নষ্ট রাজনীতির অন্তরালে
নষ্ট রাজনীতির অন্তরালে - ছবি সংগৃহীত
কোন দেশ কতটা উন্নত এবং কোন জাতি কতটা সভ্য তা নির্ভর করে তার শিক্ষা, জীবনাচার, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ প্রভৃতির ওপর। গণতান্ত্রিকভাবে সে দেশ কিংবা সমাজ চলছে কি না তার ওপরও অনেক কিছু নির্ভর করে। অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল হলেই সে জাতি কিংবা দেশ উন্নত হবে বিষয়টা এমন নয়। অর্থনীতি জীবনের অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ নয়। জাপান বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ। স্বনির্ভর। আত্মমর্যাদা সম্পন্ন। কিন্তু এসবের সাথে তাদের বিনয় এবং উন্নত মূল্যবোধ ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। কয়েক বছর আগে জাপানের বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে দেয়া এক ভাষণে বলেছিলেন, আমি কতটুকু করেছি সেজন্য প্রশংসা করবেন না। সেটা আমার দায়িত্ব ছিল। যেটা করতে পারিনি সে জন্য আমি দুঃখিত এবং ক্ষমা প্রার্থনা করছি। কী রাষ্ট্রনায়কোচিত বক্তব্য। কি বিনয়! এর মধ্যে লুকিয়ে আছে সম্মান আর আত্মমর্যাদা। একটা জাতি উন্নত হতে সময় লাগে। এজন্য চিন্তার ঐক্য থাকতে হয়। ভাবনার জায়গা এক হতে হয়। ব্যথা বেদনা দুঃখ কষ্ট মিলে মিশে এক রকম হতে হয়। উন্নত নৈতিকভিত্তি উন্নত জাতি গঠনে সবচেয়ে বড় নিয়ামক শক্তি। ক্ষুদ্র জাতি রাষ্ট্রগুলো টিকে থাকে নিজস্ব উন্নত নৈতিক ভিত্তির ওপরে।
বাংলা উইকপিডিয়ার মতে, নৈতিক ভিত্তি কি? ‘নৈতিকতা’ যার অর্থ -ভদ্রতা, চরিত্র, উত্তম আচরণ। এটি মূলত উদ্দেশ্য, সিদ্ধান্ত এবং কর্মের মধ্যকার ভালো-খারাপ, উচিত-অনুচিতের পার্থক্যকারী। নৈতিকতা হলো কোনো মানদণ্ড বা নীতিমালা যা নির্দিষ্ট কোনো আদর্শ, ধর্ম বা সংস্কৃতি থেকে আসতে পারে।
পৃথিবীতে রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে জাতিতে জাতিতে প্রভেদ আছে। আমেরিকানদের জাতিগত মূল্যবোধ গণতান্ত্রিক চর্চার ক্ষেত্রে প্রসংশার দাবি রাখে। ব্রিটিশদের মধ্যেও এ চর্চা প্রবল। চীন, জাপান, জার্মানি সব দেশই স্বাজাত্যবোধে এমনভাবে উদ্দীপ্ত যে, সেখানে অন্যকিছু চিন্তাই করা যায় না। আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী ভারত। ভাষা কৃষ্টি কালচার অনেক কিছুর সাথে আমাদের সাদৃশ্য রয়েছে। কিন্তু ভারতীয়রা দেশপ্রেম এবং জাতীয় স্বার্থের ভাবনায় এতদূর অগ্রসর হয়েছে যে হাজারো ভাষা বর্ণ সংস্কৃতির বৈচিত্র্য সত্ত্বেও টিকে আছে। ভবিষ্যতে এক অজেয় জাতি হওয়ার স্বপ্ন দেখে। এসব কথা বলা এ কারণে যে, বেশ কিছু ক’দিন আগে বাংলাদেশে এক ধরনের ঝড় বয়ে গেছে। সিনেমা জগতের নায়ক-নায়িকাদের ধরপাকড় করা হয়। নায়িকা পরীমণি, পিয়াসা, মৌ, রাজ প্রমুখকে আইন-শৃংখলা বাহিনীর হাতে আটক হন। তাদের একের পর এক পুলিশি রিমান্ডে নেয়া হয়। এসব ছাপিয়ে