ইসলাম ও প্লুরালিস্টসংস্কৃতি
ইসলাম ও প্লুরালিস্টসংস্কৃতি - ছবি সংগৃহীত
আল্লাহ ইচ্ছা করলে সকল মানুষকে একজাতি করতে পারতেন (কুরআন ৫:৪৮ ও ১১:১১৮)। কিন্তু তাঁর পরিকল্পনা ভিন্ন। আয়াতদ্বয়ের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কুরআনের মুফাস্সিরগণ দিকনির্দেশ করেছেন যে মুসলিম সংস্কৃতি একরৈখিক (মনোলিথিক) নয়। এমনকি বিশ^ব্যাপী ইসলামকে যেভাবে চর্চা করা হয়, তার দিকে একপলক দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে উপলব্ধি করা যায়, ইসলামী সংস্কৃতি একরৈখিক হওয়ার ধারণার কোনো ভিত্তি নেই। এ নিবন্ধে দৃষ্টান্ত দিয়ে বারবার বলার চেষ্টা করা হয়েছে যে মুসলিম বিশে^র বিভিন্ন অঞ্চলের সংস্কৃতি গঠনপ্রকৃতি, কাঠামো ও বিন্যাস ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতির। ইসলামী সংস্কৃতি মূলত প্লুরালিস্ট। জনমনে প্রচলিত ভুল ধারণা মুছে ফেলার জন্য বিষয়টি নতুন করে অধ্যয়ন করা প্রয়োজন বিশেষত আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত এবং প্রাচ্যবিদ যারা মনে করে ইসলামী সংস্কৃতি একরৈখিক। বস্তুত ইসলাম সূচনালগ্ন থেকেই প্লুরালিস্ট সংস্কৃতি চর্চা করেছে।
যারা প্রথা, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি১ এবং ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার সম্পর্কে পূর্ণ সচেতন, তারা ভুল কর্মপন্থা অবলম্বন করতে পারে না। চূড়ান্ত বিবেচনায় মুসলিম উম্মাহ দীর্ঘদিনের পরম্পরা-হেরিটেজ এসব কিছুর সমাহার ব্যতীত আর কিছু নয়। তাই আমরা স্থানীয় সংস্কৃতির বিষয়কে অবশ্যই ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখবো- কিছু উদ্ধত ও গোঁড়া লোক তার দেশকে ভুলত্রুটির ঊর্ধ্বে মনে করে আমরা তাদের উপেক্ষা করব।২ গোষ্ঠীভুক্ত মানসিকতাকে৩ ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখতে হবে; কারণ দলবদ্ধ গোষ্ঠী মানবতার স্বার্থেও কাজ করতে পারে। চূড়ান্ত বিবেচনায় উম্মাহ৪ হচ্ছে একটি গ্রুপ। যা শুভ ও কল্যাণকর তার জন্য এবং একই সাথে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আমাদের কাজ করা প্রয়োজন। সংস্কৃতির মধ্যে যদি ফাহশা ও মুনকার (দৃষ্টিকটু নগ্নতা, অন্যায়, অনৈতিক ও মন্দ)-এর কোনো উপাদান না থাকে, তবে নিজকে সে সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিবেচনা করার মধ্যে দোষের কিছু নেই। আমাদের অবশ্যই ভুললে চলবে না যে, আমাদের জাতীয় সংস্কৃতি বা স্থানীয় সংস্কৃতি পূর্ববর্তী প্রজন্মের অবদান এবং তারা প্রজন্ম পরম্পরায় স্থাপিত ভিত্তির ওপর তা প্রতিষ্ঠা করেছে। পূর্ববর্তী প্রজন্ম যদি এ বিষয়ে নিশ্চিত না হতো যে তাদের অবদান জীবন, সমাজ ও জাতির জন্য ইতিবাচক কল্যাণ বয়ে আনবে, তবে তারা নিজেদের সংস্কৃতিকে এগিয়ে নেয়ার জন্য অবিশ্রান্তভাবে কাজ করত না।
বিশ্ব সংস্কৃতি ও নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর সাথে ইসলামের সম্পর্ক বিরোধপূর্ণ নয়। মুসলমানরা মানুষকে বর্ণবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে কালো ও সাদা হিসেবে দেখে না। জেন্ডার বা লিঙ্গের ক্ষেত্রেও নেই কোনো বৈষম্য। যা কিছু মানুষের জন্য শুভ ও কল্যাণকর, তাকে তুলে ধরতে ইসলাম প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ইসলাম চায় যা সমাজের জন্য ক্ষতিকর, তা ন্যূনতম পর্যায়ে নামিয়ে আনতে।
ইসলাম-পূর্ব আরব সংস্কৃতির গ্রহণযোগ্য রীতি-আচার-ব্যবহার নিয়ে মহানবী তার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক-এর জীবনাচার। এক্ষেত্রে মৌলিক বিষয় হচ্ছে, বৈচিত্র্যপূর্ণ সাংস্কৃতিক আচার-প্রথার গ্রহণ বা স্থান সঙ্কুলানের মূলনীতি। নবী প্রবর্তিত পোশাকের বিধানের উদ্দেশ্য অনারব মুসলমানদের সংস্কৃতির ওপর হস্তক্ষেপ করা নয়। তারা নিজেদের পোশাক-পরিচ্ছদ, ইসলামের ব্যাপক মূলনীতির আওতায় বিকশিত করা এবং অক্ষুণ্ন রাখার ব্যাপারে মুক্ত-স্বাধীন।
