ইব্ন কাসিমের জয় ও এর প্রভাব
ইব্ন কাসিম - ছবি সংগৃহীত
দশম শতাব্দীতে পর্যটক ইব্ন হাউকল সিন্ধু দেশ ভ্রমণ করতে এসে জনগণকে আরবি ও সিন্ধি দু’ভাষাতেই কথা বলতে শোনেন এবং মুসলিম ও হিন্দু জনতার মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব লক্ষ্য করেন। এখনো সিন্ধি ভাষায় আরবি হরফ ব্যবহৃত হয় এবং এ ভাষায় আরবি ভাষার প্রভাব খুব বেশি। সিন্ধুর সমাজব্যবস্থাও অনেকটা আরব দেশের অনুকরণে গোত্রীয় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং আরবদের মতো সিন্ধিরাও অতিথিবৎসল। সিন্ধুতে মুসলিম শাসনামলের অনেক কীর্তি আজও বিদ্যমান রয়েছে। কাজেই রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে আরবদের সিন্ধু বিজয়ের গুরুত্ব একেবারেই খাটো করা যায় না। আরবদের সিন্ধু বিজয় শুধু কাহিনীস্বরূপ নয়, এর স্থায়ী ফল ও প্রভাব সুপ্রতিষ্ঠিত।
আগে থেকেই ভারতবর্ষে আরব বণিক ও পীর-দরবেশদের আনাগোনা থাকলেও ইব্ন কাসিম কর্তৃক সিন্ধু বিজয়ের ফলে আলেম, ধর্মপ্রচারক, পীর, আউলিয়া ও দরবেশদের ভারতবর্ষে আগমন বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। বিভিন্ন স্থানে মসজিদ, খানকাহ ও মাদরাসা গড়ে উঠে। ইসলামের দাওয়াত নিয়ে তারা ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। তাদের মধ্যে লাহোরের দাতা গঞ্জবখ্শ, পাঞ্জাবের সায়্যিদ জালালুদ্দিন সুরখ্পোশ বুখারি, রাজস্থানের শায়খ হামিদুদ্দিন নাগুরি, মুলতানের শায়খ বাহাউদ্দিন জাকারিয়া, পশ্চিম পাঞ্জাবের শায়খ ফরিদুদ্দিন গঞ্জশকর, দিল্লির হজরত নিজামুদ্দিন আউলিয়া, আজমিরের খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি, দাক্ষিণাত্যের শায়খ কামালুদ্দিন চিশতি, পানিপথের বু’আলী শাহ কলন্দর, গুজরাটের শায়খ আবদুল ওয়াহাব শাযলি, কাশ্মিরের সায়্যিদ আলী হামাদানি, বিহারের শায়খ শারফুদ্দিন ইয়াহিয়া মানিরি, সিলেটের হজরত শাহজালাল, রাজশাহীর শাহ মাখদুম, চট্টগ্রামের শাহ আমানত, সোনারগাঁয়ের শায়খ শারফুদ্দিন আবু তোয়ামা, বগুড়ার সাইয়্যেদ মাহমুদ মাহিসওয়ার এবং রংপুরের মাওলানা কারামাত আলী জৌনপুরির নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। এ পীর মাশায়েখদের অব্যাহত দাওয়াতি তৎপরতার ফলে ইসলামের সাম্য, ভ্রাতৃত্ব, উদারতা ও পরমত সহিষ্ণুতার বাণী বর্ণভেদ ও সামাজিক বৈষম্যের শিকার হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে।
