জার্মানিতে এক নারীর উত্থান যেভাবে
বেরবেল বাস - ছবি সংগৃহীত
২০তম নির্বাচনের চার সপ্তাহ পরে গত ২৬ অক্টোবর জার্মান পার্লামেন্ট তাদের অভিষেক অনুষ্ঠানে এসপিডি দলীয়, ডুইসবুর্গ থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য মিসেস বেরবেল বাসকে নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত করেন। ৭২৪ ভোটের মধ্যে মিসেস বাসকে ৫৭৬ সদস্য পক্ষে ভোট দিয়েছেন; বিপক্ষে ৯০ এবং ৫৮ সদস্য ভোটদান বিরত ছিলেন। ৫৩ বছর বয়সী মিসেস বাস ৭৯ বছর বয়স্ক মি. ভলফগাং শয়েবলের স্থলাভিষিক্ত হলেন। মিসেস বাস ২০০৯ থেকে ‘বুন্দেসটাগ’ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। উল্লেখ্য, এটা পূর্বেই অনুমান করা হচ্ছিল, যেহেতু রাষ্ট্রপতি পুরুষ এবং সম্ভাব্য চ্যান্সেলরও পুরুষ তাই রাষ্ট্রের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে একজন নারীই এবার অগ্রাধিকার পাবেন। শুধু তাই নয়; পার্লামেন্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে অতিরিক্ত আরো তিনজন নারীকে নির্বাচিত করেছে। জার্মান সংসদে সর্বোচ্চ সংখ্যক আসনপ্রাপ্ত দল থেকেই পার্লামেন্ট প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে থাকেন। যিনি রাষ্ট্রীয় প্রিসিডেন্স অনুযায়ী চ্যান্সেলরেরও উপরে এবং রাষ্ট্রপতির নিচে।
ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে মিসেস ইভনে মাগভাস সির্ডিউিউ/সিএসউ (প্রাপ্ত ভোট ৬০০) ক্লাউডিয়া রথ গ্রীনপার্টি, (প্রাপ্ত ভোট ৫৬৪,) ভলফগাং কুবিকি এফডিপি (প্রাপ্তভোট ৫৬৪,) আইদান ওসোগ্রুস (প্রাপ্তভোট ৫৪৪ )এবং পেট্রা পাউ লিংকে (প্রাপ্তভোট ৪৮৪) নির্বাচিত হয়েছেন। গতবারের মতো এবারও বর্ণবাদী দল এএফডি থেকে মনোনীত প্রার্থী মি. মিখাইল কাউফমান নির্বাচিত হতে পারেননি। তিনি পেয়েছেন পক্ষে ১১৮ যা পাস করার জন্য যথেষ্ট নয়। তবে তাদের আসন সংখ্যা ৮২ অর্থাৎ অন্যান্য দল থেকে আরো ৩৬ জন সদস্য তাদের প্রার্থীকে ভোট দিয়েছেন। এএফডিকে নিয়ে এবারও বেশ নাটকীয়তা হয়েছে। তবে বিদায়ী প্রেসিডেন্ট মি. শয়বলেও বর্তমান প্রেসিডেন্ট মিসেস বাস তাদের অত্যন্ত বিনয়ের ও বুদ্ধিমত্তার সাথে মোকাবেলা করেছেন।
২০তম সংসদের অভিষেক অনুষ্ঠানে নিম্নলিখিত সিদ্ধান্তগুলো নেয়া হয়েছে : বুন্দেস্টাগ প্রেসিডেন্ট মিসেস বেরবেল বাস ও চারজন ভাইস প্রেসিডেন্টকে নির্বাচিত করা হয়। এএফডি প্রার্থী ভাইস প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্যে ৩৬৯ ভোট সংগ্রহে ব্যর্থ। জার্মান শাসনতন্ত্রের আর্টিকেল ৬৯-এর ক্ষমতাবলে মহামান্য রাষ্ট্রপতি বিদায়ী চ্যান্সেলার ড. মার্কেল ও তার মন্ত্রিপরিষদকে অনুরোধ করেছেন নতুন চ্যান্সেলর ক্ষমতা গ্রহণ না করা পর্যন্ত সরকারের রুটিন কাজগুলো চালিয়ে যেতে। উল্লেখ্য, রাষ্ট্রপতির এই অনুরোধ উপেক্ষা করার অধিকার চ্যান্সেলর বা মন্ত্রীদের নেই। লক্ষ করার বিষয়, জার্মান সংসদের প্রেসিডিয়ামে এবার মহিলাদের আধিক্য।