কুরআনে বর্ণিত : প্ররোচিত করো [মানুষকে] ক্ষমাশীলতায় [গ্রহণ করার মাধ্যমে] যা স্বতঃস্ফূর্তভাবে মানুষের আচার-আচরণ [স্বভাব] থেকে উৎসারিত এবং তাদেরকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করো না এবং নির্দেশ দাও সহৃদয়তা, শালীনতা এবং অজ্ঞদের হতে মুখ ফিরিয়ে নিতে এবং তাদের মূঢ়তার জবাবে একই আচরণ করো না (৭:১৯৯)। আয়াতটি সাধারণত ভাষান্তর করা হয় ক্ষমাশীল হওয়া বা এতদসংক্রান্ত কোনো বিষয়। এর ব্যাখ্যায় ‘আফ্্উ’-কে ‘ইউস্্র’ হিসেবে ইঙ্গিত করা হয় যার অর্থ করা হয় ‘সহজ’ বা ‘অবাধ’। অন্য কথায় যা মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আচার-আচরণ-স্বভাব থেকে উদ্ভূত এবং যা কোনো পূর্বপরিকল্পনা বা চিন্তাভাবনার ফল নয়। ব্যাখ্যায় পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে যে, নবী বিনা প্রয়োজনে মানুষের কাজকর্ম বা আচার-আচরণের বিষয়ে অনুসন্ধান বা প্রমাণ খুঁজে বেড়াতেন না।৫
কুরআনের পূর্ব বর্ণিত আয়াতের অনুবাদ এভাবেও করা হয়েছে : মানুষের নিকট হতে তা গ্রহণ করো যা তাদের জন্য স্বাভাবিকভাবে উৎসারিত; প্রথাগতভাবে যা কল্যাণকর তার আদেশ দাও; এবং অজ্ঞ হতে মুখ ফিরিয়ে নাও একই পন্থায় জবাব না দিয়ে (৭:১৯৯)। এ আয়াতটি কয়েকটি মূলনীতি নির্দেশ করে। নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক স্বরূপ সম্পর্কে মহানবীর দৃষ্টিভঙ্গি এ আয়াতের প্রয়োগ হতে দৃষ্টান্ত মিলবে।
জনগণের ন্যায়সঙ্গত প্রথা ও আচার-ব্যবহারের প্রতি সমর্থন এবং এসবকে মৌলিক বুনিয়াদি ও স্থায়ী পলিসি গাইডলাইন হিসেবে গ্রহণ করার জন্য আল্লাহ রসূল মুহাম্মদকে- তার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক- নির্দেশ দিয়েছেন। ইসলাম-পূর্ব যুগের আরব দেশের স্থানীয় সংস্কৃতিকে রাসূল সা: ধ্বংস করেননি। বরং তিনি এসবের মাঝে সামঞ্জস্যবিধান করেছেন; যা অসঙ্গত, তা সংশোধন করেছেন; যা ক্ষতিকর, তা পরিবর্তন করেছেন।
রসূলের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে অনুমোদনের সর্বোত্তম উদাহরণ হলো- প্রচলিত সাতটি বাচনভঙ্গিতে (আহরুফ) কুরআন তিলাওয়াতের অনুমতি দানের সিদ্ধান্ত। কুরাইশরা মক্কার যে বাচনভঙ্গি অনুসরণ করত, আরবের সব গোত্রই তা বুঝত। এটা ছিল অন্যান্য আরব গোত্রের প্রতি নবীর শ্রদ্ধা, সৌজন্য ও সুবিবেচনার পরিচায়ক। এটা সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বহু মত ও পথকে মেনে নেয়ার ইঙ্গিত দেয়।
আরব গোত্রসমূহ এবং অন্যান্য নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের প্রতি রসূলের দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত গুরুত্ববহ একটি উদাহরণ এবং তা ইসলামের মৌলিক বুনিয়াদি নীতি। সাংস্কৃতিক নীতি ও চর্চার ক্ষেত্রে বৈচিত্র্যকে রসূল ব্যাপক অনুমোদন ও সমর্থন দেন। বিনা প্রয়োজনে তিনি এসব রদবদল করেননি। এভাবে তার জীবন থেকেই অন্যান্য সংস্কৃতির প্রতি ইসলামের উদার দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
সুস্থ ও কল্যাণকর প্রথা-রীতিনীতির ওপর যা প্রতিষ্ঠিত, তা গ্রহণযোগ্য। তাই স্কলারদের অভিমত হচ্ছে জনগণকে তাদের প্রথা-রীতিনীতি এবং আচার-অনুষ্ঠান অনুসরণ করতে দিতে হবে। ক্লাসিক্যাল মুসলিম আইনজ্ঞরা ইতিবাচক সাংস্কৃতিক প্রথা-রীতিনীতি অনুমোদনের একটি বড় প্রমাণ হিসেবে কুরআনের ৭:১৯৯ আয়াতের উল্লেখ করে থাকেন। যা কিছু মানুষের স্বভাবপ্রকৃতি আর পরিবেশের অনুকূল এবং যা তাদের একান্ত প্রয়োজনীয় ও বৈধ আকাক্সক্ষাকে পূরণ করে, তাকে সাধারণত গ্রহণ করা হয়। কুরআন দেশজ ও স্থানীয় সংস্কৃতির শুদ্ধতাকেই কেবল তুলে ধরে না; বরঞ্চ শুভ ও কল্যাণকর সবকিছুর পূর্ণ অনুমোদন দেয়, যদি তা ঐশী বাণীর সরাসরি পরিপন্থী না হয়।
এ পর্যায়ে সিরাহ বা রসূলের জীবন থেকে উদাহরণ সন্ধান করা যাক। একদল কালো আফ্রিকান নওমুসলিম মদিনায় মসজিদ আল নববিতে চামড়ার তৈরি ঢোল পিটিয়ে বর্শাসহ নাচতে শুরু করে। উমর বিন খাত্তাব তাদের থামাতে চেষ্টা করেন; কিন্তু নবীজী উমরকে তাদের বাধা না দেয়ার জন্য বললেন। রাসূল সা: বললেন, আরফিদার সন্তানরা তার লোক নয়। উমরের দৃষ্টিভঙ্গি যেন ইথিওপিয়দের মাঝে ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি না করে, সেজন্য রাসূল সা: তাদের নাচতে উৎসাহ দেন এ কথা বলে, ‘তোমাদের খেলা চালিয়ে যাও, আরফিদার সন্তানরা’ যাতে ইহুদি ও খ্রিষ্টানরা বুঝতে সক্ষম হয় যে আমাদের ধর্মে সহনশীলতা রয়েছে (সহিহ বুখারি ৯০৭ এবং সহিহ মুসলিম ৮৯২)।
