হাড় নেই, চাপ দেবেন না
হাড় নেই, চাপ দেবেন না - ছবি : সংগৃহীত
এই মর্মান্তিক ঘোষণাটি লেখা ছিল চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মাহাদি জে আফিবের মাথার ব্যান্ডেজে। মাহাদি ছাত্রলীগের কর্মী। যারা তাকে পিটিয়ে মাথার খুলি ভেঙে দিয়েছে তারাও ছাত্রলীগের লোক। করোনা পরিস্থিতিতে দেড় বছর বন্ধ থাকার পর অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো খুলেছিল চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ মাস দেড়েক আগে। কিন্তু খোলার দেড় মাসের মধ্যেই আবার বন্ধ হয়ে গেল চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক)। শিক্ষার্থীরা হল ত্যাগ করেছে।
ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গত ২৯ ও ৩০ অক্টোবর শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিনের অনুসারীদের মধ্যে এই মারামারি হয়। ওই দুই নেতার অনুসারীদের দ্বন্দ্বে উত্তপ্ত হয়ে আছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ও। চমেকে দু’পক্ষের সংঘর্ষে আহত হয়েছেন তিনজন। তারা হলেন, মাহফুজুল হক, নাঈমুল ইসলাম ও মাহাদি জে আফিব। তারা চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। মাথায় গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত মাহাদি জে আফিব মুহিবুল হাসান নওফেলের অনুসারী। আর অন্য দু’জন নাছিরপন্থী হিসেবে ক্যাম্পাসে পরিচিত। আহত তিনজনই দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, মাহাদির মাথা ফেটে থেঁতলে গেছে। তার মাথার খুলি আলগা করে মস্তিষ্কের কিছু অংশ অপারেশন করে পেটের ভেতরে রেখে দেয়া হয়েছে। তবে অবস্থার উন্নতি হলে পরে তার মস্তিষ্ক মাথার খুলির ভেতরে প্রতিস্থাপন করে দেয়া হবে। কলেজ সূত্র জানায়, করোনায় দীর্ঘ দিন বন্ধ থাকার পর গত ১৩ সেপ্টেম্বর কলেজে শ্রেণিকক্ষে ক্লাস শুরু হয়। শুরুর দুই দিনের মাথায় দু’পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। তবে সে সময় কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি।
এ দিকে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সর্বশেষ ঘটনার সূত্রপাত গত ২৯ অক্টোবর শুক্রবার রাত সাড়ে ১১টায় কলেজের প্রধান ছাত্রবাসে। রাতে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মাহফুজুল হক ডাইনিংয়ে খেয়ে নিজের কক্ষে যাচ্ছিলেন। এ সময় তাকে লক্ষ্য করে প্রতিপক্ষের কয়েকজন কটু মন্তব্য করেন।
তখন দু’পক্ষের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে আ জ ম নাছির উদ্দিনের অনুসারীরা ছাত্রলীগ কর্মী মাহফুজুল হক ও নাইমুল ইসলামকে মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের অনুসারীরা মারধর করে। এর জেরে ক্যাম্পাসে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। রাতে মহিবুল হাসান নওফেলের অনুসারীদের দু’টি ও নাছির উদ্দিনের সমর্থকদের একটি কক্ষ ভাঙচুর করা হয়। তার