আফগানিস্তান : ইতিহাসের পাতা থেকে
ইতিহাসের পাতা থেকে - ছবি সংগৃহীত
কেউ আফগানিস্তানে ঢুকতে চাইলে সেটা বেশ সহজ। কিন্তু যখন বেরিয়ে আসতে চাইবেন তখন খুব কঠিন হয়ে যাবে। এমন কথা বলেছিলেন বিশ্ববিজয়ী গ্রিক বীর আলেকজান্ডার। কথাটা তিনি বলেছিলেন, যারা গায়ের জোরে আফগানদের পদানত করতে চান তাদের উদ্দেশে। আলেকজান্ডার কথাটি বলেছিলেন খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩০ অব্দে। সেই সময়ে আফগানিস্তান ছিল পারস্য সাম্রাজ্যের অংশ। পারস্য সম্রাট তৃতীয় দারিয়ুসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে আলেকজান্ডার আফগানিস্তানে ঢুকেছিলেন। তার হাতে দারিয়ুসের বিশাল বাহিনী পরাস্ত হয়েছিল। পরে ভারত আক্রমণ করে ব্যর্থ হন। আরো পরে পারস্যের পূর্বপ্রান্তের প্রদেশ আফগানিস্তানে একটি গ্রিক রাষ্ট্রও প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমান আফগানিস্তান, উজবেকিস্তান ও তাজিকিস্তানের অংশ মিলিয়ে প্রতিষ্ঠিত সেই রাষ্ট্রের নাম ছিল ব্যাক্ট্রিয়া। আলেকজান্ডারের অন্যতম সেনাপতি যার নাম একটি বিস্ময়বাক্যের মধ্যে (সত্যি সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ!) এখনো মানুষের মুখে মুখে আছে সেই সেলুকাসের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত ব্যাক্ট্রিয়ায় গ্রিকরা পরবর্তী তিনশ’ বছর শাসন জারি রাখে। তবে যত বড় বীরই দেশটি দখল করতে গেছেন তাদের প্রায় কেউই অক্ষত ফিরতে পারেননি। সেই আলেকজান্ডারের সময় থেকে বর্তমান পর্যন্ত অসংখ্য বহিঃশক্তি আফগানিস্তান দখল করেছে এবং বা করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু আলেকজান্ডার যে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন তা কেউই মনে রাখেননি।
আফগানিস্তানে দীর্ঘদিন বিদেশী শক্তি টিকে না থাকার পেছনের কারণ হলো ভেতরের শক্তির পাশাপাশি বাইরের শক্তির কারণে বহিরাগত কারো পক্ষে সেখানে দীর্ঘদিন দখলদারিত্ব টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। আফগানিস্তানের ইতিহাস খুঁজলে দেখা যাবে, একটা সময় যখন এখানের অধবাসীরা জরথুস্ট্রীয় ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিল, তখনো কিন্তু বড় একটা শান্ত ছিল না। উপজাতিদের মধ্যে সব সময় কলহ-বিবাদ লেগেই থাকত। সেই কলহের মীমাংসা নিয়ে আবার সংঘর্ষ। কিন্তু একটি বিষয় পরিষ্কার আফগানরা বিদেশী শক্তির বা দখলদারি বা অন্যের কর্তৃত্ব মেনে নেয়নি।
একসময় আফগানিস্তানে আসে ইসলাম। ইসলামের মিশ্র অর্থনীতি ও অন্যান্য বিধিনিষেধে আফগানরা মানিয়ে নিলেও, বিশ্বরাজনীতির যে দখলদারি আগ্রাসন, তাকে কোনোভাবেই স্বীকার করেনি। দেশটি প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর, সেই টানেই বারবার বিদেশী শাসক এসেছেন, আফগানরা তাদের একত্রিত হয়ে তারিয়েছে। পুনরায় নিজেদের মধ্যে সাংঘর্ষিক জীবন অতিবাহিত করেছে।
ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি ফেরালে দেখা যায়, ব্রিটিশরা ১৮৩৯-১৮৪২ সালে এখানে পর্যুদস্ত হয়েছে, এর আগে মুঘল শক্তি। আফগানিস্তান জয় করার প্রধান বাধা তিনটি- এক, আফগানিস্তানের ভৌগোলিক অবস্থা- ইরান, মধ্য এশিয়া ও ভারতের মধ্যবর্তী অঞ্চল আফগানিস্তান বহুবার আক্রান্ত হয়েছে। এ দেশে বসবাসকারী উপজাতিরা বিদেশী শক্তির পক্ষে বিরাট প্রতিকূলতার সৃষ্টি করেছে। দ্বিতীয়ত, বারংবার আক্রমণের মুখে পড়ে এ এলাকার লোকজন আইনের শাসন কী তা জানে না, প্রতিটি গ্রাম এমনকি প্রতিটি বাড়িও যেন এক একটি দুর্গে রূপ নিয়েছে। মারণাস্ত্রের ব্যবহার তাই এদের কাছে স্বাভাবিক। তৃতীয়ত, আফগাননিস্তানের যে চেহারা, তাতে উপজাতিদের এক ধরনের স্বাতন্ত্র্য রয়েছে, যা বিদেশী শক্তির বিজয় ও শাসনকে দুরূহ করে তোলে প্রতিনিয়ত। আফগানিস্তানের চারপাশের পর্বতগুলো খুবই উঁচু, যার মধ্যে রয়েছে হিন্দুকুশ, পূর্ব দিকে পামির, এ ছাড়া রয়েছে কারাকোরাম, তিয়েনমান, কুনলুন এবং হিমালয়। প্রাকৃতিক এই রক্ষাকবচও আফগানদের চরিত্র বদলে দিয়েছে।
