যা বললেন রুমিন ফারহানা
রুমিন ফারহানা - ছবি সংগৃহীত
করোনায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত খাতের মধ্যে পর্যটন খাত থাকবে একেবারে সর্বোচ্চ পর্যায়ে। কিন্তু অবিশ্বাস্যভাবে এর জন্য ২০২০ সালে কোনো প্রণোদনাই দেয়া হয়নি। এই খাতে প্রথম ঋণ প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়েছে এই বছরের জুলাই মাসে। মজার ব্যাপার সরকার ঘোষিত এক হাজার কোটি টাকার এই তথাকথিত প্রণোদনা পায়নি প্রায় কেউই। আর যে ট্যুর অপারেটরদের নিয়ে আজকের এই বিল, তারা ছিল এই ঋণের একেবারেই বাইরে। অথচ আর্থিকভাবে এরাই ছিলেন দুর্বল এবং বেশি ভঙ্গুর। হোটেল-মোটেল, রিসোর্ট, থিম-পার্কের আওতাধীন ছিল, কিন্তু তারাও শর্তের জটিলতায় এই ঋণ পায়নি। গত অক্টোবর পর্যন্ত একটি প্রতিষ্ঠানও ঋণ পাবার তথ্য নেই। সবচেয়ে বড় কথা এই খাতে কর্মরত কর্মীরা করোনার সময় সরকারের কাছ থেকে সরাসরি কিছুই পায়নি, তাই এই পেশা ছেড়ে চলে গেছে ৬০ শতাংশের বেশি কর্মী। শুধুমাত্র সরকারের গাফিলতির কারণে এই সেক্টর বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে পারছে না।
'বাংলাদেশ ট্যুর অপারেটর ট্যুর গাইড (নিবন্ধন ও পরিচালনা) আইন, ২০২১'-এর বিলটি পড়তে গিয়ে ক্ষুব্ধ হয়েছি ১৫ ধারায় এসে– এখানেও এই আইনের অপরাধকে মোবাইল কোর্ট আইন, ২০০৯-এর তফসিলভুক্ত করে বিচার করার বিধান যুক্ত করা হয়েছে। ফৌজদারি অপরাধ হতে পারে এমন কোনো আইনে মোবাইল কোর্টকে সংযুক্ত করা এখন এক ভয়ঙ্কর প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাতে সিল মেরে আমলারা সরকারকে ক্ষমতায় এনেছে এবং বিরোধী দলকে যাচ্ছেতাইভাবে দমন করে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করেছে বলেই কি আমলাদের কাছে সরকার সবকিছু সঁপে দিচ্ছে? সরকারের এই আমলা প্রীতির বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের নেতারাই নানা ফোরামে ক্ষোভ-উষ্মা প্রকাশ করছেন। করেছেন এই সংসদেও।
রেইন্ট্রি হোটেলে ধর্ষনের চাঞ্চল্যকর মামলায় বিচারক যে অবজারভেশন দিয়েছিলেন তার প্রতিক্রিয়ায় আইনমন্ত্রী যে প্রধান বিচারপতিকে চিঠি লিখেছেন, তিনি যে মিডিয়ায় এটার ব্যাপারে ব্যবস্থার কথা বলেছেন, সেই বিচারককে বিচার কাজ থেকে সাময়িকভাবে নিবৃত্ত করে সরকারের আইন মন্ত্রণালয়ে পদায়ন করা হয়েছে, এসব একজন আইন প্রণেতা তো বটেই একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবেও আমাকে হতাশ এবং ক্ষুব্ধ করেছে। নিম্ন আদালতকে পুরো নিজের কব্জায় রাখা সরকারের একজন মন্ত্রী বিচার বিভাগ নিয়ে ব্যবস্থা নিচ্ছেন – এই দৃশ্য অসুন্দর, অশোভন। একটা সভ্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এটা হতে পারে না। দেশের নিম্ন আদালতের একজন বিচারকের রায় বা পর্যবেক্ষণে কোনো ভুল হলে সেটার তদারকি করার জন্য তো উচ্চ আদালতই আছে, তারাই করবেন সেটা। কিছুদিন আগেই তো পরিমনিকে অন্যায়ভাবে একাধিকবার রিমান্ড দেয়ার কারণে নিম্ন আদালতের বিচারকের বিরুদ্ধে তো উচ্চ আদালত নিজেই ব্যবস্থা নিয়েছে।
