ভারত সাহস করে মালাক্কা প্রণালীর টুঁটি চেপে ধরবে?
মালাক্কা প্রণালী - ছবি সংগৃহীত
ভারত কী করতে পারে? ভালো বিকল্প হতে পারে, যদি ভারত সাহস করে মালাক্কা প্রণালীর টুঁটি চেপে ধরে। এই প্রণালী দিয়ে চীনের তাবৎ তেল সরবরাহ হয়। এই বাণিজ্য রুটগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ বাধা তৈরি করে ভারত সমর কৌশলের পরিচয় দিতে পারে। ভারত কি এটা করবে? এর ফলাফল হলো চীনকে ঢাকঢোল পিটিয়ে যুদ্ধের ময়দানে আমন্ত্রণ জানানো। চীনের সমুদ্র আগ্রাসন কী ভয়াবহ রূপ পরিগ্রহ করবে তা বলা বাতুলতা মাত্র। ইতোমধ্যে পেন্টাগন স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়েছে যে, চীনের বহর ও নৌসেনা বিশ্বসেরা।
চীনও মালাক্কা প্রণালীর ঝুঁকি নিয়ে সচেতন। মালাক্কা ছাড়া চীন ইতোমধ্যে বিকল্প পথ খুঁজতে শুরু করেছে; বাণিজ্য ও তেল সরবরাহ লাইনের জন্য ভারত মহাসাগরে প্রবেশের অন্য কোনো পথ। এর মধ্যে আপাতত দু’টি বিকল্প পাওয়া যাচ্ছে- প্রথমটি সিপিইসি বা পাকিস্তানের মাধ্যমে, এটি হবে ভারত মহাসাগরে চীনের সবচেয়ে সুবিধাজনক অ্যাক্সেস রুট; দ্বিতীয়টি থাই খাল, থাইল্যান্ডের ক্রা ইস্থমাস, মালয় উপদ্বীপের সঙ্কীর্ণতম বিন্দু, যা চীন থেকে ভারত মহাসাগর পর্যন্ত দ্বিতীয় সমুদ্রপথ খুলে দেবে। এই থাই খাল বা ক্রা খাল চীনা নৌবাহিনীকে দ্রুত দক্ষিণ চীন সাগর এবং ভারত মহাসাগরে তার নবনির্মিত দক্ষিণ চীন সাগরের ঘাঁটিগুলোর মধ্যে জাহাজ সরানোর সুবিধা দেবে। মালাক্কা প্রণালীর মধ্য দিয়ে মালয়েশিয়ার চারপাশে ৭০০ মাইলেরও বেশি পথ অতিক্রম করবে এবং এর জন্য চীন থাইল্যান্ডকে খাল খননের জন্য ৩০ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত দিচ্ছে।
এই দু’টি পথ, একবার কার্যকর হয়ে গেলে, চীন এই অঞ্চলে তার বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগকে সঙ্কুুচিত করার ইতোমধ্যে আধামরা ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় স্বপ্নগুলোর মেরুদণ্ড সম্পূর্ণ ভেঙে দিতে সক্ষম হবে।
ইতোপূর্বে এ অঞ্চলে চীনের মোকাবেলায় ভারতের প্রতিশ্রুতির ওপর নির্মিত ‘ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয়’ ধারণাটি ২০১৮ সালের। বিশেষ করে, ৩০ মে, ২০১৮ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা সচিব জিম ম্যাটিস ঘোষণা করেছিলেন যে, পেন্টাগনের প্রশান্ত মহাসাগরীয় কমান্ডের নাম পরিবর্তন করে ‘ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় কমান্ড’ রাখা হচ্ছে, যা চীনকে নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধের লক্ষ্যে প্রশান্ত মহাসাগরীয় থিয়েটারে ভারতকে বৃহত্তর ভূমিকা প্রদান করবে। এ বিষয়টি ওয়াশিংটনের একটি উল্লেখযোগ্য নীতি পরিবর্তন ছিল। বিশ্লেষকরা দেখিয়েছেন, দিল্লি পেন্টাগনকে নিশ্চিত করেছিল যে, প্রশান্ত মহাসাগরীয় থিয়েটারে চীনের প্রতিওজন হিসেবে কাজ করবে এবং এই অঞ্চলজুড়ে চীনের অর্থনৈতিক স্বার্থকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারবে- বিশেষ করে সিপিইসি প্রকল্প। এখন যেভাবে ঘটনা ও সম্ভাবনা গড়াচ্ছে তাতে সিপিইসি, চীন-পাকিস্তান ইকোনমিকে করিডোরকে পাকিস্তান অর্থনীতির উৎকর্ষের অন্যতম অবলম্বন মনে করছে। ইমরান খান বলেছেন, ‘সিপিইসি প্রকল্পের সাথে আমাদের অর্থনীতির ভবিষ্যত একসাথে বাঁধা।’
সেই সময় কেউ জানত না, ভারত তার প্রতিশ্রুতি কতটুকু পালন করতে পারবে বা আদৌ পারবে কি না। এ পরিবর্তন কি সত্যিই চীনের প্রতিওজন হিসেবে কাজ করতে পারে? এটি কি চীন এবং তার ক্রমবর্ধমান শক্তিকে ‘নিয়ন্ত্রণ’ করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সহায়তা করতে সক্ষম হবে?
