঐতিহাসিক কাগমারী ও সন্তোষ এলাকা। অথচ এর পেছনে আছে এক ঐতিহাসিক রক্তাক্ত ঘটনা যা শুধু বিস্ময়ের উদ্রেক করে।
আজকের যে সন্তোষ তার নাম ছিল খোশনদপুর। দিল্লিতে বাদশাহ আওরঙ্গজেবের অভিষেক হয় ১৬৫৯ সালে। দাওয়াত পান ভারতের বিভিন্ন এলাকার জ্ঞানী-গুণী, পণ্ডিতসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। এর মধ্যে ছিলেন রাজন্যবর্গ, সুসাহিত্যিক, শিল্পী, আলেম, দরবেশ অনেকেই। এ অনুষ্ঠানে দাওয়াত পান সুদূর কাশ্মিরের একজন বিখ্যাত কামেল হজরত শাহজামান রহ:।
হজরত শাহজামান জৌলুশপূর্ণ অভিষেক অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন দ্বীনি আন্দোলনের ব্যাপারে সহযোগিতার মনোবাসনা বুকে নিয়ে। কারণ তিনি জানতেন বাদশাহ আলমগীর একজন আধ্যাত্মিক জ্ঞানসম্পন্ন আল্লাহর ওলি। তিনি ডেকেছেন নিশ্চয়ই এর মধ্যে দ্বীন প্রচারের ব্যাপারে একটা বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণের সিদ্ধান্ত হবে।
ইমামুর রব্বানী শায়খ আহমদ মোজাদ্দেদে আলফে সানী রহ: পরিকল্পিত ও তারই সুযোগ আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকারী খাজা মাসুম রহ: পরিচালিত মিশনারির প্রস্তুতি নিতেই জমায়েত হয়েছিলেন অভিষেক অনুষ্ঠানে।
বঙ্গীয় এলাকার রিপোর্ট পর্যবেক্ষণ করে পরিষদবর্গ দেখলেন, মোমেনশাহী এলাকার কিছু জায়গা সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময় থেকেই দেখাশুনার লোক নেই। তাই বাদশাহের নির্দেশেই এলাকাগুলোর জন্য রেইনফোর্সমেন্ট হিসেবে অন্তত একজনকে পাঠানো প্রয়োজন- এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। টাঙ্গাইল শহরের দক্ষিণসংলগ্ন আটিয়া পরগনা এবং মধুপুরগড়ের বিস্তৃত এলাকা রসূলপুর পরগনা- এ দুটোর মাঝখানে কাগমারী পরগনা। এখানে একজন শাসক প্রয়োজন। বাদশাহ আওরঙ্গজেব স্বয়ং হজরত শাহজামান কাশ্মিরি রহ:কে এ এলাকার শাসক নির্বাচিত করলেন। মিশনারি কাজের ব্যয়ভারের জন্য তামার পাতায় লিখে দিলেন ওয়াকফ দানপত্র। বাদশাহ বাইশটি গ্রাম এতে লিখে দিলেন। এ বাইশটি গ্রামের মধ্যে একটি গ্রাম হলো খোশনদপুর।
হজরত পীর শাহজামান কাশ্মিরি সুদূর দিল্লি থেকে চলে এলেন মোমেনশাহী জেলার টাঙ্গাইলের এক প্রত্যন্ত এলাকা কাগমারী পরগনায়। তিনি এসেই পার্শ্ববর্তী আটিয়া, রসুলপুর ও কিল্লাআতা (কালিহাতী) পরগনার কর্মীদের পরামর্শক্রমে চারটি পরগনার মাঝখানে খোশনদপুর কেন্দ্রস্থল হিসেবে ইসলাম প্রচার মিশনের কেন্দ্রীয় অফিস স্থাপন করলেন।
অল্প দিনের মধ্যে এলাকার লোকজন হজরতের সহযোগিতার জন্য এগিয়ে এলো। ওয়াকফের আয় থেকে প্রতিষ্ঠা করল পর্যায়ক্রমে মসজিদ, মাদ্রাসা, পশু হাসপাতাল, মুসাফির খানা, দাতব্য চিকিৎসালয় ইত্যাদি। কোনো কোনো দরিদ্র এলাকায় অস্থায়ীভাবে লঙ্গরখানাও প্রতিষ্ঠা করেন।
হজরত শাহজামানের খানকায় হিন্দু, মুসলমান নির্বিশেষে ফাসিী, আরবি ভাষা ও ধর্মশিক্ষা গ্রহণের জন্য আসতে থাকে। মুসলিম ছেলেমেয়ে, বয়স্ক লোকদের জন্য কুরআন ও হাদিস শিক্ষা কেন্দ্র গড়ে তুললেন পীর সাহেব।
খোশনদপুরের উত্তরে বাটনা গ্রামের এক এতিম কিশোরকে পেলেন পীর সাহেব শিষ্য হিসেবে। সে শিক্ষা ও সাহচর্য লাভের জন্য এলো। পালকপুত্র হিসেবে গ্রহণ করলেন তিনি। এক সময় ইসলাম ধর্মের প্রতি মুগ্ধ হয়ে ছেলেটি ইসলাম গ্রহণ করল। আগে তার নাম ছিল ইন্দ্রনারায়ণ। ইসলাম কবুলের পর নাম রাখলেন শাহ এনায়েত উল্লাহ চৌধুরী।