আমরা তো কাগজে-কলমে অন্তত স্বাধীন বিচার বিভাগের প্রাথমিক স্বীকৃতি দিয়েছিলাম। বাংলাদেশ সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদ বলে - 'রাষ্ট্রের নির্বাহী অঙ্গসমূহ হইতে বিচারবিভাগের পৃথকীকরণ রাষ্ট্র নিশ্চিত করিবেন'৷ তাই আমাদের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১৫ এবং ১১৬ এই ২২ অনুচ্ছেদের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক।
মজার ব্যাপার ১৯৭২ সালের সংবিধানের কথা সরকার ব্যবহার করে তার সুবিধামত। ষোড়শ সংশোধনী করার সময় ১৯৭২-এর সংবিধানের দোহাই দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ওই সংবিধানেই অনুচ্ছেদ ১১৫ আর ১১৬ তে রাষ্ট্রপতি (যা আসলে সরকার) ছিল না, ছিল শুধুমাত্র সুপ্রিম কোর্ট। এই ক্ষেত্রে কেন সরকার ১৯৭২ এর সংবিধানের কথা বলছে না।
সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদ সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগ অর্থাৎ 'রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি' অধ্যায়ের অংশ। এটা যদি রাষ্ট্রের মূলনীতি হয়ে থাকে তাহলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কোনোভাবেই বিচারকার্য পরিচালনা করতে পারেন না। এটা সুস্পষ্টভাবে অসাংবিধানিক। এটা আদালতেরও বক্তব্য।
নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের দিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করাকে চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা রিটের রায়ে ২০১৭ সালের ১১ মে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার ২০০৯ সালের আইনের ১১টি ধারা ও উপধারা অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন হাইকোর্ট৷ একইসঙ্গে, এই আইনে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা অবৈধ ঘোষণা করেন আদালত৷ রায়ে বলা হয়, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটদের বিচারিক ক্ষমতা দেওয়া সংবিধানের লঙ্ঘন এবং তা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ওপর আঘাত৷ এটি ক্ষমতার পৃথককরণ নীতিরও পরিপন্থী৷ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটসহ কর্ম-কমিশনের সব সদস্যরা প্রশাসনিক নির্বাহী৷ একজন নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে তারা প্রজাতন্ত্রের সার্বভৌম বিচারিক ক্ষমতা চর্চা করতে পারেন না৷
এই রায়ের পর সরকার আপিল করে এবং আপিল বিভাগ স্থগিতাদেশ দেয় রায়ের ওপরে। সেই স্থগিতাদেশের বলেই এখনো এই আদালতগুলো চলতে পারছে। এতে খুব গুরুত্বপূর্ণ দুটি প্রশ্ন আছে। প্রথমটি হলো দেশের হাইকোর্টের এরকম সুস্পষ্ট রায়ের বিরুদ্ধে সরকার কেন আপিল করল? বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কথা কি সরকার জানে না? কেন এখনো একের পর এক নতুন আইনে সরকার মোবাইল কোর্টের বিধান রাখছে?
আপিল করার পর সাড়ে তিন বছর পেরিয়ে যাবার পরও এই আপিলের শুনানি এখনো কেন শুরু হয়নি? এই শুরু না হওয়াটা কি প্রমাণ করে না স্থগিতাদেশ অনন্তকাল ঝুলিয়ে রাখার চেষ্টা করবে সরকার এবং সেটা দিয়েই এই নির্বাহী বিভাগের পরিচালনায় মোবাইল কোর্ট চলতেই থাকবে?
কী করা উচিত তাহলে? মোবাইল কোর্ট বাতিল করা উচিত। রাষ্ট্রকে বুঝতে হবে মোবাইল কোর্ট প্রচলিত বিচারব্যবস্থার অপ্রতুলতা এবং অদক্ষতার প্রমাণ দেয়। যেভাবে মানুষকে চাপ দিয়ে স্বীকৃতি আদায় করে বিচার করে ফেলা হয় সেটা ন্যায়বিচারেরও পরিপন্থী।