আলোচনায় আসে পুলিশের এক তরুণ কর্মকর্তার নাম যিনি জড়িয়ে যান স্ক্যান্ডালে। গোলাম সাকলায়েন নামে ওই গোয়েন্দা পুলিশ কর্মকর্তার সাথে নায়িকা পরীমণিকে জড়িয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বহু ছবি ও খবর ছড়িয়ে পড়ে। এর আগে হেলেনা জাহাঙ্গীর নামে সরকারি দলের এক ব্যবসায়ী নেত্রীকে পুলিশ গ্রেফতার করে মাদক কারবার ও প্রতারণার অভিযোগে। আমরা মাঝে মাঝে দেখছি সরকারি দলের এক শ্রেণীর নেতাকর্মী প্রভাবশালী ব্যক্তি পুলিশের জালে ধরা পড়ছেন। ইসমাইল হোসেন সম্রাট, শাহেদ করীম, খালিদ হোসেনরা এখনো জেলে। প্রভাবশালী হওয়া সত্ত্বেও তারা সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশে গ্রেফতার হন এবং এখনো কারাগারে। দেশের অন্যতম সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রিন্সিপাল কামরুন্নাহারের একটি ভিডিও ক্লিপ নেট দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে তিনি তার কলেজের একজন অভিভাবক প্রতিনিধির সাথে যে ভাষায় কথা বলেছেন তা অভব্য। অত্যন্ত নীচুমানের ভাষা প্রয়োগ করে তিনি বলেছেন, ‘অতীতে তিনি রাজনীতি করতেন। এবং তিনি নিজে মোটেও ভালো মানুষ নন। মাথার নিচে পিস্তল নিয়ে তিনি ঘুমাতেন।’ তার এ কথার কারণে উচ্চ আদালতও বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।
বলছিলাম আমেরিকানদের কথা। দেশটিতে নারী-পুরুষের সম্পর্ক একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। কিন্তু আমেরিকান আমজনতা যাই করুক না কেন তাদের কোনো নেতা কিংবা পদস্থ কেউ কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়লে ছাড় দেন না। বিল ক্লিনটনের সাথে মনিকা লিউনস্কির কাহিনী নিয়ে গদি টলমলে হয়ে গিয়েছিল। শেষতক তিনি জাতির কাছে ক্ষমা চেয়ে পার পান। হাজারো কিচ্ছা কেলেঙ্কারিতে ভরপুর সমাজে তারা তাদের নেতাদের চরিত্রকে উন্নত এবং একটি নৈতিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত দেখতে চান। তাই সেখানে নেতাদের কালিমাযুক্ত কোনো কিছুই তারা মানতে পারেন না। তারা মনে করেন, সাধারণ মানুষ যাই করুন না কেন, নেতা হতে হবে নিষ্কলুষ। এ জন্য পাশ্চাত্যে এবং উন্নত অনেক দেশেই নেতাদের কেলেঙ্কারি ফাঁস হলে তাদের পতন পর্যন্ত হয়ে যায়।
বাংলাদেশে কার্যত এখন কোনো রাজনীতিই নেই। প্রধান দু’টি দলের নেতাদের মধ্যে প্রত্যেক দিনই আমরা বাক্যবিনিময় দেখি। কিন্তু গঠনমূলক কোনো আলোচনা আমরা দেখতে পাই না। গঠনমূলক কোনো আলোচনা এখানে হয় না। পরচর্চা আর পরস্পরের নিন্দা মন্দ বলা এখন অতি সাধারণ ঘটনা। জাতীয় কোনো সঙ্কট, ক্রান্তিকাল নিয়ে আলোচনা হয় না। বাংলাদেশে দীর্ঘ দিন দুটি দল দেশ পরিচালনা করেছে। একটি বিএনপি, অন্যটি আওয়ামী লীগ। দুটি দলেরই ঐতিহ্য রয়েছে। রয়েছে দেশ পরিচালনার অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতা বিনিময়ের মাধ্যমে দেশকে সমৃদ্ধ করা যায়। অনেক সঙ্কট সহজে নিরসন করা সম্ভব। কিন্তু এটি এখন দুরাশা। আমরা আলোচনার পরিবর্তে চুপ করে বসে থাকি কি করে অন্যের ভুল ধরা যায়। সমালোচনা করা যায়। এমনো দেখা যায়, অনেকের কাজই এমন যে প্রতিদিন কিছু বলতে হবে। অন্যের সমালোচনা করতে হবে। রাজনৈতিক ময়দানে বিভেদ থাকবে। দ্বিমত থাকবে। কিন্তু সব ছাপিয়ে থাকতে হবে শ্রদ্ধাবোধ। সেই শ্রদ্ধাবোধের জায়গাটা হারিয়ে গেছে।
দেশে ঘটে যাওয়া প্রতিটি ঘটনার পেছনে রাজনীতি থাকে। রাজনীতি উন্নত বিশ্বেও থাকে। আমরা খালি চোখে যেটা দেখি আড়ালে লুকিয়ে থাকে অন্য সত্য। নতুন ঘটনা। আমরা সব সময় বুঝতে পারি না। সেলিব্রেটিদের বিরুদ্ধে গ্রেফতার অভিযানের পেছনে যে রাজনীতি লুকিয়ে আছে সেটা প্রকাশ হতে হয়তো কিছু দিন সময় লাগবে। সমস্যা হচ্ছে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বের হয়ে যাওয়া। হেলেনা জাহাঙ্গীরের কথাই বলি, শাহেদ করীম কিংবা পরীমণির কথাই বলি। তারা কেউ নিজে থেকে এত দূর আসতে পারেননি। কারো না কারো প্রশ্রয়ে সামনে এগিয়েছেন। তাদের আছে রাজনৈতিক গুরু। যার আশ্রয় কিংবা প্রশ্রয়ে বেড়ে ওঠা। হৃষ্টপুষ্ট হওয়া। এখন প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে কিংবা স্বার্থের টানাপড়নে ছিটকে পড়েছেন। সমাজের এ এক ক্ষত।
উন্নত দেশে সরকার আসে সরকার যায়। কিন্তু সিস্টেম টিকে থাকে। আর এ সিস্টেম যে নিয়মনীতির ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে সেখানে নাগরিকরা নিরাপত্তা পান। কোনো নাগরিক বৈষম্যের স্বীকার হন না। ইনসাফ থাকে। আমাদের এখানে এসবের বড় অভাব। এখানে সরকার এসেই আগের সরকারের রেখে যাওয়া কাজগুলো বদলাতে থাকে। অবস্থা একেবারে শূন্যে নামিয়ে ফেলে। এতে মেধাহীন চাটুকার শ্রেণীর উত্থান ঘটে। তারা স্বার্থচিন্তায় চলেন। সরকার দিনশেষে বিপদে পড়লে আস্তে করে কেটে পড়েন।
উপমহাদেশের আমলাতন্ত্র ব্রিটিশদের উত্তরাধিকার। অধিকাংশ আইনো ব্রিটিশদের করা। দীর্ঘ সময়েও আমরা এসব আইন বহন করে চলেছি। প্রশাসন কিংবা আমলাতন্ত্র এ থেকে বের হতে পারেনি। শোবিজের অভিযানে মন্দভাবে পুলিশ প্রশাসনের একটি অংশের কদর্য দিক বের হয়ে এসেছে। আমাদের সংবিধানের মূল চেতনা ছিল নাগরিকদের মধ্যে বঞ্চনা কিংবা বৈষম্য সৃষ্টি না করা। মেধার ভিত্তিতে সরকারি চাকরিতে সমান প্রবেশাধিকারের নিশ্চয়তা দেয়া। চাকরি ক্ষেত্রে বঞ্চনা কিংবা বৈষম্য থাকলে নাগরিকদের মধ্যে সমতার মনোভাব সৃষ্টি হয় না। আলোচিত পরীমণি কাণ্ডে পুলিশের একজন কর্মকর্তার নাম জড়িয়ে যাওয়ায় জনমনে তীব্র অসন্তোষ দেখা দেয়। পুলিশের একজন পদস্থ কর্মকর্তার যদি এতটুকু পরিমিতিবোধ না থাকে, কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে যায়; তাহলে চলবে কিভাবে? বস্তুত বর্তমান সরকার দায়িত্বগ্রহণের পর থেকেই পুলিশকে অতিরিক্ত ক্ষমতা চর্চার সুযোগ দেয়া হয়েছে রাজনৈতিক