উমরকে থামাতে নবীর হস্তক্ষেপ হতে এটা স্পষ্ট যে ইথিওপিয়দের উমরের আরবদেশীয় মানসিকতা দ্বারা বিচার করা যথার্থ হবে না কিংবা তারা তাদের অনুরূপ হবে এটা প্রত্যাশা করা ঠিক নয়। ‘আরফিদার সন্তান’দের রয়েছে নিজস্ব বৈশিষ্ট্যপূর্ণ প্রথা-আচার-আচরণ। তাদের ইসলাম গ্রহণের অর্থ এটা নয় যে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে পরিত্যাগ করতে হবে। ‘আরফিদার সন্তান’- এ স্পষ্ট ঘোষণা দেয়ার মাধ্যমে নবী একটি চিরন্তন ও চূড়ান্ত মূলনীতি প্রতিষ্ঠা করেন যা বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতাকে শ্রদ্ধা করতে শেখায়। নবী উদারতা, প্রসারিত মনোভাব এবং অন্যের প্রতি নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি চর্চা করতেন। তাঁর উল্লিখিত বাণীর এটাই শিক্ষা এবং এ উদার দৃষ্টিভঙ্গি প্রাথমিক যুগের আরব মুসলমানদের অন্যান্য সকল সংস্কৃতির সুস্থ ও কল্যাণকর দিকের স্বীকৃতি দিতে অনুপ্রাণিত করে।
রাসূল সা: বলেছেন- ইথিওপিয়ার সন্তানরা, তোমাদের খেলা অব্যাহত রাখো যাতে ইহুদি-খ্রিষ্টানরা বুঝতে পারেÑ আমাদের ধর্মে নমনীয়তা (ফুসহা) রয়েছে (মুসনাদ ইমাম আহমদ ২৪৩৩৩)। এর মাধ্যমে রাসূল সা: সংস্কৃতির মাঝে বিরাজমান পার্থক্যকে স্বীকৃতি দিয়ে নজির সৃষ্টি করেন এবং এটা স্পষ্ট করে দেন যে, ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার জন্য অনারবদের নিজস্ব সংস্কৃতি-আচার-নিয়ম-পদ্ধতিকে ত্যাগ করে আরবদের সংস্কৃতি গ্রহণ করার প্রয়োজন নেই।
প্রথা (র্উ্ফ)৬ এবং আচার-ব্যবহার (আদা) বলতে স্থানীয় সংস্কৃতির সেসব বিষয়কে বুঝায় যা ইতিবাচক, কল্যাণকর, মূল্যবান, হিতকর; ক্ষতিকর এবং ধ্বংসাত্মক নয়। স্থানীয় সংস্কৃতিকে মূল্যায়ন করতে হবে ইসলামী মূলনীতির আলোকে। এর অর্থ হলো যা বীভৎস, ঘৃণ্য, অশোভন, অপ্রীতিকর, কুরুচিপূর্ণ ও জঘন্য তা প্রত্যাখ্যাত। যেমন জর্দানের কোনো কোনো অঞ্চল এবং পাকিস্তানের উপজাতি এলাকায় প্রচলিত অনার কিলিং। সুস্থ ও কল্যাণকর প্রথা ও আচার-ব্যবহার-রীতিনীতির প্রত্যাখ্যান শুধু অশুভই নয়, তা জনগণের জন্য অপ্রয়োজনীয় জটিল ও ক্ষতিকর অবস্থা সৃষ্টি করে।
ইসলামের অন্যতম প্রধান ও অপরিহার্য মূলনীতি হচ্ছে, সাংস্কৃতিক আচার-আচরণ-রীতিনীতির আইনগত গুরুত্ব রয়েছে। ‘প্রথার আইনগত গুরুত্ব রয়েছে’ বলতে সন্তোষজনক সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যকে বুঝায়। ওই সব প্রথা যা স্পষ্টত এবং সন্দেহাতীতভাবে অনুশীলিত ও প্রতিষ্ঠিত। যা প্রায়ই মানুষের জীবনে পুনঃ পুনঃ ঘটে এবং সুস্থ ও কল্যাণকর বৈশিষ্ট্য হিসেবে গ্রহণযোগ্য। ‘সুস্থ-কল্যাণকর বৈশিষ্ট্য’ (আল-তিবা আল-সালিমা) ইসলামের এ বিশ্বাসের সাথে সম্পর্কিত যে, মানবজাতিকে সৃষ্টি করা হয়েছে সুস্থ ও কল্যাণকর বৈশিষ্ট্যসহ; মানুষ সহজাত ও প্রকৃতিগতভাবে নৈতিকগুণে গুণান্বিত এবং তারা ভালো ও মন্দ, কল্যাণ ও অকল্যাণ বিষয়ে অন্তর্জ্ঞানসম্পন্ন। মানুষ এমনসব সাংস্কৃতিক রীতিনীতি, আচার-আচরণ ও প্রথা গ্রহণ করে যা তার উপযোগী এবং যে পরিস্থিতি সময় ও স্থানে তারা বাস করে তার জন্যও যথোপযুক্ত। সাংস্কৃতিক প্রথা-পদ্ধতি-ঐতিহ্যের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে ব্যাপক বৈচিত্র্যময়, পরস্পর বিপরীত ও সাংঘর্ষিক প্রেক্ষাপটে যতটা সম্ভব সফলতা অর্জন এবং মন্দ ও ক্ষতি পরিহার করা। ইসলামী মলূনীতির প্রেক্ষাপটে, দেশীয় বা স্থানীয় সংস্কৃতি মূলত বৈশিষ্ট্যগতভাবে সেসব সামাজিক গোষ্ঠীর কল্যাণের সাথে সম্পৃক্ত যারা সেসব নীতিমালা গ্রহণ করেছে। এ কারণে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের অনুমোদনকে স্কলাররা কল্যাণসাধন এবং ক্ষতি থেকে রক্ষার ইসলামের চূড়ান্ত অঙ্গীকারের নজির হিসেবে বিবেচনা করে।
