আবি আহমেদের টোপ
আবি আহমেদ - ছবি সংগৃহীত
১৯৭০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে ইথিওপিয়ার মার্কসবাদী সামরিক একনায়কত্বের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক প্রান্তিক হওয়া গোষ্ঠী টাইগ্রিয়ানদের একটি ছোট মিলিশিয়া হিসাবে টিপিএলএফ জন্ম নেয়। দেশটির দুটি বৃহত্তম জাতিগোষ্ঠী, ওরোমো এবং আমহারা মিলিতভাবে জনসংখ্যার ৬০ শতাংশেরও বেশি আর তৃতীয় বৃহত্তম টাইগ্রায়ানরা ৭ শতাংশের মতো। এর পরও টিপিএলএফ দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী বিদ্রোহী বাহিনী হয়ে ওঠে, অবশেষে একটি জোটের নেতৃত্ব দেয় যা ১৯৯১ সালে সরকারের পতন ঘটায়।
টিপিএলএফ এর সাথে ঐক্যবদ্ধ বিদ্রোহী জোট ইথিওপিয়ার ক্ষমতাসীন জোটে পরিণত হয়। টিপিএলএফ-এর নেতৃত্বদানকারী মেলেস জেনাভি, ১৯৯১ থেকে ২০১২ সালে তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ইথিওপিয়াকে নেতৃত্ব দেন। এ সময়কালে অশান্ত অঞ্চলে ইথিওপিয়া একটি স্থিতিশীল দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয় এবং উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয় দেশটিতে। কিন্তু ২০১৬ সালে শুরু হওয়া সরকারবিরোধী বিক্ষোভ আবি আহমদের ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পথ প্রশস্ত করে। তার সরকার টাইগ্রায়ান কর্মকর্তাদের ওপর শুদ্ধি অভিযান শুরু করে এবং টাইগ্রিয়ান নেতৃত্বকে এটি ক্ষুব্ধ করে।
ইথিওপীয় সরকারি বাহিনীর সাথে রয়েছে ইএনডিএফ, আমহারা, আফার, বোনিসাংগুই- গুমুজ, দিরে দাওয়া, গামবেলা, হারারি, অরোমিয়া, সিডামা, সোমালি রিজিয়ন ও এসএনএনপিআর। টাইগ্রিয়ানদের দাবি অনুসারে ইরিত্রিয়া, জিবুতি সোমালিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাত তাদের সহায়তা করছে।
অন্য দিকে বিদ্রোহী ফ্রন্টের সাথে রয়েছে, টাইগ্রের টিডিএফ, অরোমো লিবারেশন আর্মি-ওএলএ, আর্ডোফ আগাউ লিবারেশন ফ্রন্ট, সিদামা ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট, বেশিংগুল পিপলস লিবারেশন ফ্রন্ট, সোমালি স্টেট রেসিসটেন্স, কিমান্ট ডেমোক্রেটিক পার্টি ও গামবেলা পিপলস লিবারেশন আর্মি। ইরিত্রিয়ার বিরোধী দল তাদের সমর্থন করে বলে ইথিওপীয় সরকার দাবি করে। উইকিপিডিয়ার তথ্যে, ইথিওপীয় সরকারি পক্ষে ১ লাখ ৮৩ হাজার এবং বিদ্রোহী জোটের পক্ষে এক থেকে আড়াই লাখ যোদ্ধা রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।