স্বার্থেই। পুলিশের মধ্যে এখন একথা ওপেন সিক্রেট যে সরকারকে তারাই ক্ষমতায় এনেছেন এবং তাদের জন্যই সরকার টিকে আছে। এ মনোভাব নিয়ে চলার কারণে তাদের মধ্যে আইন না মানার একটি প্রবণতা গড়ে উঠেছে। এ মনোভাব খুবই ভয়ঙ্কর। আলোচিত পুলিশ কর্মকর্তা সিভিল সার্ভিসে যোগ দেয়ার আগে যথেষ্ট মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন। তিনি ৩০তম বিসিএসে পুলিশ ক্যাডারে প্রথম হন। কিন্তু তা সত্ত্বেও কিভাবে তিনি কেলেঙ্কারিতে জড়ালেন অবাক করার মতো। এর অন্যতম কারণই হচ্ছে পুলিশের কতিপয় সদস্যের বেপরোয়া মনোভাব। তারা যে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী এবং তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ যে অন্য অনেকের চেয়ে আলাদা সেটি বেমালুম ভুলে গেছেন। এ মনোভাব এক দিনে তৈরি হয়নি। এখন বড় আকারে প্রকাশ পেয়েছে। রাতের আঁধারে ভোটারবিহীন নির্বাচনে পুলিশকে কাজে লাগানোর ইতিহাস সৃষ্টি যারা করেছেন এসব ঘটনায় তারা কি বলবেন জানি না। পুলিশের পেশাদারিত্ব এখন এমন নিম্নমুখী হয়েছে যা না বলাই ভালো। নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রের এই জামানায় মাঝে মাঝে পত্রিকার শিরোনাম হয় ব্যবসায়ীকে আটকে রেখে পুলিশের চাঁদাবাজির খবর। গত আগস্টে ফেনীতে ছয় ডিবি পুলিশ গ্রেফতার হন স্বর্ণ ব্যবসায়ীর কাছ থেকে স্বর্ণ ছিনতাইয়ের কারণে।
এসব আলোচনার মধ্যেই খবর বেরোয় আরেক কেলেঙ্কারির। মোক্তার হোসেন নামের এক পুলিশ সুপারের বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা করেন এক নারী পুলিশ ইন্সপেক্টর। ১২ আগস্ট ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭ এ মামলার আবেদন করেন ওই নারী পুলিশ কর্মকর্তা। এরপর শুনানি শেষে উত্তরা (পূর্ব) থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে বাদির অভিযোগ এজাহার হিসেবে গণ্য করার নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনালের বিচারক কামরুন নাহার। বাদির আইনজীবী সালাউদ্দিন খান সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ট্রাইব্যুনাল আদেশে উল্লেখ করেছেন অভিযোগের প্রাথমিক উপাদান মামলার আরজিতে রয়েছে। তাই এজাহার হিসেবে গণ্য করার নির্দেশ দেয়া হলো। নারী পুলিশ কর্মকর্তা অভিযোগে বলেন, দীর্ঘ দিন পুলিশে সুনামের সঙ্গে কাজ করায় ২০১৮ সালে সরকার তাকে জাতিসঙ্ঘ শান্তিরক্ষী মিশনে সুদানে পাঠায়। সুদানের দারফুর সদর দফতরে পদায়ন করা হয় তাকে। অভিযুক্ত মোক্তার হোসেনকে পুলিশ সুপার (এসপি) ও বাংলাদেশ পুলিশ কন্টিনজেন্ট কমান্ডার হিসেবে ২০১৯ সালের মে মাসে সুদানে পাঠানো হয়। একই বছরের অক্টোবরে এসপি মোক্তার হোসেন দারফুরে যোগ দেন। আরজিতে বলা হয়, এসপি মোক্তার হোসেন প্রায়ই তার পারিবারিক অশান্তির কথা বাদিকে বলতেন। শুনতে না চাইলেও জোর করে শোনাতেন। ২০১৯ সালের ২০ ডিসেম্বর বাদিকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে সম্ভ্রমহানি করেন। পরে মোক্তার হোসেন ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চান। সেই সঙ্গে হুমকি দেন, এ ঘটনা বলাবলি করলে তোমার চাকরি থাকবে না। দেশে পাঠিয়ে দেয়া হবে। এরপরও কয়েক দফায় সুদান বিমানবন্দরের পাশের হোটেলে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে সময় কাটান।