এনায়েতুল্লাহ হলেন পীর শাহজামানের যোগ্য উত্তরসূরি। তাকে শেখানো হলো আরবি ফারসি ভাষা এবং শরিয়ত ও মারেফতের জ্ঞান। লালন পালন করেন পীর সাহেব। তাকে গড়ে তুললেন আধ্যাত্মিক ও জাগতিক শিক্ষায়।
হজরত শাহজামান সম্রাট আলমগীরের দেখা করা, দোয়া ও আশীর্বাদের জন্য তাকে নিয়ে দিল্লি যান। বাদশাহ খুশি হলেন তাকে দেখে। তারপর সমগ্র কাগমারী পরগনার ওয়াকফ স্টেটের অন্তর্ভুক্ত করে এ ব্যাপারে মুর্শীদ কুলী খানকে সার্বিক দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেন।
মুর্শীদ কুলী খানের সঙ্গে পীর শাহজামানের পূর্বের পরিচয় ছিল। তিনি মুির্শদাবাদের নবাব পরিবারের এক কন্যার সঙ্গে এনায়েতুল্লাহর বিয়ের ব্যবস্থা করলেন। অল্প দিন পরে কাগমারী পরগনার প্রতিষ্ঠাতা হজরত শাহজামান এত প্রস্তুতি গ্রহণ করার পর ১৭১৮ সালে ৯১ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। এ সময় এনায়েতুল্লাহর বয়স ছিল মাত্র ৩২ বছর। তিনি মিশনের দায়িত্ব ভার গ্রহণ করেন। বিদায়কালে পুত্রকে কাছে ডেকে মিশনের সব দায়িত্ব দিয়ে হজরত শাহজামান রহ: হাত উঠিয়ে দোয়া করেন আল্লাহর দরবারেÑ ‘হে আল্লাহ! আমার ছেলেকে তার দায়িত্ব পালনে সাহায্য করুন।’
হজরত শাহজামান কাশ্মিরির যোগ্য শিষ্য হয়ে ওঠেন শাহ এনায়েতুল্লাহ চৌধুরী। কাগমারী পরগনা মিশনের কাজ অত্যন্ত কামিয়াবির সাথে এগিয়ে চলছিল। শাহজামানের মিশনের অর্থানুকূল্যে বিভিন্ন স্থানে ২২টি প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ মসজিদ, মাদরাসা, এতিমখানা, পাঠাগার, দাতব্য চিকিৎসালয়, পশু হাসপাতাল, লঙ্গরখানা প্রভৃতি পুরো গতিতে চলছিল। দলে দলে নিম্নবর্ণের হিন্দু নারী-পুরুষ ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় নিচ্ছিল।
এনায়েতুল্লাহর আপন চাচা ব্রজমোহন চৌধুরীকে নিয়েছিলেন বৈষয়িক কাজ, হিসাব নিকাশ ও আয় ব্যয়ের ব্যাপারে দেখাশুনার জন্য ও ওয়াকফ স্টেটের নায়েব হিসেবে। তিনি নিজ ধর্মই পালন করতেন।
কিছু দিন পর এনায়েতুল্লাহ ভাবলেন, মহান আল্লাহর ঘর কাবা ও রাসূলের রওজা মোবারক যাওয়ার এটাই উপযুক্ত সময়। আল্লাহ তায়ালা তাকে যে পবিত্র দায়িত্ব দিয়েছেন তার জন্য শুকরিয়া জ্ঞাপন করবেন।
শাহ এনায়েতুল্লাহ যাত্রার সময় এস্টেটের দেখাশুনার সার্বিক দায়িত্ব দিয়ে যান তার কাকা ব্রজমোহন চৌধুরীকে। স্ত্রী ও একমাত্র শিশুপুত্র সন্তানকে রেখে যান কাকার জিম্মায় খোশনদপুরে।
ব্রজমোহন ভাতিজার সব দায়িত্ব খুশি হয়ে গ্রহণ করলেন। পৈতা ছুঁয়ে ও গীতা স্পর্শ করে ওয়াদা করেন, জীবনের বিনিময়ে হলেও ভাতিজার দেয়া সব দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করবেন। খোশনদপুরে ঘটে গেল ইতিহাসের আরেক পলাশী খলনায়ক কাকা ব্রজমোহন স্বরূপে আবির্ভূত হলেন। ভাতিজাকে হত্যা করার জন্য গুপ্ত ঘাতক পাঠালেন। ঘাতকেরা অনেক দিন থেকে তাকে অনুসরণ করছিল। হজ থেকে ফেরার পথে এনায়েতুল্লাহকে হত্যা করা হবে। যশোরে দু’জন ঘাতক নিরস্ত্র অবস্থায় এনায়েতুল্লাকে নির্মমভাবে শহীদ করল। ঘটনাটি ঘটে ১৭৩৯ সালে। বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলার হত্যার বছর আগে।
