তালেবান ক্ষমতায় আসায় রাশিয়া খুশি!
তালেবান ক্ষমতায় আসায় রাশিয়া খুশি! - ছবি সংগৃহীত
তালেবান পক্ষ এবার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই রাশিয়া মূলত খুবই খুশি, তার অনুমান, এবার দিন তার পক্ষে এসেছে আর আমেরিকার বিপক্ষে। কিন্তু একই রাশিয়ারই আবার প্রবল শঙ্কা; কারণ, সে আবার সেন্ট্রাল এশিয়ার ছয় রাষ্ট্রকে (এরই চার রাষ্ট্র ভারতের সম্মেলনে যোগ দিয়েছে) প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যে রেডিক্যাল ইসলাম বা আইএস টাইপের সশস্ত্র আন্দোলন বা আক্রমণ থেকে এদের সুরক্ষিত রাখবে। আর এ কাজে রাশিয়া তালেবানদের ওপর নির্ভর করতে চায়।
এসব কিছু অবশ্যই রাশিয়ার বড় স্বার্থ। কিন্তু এসব ছাড়াও রাশিয়ার আরেক বড় স্বার্থ আছে। যেমন সেটা হলো, রাশিয়ান এস-৪০০ মিসাইলের হবু ক্রেতা ভারত যার একটার দামই আধা বিলিয়ন ডলার। এ ছাড়া ভারত এটা কিনলে আমেরিকা ক্ষেপে গিয়ে ভারতের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধসহ বহু ধরনের বাধা আরোপ করবে তা আনুষ্ঠানিকভাবে আগেই জানানো হয়ে আছে। তাই ভারত চেষ্টা করছে কোনো ছাড় পাওয়া যায় কিনা। কিন্তু উদাহরণ হলো, একই পথে তুরস্কের বেলায় সে ব্যর্থ হয়ে আছে।
তাই অনুমান করা যায় রাশিয়ার হবু ক্রেতা ও অন্য অনেক সমরাস্ত্রের ইতোমধ্যেই ভালো ক্রেতা, ভারতের ‘মন রক্ষা’ করতে রাশিয়া সেন্ট্রাল এশিয়ার চার রাষ্ট্র সাথে নিয়ে ভারতের সম্মেলনে যোগ দিয়েছে। তবে সেন্ট্রাল এশিয়ার চার রাষ্ট্র-এদের দিক থেকে দেখলে তাদের নিজস্ব বড় স্বার্থও এটা যে, তারা তালেবানদের ভরসা করে যেকোনো রেডিক্যাল ইসলাম থেকে সুরক্ষিত থাকতে চায়। এটা তাদের ভাইটাল স্বার্থ!
ইরান ভারতের সম্মেলনে কেন এটা এক বিরাট প্রশ্ন। তবে জবাবটা সহজেই এভাবে বলা যায় যে, সম্প্রতি আফগানিস্তানে শিয়া মসজিদে হামলা পরপর সম্ভবত তিনবার বোমা হামলার ঘটনা ঘটেছে। আর প্রত্যেকবারই দেড়শ’ জনের বেশি লোক মারা গেছে। এটা শুধু শিয়া মসজিদে হামলা না; এরা ছিল মূলত আফগানি হাজারা শিয়া।
ওরা শিয়া এই সেন্টিমেন্টের ওপর ভর করে এই হামলা হয়েছে। কিন্তু এরা মূলত আফগানিস্তানের তৃতীয় বৃহত্তম এথনিক জনগোষ্ঠী। আমাদের মতো দেশের ভূখণ্ডের সীমানা টেনেছে কলোনিয়াল শক্তিগুলো তাদের নিজের একান্ত স্বার্থে, আর এতে একই এথনিক জনগোষ্ঠী কাটা পড়ে সীমানা দুই দেশে বিভক্ত করার ভিত্তিতে। আমাদের বেলায় একই বাঙালি বা পাঞ্জাবি এথনিক জনগোষ্ঠী যেমন ভারতে থেকে গেছে; যাদের আরেক অংশ বাংলাদেশে বা পাকিস্তানে। তেমনি আফগান হাজারা জনগোষ্ঠী আরেক বড় অংশ আছে ইরানে। ফলে আফগানিস্তানের অংশ হামলায় বিপদগ্রস্ত হলে ইরানের দুটো সমস্যা। ইরানে সেন্টিমেন্ট তৈরি হয় আফগানদেরকে উদ্ধার ও রক্ষার। আবার আরেক বিপদ হলো, ইরান না চাইলেও তারা রিফুজি হিসাবে ইরানে ভিড় করে, করবেই- এটাই স্বাভাবিক। আর ইরান সেই দায় ঠেলে ফেলেও দিতে পারে না।
কাজেই তালেবানেরা যদি হাজারারা শিয়া (ওরা কম মুসলমান বা সহি মুসলমান না ইত্যাদি ধরনের যেসব এথনিক ঘৃণা আফগান পশতুন ডমিনেটেড সমাজে প্রচলিত আছে) এই ধর্মীয়-সামাজিক মনোভাবের আলোকে উপেক্ষায় আইএসের হাতে হামলায় মারা যেতে দেয়, নাগরিক নিরাপত্তা না দিতে পারে তাহলে গত আগস্টে তালেবানেরা ক্ষমতায় আসার পর থেকে ইরান সরকারের যে ইতিবাচক মনোভাব বজায় আছে তা ইরান চাইলেও বজায় রাখতে পারবে না। যেমন আফগানিস্তানের প্রয়োজনীয় তেল সরবরাহ এখনো ইরান করছে যেখানে এর অর্থ পরিশোধের কী ব্যবস্থা হবে সেটা এখনো অনিশ্চিত।
