মুহাম্মদ ইব্ন কাসিমের ভারতবর্ষে অভিযান : একটি মূল্যায়ন

ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন | Nov 14, 2021 03:05 pm
মুহাম্মদ ইব্ন কাসিমের ভারতবর্ষে অভিযান

মুহাম্মদ ইব্ন কাসিমের ভারতবর্ষে অভিযান - ছবি সংগৃহীত

 

উমাইয়া খলিফা ওয়ালিদের রাজত্বকালে মুহাম্মদ ইব্ন কাসিমের ভারতবর্ষে আগমন ইতিহাসে এক তাৎপর্যমণ্ডিত ঘটনা। এর ফলাফল অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী। তিন বছরের মধ্যে ইব্ন কাসিম সিন্ধু ও মুলতানে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে এক নব অধ্যায়ের সূচনা করেন। ভারতীয় জনগণের অনৈক্য, সিন্ধুর রাজা দাহিরের স্বৈরশাসন, নৌশক্তির অভাব এবং বিক্ষুব্ধ জাঠ, মেড, বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর সহযোগিতা আরবদের সফলতার প্রধান কারণ। এ ছাড়া ইসলাম প্রচার ও দুঃসাহসিক চেতনা মুসলমানদেরকে সিন্ধু বিজয়ে যথেষ্ট সাহস জোগায়। তরুণ মুহাম্মদ বিন কাসিম যেসব এলাকা জয় করেন সর্বত্র বিজিত লোকদের প্রতি ন্যায় ও সহনশীলতার পরিচয় দেন। তিনি সেখানে দেবলনগরে প্রবেশের পর শুধু অযথা রক্তপাতেই বাধা প্রধান করেননি; অধিবাসীদের প্রতি তিনি সৌজন্য ও উদারতামূলক আচরণ করেছিলেন। হিন্দুরা তাদের পূর্ববর্তী পদে বহাল থাকে, শুধু শাসনব্যবস্থা হিন্দুদের হাত থেকে মুসলমানদের হাতে স্থানান্তরিত হয়। অমুসলিমদের ধর্মীয় স্বাধীনতা দেয়া হলো। সিন্ধুবাসীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মন্দির মেরামতের অনুমতি দেয়া এবং যুদ্ধের সময় ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার ব্যবস্থা হয়। ব্রাহ্মণাবাদ, আরোর, রাওয়ার, মুলতান এবং অন্যান্য স্থানেও একই ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। অমুসলিমদের ওপর জিজিয়া ছাড়া অন্য কোনো নতুন কর ধার্য করা হয়নি। যারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন, তাদেরকে ‘জিজিয়া’ কর থেকে মুক্তি দেয়া হয়।

ইব্ন কাসিমের সিন্ধু বিজয় রাজনৈতিক ফলাফল বিবেচনায় ইতিহাসবিদদের মধ্যে ভিন্ন মত থাকলেও আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় তাৎপর্য নিয়ে কারো দ্বিমত নেই। ইতিহাসবিদ ড. ঈশ্বরী প্রসাদের মতে আরবদের সিন্ধু বিজয় রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ইসলামের ইতিহাসে ‘একটি অকিঞ্চিৎকর ঘটনা’ (ওহংরমহরভরপধহঃ বাবহঃ); স্ট্যানলি লেনপুলের মতে ‘একটি উপাখ্যান বিশেষ, একটি নিষ্ফল বিজয়’ (অহ বঢ়রংড়ফব, ধ ঃৎরঁসঢ়য রিঃযড়ঁঃ ৎবংঁষঃ)। একই ভাবধারায় ঐতিহাসিক এস আর শর্মা বলেন, ‘রাজকীয় আকাশের চক্রবালে অর্ধচন্দ্রটি সর্বোচ্চ স্থানে উদিত হইবার সৌভাগ্য লাভ করে, কিন্তু ইহা শুধু অর্ধচন্দ্র থাকিবার জন্যই, পূর্ণচন্দ্র নহে।’ তাদের মতে, মুহাম্মদ ইব্ন কাসিমের আধিপত্য শুধু সিন্ধু ও মুলতানের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল এবং উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের বিশাল অঞ্চলের উপর তিনি কোনো প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হননি। ইব্ন কাসিমের আকস্মিক মৃত্যু, উমাইয়া খলিফা সুলায়মানের ক্ষমতায় আরোহণ, দামেশ্কের বিদেশনীতির পরিবর্তন, ভারতীয় রাজা, হিন্দু পুরোহিতরা ও সামন্ত বিশেষত রাজপুতদের প্রবল বিরোধিতার ফলে মুসলিম বিজয়ে আর কোনো অগ্রগতি হয়নি। এ ছাড়া আরবরা সিন্ধু দেশে যেসব রাস্তাঘাট ও প্রাসাদ নির্মাণ করেন সেগুলোও স্বল্পকালের মধ্যে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। খুব সম্ভবত এসব কারণে ইতিহাস গবেষকরা রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণে আরবদের সিন্ধু বিজয়কে ‘নিষ্ফল’ বলে মন্তব্য করেন। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, সিন্ধু বিজয় পরবর্তীকালে ভারতে মুসলিম শাসনের পথ উন্মুক্ত করে দেয়। এটি ছিল মূলত অগ্রবর্তী অভিযান। স্বল্পতম সময়ে গোটা ভারত জয় করা অসম্ভব। এর জন্য প্রয়োজন দীর্ঘ প্রক্রিয়া। মুহাম্মদ ইব্ন কাসিমের পথ ধরে সুলতান মাহমুদ গজনবি, মুহাম্মদ ঘোরি ও বাবর অভিযান পরিচালনা করে ভারতের বুকে মুসলিম রাজত্বের ভিত্তি স্থাপনে সমর্থ হন। সুতরাং এই ঘটনাকে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণে ‘একটি অকিঞ্চিৎকর ঘটনা’ বা ‘একটি উপাখ্যান বিশেষ বা একটি নিষ্ফল বিজয়’ বলে উড়িয়ে দেয়া সমীচীন নয়।

