১২০০ বছরের ইতিহাস : দৃষ্টিপাত জরুরি
১২০০ বছরের ইতিহাস : দৃষ্টিপাত জরুরি - ছবি : সংগৃহীত
১.ইসলামি সভ্যতা সুদীর্ঘ ১২০০ বছর বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত ভূখণ্ডজুড়ে প্রতিষ্ঠিত ছিল। হজরত আবু বকর [রা.]-এর মাধ্যমে সূচিত হওয়া খেলাফত ব্যবস্থার ধারাবাহিকতা ১৯২৪ সালে তুরস্কের সর্বশেষ উসমানিয়া খলিফা সুলতান আব্দুল হামিদ হান পর্যন্ত চলে এসেছে। এ খেলাফত ব্যবস্থায় আবু বকর [রা.] থেকে শুরু করে আব্দুল হামিদ হান পর্যন্ত মোট ১০৬ জন খলিফা শাসনকাজ পরিচালনা করেছেন। এই ১০৬ জন খলিফার মধ্যে মাত্র বিশ-বাইশ জন খলিফা কিছুটা অসংযমী ছিলেন। মানে খেলাফতে রাশেদার শাসনব্যবস্থার পুরোপুরি অনুসরণ ও অনুকরণ তাদের পক্ষে সম্ভবপর হয়নি । কিন্তু সামগ্রিকভাবে তাদেরও অনেক ভালো কাজ ছিল।
২. এই ১০৬ জনের মধ্যে অন্তত ৪০ জন এমন খলিফার সন্ধান পাওয়া যায় যাদের শাসন-ব্যবস্থা খোলাফায়ে রাশেদার অন্যতম খলিফা হযরত উমর [রা.]-এর শাসনব্যবস্থার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। তারা আল্লাহর বিধানকে দুনায়াব্যাপী প্রতিষ্ঠিত রাখার ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা পালন করেছেন। তাদের নৈতিকতা, চারিত্রিক নির্মলতা ছিলো অতুলনীয় । শাসনকাজে তারা বিপুল দক্ষতা ও নৈপুণ্যতার পরিচয় দিয়েছেন। তাদের প্রতিষ্ঠিত সভ্যতা পুরোপুরি আদালতের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। কৃষি ও শিল্পে ব্যাপক উৎকর্ষ সাধিত হয়েছিল। অর্থনৈতিকভাবে তারা ছিল সমৃদ্ধ।
৩. পুরো সাম্রাজ্যে কোনো অনুৎপাদনশীল ব্যক্তি ছিল না, সবাই ছিল পরিশ্রমী। সুলতান আমিররা কৃষক শ্রমিকদের সাথে পরামর্শ করে কাজ করতেন। কোষাগার থেকে তাদের সহযোগিতা করতেন। রাষ্ট্রে জাকাত নেয়ার মতো কোনো অভাবি লোক পাওয়া যেত না।
স্যার অ্যাডমন্ড বার্ক বলেছিলেন-
"মুহাম্মদ [সা.]-এর অনুসারীরা যে শাসন-ব্যবস্থার সূচনা করেছিলেন, তাতে অন্তত পরবর্তী ১০০০ বছরের মধ্যে এমন কোনো দুঃসংবাদ আমরা পাই না যে, তাদের দ্বারা শাসিত এলাকার মানুষ দুর্ভিক্ষের শিকার হয়েছে কিংবা কোনো মানুষ না খেয়ে মরেছে।"
৪. ইসলামি সভ্যতা হাজার হাজার মনীষীর জন্ম দিয়েছিল। আলখাওয়ারিজমি, ইবনে সিনা, ইবনে রুশদ, ইবনে হাইসাম, ইবনে খাল্লিকান, জাবির ইবনে হাইয়ান, আল-রাজি, আল-ফারাবি, ইবনে খালদুন, ইমাম গাজালিদের মতো অসংখ্য কিংবদন্তি এ সভ্যতায় বেড়ে উঠেছিলেন। তাদের সমতুল্য একজন মনীষীও পাশ্চাত্য সভ্যতায় দেখা মেলে না । তারা স্থাপত্য, শিল্পকলা, প্রকৌশল ও বিজ্ঞানে অভূতপূর্ব সাফল্য দেখিয়েছিলেন।
এ সভ্যতার ছিলো কুতায়বা বিন মুসলিম, মুসা বিন নুসাইর, তারিক বিন জিয়াদ, মুহাম্মদ বিন কাশিমের মতো দিগ্বিজয়ী সেনাপতি। অপরদিকে ছিল পিরি রেইসের মতো হাজারো অ্যাডমিরাল এবং ইবনে ফিরনাস ও ইখতিয়ার উদ্দিনের মতো অসংখ্য ইঞ্জিনিয়ার।
৫. ইসলামি সভ্যতায় আদালত ও ইনসাফ এবং আখলাক ছিল দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত। সেখানকার পরিবেশ,আব-হাওয়া ছিল ভারসাম্যপূর্ণ । সেখানকার শিল্পায়ন প্রকৃতিকে ধ্বংস করেনি। নদী-সমুদ্র,পহাড় ও বন পুরোপুরি আপন স্বভাবের ওপর বিদ্যমান ছিল।
পরিকল্পিত নগরী, নিরাপদ সড়কব্যবস্থা, মানুষের কর্মসংস্হান ও জীবিকা, সংস্কৃতি ও শিক্ষার বিকাশ, নিরাপদ পানি ও খাদ্যব্যবস্থা, নিরাপদ চিকিৎসা, মৌলিক অধিকার বাস্তবায়ন, বিনোদন এবং সর্বোপরি মানব জাতির কল্যাণে তাদের ভূমিকা ছিলো অনন্য ।
কিন্তু ইসলামি সভ্যতার ইতিহাস লেখার সময় ইউরোপীয়রা তাদের সেসব সমৃদ্ধ কল্যাণের কথা লিখেনি। তাদের পরিবার, সমাজব্যবস্থার কথা তুলে ধরেনি।
তাদের স্থাপত্য ও শিল্পকলার কথা সেখানে প্রাধান্য পায়নি । সবচেয়ে ভয়ানক ব্যাপার হচ্ছে মুসলমানদের যুদ্ধের ইতিহাসকে ইসলামের ইতিহাস নামে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে। অগণিত কল্যাণের প্রস্রবনকে চেপে রেখে মুসলিম শাসকদের ভ্রাতৃহত্যার মতো বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে প্রধান শিরোনামে আলোচনা করা হয়েছে। আজকের পরিস্থিতিতেও ইতিহাসের সেই মূলধারা থেকে বেরিয়ে আমরা বিচ্ছিন্ন ঘটনা ও যুদ্ধের ইতিহাসকে সামগ্রিক ইতিহাস হিসেবে পাঠ করছি । এজন্য পুরো ইসলামি সভ্যতাকে পুনর্পাঠ করা জরুরি।