আশ্বাস দেন দেশে গিয়ে বিয়ে করবেন। ২০২০ সালের ২৬ জুলাই ভুক্তভোগীর মিশন শেষ হয়। এরপরও পাঁচ দিন সুদানের খার্তুম বিমানবন্দরের পাশের একটি হোটেলে রাখেন অভিযুক্ত এসপি। ৩০ জুলাই তিনি দেশে ফেরেন। অভিযুক্ত এসপি গত বছর নভেম্বরে ছুটিতে দেশে আসার পর ১০ থেকে ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত বাদিকে উত্তরার হোটেল ডি মেরিডিয়ানে রাখেন। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি মিশন শেষ করে দেশে আসার পর মোক্তার হোসেন বাদিকে নিয়ে ২১ থেকে ২৪ ফেব্রুয়ারি হোয়াইট হাউজ হোটেলের ২০৯ নম্বর কক্ষে ওঠেন এবং বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ফের শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। গত ১২ এপ্রিল বাদি অভিযুক্তের বাসায় গেলে (রাজারবাগ মধুমতি অফিসার্স কোয়ার্টার) তাকে মারধর ও অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি করে তাড়িয়ে দেয়া হয়। নারী পুলিশ পরিদর্শকের অভিযোগ, এসপির কথামতো তিনি তার স্বামীকে তালাক দেন। আদতে তাকে বাধ্য করা হয় তালাক দিতে। কিন্তু তালাকের পর তাকে বিয়ে করতে অস্বীকার করেন। বাদির আইনজীবী সালাউদ্দিন খান বলেন, ভুক্তভোগী পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ঘটনা জানিয়েছেন। কিন্তু কোনো প্রতিকার পাননি। আবার থানায় মামলা দায়ের করতে গেলে প্রথমে মামলা নেয়নি। পরে আদালতের নির্দেশে মামলা রুজু করা হয়। আলোচিত পুলিশ কর্মকর্তা ২৪ বিসিএস ব্যাচের কর্মকর্তা। এসব খবর আমাদের বিচলিত করে। আমরা মর্মাহত হই। আশার কথা, সরকারই এখন এসবের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিচ্ছে। এর শেষ কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় দেখতে অপেক্ষা করতে হবে।
প্রশাসনের অন্য স্তরেও নীতি নৈতিকতার তীব্র সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এখানে পুলিশ ক্যাডারকে এককভাবে দুষে লাভ নেই। ২০১৯ সালের আগস্ট মাসে জামালপুরের তৎকালীন ডিসি আহমেদ কবীর একজন নারী সহকর্মীর সাথে কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েন। তার পদাবনতি ঘটে। তদন্তে তাকে শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়। কুড়িগ্রামের ডিসি সুলতানা পারভীন সাংবাদিক আরিফুলকে ধরে মারধর করেন, ক্রসফায়ারের ভয় দেখান শুধু তার অনিয়মের বিরুদ্ধে রিপোর্ট করার কারণে। ২০২০ সালের মার্চের ওই ঘটনার তদন্তে সত্যতা মেলে। ডিসি সুলতানাকে শাস্তিমূলক বদলি করা হয়। ওই ঘটনায় আরেকজন অভিযুক্তের নাম প্রকাশ পায়। তিনি কুড়িগ্রামের আরডিসি নাজিম উদ্দিন। লকডাউনে ভ্যানগাড়ি নিয়ে বাইরে বের হওয়ায় ২০২০ সালের মার্চে মনিরামপুরের সহকারী কমিশনার সাইয়েদা হাসান বয়োবৃদ্ধ কয়েকজনকে কানধরে উঠবোস করান।