আগে নওফেল সমর্থকরা নাছিরের সমর্থকদের মারধর করে। পরে কলেজ কর্তৃপক্ষ দু’পক্ষেকে বুঝিয়ে শান্ত করে। এরপর কলেজ কর্তৃপক্ষ দু’পক্ষের পাঁচজন করে প্রতিনিধি নিয়ে বৈঠক করেন। সে বৈঠক চলাকালে সকাল ১০টায় মহিবুল হাসান নওফেলের অনুসারী ছাত্রলীগ কর্মী মাহাদিকে ক্যাম্পাসের সামনের রাস্তায় মারধর করে। এরপর পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। দু’পক্ষ ক্যাম্পাসে অবস্থান নিয়ে উত্তপ্ত স্লোগান দিতে থাকে। দুপুর পর্যন্ত ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া হতে থাকে। একপর্যায়ে উপমন্ত্রী নওফেলের সমর্থকরা ক্যাম্পাসে অবস্থান নিয়ে স্লোগান দিতে থাকে। দুপুর পর্যন্ত দু’পক্ষের ধাওয়া-ধাওয়ি চলতে থাকে। একপর্যায়ে মহিবুলের অনুসারীরা অধ্যক্ষের কক্ষের সামনে অবস্থান নেন। এতে অধ্যক্ষ কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। বেলা সাড়ে ১২টায় পুলিশ এসে মহিবুলের সমর্থকদের সরিয়ে দেয়।
কিন্তু যে মাহাদিকে মাথায় সর্বশক্তি দিয়ে আঘাত করে মৃত্যুর মুখোমুখি ঠেলে দেয়া হয়েছে, তার কী হবে? সে তো পড়তে এসেছিল। ভালো ছাত্র। ডাক্তার হতে চেয়েছিল। সে তো লড়ছে মৃত্যুর সাথে। এখন স্থানে স্থানে লীগে লীগে কোন্দল হানাহানি।
ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের অর্ধশতাধিক লোক খুন হয়েছে। কোনো ভিন্ন দল এখানে প্রতিপক্ষ নয়। আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ। সরকার ও নির্বাচন কমিশন মিলে গোটা নির্বাচনব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। নৌকা মার্কা যে পাবে, তার বিজয় নিশ্চিত। নৌকাঅলা যদি তেমন প্রভাবশালী হয়, তা হলে কোনো বিদ্রোহী বা স্বতন্ত্র প্রার্থীকে সে ঠেঙিয়ে নির্বাচনের মাঠ থেকে তাড়িয়ে দেয়। এরপর বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের অবিরাম বলছেন যে, এ ধরনের কৌশলবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। বিদ্রোহী প্রার্থীদের আওয়ামী লীগ থেকে বের করে দেয়া হবে। সে রকম ঘটনা কদাচিৎ ঘটে। দেখা গেছে, দুর্নীতি প্রমাণিত হওয়ায় চেয়ারম্যানশিপ চলে গেছে। তারপর তিনি মুচলেকা দিলেন যে, আর কোনোদিন দুর্নীতি করবেন না। প্রায় পুনর্বহাল হলেন। আবার হলেন চেয়ারম্যান। আবার প্রার্থী। সেটা নিয়ে তুলকালাম চলছে।
আর চলছে ব্যাপকভাবে মনোনয়ন বাণিজ্য। ওবায়দুল কাদের বারবার ক্ষীণ কণ্ঠে হুঙ্কার দিচ্ছেন, টাকা খেয়ে নাম পাঠাবেন না। কিন্তু কেন্দ্রে প্রার্থীর নাম পাঠানোর যিনি দায়িত্বে তিনি সবার কাছ থেকে টাকা পাচ্ছেন। একই আমলে মনোনয়ন পাইয়ে দেবেন বলে একাধিক প্রার্থীর কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা খেয়েছেন। তাদের কেউ কেউ জনসভা করে টাকা ফেরত চাইছেন। সুযোগ পেলেই কোনো প্রমাণ ছাড়াই বিএনপির বিরুদ্ধে যারা মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ তোলেন, এবার তারা কী জবাব দেবেন?