ভারতীয় ইতিহাস গবেষক ড. কিরণচন্দ্র চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘কিন্তু সামান্য অনুধাবন করিলে আমাদের বুঝিতে বিলম্ব হইবে না যে, আরবদের সিন্ধু অধিকারের সময় হইতে শুরু করিয়া আধুনিক যুগের পূর্বাবধি সিন্ধুর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক তথা সামাজিক জীবন ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের দ্বারা প্রভাবিত ছিল। আরবদের শাসন স্থাপনের ফলে বহু সংখ্যক আরব বণিক পর্যটক, সন্ত, মনীষী সিন্ধুতে আসিয়াছেন এবং ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে পরিভ্রমণ করিয়া যেই সকল বর্ণনা রাখিয়া গিয়াছেন, সেইগুলি পরবর্তীকালে তুর্কিদিগকে ভারতবর্ষ অভিযানে উৎসাহিত করিয়াছে’ (ড. কিরণচন্দ্র চৌধুরী, ভারতের ইতিহাস কথা, পৃ. ৫৭৬)। আরবদের সিন্ধু বিজয়ের পর থেকে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে মুসলিম প্রভাব দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে। দেবল, সোমনাথ, কাথিওয়াড়, কঙ্কন, ব্রোচ, ক্যাম্বে, সিন্দন, চেউল, গুজরাট প্রভৃতি স্থানে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুসলিম বসতি গড়ে উঠে এবং প্রায় প্রতিটি স্থানেই মসজিদ নির্মিত হয়। বেশির ভাগ হিন্দু শাসক তাদের রাজ্যে মুসলমানদের স্বাগত জানান। বসতি স্থাপনের পরপরই মুসলমানরা ধর্মপ্রচারে ব্রতী হন। কেননা ইসলাম অপরিহার্যভাবে একটি প্রচারব্রতী ধর্ম এবং প্রতিটি মুসলমানই আপন ধর্মের প্রচারকস্বরূপ। নব প্রতিষ্ঠিত ধর্মের উদ্দীপনা এবং বিজয়ের মর্যাদা ও গৌরব বহন করে এসব মুসলিম ভারতে আসেন। নবম শতাব্দী শেষ হওয়ার আগেই তারা ভারতের সমগ্র পশ্চিম উপকূল অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে এবং ধর্মাচরণের বৈশিষ্ট্য, ধর্মপ্রচার ও পালনের উৎসাহ দ্বারা হিন্দু জনগোষ্ঠীর মধ্যে গভীর সাড়া জাগাতে সক্ষম হন (ড. তারা চাঁদ, ভারতীয় সংস্কৃতিতে ইসলামের প্রভাব,পৃ. ২৭, ৩৬)।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us