‘সংস্কৃতির আইনগত গুরুত্ব রয়েছে’- এ মূলনীতি সাংস্কৃতিক-উত্তরাধিকারকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান অনুমোদন করে না। এ মূলনীতি যেকোনো সাংস্কৃতিক উপাদান গ্রহণ করতে মুসলমানদের অনুমতি দেয় যতক্ষণ পর্যন্ত না তা অনিষ্টকর ও অপকারী প্রমাণিত হয় এবং যা কোনোভাবেই শিরক- মূর্তিপূজা, বহু সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস কিংবা আল্লাহর সাথে শরিক করা সম্পর্কিত না হয়। এ মূলনীতি ঈমান বা বিশ^াসের সুরক্ষা প্রদান করে এমন সাংস্কৃতিক উপাদান গ্রহণ করে যা মানুষের যাবতীয় কর্মপ্রয়াসের অন্যতম লক্ষ্য- মাকাসিদ আল-শরিয়াহ। ইসলামের স্বীকৃত দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে প্রথা-আচার-আচরণ ততক্ষণ পর্যন্ত অনুমোদনযোগ্য, হিতকর ও কল্যাণকর মনে করতে হবে যতক্ষণ পর্যন্ত তা ভিন্নকিছু প্রমাণিত না হয়। সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ইসলামের সুস্পষ্ট মৌলনীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে।
সাংস্কৃতিক প্রথা-ঐতিহ্য পরিচয়ের একটি মৌলিক দিক। এসব রীতিনীতি ও প্রথা জনগণের মাঝে এত গভীরভাবে প্রোথিত যে তা তাদের মৌলিক সত্তা ও প্রকৃতি থেকে পৃথক করা কঠিন। চিরস্থায়ী মূলনীতি সামনে রেখে প্রথাকে যতদূর সম্ভব অপরিবর্তিত রাখাই অধিকতর বিজ্ঞোচিত। চিরপ্রচলিত প্রথা-ঐতিহ্যকে বিনা কারণে পরিবর্তন ক্ষতিকর ও অপকারী কেননা প্রথা-আচার-রীতিনীতির সাথে সামাজিক চাহিদার সুদৃঢ় সম্পর্ক রয়েছে। ক্ষতিকর প্রথা-আচার-রীতিনীতি অবশ্যই বাতিল করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন বিচক্ষণ কলাকৌশল ও সময়। এক্ষেত্রে নবীর জীবনের ঘটনা আমাদের সামনে পূর্ব-দৃষ্টান্ত। তিনি ধীরে ধীরে তাঁর সাহাবিদের- আল্লাহ তাদের ওপর সন্তুষ্ট থাকুন- ইসলামের আদর্শ পূর্ণ অনুসরণের পথে আনেন।
যে ব্যক্তি কোনো জাতির অনুকরণ করে (তাশাব্বাহা), সে তাদের অন্তর্ভুক্ত (সুনান আবু দাউদ ৪০৩১)। এ হাদিসে নিন্দা করা হয়েছে অন্যদের বশংবদ, মাত্রাতিরিক্ত আজ্ঞাবহ ও মোসাহেবি স্বভাবসুলভ অনুকরণের। এখানে নবী সংস্কৃতির সুস্থ ও কল্যাণকর মিথস্ক্রিয়াকে ভর্ৎসনা, সমালোচনা, তিরস্কার, নিন্দা বা দোষারোপ করেননি।
এসব মিথষ্ক্রিয়ার গুরুত্ব ও তাৎপর্য স্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়ে ওঠে যখন তা করা হয় কোনো প্রশংসনীয় কারণে। যেমন অন্যদের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং সমঝোতা ও সহযোগিতার সেতুবন্ধন গড়ে তোলা। নির্ভরযোগ্য হাদিসে বর্ণিত, নবী নিজে বিভিন্ন ধরনের পোশাক পরিধান করেছেন যা তাকে উপহার হিসেবে দেয়া হয় বাইজেনটাইন, ইয়েমেন এবং অন্যান্য অমুসলিম শাসকদের পক্ষ থেকে (সুনান আবু দাউদ ৪০৪৭)।
মুসলমানরা তাদের নিজস্ব স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত সৃজনশীল পোশাকের উদ্্গাতা। এর মধ্যে রয়েছে আরব পুরুষদের ব্যবহৃত দীর্ঘ সাওব বা আবা এবং হিজাব বা মাথার স্কার্ফ ও অন্যান্য পোশাক যা মুসলিম নারীরা বর্তমানে মরক্কো থেকে মালয়েশিয়া পর্যন্ত ব্যবহার করছে। বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ আলেমদের ব্যবহৃত পাঞ্জাবিকে সুন্নতি পোশাক হিসেবে বিবেচনা করে। সুন্নতি পোশাক মানে যা স্বয়ং রাসূলুল্লাহ পরিধান করতেন। প্রকৃতপক্ষে পাঞ্জাবি হচ্ছে পোশাকের ক্ষেত্রে এক নতুন ধরনের সাংস্কৃতিক উপাদান যা রাসূল সা:-এর পোশাক থেকে তাৎপর্যপূর্ণভাবে পৃথক। আরবরা যে খাবার তৈরি করে তা সেন্ট্রাল এশিয়া, ইরান ও ভারতের মুসলমানদের প্রস্তুতকৃত খাবার থেকে বহুলাংশে আলাদা। মুসলমানরা ঋতু এবং ফসল কাটার সময়ভিত্তিক সৌর ও তারকানির্ভর পঞ্জিকা ব্যবহার করেছে যদিও তারা চান্দ্রপঞ্জিকাও ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছে।
রাসূল সা:-এর সময়কাল থেকে আজ পর্যন্ত মুসলিম বিশে^র সর্বত্র মসজিদের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে মিহরাব বিদ্যমান যার উৎপত্তি হচ্ছে শ্যাম বা সিরিয়া।৭