অতএব ইরানের ভারতের সম্মেলনে যোগ দেয়া বলতে গেলে তালেবানদের ওপর অপ্রকাশ্য অসন্তুষ্টির পরোক্ষ প্রকাশ: তুমি আইএস ধরনের রেডিক্যাল ইসলামিস্টদের যদি আফগানিস্তান থেকে দূরে রাখতে না পারো তবে ইরানের তোমার বিপরীতে যাওয়া ছাড়া পথ নেই।’
তার মানে কি, যারা আইএস ধরনের রেডিক্যাল ইসলামীদের মুক্ত আফগানিস্তান দেখতে চায় তাদের সম্মেলন ছিল ভারতেরটা? ভাবটা তাই কিন্তু সত্যিকারভাবে নয়। যেমন আইএস ধরনের রেডিক্যাল ইসলামী সশস্ত্র গ্রুপ- এই হলো অ্যালার্জি বা অগ্রহণযোগ্যতার মাপকাঠি যদি ধরি, তাহলে কী বলা যাবে এমন গ্রুপের বিরোধীদের সম্মেলন ছিল ভারতেরটা? এটা বলা যাবে না। কেন?
কারণ, বাইরে থেকে মনে হতে পারে, হিন্দুত্ববাদী ভারত নিশ্চয় এমন রেডিক্যাল ইসলামী সশস্ত্র গ্রুপদের বিরোধিতা পছন্দ করবে। কিন্তু না করবে না। প্রমাণ কী?
ইদানীং পাকিস্তানের ইমরান খান দুটা ইসলামী গ্রুপ নিয়ে পেরেশান- টিটিপি (তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান) আর টিএলপি (তেহরিক-ই-লাব্বায়েক পাকিস্তান)। এমনকি সুপ্রিম কোর্টও প্রধানমন্ত্রী ইমরানকে সমন জারি করে ডেকে অসন্তুষ্ট জানিয়েছেন। এদের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নিতে প্রধানমন্ত্রী অবস্থান জানিয়েছিলেন। সেনাবাহিনী মনে করে এতে জীবন ও সম্পদ ক্ষয় হবে মাত্রাতিরিক্ত। তাই কৌশল হিসাবে এখনই সামরিক পদক্ষেপ বাতিল করা হয়েছে।
মজার কথা, এই খবর আরো বিস্তারিত ছাপা হয়েছে পাকিস্তানের ‘ডন’ পত্রিকা। আর যা খুবই কম ঘটে থাকে- আমাদের অবাক করে প্রথম আলো এই খবরগুলো ছেপে দিয়েছে ডনের রেফারেন্সে, বিনাদ্বিধায়।
কিন্তু কেন ‘মজার খবর’ বলছি? ডনের খবরে লেখা হয়েছে, সশস্ত্র গ্রুপগুলো ভারতের সাথে সম্পর্কিত। প্রথম আলো ডন-এর রিপোর্ট থেকে অনুবাদ করে লিখেছে, ‘পাকিস্তানের মতে আফগানিস্তানভিত্তিক টিটিপির অন্যতম প্রধান সমর্থক ও অর্থদাতা হলো ভারত। পাকিস্তানে সন্ত্রাসী হামলা চালাতে নিষিদ্ধ গোষ্ঠীটিকে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করে আসছে দেশটি।’ এ ধরনের পাকিস্তান সরকারের পুরা মনোভাব ও পরিকল্পনাই ওই রিপোর্টে আছে। কিন্তু আমাদের এখানকার জন্য এটুকুই যথেষ্ট যে, মোদি-অমিতের কাশ্মির বাঁচাতে তারা পাকিস্তানের অভ্যন্তর অস্থিতিশীল করতে সশস্ত্র ইসলামী গ্রুপের ওপর নির্ভর করতেও রাজি। অর্থাৎ যে অভিযোগ আগে কেবল বেলুচ বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত অথবা একালে উইঘুর সশস্ত্র গোষ্ঠী (ঊঞওগ) এর কথা উঠছে এখন তা অনেক দূরে বিস্তৃত। এখানে উল্লেখ্য, হাজারাদের ওপর আইএসের যে তিন হামলা, তাতে সর্বশেষটাতে হামলাকারী হিসাবে ধৃত ব্যক্তি উইঘুর জনগোষ্ঠীর লোক। কেন? কারণ, তালেবানেরা এই ঊঞওগ গ্রুপকে আফগানে আশ্রয় দিবে না বলে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে প্রতিশ্রুতি দেয়ার পর থেকে এই উইঘুর গ্রুপ আইএসে যোগ দিয়েছে, তাই এই ঘটনা।