যাই হোক, ১৮ মাসেও এমন কিছু ঘটেনি। চীন যখন ভারতের দখলে থাকা লাদাখের সীমানা দিয়ে অনুপ্রবেশ করছে, প্যাংগং হ্রদ এবং গালওয়ান উপত্যকার গুরুত্বপূর্ণ সুবিধাজনক পয়েন্ট দাবি করছে, তখন ভারতের পক্ষ থেকে প্রকৃত প্রতিরোধ সৃষ্টি হয়নি। তবে এ ধরনের এক ঘটনায় ভারত চাপ দিতে গেলে তারা ২০ জন সেনাকে হারায়, তবুও চীন থেকে এক ইঞ্চি জমি ফিরে পায়নি।
বিভিন্ন ভারতীয় প্রতিবেদন অনুযায়ী, চীনারা ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছ থেকে কার্যত প্রতিরোধ ছাড়াই লাদাখে প্রবেশ করে এবং অঞ্চলটি ফিরিয়ে দেয়ার বিষয়ে আলোচনা করতেও অস্বীকার করে। চীনা কর্মকাণ্ডের দ্বারা উৎসাহিত হয়ে নেপাল ভারতীয় সীমানার মধ্যে অঞ্চলদাবি করে, নাগাল্যান্ড ও পূর্বাঞ্চলীয় অঞ্চলগুলোও ভারতীয় ইউনিয়নের বিপক্ষে কথা বলছে। বিআরআইতে অন্তর্ভুক্তির জন্য বাংলাদেশ চীনের সাথে প্রতিশ্রুতি স্বাক্ষর করেছে। শ্রীলঙ্কা কলম্বো বন্দর চীনকে লিজ দিয়েছে। মিয়ানমারকে চীন কৌশলগত সমর্থন দিয়েছে। ইরান চীনের সাথে একটি দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। তালেবানরা আফগানিস্তানে পুনর্গঠনের প্রচেষ্টায় চীনের সাথেই কথোপকথন চালাচ্ছে। সিকিমেও চীনাদের সীমান্ত চাপ বৃদ্ধি পেয়েছে। পাকিস্তানের গোয়াধর ও ইরানের চাবাহার পুরোদমে তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে বিদেশী কোনো প্রকার প্রতিরোধ ছাড়াই।
এই পরিস্থিতিতে, ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় সমগ্র ধারণার অবস্থান কী দাঁড়াল তা আরো পর্যবেক্ষণ করা উচিত। মিডিয়ায় প্রশ্ন তোলা হয়েছে, ভারত প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনাদের বিরুদ্ধে কেমন সুবিধা দিতে পারে যদি তারা চীন থেকে এমনকি তাদের নিজস্ব দাবিকৃত অঞ্চলই পুনরুদ্ধার করতে না পারে? যদি তার বাহিনী লাদাখে চীনা সামরিক বাহিনীর মুখোমুখি হতে না পারে, তাহলে কি ভারত সত্যিই দক্ষিণ চীন সাগরে যুদ্ধজাহাজ পাঠাবে বা সিপিইসি রুট সঙ্কুচিত বা বাধাগ্রস্ত করার বিষয়ে আস্থা রাখা যাবে?
যুক্তরাষ্ট্র ও সহযোগীরা চাইবে না কোনো দেশের কারণে শক্তিশালী পশ্চিমা জোটের ‘মিথ’ ধ্বংস হোক বা নিচে নামুক। তবে তাদেরও বুঝতে হবে, ভারত প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের কোনো দেশ নয়। তাই প্রশান্ত মহাসাগরে ভারতকে নিয়ে স্বপ্ন না দেখাই উচিত। এমতাবস্থায়, কোয়াড ও ইন্দো প্যাসিফেক রিমে যৌথ শক্তি বাড়ানো বেশিদূর নাও এগোতে পারে এবং সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর অবস্থানের পরিবর্তনও হতে পারে।