রাসূল সা: মক্কা থেকে হিজরতের পর মদিনায় নির্মাণ করা হয় মসজিদ আল নববি। তখন রসুল তার সাহাবিদের সাথে পরামর্শ করেন মসজিদে সালাত আদায়ের উদ্দেশ্যে কিভাবে মানুষকে আহ্বান করা যায়। কেউ একজন পরামর্শ দেন সালাতের সময় হলে একটি পতাকা উত্তোলন করার জন্য যাতে মানুষ এটা দেখে একে অপরকে সালাতের জন্য ডাকতে পারে। কিন্তু রাসূল সা:-এর এ মতটি পছন্দ হয়নি। অপর একজন শিঙ্গা ফুঁকে সালাতের জন্য মানুষকে আহ্বান জানাতে বলেন। রাসূল সা:-এর এ মতটিও পছন্দ হলো না। তিনি বললেন, এটা ইহুদিদের প্রথা। কেউ একজন ঘণ্টা বাজানোর কথা বললে তিনি বলেন, এটা খ্রিষ্টানদের রীতি। আবদ্্আল্লাহ ইবন যায়েদ ইবন আবদ রাব্বিহি ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে আজান হতে দেখেন। তিনি রাসূল সা:-এর নিকট আসেন এবং স্বপ্নের বিষয়ে বলেন। রাসূল সা: বিলালকে আবদ্আল্লাহ ইবন যায়েদের কথামতো কাজ করার জন্য বলেন (সংক্ষেপিত- আবু দাউদ ৪২০)। তখন থেকে বিশ^ব্যাপী মুসলমানরা আজানের এ নিয়ম পালন করে আসছে।
প্রাক-আধুনিক যুগের আদ্যোপান্ত দেশজ সাংস্কৃতিক সৃজনশীলতা ইসলামের স্থানীয় রূপ বা বহিঃপ্রকাশের সাক্ষ্য বহন করে। ইসলামের প্রাথমিক যুগে আরব মুসলিম নাবিক ও সওদাগরদের মাধ্যমে ইসলাম মালয়েশিয়া-ইন্দোনেশিয়ার উপকূলে পৌঁছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিপুলসংখ্যক মানুষের কাছে ইসলাম কিভাবে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে? এ প্রসঙ্গে ফিলিপাইনের জাতীয় বীর জোসে রিজালের উদ্ধৃতি দেয়া প্রাসঙ্গিক হবে। তিনি লিখেছেন, ‘দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মুসলিম বণিকদের কয়েকটি প্রশংসনীয় গুণের মধ্যে ছিল পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বদান্যতা, আতিথেয়তা ও সততা। এভাবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিপুলসংখ্যক মানুষ ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে।’
সে সময় ছিল না কোনো অ্যামপ্লিফায়ার বা মাইক। মুসলমানরা বুঝতে সক্ষম হয়, সালাতের দিকে আহ্বানের জন্য দেয়া আজান সব সময় এর উদ্দেশ্য পূরণ করছে না। ইন্দোনেশিয়ার গভীর অরণ্য অঞ্চলে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর কাছে মানব কণ্ঠনিঃসৃত ধ্বনি পৌঁছাচ্ছিল না। তাহলে কিভাবে গভীর অরণ্যের মানুষের কাছে আজানের সুমধুর আহ্বানকে পৌঁছানো যায়?
মুসলমানরা ঢোল পিটিয়ে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করার স্থানীয় রীতি-প্রথা-ঐতিহ্যকে গ্রহণ করে। তারা ঢোলকে আজানের স্থলাভিষিক্ত করেননি। তবে মসজিদের বাইরে রাখা বড় আকারের ঢোল পিটিয়ে মানুষকে সালাতের দিকে আহ্বান জানানোর রীতি-প্রথা চালু করে। মানুষকে সালাতে আহ্বান করার জন্য ঢোল পিটিয়ে জোরালো শব্দ সৃষ্টি করা হয়। এ ঢোলের সুগভীর, অতল ও অগাধ শব্দ অরণ্যের মাঝে প্রতিধ্বনিত-কম্পিত-স্পন্দিত হয়। ঢোলের শব্দ জানান দেয়- সালাত আদায়ের সময় হয়েছে।
মালয়েশিয়াসহ পুরো মালয় দ্বীপপুঞ্জে এই ঢোলকে বলা হয় বেদুক-বেদুগ। মানুষকে সালাতের দিকে আহ্বান করতে এটা ব্যবহার করা হয়। আজানের পূর্বে বিশেষ সুমধুর ছন্দে ধ্বনি সৃষ্টি করার জন্য এটা ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে মাইক বা অ্যামপ্লিফায়ার সহজপ্রাপ্য হওয়া সত্ত্বেও পূর্বের মতো এর প্রচলন রয়ে গেছে। একটি ব্যতিক্রমধর্মী পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য ঢোলের প্রচলন হয়। আলেমদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের অভিমত হচ্ছে, যেহেতু মাইক বা অ্যামপ্লিফায়ার এখন সহজলভ্য, তাই আজানের পূর্বে ঢোল ব্যবহারের প্রয়োজন নেই। আলেমদের একাংশ মনে করে, আজানের পূর্বে ঢোল ব্যবহার বিদায়াত বা নবরীতির প্রচলন।
২০১৯ সালের ২৭ আগস্ট জাকার্তার দি নিউ স্ট্রেইটস টাইমস পত্রিকায় এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, জাকার্তাস্থ ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় মসজিদÑ ইশতিকলাল মসজিদে আজানের পূর্বে ঢোল পিটিয়ে মালয়েশিয়ার রাজা সুলতান আবদুল্লাহ সালাতের জন্য নামাজিদের প্রতীকী আহ্বান জানান। এ মসজিদটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৃহত্তম মসজিদ যেখানে একই সাথে দুই লাখ মুসল্লি সালাত আদায় করতে পারে। যে ঢোলের দ্বারা সালাতের জন্য আহ্বান করা হয় তা তিন শতাধিক বছরের পুরনো।