ইতিহাসে দেখা গেছে, শেষ পর্যন্ত আফগানরা হারে না। ৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে দেশটি ছিল পারস্যের উপনিবেশ। তখন প্রধান ধর্ম ছিল জরথুস্ট্রবাদ। কিন্তু সেই উপনিবেশ বেশি দিন টেকেনি। যেমন টেকেনি আলেকজান্ডারের রাজত্ব ও মৌর্য সাম্রাজ্যের মেয়াদ। এর বহু পরে আসে আরবরা। সেটা অষ্টম শতক। আফগানিস্তান তখন ছোট ছোট রাজ্য হলেও খুব দুর্গম। আরবরা গান্ধারের জুনবিলদের জয় করতে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়, এটি ছিল তাদের বিজয়ের প্রথম বড় বাধা। জুনবিল উপজাতিদের বিরুদ্ধে বিশ হাজার সৈন্য পাঠানো হলেও ফিরে আসে মাত্র পাঁচ হাজার সৈনিক। আফগানিস্তানে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে সময় লাগে প্রায় দুশো বছর। পারস্যের অধিবাসী ইয়াকুব ইবন আল লাইস অবশেষে কাবুল জয় করেন। ওই সহস্রাব্দের শেষে গজনির সুলতান মাহমুদের আগে পর্যন্ত হিন্দু শাহী সাম্রাজ্য কাবুল শাসন করেছে। এরপর মোঙ্গলরা বামিয়ান উপত্যকায় প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়ে, চেঙ্গিস খাঁর পৌত্র নৃশংসভাবে খুন হন। সেটা ত্রয়োদশ শতক। সেই ক্রোধে মোঙ্গলরা বামিয়ানের মূল বাসিন্দাদের নির্বিচারে হত্যা করতে থাকে। এখনকার যে হাজার সম্প্রদায় সেখানে বাস করে, তাদের বেশির ভাগ মঙ্গোল রক্তের উত্তরসূরি। মোঙ্গল সাম্রাজ্য দুর্বল হলে আফগানিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদ আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
এরপর আসেন বাবর। ভারত বিজয়ের আগে বাবর আফগানিস্তান শাসন করেন দু’দশক। ১৭৩৮ সাল পর্যন্ত হিন্দুকুশের বেশির ভাগ অঞ্চল মুঘল নিয়ন্ত্রণে ছিল। তবে মুঘল শাসনও ছিল সব সময় টলমল। তারপর আসেন নাদির শাহ, এর এক দশক পরে আহমদ শাহ দুররানি। নাদির শাহর মৃত্যুর পর আহমদ শাহ দুররানি আধুনিক আফগানিস্তান প্রতিষ্ঠা করেন। মুঘলদের আফগানিস্তান গজনি থেকে বামিয়ান পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এর পর পারস্যের সাফাভিদ সাম্রাজ্য আফগানিস্তান আক্রমণ করে। যুদ্ধরাজ আফগানদের সাথে সাফাভিদেরও বিস্তর লড়াই করতে হয়েছে।
সাফাভিরা দেশটিতে ইসলামের শিয়া ধারার পথ প্রশস্ত করে। এক্ষেত্রে পশতুনরা ছিল অগ্রগামী। আফগান বিদ্রোহের ফলে শেষমেশ সাফাভি সাম্রাজ্যের পতন ঘটে এবং যুদ্ধবাজ নাদির শাহর উত্থান ঘটে, তার পর আহমদ শাহ দুররানি। তার পর ব্রিটিশ ও রুশরা বুঝেছিল, আফগানিস্তাকে যুদ্ধে পরাজিত করা গেলেও সেখানে শাসন করা অসম্ভব। আফগান উপজাতিদের লড়াই, তাদের দুর্গ, গেরিলাশক্তি প্রভৃতি বিদেশী শক্তিকে পর্যদুস্ত করার পক্ষে যথেষ্ট ছিল এবং আছে। আফগানরা সারা জীবন যুদ্ধ করতে পারে কিন্তু বিদেশীদের পক্ষে কার্যত তা অসম্ভব। এখানকার স্থানীয় শক্তিই শেষ বিচারে জললাভ করে, সেটি ভালো না খারাপ সে প্রশ্ন অবান্তর। এর মানে যদি হয় আফগানিস্তানের স্থিতিশীলতায় তালেবানকে মেনে নেয়া, তবে আফগানদের বড় অংশ ঠিক তাই-ই চায়। কারণ তারা জানে এর বিকল্প হচ্ছে এক অনন্ত যুদ্ধ।
এর সঙ্গে ইসলামকে গুলিয়ে ফেলা বা ইসলামবিদ্বেষ প্রচার একেবারেই ভিত্তিহীন। ফলে উগ্রবাদের উত্থানে আফগানিস্তানের এমন অবস্থা, এ সরলীকরণ আদৌ ধোপে টেকে না। আফগানরা এমন এক জাতি, যাদের যুগ যুগ ধরে সারা জীবন আক্রমণের সাথে বাস করতে হয়েছে। হাল আমলে আন্তর্জাতিক রাজনীতির মানচিত্রে সব চেয়ে শক্তিশালী যুক্তরাষ্ট্র ক্রমান্বয়ে হিরোশিমা নাগাসাকি থেকে লিবিয়, ইরাকসহ আরো একাধিক দেশের মতো আফগানিস্তানকেও ধ্বংস করে গেছে। আফগানিস্তানকে অবশেষে তালেবানের কাছে ফিরিয়ে দিতে হয়েছে। বলা যায় বাধ্য হয়েছে। এর আগে রাশিয়া যখন দেশটিতে দখলদারি কায়েম করে, তখন তালেবানকেই মার্কিনিরা সহযোগিতা করে।