এ ঘটনায় ব্যাপক জন-অসন্তোষ তৈরি হলে সাইয়েদা হাসানকে বদলি করা হয়। নিগ্রহের শিকারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করেন মনিরামপুরের ইউএনও। চলতি বছরের মে মাসে নারায়ণগঞ্জ সদরের ইউএনও আরিফা জহুর লকডাউনে ৩৩৩ নম্বরে সরকারি সাহায্য চাওয়ায় ফরিদ আহমেদ নামে একজন বিপদাপন্ন ব্যবসায়ীকে উল্টো জরিমানা করেন। তাকে ১০০ জন লোককে খাওয়ানোর শাস্তি দেয়া হয়। এ ঘটনা তদন্তে ইউএনওর বিরুদ্ধে বাড়াবাড়ি এবং আইন অমান্যের অভিযোগের সত্যতা মেলে। এসব ঘটনা যেকোনোভাবে বাইরে প্রকাশ হওয়ায় তোলপাড় সৃষ্টি হয় এবং প্রশাসন নড়েচড়ে বসে। এর বাইরে কত যে ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটছে যা আড়ালেই থেকে যায়।
গত এপ্রিলে লকডাউনের মধ্যে এলিফ্যান্ট রোডে ডিউটি শেষে বাসায় ফেরার পথে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে কী নাজেহালই না হলেন বিএসএমএমইউর সহযোগী অধ্যাপক সাইবা শওকত জেমি। একজন নারী চিকিৎসক হয়েও যেভাবে তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের মুখোমুখি হতে হয়েছে তা ভাবলে অবাক হতে হয়। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শেখ মামুনুর রশীদের উপস্থিতিতেই এ ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনা প্রমাণ করে সিভিল সার্ভিসের বহু অফিসারই এখন আর আইন ও নীতি নৈতিকতার ধার ধারেন না। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী এই আপ্তবাক্য তারা প্রশিক্ষণের পরই বেমালুম ভুলে যান। এসপি, অতিরিক্ত এসপির বাইরে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনেকের বিরুদ্ধেও অভিযোগ পাওয়া যায়। আলোচিত ও বরখাস্ত ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধেও একজন নারী তাকে জোর করে বিয়ে করার অভিযোগ ওঠে। ওই ঘটনাও দেশজুড়ে আলোচনার সৃষ্টি করে।
সম্প্রতি পুলিশ সদর দফতরের এক জরিপ প্রতিবেদন পত্রিকান্তরে প্রকাশিত হয়। সেখানে পুলিশের নারী সহকর্মীরা পুরুষ সহকর্মীদের দ্বারা সম্ভ্রমহানির শিকার হয়েছেন বলে উঠে আসে। জরিপে অংশগ্রহণকারী ৪৪১ জনের শতকরা ৪০ ভাগই বলেছেন নারী পুলিশ সদস্যরা নিগ্রহের শিকার হয়েছেন। বিষয়টি আঁতকে ওঠার মতো। পেশাগত নৈতিকতা কিংবা পেশাদারিত্বের মনোভাবের অভাবই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেপরোয়া করে তোলে বলে অনেকেই মনে করেন। কারো ব্যক্তিগত জীবনাচরণ নিয়ে আলোচনা এখানে উদ্দেশ্য নয়। অসুস্থ রাজনীতি আমাদের কোন গন্তব্যে নিয়ে যাচ্ছে সেটিই আলোচনার বিষয়।