মানব সংস্কৃতি স্থির ও অপরিবর্তনশীল রূপ নয়। যে কোনো বৃহৎ দেশের রয়েছে জটিল ও বহুরূপী বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য, যা পরস্পরের পরিপূরক ও প্রতিযোগী। এমন বহুধা সংস্কৃতির অনুমোদন দেশজ নানা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বহিঃপ্রকাশের প্রতি মানুষের মুক্তমন মনোভাবের পরিচায়ক।
দেশজ আচার-আচরণ-প্রথার সৃজনশীল অভিযোজন শুধু পরিগ্রহণের চেয়ে বেশি কল্যাণকর। একইভাবে শুধু সুস্থ সাংস্কৃতিক আচার-প্রথা নিছক পরিগ্রহণের মধ্যেই আমাদের পরিতৃপ্ত হওয়ার কিছু নেই। আগের চেয়ে অধিকতর কল্যাণকর ফল লাভের জন্য আমাদের থাকতে হবে বাছাই করার সক্ষমতা।
মসজিদ নির্মাণের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোনো একক ছাঁচ বা বাহ্যিক অবয়ব বা গঠন থাকা প্রয়োজনীয় নয়। বরং মসজিদের কাঠামো ও নকশা অবশ্যই সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে অবস্থান ও পরিবেশের যৌগিক সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের সাথে। মসজিদকে এর পারিপাশির্^ক অবস্থার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে। মসজিদের নকশা, কাঠামো ও দৃশ্যচিত্র দেশজ ও আঞ্চলিক স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য, প্রাকৃতিক ও পরিবেশ উপযোগী হতে হবে। মসজিদের স্থাপত্য নকশা দেশজ রুচিবোধ উপলব্ধি ও শৈলীর সাথে সাংঘর্ষিক না হওয়া বাঞ্ছনীয়। ইতিহাসে আগাগোড়া মসজিদের স্থাপত্য, বিন্যাস-পরিকল্পনা, লেআউট ও নকশা দেশজ ও আঞ্চলিক সংস্কৃতির যথাযথ অনুলিপি- প্রতীকসদৃশ।
ইসলাম মসজিদ নির্মাণের ক্ষেত্রে কোনো বিশেষ নকশা অনুকরণে বাধ্যবাধকতা নির্দেশ করে না। এ ক্ষেত্রে অভিন্ন বিষয় হলোÑ সালাতের জন্য স্থান এবং ইমামের দাঁড়ানোর জন্য মিহরাব থাকা। কিছুসংখ্যক মুসলমান মনে করে গম্বুজ ও মিনার মসজিদের অপরিহার্য উপাদান-বৈশিষ্ট্য। নবীর মসজিদ- মসজিদ আল নববির কোনো গম্বুজ কিংবা মিনার ছিল না তাঁর জীবদ্দশায়। প্রকৃতপক্ষে, মুসলিম বিশে^ স্থাপত্যের ক্ষেত্রে গম্বুজ ও মিনার হচ্ছে নবী-পরবর্তী কালের উদ্ভাবন।
আধ্যাত্মিকতার প্রতিকূলে বস্তুগত বিবেচনায় বলা যায়, বৈচিত্র্যের মধ্য দিয়ে ঐক্যই হলো ইসলামী স্থাপত্যকলার প্রতীকী উদাহরণ। বিশে^র সর্বত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সব গুরুত্বপূর্ণ সুবিদিত মসজিদ তার সৌন্দর্যের প্রকাশ এমনভাবে করে যা বাস্তব পরিবেশ এবং সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটের যথোপযুক্ত। শিল্পকর্ম ও নকশার জন্য পাথর, কাঠ এবং অন্যান্য উপকরণ ব্যবহার করা হয়। সেই সাথে ব্যবহার করা হয় দেশজ ঐতিহ্য-আশ্রয়ী অলঙ্করণ।
মুসলিম স্থাপত্যশিল্পের ক্ষেত্রে গম্বুজ হলো তুলনামূলকভাবে পরবর্তী সময়ের সংযোজন। এর নকশা এমনভাবে করা হয় যাতে সালাত আদায়ের জন্য বিলাসবহুল ও আরামপ্রদ সুপ্রশস্ত বিস্তৃত স্থানের ব্যবস্থা থাকে। এটা পিলারের সাহায্য ছাড়া এমন সময় করা হয় যখন নির্মাতাদের লোহা ও ইস্পাতের বিম ব্যবহার করার সামর্থ্য ও সুযোগ ছিল না। অ্যামপ্লিফায়ারবিহীন যুগে আজান দেয়ার জন্য মিনার যথোপযুক্ত ছিল। সেইসাথে মিনারের আরেকটি অভীষ্ট লক্ষ্যও ছিল। বাতিঘর যেমন জাহাজের দিকনির্দেশ দেয়, তেমনি মিনার সূচনাতে কাফেলার জন্য দিকনির্দেশক ছিল। দূরবর্তী কাফেলা যাতে পথের দিকনির্দেশ পেতে পারে এজন্য মসজিদের মিনারের উপরিভাগে আগুন প্রজ¦লিত করা হতো এশার সালাতের পর। আরবি শব্দ মিনারের অর্থ হচ্ছে আগুনের স্থান। চীন, আন্দালুসিয়া এবং উত্তর ও পশ্চিম আফ্রিকার মুসলমানরা গম্বুজ ও মিনার পরিগ্রহণ করেনি। এর অন্যতম কারণ হলো, গম্বুজ ও মিনার এসব স্থানের পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