নির্বাচিত হওয়ার পর প্রথম ভাষণেই মিসেস বাস প্রথমে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন পূর্বসূরি ও ১৯৭২ সাল থেকে যিনি পার্লামেন্ট সদস্য ও প্রেসিডেন্ট ভলফগাং শয়বলেকে। তিনি আরো বলেন, আমার আন্তরিক চেষ্টা থাকবে সব সংসদ সদস্যের প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য। সর্বোপরি আমাদের রাজনীতি জনগণের আরো কাছে নিয়ে যাবার আপ্রাণ চেষ্টা থাকার। আমাদের শ্রদ্ধা জনগণের প্রতি এবং জনগণও যাতে রাজনীতিকদের সম্মান করেন এই প্রত্যাশা আমার। মিসেস বাস হচ্ছেন জার্মান পার্লামেন্টের ইতিহাসে তৃতীয় মহিলা যিনি প্রেসিডেন্টের পদ অলকৃত করছেন।
পূর্বের দুজন মিসেস আনেমারী রেনগার (এসপিডি : ১৯৭২-১৯৭৬) ও রিতা সুইসমুথ (সিডিউ : ১৯৮৮-১৯৯৮)। প্রাক্তন বুন্দেসটাগ প্রেসিডেন্টসহ অনেক রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ জার্মান ভোট পদ্ধতি নিয়ে, বিশেষ করে পার্লামেন্টের অপ্রয়োজনীয় সদস্য সংখ্যার সমালোচনা করে বর্তমান ভোট পদ্ধতির সংস্কারের দাবি করছেন। সেপেলিন বিশ্ববিদ্যালয়ের বুন্দেসটাগের গবেষক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. বেহমকের মতে, অতিরিক্ত সদস্য সংসদ প্রতিনিধিদের কোয়ালিটি খর্ব করে ও সরাসরি না হলেও সংসদের আকার বড় হতে সাহায্য করে।
সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ভোটারের প্রথম ভোট দ্বারা নির্বাচিত প্রত্যেক সংসদীয় আসনের জন্য ডিরেক্ট ম্যান্ডেটপ্রাপ্তরা। উদাহরণস্বরূপ, অধ্যাপক বেহমকের মতে, জাকসেন প্রদেশ- সেখানে ১৬ আসনের মধ্যে এএফডি ১০টি সরাসরি আসন জিতেছে প্রথম ভোটের সাহায্যে। রাজ্যে এএফডির প্রথম ভোটের হার ২৪.৬%। সিডিউ : ২৪.৪%, এসপিডি : ২০.০%, এফডিপি : ৯.৮%, গ্রীন ৫.০% ও লিংকে ৭.৯%। প্রশ্ন হচ্ছে, সারা দেশে যে দলের ভোটারের সংখ্যা অতি নগণ্য বা যারা কখনই ৫০% বা তার বেশি ভোট পেয়ে সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় আসন সংগ্রহ করার ক্ষমতা রাখে না, উপরন্তু দ্বিতীয় ভোটের মাধ্যমে যারা নির্বাচিত হবেন, উল্লিখিত সদস্যদের তখন বাদ দেয়া হবে। অথচ এদের হিসেবে নিয়ে অন্য দলগুলোকে অতিরিক্ত ও ক্ষতিপূরণ ম্যানডেট দিয়ে পার্লামেন্টের আকার বড় করা হলো; অথচ এই সদস্যদের দ্বারা জনকল্যাণ কিছুই হচ্ছে না। একই উদাহরণ ব্যাভারিয়া প্রদেশের সিএসউর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য যা রাষ্ট্রের ক্ষতি এবং এই ক্ষতি নিরাময়ের জন্যই সংস্কার প্রয়োজন।
লেখক : জার্মান গ্রাজুয়েট এবং জাবির ভাষা শিক্ষাকেন্দ্রের খণ্ডকালীন জার্মান ভাষা শিক্ষক