রাজবল্লভ উমিচাঁদের আরেক পূর্বসূরি ব্রজমোহন এভাবে এনায়েতুল্লাকে নির্মমভাবে হত্যা করে খোশনদপুরে প্রচার করল, ভাতিজাকে দস্যুরা হত্যা করেছে। মায়াকান্নাও জুড়ে দিল সে ও তার পরিবার। মানুষেরা জানতে পারল না হৃদয়বিদারক সত্য ঘটনা।
এনায়েতুল্লাহর এক মাত্র নাবালকপুত্রকে কৌশলে ঘাতক দিয়ে গোপনে হত্যা করল। কিন্তু প্রচার করল এনায়েতুল্লাহর শিশু ছেলে কলেরা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। এনায়েতুল্লাহর স্ত্রী সন্তান হারিয়ে উন্মাদিনী অবস্থায় এক বিশ্বস্ত ভৃত্যের মাধ্যমে রাতের আঁধারে পালিয়ে মুর্শিদাবাদ চলে যান।
১৭৩৯-৪০ এর সময়ে খোদ মুর্শিদাবাদে নবাবী নিয়ে মারামারি কাটাকাটি চলছিল। তবে ব্রজমোহনকে এনায়েতুল্লাহর হত্যার অভিযোগে গ্রেফতার করে মুর্শিদাবাদ নিয়ে যাওয়া হয়।
কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! কারাধ্যক্ষ বিশ্বম্বর রায় কারসাজি করে ব্রজমোহনকে ছেড়ে দেয়। খোশনদপুরে এসে দুজন মিলে কোষাগারের নগদ অর্থ সম্পদ লুটপাট করে নিয়ে যায়।
এভাবে বাদশাহ আলমগীরের তামার পাতায় দান করা ওয়াকফ সম্পত্তি আধ্যাত্মিক গুরু হজরত শাহজামান কাশ্মিরি রহ: ও তার প্রিয় পুত্র শাহ এনায়েতুল্লাহ চৌধুরী রহ: পরিচালিত ইসলামী মিশনের কাজ বন্ধ হয়ে তা খলনায়ক ব্রজমোহনের কারসাজিতে পারিবারিক সম্পত্তিতে পরিণত হয়। তারা এসে পালাক্রমে ভোগ দখল করে ১৯০ বছর। কখনো জমিদার কখনো বা রাজা এবং মহারাজা উপাধি ধারণ করে পরের সম্পত্তি ভোগদখল করে বিলাসবহুল জীবন কাটায়। খোশনদপুরের নাম পর্যন্ত পরিবর্তন করে নাম রাখে সন্তোষ।
অতীব দুঃখের ব্যাপারে এই যে, সন্তোষের কথিত রাজারা টাঙ্গাইল শহরে বিভিন্ন জায়গায় কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তাদের নামে। কোথাও হজরত শাহজামান ও এনায়েতুল্লাহ চৌধুরীর নামে কিছু নেই। শাহজামান শুয়ে আছেন নিভৃত কাগমারী কলেজের সামনে মাজারে।
দানকৃত ওয়াকফ সম্পত্তি যা ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে মিশনারি আন্দোলনের জন্য দেয়া হয়েছিল । তা একসময় ব্যক্তিগত সম্পত্তি পরিণত হয়। মজলুম জননেতা আধ্যাত্মিক পীর মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী টাঙ্গাইল এসে ১৯৩৬ সালে এ ব্যাপারটি অবগত হন। তার পর থেকে দীর্ঘ দিন সন্তোষে জবরদখলকারী জমিদারদের সঙ্গে এ সম্পত্তি পুনরুদ্ধারে আইনি প্রচেষ্টা চালান। ১৯৪৬ সালে তিনি উদ্ধার করেন এসব সম্পত্তি।
১৯৭৩ সাল থেকেই মওলানা ভাসানী হজরত শাহজামানের লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় নাম দিয়ে একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। সেখানে প্রাথমিক স্কুল, কুরআন হেফজ খানা, এতিমখানা, সূচি শিক্ষা, বালক-বালিকা উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কলেজ, পশু হাসপাতাল, দাতব্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠা করেন। অবশ্য এগুলো হজরত শাহজামানের ইসলাম মিশনের প্রাথমিক কর্মসূচি ছিল।
মওলানা ভাসানীর নামে পরবর্তী সময়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে।