ভারতের আফগান নীতিতে পরিবর্তন!
ভারতের আফগান নীতিতে পরিবর্তন! - ছবি সংগৃহীত
এ সপ্তাহে আফগানিস্তান নিয়ে দুটি উদ্যোগ থেকে মিটিং ডাকা হয়েছে। একটার আয়োজক ভারত, অন্যটার পাকিস্তান। ভারতেরটা নিয়ে পাঠক কৌতূহলী হতে পারেন ঠিক ভারতই বুঝাতে চেয়েছি কিনা। কারণ, আমরা জানতাম আমেরিকার বসানো পুতুল- গণি সরকারকে ফিরিয়ে আনা ছাড়া ভারত অন্য কোনো কিছুতে আস্থা রাখে না, এমন ভারতকেই আমরা চিনতাম। হ্যাঁ, তা বটে। কিন্তু ইদানীং তাতে ছোট্ট কিছু মোচড় দেখছি আমরা। তা হলো, ভারত হঠাৎ করে জানাল তারা (নাকি আফগানিস্তানকেই দাওয়াত না করে তবে) আফগানিস্তান ইস্যুতে বিভিন্ন দেশের নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের নিয়ে এক সভা করতে চায়। এমন ইচ্ছা করাটাই অবশ্য ভারতের ‘গণি সরকার’ ছেড়ে অন্য কিছুর তালাশ করা। তাই ভারতের দিক থেকে এটা বাস্তবতা স্বীকার করে নেয়া যে, ‘গণি সরকারকে’ ফিরিয়ে আনতে আবদার এটা বাস্তবের মাটিতে পা রেখে দাঁড়ানো কোনো পক্ষের জন্য কোনো অপশনই নয়। তাই বলা যায়, ভারত যে আফগান ইস্যুতে এক দিকভ্রান্ত মুসাফির হয়ে গেছে; যে আবার দিশা খুঁজতে এবার পথে নেমে পড়েছে তা আর লুকানো থাকল না।
শুধু কি তাই? ভারত কি মনে করে সে এবার পথে পেয়ে যাবে? এক কথায় উত্তর, একেবারেই না। কিভাবে তা জানা গেল? ভারতের মিডিয়ারই ভারতের এই উদ্যোগ থেকে কোনো ফলাফল আসা নিয়ে আস্থায় নেই। যেমন ধরা যাক, এক সহযোগী দৈনিকের নয়াদিল্লি প্রতিনিধি লিখছেন এভাবে : ‘পাকিস্তান বেঁকে বসেছে। মুখ ফিরিয়েছে চীনও। এখন আফগানিস্তান পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে ভারতের উদ্যোগ কতটা ফলপ্রসূ হবে, তা নিয়ে সন্দেহ জেগেছে। তবু ভারত চেষ্টা ছাড়তে রাজি নয়।’ অর্থাৎ স্পষ্ট করেই প্রতিনিধি আমাদের বুঝিয়ে দিচ্ছেন, ভারতীয় উদ্যোগের ওপর তার কোনো আস্থাই নেই।
ভারতের এই উদ্যোগে দাওয়াত পেয়েছিল ইরান, কাজাখস্তান, রাশিয়া, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান ও উজবেকিস্তান। আসলে এতে ভারতসহ সাত রাষ্ট্রকে দেখা গেলেও এতে মূল গুরুত্ব ইরান ও রাশিয়ার। এ দুটোর মধ্যে আবার মূল ওজনটা একমাত্র রাশিয়ার; যদিও ভারত এই সম্মেলনের শিরোনাম দিয়েছে এভাবে : ‘দ্যা দিল্লি রিজিওন্যাল সিকিউরিটি ডায়লগ অন আফগানিস্তান... ’।
কিছু কথা এখানে খুলে বলাই ভালো, বুঝতে সুবিধা হবে তাতে। গত আগস্ট থেকে আফগানিস্তান ইস্যু ভারতের কেন ‘ঘুম হারাম’ হয়েছে সে কথা কাউকে সে খুলে বলতে পারছে না। প্রধানত ঘুম হারাম ঘটনাটা হলো কাশ্মির; অর্থাৎ কাশ্মিরের ভবিষ্যৎ বা তা হাত ছাড়া হয়ে যায় কিনা! কেন?