আন্দালুসিয়া ও উত্তর আফ্রিকার মসজিদে স্থানীয় রোমান খিলানের উপাদানের সংমিশ্রণ ঘটেছে ব্যাপকভাবে। অটোম্যানরা স্থানীয় আনাতোলিয় বিষয়বস্তুর ওপর ভিত্তি করে সুউচ্চ গম্বুজ কাঠামো এবং দেশজ গ্রিক গির্জার মৌলিক রূপরেখাকে গ্রহণ করেছে।
চীনে মসজিদের ক্ষেত্রে সুস্পষ্টভাবে গ্রহণ করা হয়েছে চীনের প্রাচীন প্রতীকী উপাদানকে। অপর দিকে পূর্ব ও পশ্চিম আফ্রিকার মসজিদে আফ্রিকার সুনির্দিষ্ট চেতনাকে ধারণ করা হয়েছে। তাজমহলে নিখুঁত সমন্বয় ঘটেছে ভারতীয় ও ইরানি উপাদানগুলোর। এভাবে তাজমহল ফলপ্রসূভাবে উপমহাদেশীয় সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করেছে এবং ভারতে মুসলিম অবদানের সর্বাধিক সমৃদ্ধ স্বাক্ষরে পরিণত হয়েছে।৮
বাংলাদেশের চিত্রকলা ও স্থাপত্যে আঞ্চলিক শৈলী দৃশ্যমান- যেমন, ঢাকায় গুলশান আজাদ মসজিদের সুদীর্ঘ মিনার প্রচলিত ঐতিহ্যবাহী মিনার হতে পৃথক। এই মিনারের উপরিভাগ একটি কুঁড়ির মতো। দেখে মনে হয়, আজানের ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হলে এটি বিশাল ছাতার মতো খুলে যাবে। উল্লেখ্য, মদিনার মসজিদ আল নববির সুবিশাল রৌদ্র-ছাতা সূর্যের অবস্থান পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে খুলে যায় এবং বন্ধ হয়। নামাজিদের ছায়া দিতে এ ছাতা সর্বদা সূর্যের দিকে তাক করে থাকে। বাংলাদেশের স্থপতি মেজবাহ-উল-কবিরের নকশাকৃত গুলশান আজাদ মসজিদের কোনো গম্বুজ নেই।
স্থপতি মেরিনা তাবাসসুম ঢাকার বায়তুর রউফ মসজিদের নকশা প্রণয়ন করেছেন। এ মসজিদের স্থাপত্যশিল্প বিষয়ক পরমোৎকর্ষতার জন্য তিনি এক মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের আগা খান অ্যাওয়ার্ড ২০১৬ অর্জন করেন। দেশের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য এবং জনগণের সাংস্কৃতিক পটভূমির পরিপ্রেক্ষিতে মসজিদটির নকশা করা হয়েছে।
আজান-এর শাব্দিক অর্থ ঘোষণা। সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত কোনো অনুষ্ঠানে জনসমাবেশ করার উদ্দেশ্যে আজান ব্যবহৃত হয়। ফিলিস্তিনে বিদেশী শক্তির দখলদারিত্ব ও আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে আজানকে ব্যবহার করা হয়। দুর্যোগের সম্মুখীন হলে মানুষ ঐশী সাহায্য কামনা করে আজান দেয়। নবজাত শিশুর কানে আজান দেয়ার ইসলামী ঐতিহ্য মুসলমানদের মাঝে বিদ্যমান। সঙ্গীতের মতো আজানেরও এক ধরনের ঔষধিগুণ রয়েছে বলে ইসলামী লোকচিকিৎসায় মনে করা হয়।
বিভিন্ন অঞ্চলে আজানের বিভিন্ন ধরন প্রচলিত। এর কোনো নির্ধারিত সুর নেই। তুর্কি মুসলমানরা আজো আজানের অতিমধুর আলঙ্কারিক স্টাইলের জন্য বিখ্যাত। আরবের হিজাজ অঞ্চলের আজান আর নজদ অঞ্চলের আজান একরকম নয়। হিজাজে সুমধুর সুরেলা কণ্ঠে আজান দেয়া হয়। কিন্তু মক্কার বায়তুল হারাম মসজিদ থেকে সুরেলা কণ্ঠে কুরআন তিলাওয়াত ও আজান দেওয়াকে নিরুৎসাহিত করা হয়।
আজানের দু’টি দিক রয়েছে। কেউ শুধু আজানের সমধুর সুরকে মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করতে পারে। অন্যজন আজান শুনতে পারে তার অন্তর্নিহিত বাণী ও তাৎপর্য অনুধাবনের জন্য। আজানে ব্যবহৃত শব্দ গুরুত্বপূর্ণ ও অর্থবহ এবং মানুষ আজানের সুরেলা ধ্বনি শুনতে পছন্দ করে। আজান অবশ্যই সুরেলা, সুশ্রাব্য, সুমধুর ও প্রীতিকর হতে হবে এমন নয় কিন্তু যদি ছন্দময় ও সুরেলা ভঙ্গিতে আজান দেয়া হয় তাহলে তা অধিকতর গ্রহণযোগ্য হয়। সুমধুর স্বর মানুষকে সম্মোহিত করে। মসজিদের মিনার থেকে দেয়া সুরেলা আজান শুনে মনে হয় কেউ গাইছে। আজান মানুষকে ইসলামের দিকেও আকৃষ্ট করে। দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করা যায়, পাশ্চাত্যের নওমুসলিম মারিয়ম জামিলা বর্ণনা করেছেন কিভাবে আজান ও কুরআন তিলাওয়াত তাকে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করে। প্রত্যুষে আজানের মধ্য দিয়ে মুসলমানরা একটি নতুন দিনের সূচনাকে উদযাপন করে।