তবে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের ঘটনা মনোনয়ন বাণিজ্যের নয়। তা নয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও। এখানকার সমস্যা প্রভাব বিস্তার। আর বিপুল অঙ্কের চাঁদাবাজির টাকা ভাগাভাগি। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের পুরোটাই একটি বাণিজ্য ভবন। এখানে অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ছোট-বড় দোকানপাট। হাসপাতালের প্রয়োজনীয় সামগ্রীর বিপণি। রেস্টুরেন্ট, ওষুধের দোকান। আর নিত্য বসে শত শত হকার। তাদের কাছ থেকে নিয়মিত চাঁদা আদায় করে ছাত্রলীগ। সে টাকার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে প্রায়ই সঙ্ঘাত বাধে। শিক্ষাজীবনে এই সব ধান্ধায় ব্যস্ত থাকে বলে, এরা যখন কর্মজীবনে প্রবেশ করে তখন ঘুষ খায়। দুর্নীতি করে। এভাবে সরকার এক দুষ্টচক্র তৈরি করে তা লালন করছে।
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে, শুধু দোকানপাট থেকে ছাত্রলীগ চাঁদাবাজি করে তাই নয়। এরা চাঁদাবাজি করে লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স থেকে, লাশ বের করে নেয়ার সময়, মর্গ থেকে লাশ নেয়ার সময়। সেখানে এক অসহনীয় দুষ্টচক্র তৈরি করেছে ছাত্রলীগ।
কলেজ প্রশাসনও বোধ হয় নিরুপায়। যারা হানাহানি করে কলেজ অনির্দিষ্টকাল বন্ধের পরিস্থিতি সৃষ্টি করল, তাদের বিরুদ্ধে কলেজ প্রশাসন সাজার ব্যবস্থা না করে তাদের নিয়ে আলোচনায় বসল। এ ছাড়া বোধকরি প্রশাসনের কোনো উপায়ই নেই। এই দল উপমন্ত্রীর লোক, এই দল আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের লোক। তিনি কার দিকে যাবেন। সে যে বেশি শক্তিশালী বোঝা যায় না। কিন্তু এ রকম আলোচনার সময়ই ঘেরাও হয়ে পড়েন অধ্যক্ষ। কিন্তু ওই দুর্বৃত্তরা কার লোক, সেটা না দেখে যদি তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া যেত, তাহলে হানাহানি যেমন বন্ধ হতো, তেমনি বন্ধ হতো চাঁদাবাজিও।
আর নওফেল না নাছিরের কেন মাস্তান বাহিনী দরকার। সে-ও কি চাঁদাবাজির জন্য? টেন্ডারগুলো নিজের লোকদের জন্য বাগিয়ে নিতে? এখানেও হাজার হাজার কোটি টাকা। ছাত্ররা এসব নেতার পাল্লায় পড়ে ছিঁটাফোটা ভাগের জন্য।
এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের বুঝতে হবে, তাদের পেশিশক্তি ব্যবহার করে কিছু নেতা নামের দুর্বৃত্ত আখের গোছাচ্ছে। ভোটের সময় যাকে খুশি ভোট দেন। কিন্তু লাঠালাঠিতে শরিক হবেন না। লেখাপড়া করুন, অস্ত্র হাতে তুলে নেবেন না।
এখন মাহাদি জে আফিবের মাথায় সাদা ব্যান্ডেজ। তাতে ডাক্তার লিখে দিয়েছেন, ‘হাড় নেই, চাপ দেবেন না।’ সেখানে এঁকে দেয়া হয়েছে বিপজ্জনক চিহ্ন। হামলায়, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার চোখও। চোখও ঢেকে দেয়া হয়েছে ব্যান্ডেজ দিয়ে। প্রতিপক্ষ তাকে কুপিয়েছে। মাথায় শক্ত কিছু দিয়ে আঘাত করে থেঁতলে দেয়া হয়েছে। সিসিটিভি ফুটেজে হামলাকারীদের দেখা গেছে।
তারা কেউ গ্রেফতার হয়েছে বলে শুনিনি। হামলাকারীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা হয়নি কোনো হত্যাচেষ্টা মামলাও। এর পরিণতিতে আরো হামলা কি আসন্ন? আমরা সে অবস্থা দেখতে চাই না। মাহাদির জন্য মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা, সে যেন দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠে।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
rezwansiddiqui@yahoo.com