রেনেসাঁ বাঁধ এবং ইথিওপিয়াকে ইসরাইলের প্রলোভন
রেনেসাঁ বাঁধ - ছবি সংগৃহীত
ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবে আহমেদকে গৃহবিরোধ নিরসনের জন্য ২০১৯ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেয়া হয়েছিল। এখন নীল নদের পানি নিয়ন্ত্রণে রেনেসাঁ বাধ চালু করে আঞ্চলিক নিয়ন্ত্রক শক্তি হবার স্বপ্ন তাকে পরে এমন একদিকে তাড়িয়ে নিয়ে গেছে যেখানে তিনি সম্ভবত হতে যাচ্ছেন ইথিওপিয়ার সবচেয়ে রক্ত ঝরানো সরকার প্রধান। বলা হয়ে থাকে, ইসরাইল ও তার কিছু মিত্র শক্তি নীল নদে বাঁধ দিয়ে বৃহত্তম পানি বিদ্যুৎ প্রকল্প ও সেচ ব্যবস্থার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রলুব্ধ করেছিল ইথিওপিয়াকে। এই নীল নদই হলো মধ্যপ্রাচ্যের বৃহত্তম জনসংখ্যাবহুল আরব দেশ মিসরের মিষ্টি পানির একক উৎস। মিসরের কৃষি ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে মূলত নীল নদকে ঘিরে। নীলের প্রবাহ বন্ধ হওয়ার অর্থ হলো মিসরীয় অর্থনীতির বিপর্যয়ের মুখে পড়া। নীল নদের পানির ওপর প্রায় একইরকম নির্ভরতা রয়েছে সুদানের। ইথিওপিয়ার পানি প্রত্যাহারে সুদানের অর্থনীতিও চাপে। দুই দেশই বাঁধের জলাধার ভরা শুরু করার আগে সমঝোতা চুক্তির জন্য চাপ দিয়ে আসছিল। ইস্যুটি তারা আফ্রিকান ইউনিয়ন থেকে শুরু করে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ পর্যন্ত নিয়ে গেছে। কিন্তু ইথিওপিয়ার আবে আহমদের সরকার এসবের তোয়াক্কা না করে বাঁধের জলাধার ভরার কাজ শুরু করে। আর এতে সুদান ও মিসরে নীল নদের প্রবাহে গুরুতরভাবে টান পড়তে শুরু করে। বিষয়টি মিসরের জন্য রীতিমত বাঁচা মরার প্রশ্ন। তাই কোনও রকম সমঝোতা চুক্তি ছাড়া বাঁধের জলাধার পূরণ বা বাঁধ চালু করা হলে বিমান আক্রমণের পর্যন্ত হুমকি দেয় কায়রো। কিন্তু অনমনীয় থেকে আবে আহমদ ইথিওপিয়ার সামরিক শক্তি বৃদ্ধির প্রতি নজর দিয়েছেন। সে সাথে গৃহ বিরোধগুলোতে সমঝোতার রাস্তা ছেড়ে সামরিক জবরদস্তির পথ গ্রহণ করেন।
এই সঙ্ঘাত ও জবরদস্তির পথ একসময় ইরিত্রিয়াকে ইথিওপিয়া থেকে আলাদা করেছিল। আর সেই পথটি টাইগ্রে ও আরো কয়েকটি অঞ্চলকে ইথিওপিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হবার পরিস্থিতি তৈরি করেছে। ইথিওপিয়া হলো আফ্রিকার মুখখ্যাত অঞ্চলের এমন একটি দরিদ্র দেশ যার বিকাশের অনেক সম্ভাবনা গোত্রীয় বিরোধ ও গৃহ সঙ্ঘাতের কারণে বাস্তবতার মুখ দেখেনি। দেশটির ১০ কোটি জনসংখ্যার ৬০ ভাগের বেশি খ্রিষ্টান যার অধিকাংশ হলো ইথিওপীয় অর্থোডক্স ধারার। ৩৪ শতাংশের মতো অধিবাসী মুসলিম, যাদের প্রায় সবাই সুন্নি। ১ শতাংশের কম জনসংখ্যা ইহুদি, যাদের একটি অংশ ইহুদিদের হারানো গোত্রের অংশ হিসাবে স্বীকৃতি পেয়ে ইসরাইলের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছে। তবে ইথিওপিয়ার এখন যে রাজনৈতিক সঙ্ঘাত তাতে ধর্মের বিষয় কোনো ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়নি। এখানে জাতিগত স্বার্থ ও বিরোধই মুখ্য। এর সাথে নীল নদের বাঁধসহ যার যার স্বার্থের কারণে বিভিন্ন আঞ্চলিক পরাশক্তি যুক্ত হয়ে পড়েছে। বিশেষভাবে ইসরাইল ও তার মুসলিম মিত্র সংযুক্ত আরব আমিরাত ইথিওপিয়ার রেনেসাঁ বাধে বিপুল বিনিয়োগ করেছে। এই বাঁধটি দিয়ে মিসর-সুদানসহ ইসরাইলের প্রতিবেশী আরব দেশের ওপর নিয়ন্ত্রক প্রভাব বিস্তার করতে চায় তারা। অন্য দিকে, বাঁধের ব্যাপারে সমঝোতায় না আসায় মিসর ও সুদান পরোক্ষভাবে বিদ্রোহী শক্তিকে ইন্ধন দিচ্ছে বলে মনে হয়।
মিসর প্রকাশ্যে ইসরাইলের সাথে যতই সম্পর্ক রক্ষা করে চলুক না কেন দুটি ইস্যুকে তার অস্তিত্বের ওপর আঘাত হিসাবে বিবেচনা করে। এর একটি হলো নীল নদের ওপর ইথিওপিয়ার রেনেসাঁ বাধ নির্মাণ আর অন্যটি হলো তার দখলকৃত ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে সুয়েজ খালের বিকল্প খাল তৈরির ইসরাইলের পরিকল্পনা। এই দুটি উদ্যোগের সাথে যুক্ত ইসরাইল ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। এই বিষয়টি বিবেচনায় রেখে মিসর ইসরাইলের কৌশলগত মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বলয়ের একক আশ্রয় থেকে সরে এসে রাশিয়ার সাথে সমান্তরাল সম্পর্ক তৈরি করছে। তুরস্কের সাথে সম্পর্কোন্নয়নের উদ্যোগের সাথেও কৌশলগত সমীকরণের একটি সম্পর্ক রয়েছে বলে মনে হয়।
নীল নদের পানির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এখন পর্যন্ত একটি অহিংস কিন্তু সম্ভাব্য বৃহত্তর সংঘর্ষের পরিস্থিতি চলছে। নির্মাণের ১০ বছর পর, ইথিওপিয়া রেনেসাঁ বাঁধের জলাধার ভরাট শুরু করেছে। ইথিওপিয়া দাবি করে যে প্রকল্পটি দেশের ক্রমবর্ধমান জ্বালানি চাহিদা মেটাতে প্রয়োজনীয়। অন্যদিকে ডাউন রিভার দেশ সুদান এবং মিসর সতর্ক করেছে যে নীল নদের প্রবাহে বিঘ্ন ঘটলে তা ধ্বংসাত্মক হবে। খার্তুম এবং কায়রো দাবি করেছে যে ইথিওপিয়াকে তথ্য শেয়ার করতে হবে এবং তাদের সাথে বাঁধের ক্রিয়াকলাপের নিয়ন্ত্রণ সমন্বয় করবে। তবে এটিকে ইথিওপিয়া তার নিজস্ব সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন হিসাবে খারিজ করেছে। আবি এ ব্যাপারে অপ্রতিরোধ্য রয়ে গেছে এবং টাইগ্রে সংকট রেনেসাঁ বাধ নিয়ে আলোচনা বা আপস প্রত্যাখ্যান করার জন্য তার সংকল্পকে কেবল শক্ত করেছে বলে মনে হচ্ছে।
আনুষ্ঠানিকভাবে, সুদান এবং মিসর এই বিরোধ সমাধানের জন্য রাজনৈতিক ও আইনি উপায় অনুসরণ করেছে, জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদ এবং আফ্রিকান ইউনিয়নের কাছে আবেদন করেছে হস্তক্ষেপ করতে। তবে, উভয় দেশ ইঙ্গিত দিয়েছে যে শান্তিপূর্ণ সমাধান না হলে সামরিক পদক্ষেপ টেবিলে থাকতে পারে। এই বছরের শুরুর দিকে, সুদান এবং মিসর যৌথ সামরিক মহড়ারও আয়োজন করেছিল, এই মহড়াকে ‘নীল নদের অভিভাবক’ নাম দিয়েছিল। এই দু’দেশ আনুষ্ঠানিক সামরিক পদক্ষেপের আগে প্রক্সি লড়াইয়েও যুক্ত হতে পারে। ইথিওপিয়ার বর্তমান সঙ্ঘাতে তাদের গোপন সংশ্লিষ্টতা উড়িয়ে দেবার মতো নয়।
এখন কী হবে?
ইথিওপিয়ার সরকার জুন মাসে একতরফা যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেছিল। এখন টাইগ্রিয়ান বাহিনী আঞ্চলিক রাজধানী মেকেলে পুনরুদ্ধার করে যুদ্ধটি টাইগ্রের সীমানা ছাড়িয়ে পার্শ্ববর্তী আমহারা এবং আফার অঞ্চলে ছড়িয়ে দিয়েছে। ইথিওপিয়ার মানুষের অধিকারের জন্য লড়াই করা সবচেয়ে জনবহুল অঞ্চল ওরোমিয়ার বিদ্রোহী দল ওরোমো লিবারেশন আর্মির সাথে জোট করার পর টিপিএলএফ-এর অনুগত যোদ্ধা টাইগ্রে ডিফেন্স ফোর্সেস সামনের লাইনটিকে আরো দক্ষিণে ঠেলে দিয়েছে।
বিদ্রোহী যোদ্ধারা আদ্দিস আবাবার রাস্তার দুটি প্রধান শহর ডেসি এবং কমবোলচা দখল করেছে, ইথিওপিয়ার নেতাদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি করেছে যে রাজধানী পতন হতে পারে।
বিদ্রোহী জোটের মুখপাত্র বলেন, রাজধানী শহরে প্রবেশের সিদ্ধান্ত নেয়া হবে ফেডারেল সরকারের সাথে আলোচনায় ফলাফল কী হয় তার উপর ভিত্তি করে। গ্রুপটি অত্যন্ত ঘন জনবহুল শহরে সরাসরি সামরিক সংঘর্ষ এড়াতে চায় বলে উল্লেখ করেছে। অবশ্য আবি আহমেদের সর্বশেষ ঘোষণা এবং টাইগ্রের ওপর বিমান হামলা জোরদার করাতে তিনি সঙ্ঘাতের পথ বেছে নেবেন বলে মনে হচ্ছে। এখন দু’পক্ষের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সঙ্ঘাতের পথ বন্ধ করা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সক্রিয় উদ্যোগের ওপর নির্ভর করবে। বিশ্ব শক্তিসমূহের মধ্যে জটিল স্বার্থের টানাপড়েনের কারণে নিরাপত্তা পরিষদের শক্তি প্রয়োগে শান্তি স্থাপনের দৃষ্টান্ত সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নেই বললেই চলে।
mrkmmb@gmail.com