উভয়পক্ষের শক্তিমত্তা দেখলে মনে হয় কোন পক্ষই দুর্বল নয়। তবে এটি যতটা না জাতিগোষ্ঠীকেন্দ্রিক লড়াই, তার চেয়ে বেশি কর্তৃত্ব দখলের লড়াইয়ে রূপ নিচ্ছে। এক সময় টাইগ্রে অঞ্চলকে ইথিওপিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করা লড়াইয়ের লক্ষ্য বলে উল্লেখ করা হতো। এখন বিদ্রোহী পক্ষের মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে আবি সরকারের পতন ঘটানো। আফ্রিকান হর্নে যে কটি রাষ্ট্রে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর জটিল সমীকরণ রয়েছে তার একটি হলো আফ্রিকার দ্বিতীয় জনবহুল দেশ ইথিওপীয়া। আবি আহমদের পিতা ছিলেন মুসলিম আর মা ছিলেন খ্রিষ্টান। তিনি রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষের কারণে পিতৃধর্মের পরিবর্তে মাতৃধর্ম অনুসারে নিজেকে খ্রিষ্টান হিসাবে পরিচয় দেন।
শান্তি উদ্যোগে সাড়া নেই
ইথিওপিয়ার বর্তমান সঙ্ঘাতে কমপক্ষে ১০ হাজার মানুষ মারা গেছে। আর যুদ্ধ ধর্ষণ একটি ‘দৈনন্দিন’ ঘটনা হয়ে উঠেছে। যুদ্ধে জড়িত কিছু প্রধান দলকে সম্পৃক্ত করে শান্তি আলোচনা ও মধ্যস্থতার জন্য প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। ২০২০ সালের ৯ নভেম্বর আফ্রিকান ইউনিয়ন যুদ্ধ বন্ধ করে শান্তি আলোচনার অনুরোধ করে; আবি আহমেদ শান্তি আলোচনা করতে অস্বীকার করেন।
১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১ সালে টিপিএলএফ শান্তি আলোচনার ইচ্ছা প্রকাশ করে এ জন্য আটটি পূর্বশর্ত ঘোষণা করে। ২০ ফেব্রুয়ারি, ন্যাশনাল কংগ্রেস অব গ্রেট টাইগ্রে (বায়টোনা), টাইগ্রে ইন্ডিপেন্ডেন্স পার্টি (টিআইপি) এবং সালসে ওয়েয়ান টাইগ্রে (এসএডব্লিউইটি) আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে ছয়টি দাবি প্রকাশ করে যা টিপিএলএফ এর পূর্ব-শর্তগুলোর মতোই ছিল। টাইগ্রে ইথিওপিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে ২০২১ সালে টাইগ্রেয়ানদের এক বিতর্ক তৈরি হয়। ২০২১ সালে টিপিএলএফ এর মধ্যে সিনিয়র নেতারা এর বিরোধিতা করেন তবে টাইগ্রেতে তরুণদের মধ্যে জনপ্রিয় ছিল স্বাধীনতার জন্য একটি গণভোট আয়োজন করা।
১১ মার্চ ২০২১, ইথিওপিয়ায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত, গীতা পাসি, আন্তর্জাতিক অংশীদার এবং ইথিওপিয়ার ফেডারেল সরকারের যৌথ মানবিক কার্যক্রমের প্রতি সমর্থন ঘোষণা করেন। ২০২১ সালের আগস্টের শুরুতে, সুদান সরকার মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করে। কিন্তু ইথিওপিয়ান সরকার তা প্রত্যাখ্যান করে। এরপর তিনটি আফ্রিকান দেশ, কেনিয়া, নাইজার তিউনিশিয়া এবং একটি অ-আফ্রিকান দেশ, সেন্ট ভিনসেন্ট ও গ্রেনাডাইনস নিয়ে গঠিত হয় আফ্রিকানদের জন্য আফ্রিকান সমাধানের চেতনায় একটি মধ্যস্থতাকারী দল। কিন্তু সমাধানের কোনো সূত্র বের করা সম্ভব হয়নি।
সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার আফ্রিকান ইউনিয়ন কমিশনের চেয়ারম্যান মুসা ফাকি মোহামেত, স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র নেড প্রাইস একটি কূটনৈতিক সমাধানের আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেন। যুক্তরাষ্ট্রও দেশটির ওপর আরো নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকির পুনরাবৃত্তি করেছে।