কারণ মোদি-অমিত খুবই ভীত এজন্য যে, ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট তারা একেবারেই গায়ের জোরে কাশ্মির (পুরোটাই, পাকিস্তান ও চীনের দখলে থাকা অংশসহ) ভারতের স্বাভাবিক অঙ্গ-ভূখণ্ড বলে সংসদে ঘোষণা করেছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। এখানে ‘গায়ের জোরে’ বললাম অনেক কারণে। প্রথমত, নেহরু জানতেন কাশ্মির ভারতের নয়; তাইতো, জাতিসঙ্ঘের কাছে তিনি চিঠি লিখে মতামত চাইলে জাতিসঙ্ঘ গণভোট আয়োজন করে সিদ্ধান্ত নিতে ফয়সালা দিয়েছিল। কিন্তু ভারত তা কখনোই অনুসরণ করেনি। একেবারেই এমন কোনো পদক্ষেপ না নেয়াটা সরাসরি জাতিসঙ্ঘ অমান্য করা হয়- সম্ভবত এমন অনুমানে তিনি কিছু ‘বিশেষ শর্তে’ (যেমন কাশ্মিরে ভারতের মূল ভূখণ্ডের কেউ জমি কিনতে পারবে না ইত্যাদি) তা ভারতভুক্ত করে নেন। সেটাই হলো ভারতের কনস্টিটিউশনের ৩৭০ ধারা ও ৩৫এ। আর গত ২০১৮ সালেও ভারতের সুপ্রিম কোর্টে বিজেপি সমর্থক এক ব্যক্তি মামলা করেছিলেন ৩৭০ ধারা বাতিল করে দিতে; তা এই যুক্তিতে যে ‘ভারতের মূল কনস্টিটিউশন প্রণয়ন কমিটি’ ৩৭০ ধারা যুক্ত করেছিলেন একে ‘অস্থায়ী’ বলে উল্লেখ করে। কিন্তু পরে এ নিয়ে আর কোনো কাজ না করেই ওই প্রণয়ন কমিটি তার আয়ু শেষ, তাই ‘বিলীন’ (ডিসল্ভ) বলে ঘোষণা করে দেয়া হয়। অতএব কোর্ট এখন ৩৭০ ধারাকে বাতিল ঘোষণা করুকÑ এই ছিল আর্জি। কিন্তু কোর্ট রায় দেন, এমন করা যাবে না। কারণ এটা করা হলে আইনিভাবে কাশ্মির আর ভারতের অংশ থাকবে না। তাই আদালত ওই রীট আবেদন বাতিল করে রায় দিয়েছিলেন।
এর অর্থ, ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট অমিত শাহের ৩৭০ ধারা বাতিল ঘোষণা এক অবৈধ কাজ। কিন্তু যেহেতু কেউ এখনো এ ব্যাপারটা আদালতের দৃষ্টিতে আনেনি তাই এটা বৈধ হয়ে আছে।
আবার সুপ্রিম কোর্টের ওই রিট মামলার রায়ে দেখা যাচ্ছে সেখানে পরোক্ষে ধরে নিয়ে রায় দেয়া হয়েছে যে, কাশ্মির ভারতের মূল ভূখণ্ড নয়। তাহলে, অমিত শাহের ৩৭০ ধারা বাতিল ঘোষণা এবং কাশ্মিরকে সরাসরি ভারতের ভূমি বলে দখল করে নেয়া- এটাও অবৈধ। কিন্তু এটাও আদালতের দৃষ্টিতে কেউ আনেনি, তাই এটাও এখন বৈধ হয়ে আছে। এ ছাড়া মোদির জমানায় আদালতের ট্রেন্ড হলো, সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর বিরোধিতা করতে হয় এমন ইস্যু হলে আদালতের এড়িয়ে চলা বা বছরের পর বছর ফেলে রাখা অথবা কোনো একবারের প্রধান বিচারপতি আন্ডারহ্যান্ড ডিলের অভিযোগ মাথায় নিয়েও সরকারের পক্ষে রায় দিয়ে দেয়ার ঘটনা অনেক।
এসব ‘গায়ের জোরের’ মতো হঠকারি কাজের কারণে, আফগানিস্তানে তালেবান ক্ষমতায় আসার পরে মোদি-অমিত চমকে ওঠেন। কারণ এর প্রভাবে আজকের কাশ্মিরে (যেখানে মানুষের কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই, এটা এখন রাজ্যের মর্যাদায় নেই, আইনি রাজনৈতিক মতামত প্রকাশের কোনোই ব্যবস্থা নেই) যদি সশস্ত্র আন্দোলন আবার তুঙ্গে উঠে আর যদি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার মতো পরিস্থিতি এসে যায় তবে সারা ভারতের হিন্দুত্ববাদীরাই ফিরে মোদি-অমিতের চরম বিরুদ্ধে চলে যাবে এই বলে যে, ‘গায়ের জোরে কাশ্মির ভারতের বলে দখল, ৩৭০ ধারা বাতিল’ করা থেকেই ওই বিপর্যয়।
কাজেই মোদি-অমিত এখন চান, যেই আফগানিস্তানে ক্ষমতায় আসুক সে যেন প্রতিশ্রুতি দেয় যে কাশ্মিরে স্বাধীনতাকামী কাউকে সহযোগিতা দেবে না। মজার কথা মোদি-অমিতের এই ঘোরতর মাথাব্যথার ইস্যু কাশ্মির, এ নিয়ে বাইডেন প্রশাসন অন্তত কোনো সমর্থনের অবস্থানে নেই। বরং উল্টো কাশ্মিরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ইস্যু আমেরিকার অভিযোগের তালিকায় আছে। কিছু কংগ্রেস সদস্যও এ নিয়ে সোচ্চার।
তাহলে এখন মূল মুরুব্বি রাশিয়া- সে কেন ভারতকে এই কোল দিতে গেল যাতে ভারত একটা সম্মেলন ডাকতে পারে?