দলে দলে নির্যাতিত হিন্দুরা ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের বহু রাজা মহারাজা বিশেষত পাঞ্জাবের বেশ কয়েকটি রাজপুত পরিবার, মালবের রাজগড় রাজ্যের রাজা মুতি সিংহ ও পানিপথের অমর সিংহ রাজপুত এসব সুফির দাওয়াতি তৎপরতার ফলে ইসলাম কবুল করেন। কালক্রমে সিন্ধু এ উপমহাদেশের অন্যতম প্রধান মুসলিম এলাকায় পরিণত হয়। মুহাম্মদ ইব্ন কাসিমের পর ১০০ হিজরিতে উমর ইব্ন আবদুল আজিজ সিন্ধু অঞ্চলের সব রাজা ও ঠাকুরদের কাছে ইসলাম কবুল করার জন্য তাবলিগি পত্র প্রেরণ করেন। পত্র প্রাপ্তির পর রাজা দাহিরের দুই ছেলে জয় সিংহ ও চাচসহ অধিকাংশ রাজা ও ঠাকুর ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। উমর ইব্ন আবদুল আজিজ জয় সিংহকে ব্রাহ্মণাবাদের প্রশাসক নিযুক্ত করেন। আব্বাসীয় খলিফা মাহদি ক্ষমতায় আরোহণের পর সিন্ধুর গণ্যমান্য ব্যক্তিসহ আঞ্চলিক প্রশাসকদের কাছে ইসলাম গ্রহণের উদ্দেশ্যে দাওয়াতিপত্র প্রেরণ করেন। শ্রী রায় ও মহারাজা নামে পরিচিত দু’জন শাসকসহ বহু মানুষ ইসলামে দীক্ষা লাভ করেছিলেন।
সুতরাং ভারতীয় অঞ্চলে ইসলাম ধর্মের বিকাশের ক্ষেত্রে এই বিজয়ের ফলাফল ছিল সুগভীর ও সুদূরপ্রসারী। ড. কিরণচন্দ্র চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘সিন্ধু দেশে আরব অধিকার প্রতিষ্ঠিত হইবার এবং ভারতবর্ষে ইসলাম ধর্ম প্রচারের ফলে সমাজের অবহেলিত, জাতপাতের দরুন নীচ সম্প্রদায় বলিয়া হিন্দু সমাজে অপাঙ্ক্তেয়, পতিত শ্রেণীর যাবতীয় লোকের মধ্যে ইসলাম ধর্মের প্রতি আগ্রহ দেখা দিলো। কারণ ইসলাম ধর্মে সকল লোকের সামাজিক সমতার নীতি স্বভাবতই তাহাদের মনে গভীর রেখাপাত করিল। এক ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ সমাজ, সকলের সমান সামাজিক মর্যাদার নীতি হিন্দু সমাজের অনেককে আকৃষ্ট করিয়া ইসলাম ধর্মকে ভারতবর্ষে স্থায়িত্ব দান করিয়াছিল’ (ড. কিরণচন্দ্র চৌধুরী, ভারতের ইতিহাস কথা, পৃ. ৫৭৭)।
এ প্রথম ভারতীয় উপমহাদেশের মাটিতে দু’টি বিপরীতমুখী সংস্কৃতি একে অপরের সংস্পর্শে আসে। দু’টি সংস্কৃতির সহাবস্থান একে অপরকে প্রভাবিত করে স্বাভাবিকভাবে। মুসলমানদের সংস্পর্শে এসে ভারতীয়রা জানতে পারলো, মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ ইসলামে নেই; ধনী-দরিদ্র, রাজা-প্রজা এক কাতারে দাঁড়িয়ে মহান আল্লাহর ইবাদত করতে পারে; ধর্মগ্রন্থ পাঠে ধর্মগুরু ও সাধারণ মুসলমানের অধিকার সমান। বিজেতা আরবরা এ দেশে ইসলামী সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার ফলে হিন্দুদের সনাতনী কৌলিন্যপ্রথা, পৌত্তলিকতা ও অস্পৃশ্যতার ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। ভারতীয় সংস্কৃতি ও সভ্যতার বহু উপাদান যেগুলো আরবীয় সংস্কৃতি ও সভ্যতার উপর প্রভাব ফেলেছিল, সেগুলো পরবর্তীকালে আরবদের মাধ্যমে ইউরোপে বিস্তার লাভ করে। হিন্দুধর্ম, বেদান্তদর্শন, জ্যোতির্বিদ্যা, আয়ুর্বেদশাস্ত্র, সঙ্গীত, গণিত, সাহিত্য, লোকগীতি, চিত্রকলা, স্থাপত্য, দাবা প্রভৃতি বিষয়ে আরবরা ভারতীয়দের কাছ থেকে প্রভূত জ্ঞান লাভে সমর্থ হন (উৎ. ওংধিৎর চৎধংধফ, অ ঝযড়ৎঃ ঐরংঃড়ৎু ড়ভ গঁংষরস জঁষব রহ ওহফরধ, ঢ়.৩৯)।