‘প্রথার রয়েছে আইনগত গুরুত্ব’- এর অর্থ হচ্ছে সুস্পষ্ট সুনিশ্চিত ও সুনির্দিষ্টভাবে বাধ্যতামূলক বা অবশ্যকরণীয় কিংবা নিষিদ্ধ, তা বাতিল করতে এ নীতির সাহায্য নেয়া যাবে না। জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক বাস্তবতাকে বিবেচনায় না নিয়ে যারা মূলভাষ্যকে অন্ধের ন্যায় আঁকড়ে ধরে, তারা সুস্পষ্ট গুরুতর ভুলের মধ্যে রয়েছে। ইমাম শাফিয়ি ইরাকে অবস্থানকালে যে মত দেন, পরে মিসরে অবস্থানকালে একই বিষয়ে সময় ও স্থান বিবেচনায় বিপরীত মত প্রদান করেন। শাফিয়ি পরিস্থিতির ও পারিপাশির্^ক অবস্থার তীক্ষè পর্যবেক্ষক ছিলেন যিনি মতামত দেয়ার ক্ষেত্রে সময় ও স্থানের গুরুত্ব যথাযথভাবে বিবেচনায় নিতেন।
প্রথার ব্যাপারে ইসলাম উন্মুক্ত ও সংস্কারমুক্ত দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে। অনুমান করা অনুমোদিত যদি তা কল্যাণকর হয় এবং তা দেশজ প্রথার ক্ষেত্রেও প্রাসঙ্গিক হয়। প্রথাকেও অবশ্যই গ্রহণযোগ্য মনে করতে হবে যতক্ষণ পর্যন্ত না তা অন্যকিছু বলে প্রমাণিত হয়। প্রথার ক্ষেত্রে সম্মতি বা অনুমোদনই মূলবিধি (আল-আসল ফি আল-ইবাহা)। কোনো বিশেষ সনাতন প্রথা-ঐতিহ্য অনুমোদনের যোগ্য কিনা, তা প্রমাণের দায়িত্ব পুরোপুরিভাবে তাদের ওপর বর্তায় যারা তা প্রত্যাখ্যান করে। যারা তা অনুমোদন করে, এ দায়িত্ব তাদের নয়। ইসলামের আদর্শ-মূলনীতি ভুলের ক্ষেত্রে কঠোরতার স্বপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে না বরং নমনীয়তার পক্ষে অবস্থান নেয়া শ্রেয় মনে করে।৯ প্রথা সম্পর্কিত মূলনীতি হচ্ছে অব্যাহতি (আল-আসল ফি আল-আদাত আল-আফ্উ) অর্থাৎ তারা দোষারোপ হতে মুক্ত।
অন্যান্য মূলনীতি : যেকোনো বিষয় অনুমোদনযোগ্য যে অবধি তা অন্য কিছু বলে প্রমাণিত হয়; দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত নির্দোষ মনে করতে হবে; যা ক্ষতির কারণ তা অপসারণযোগ্য; যে বিধিবিধান নিয়ম সিদ্ধান্ত ক্ষতিকর তা অকেজো-বাতিল; অনাবশ্যক কষ্টের মুখোমুখি হওয়া ব্যতিরেকে মানুষ যা নিষ্পন্ন করতে অসমর্থ তা বাতিলযোগ্য।
বস্তুত সাংস্কৃতিক আচার-রীতিনীতির প্রত্যাখ্যানের কোনো অর্থ হয় না। সুস্থ-কল্যাণকর প্রথার অনুসরণ এক ধরনের বাধ্যবাধকতা। যা সুস্থ-কল্যাণকর প্রথার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত, তা সুস্থ-কল্যাণকর নীতি-আদর্শ দ্বারাও সমভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত যা স্থানীয় সংস্কৃতির সকল শুভ-কল্যাণকর বিষয়কে প্রকারান্তরে দৃঢ়তার সাথে অনুমোদন করে। জনগণকে তাদের প্রথা, আচার ও জীবনের সার্বজনীন আশা-আকাক্সক্ষা অনুসরণ অনুগমন করতে দেয়া বাধ্যতামূলক-অবশ্যকরণীয়।
ইসলাম মুসলমানদের সব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতি উন্মুক্ত-উদার দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করতে শিক্ষা দেয়। দেশজ সংস্কৃতির প্রতি সহনশীল হওয়ার কারণে এশিয়া, আফ্রিকা ও অন্যত্র যেখানেই ইসলাম পৌঁছেছে সেখানেই স্থানীয় সংস্কৃতির শেকড় বিস্তার করা সম্ভবপর হয়েছে। সাংস্কৃতিক প্রথা-রীতিনীতি প্রকৃতিগতভাবে সুস্থ। প্রকারান্তরে এর অর্থ হচ্ছে প্রতিষ্ঠিত নিয়মনীতি-বৈশিষ্ট্যের বিরুদ্ধাচরণ করা মানুষের জন্য দুরূহ।
ঐতিহ্যবাহী মুসলিম সমাজের স্বতন্ত্র গুণ এবং বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য। ইবন বতুতা বিদেশে ভ্রমণকালে সচরাচর অনুভব করতেন যে তিনি স্বদেশেই আছেন। বিভিন্ন মুসলিম দেশ পরিদর্শনের সময় তিনি লক্ষ করেন যে আঞ্চলিক বৈচিত্র্য সত্ত্বেও ঐশী নীতি-আদর্শে আলোকিত সমাজে ইসলামের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি অক্ষুণ্ন রয়েছে।
নৃতাত্ত্বিক চীনা হুই মুসলিম জনগোষ্ঠীর প্রাচীন-ইসলামী সংস্কৃতির মাঝে রয়েছে বহু গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষণীয় বিষয়। কেননা তা বিকশিত হয়েছে একটি অসাধারণ আলোকোজ্জ্বল অমুসলিম সভ্যতার ভেতর। চীনা মুসলিম সংস্কৃতি হুই জনগোষ্ঠীকে তাৎপর্যপূর্ণ অভিব্যক্তির মাধ্যমে বলবান করেছে। এটা স্বকীয় ঐক্যবদ্ধ বোধ সমুন্নত রাখতে তাদের সুযোগ দেয় এবং তা তারা করে তাদের বিশ^াসের ইজতিহাদি ব্যাখ্যার মাধ্যমে যা অকৃত্রিমভাবে মুসলিম কিন্তু তাদের পারিপার্শ্বিক বিরাজমান মূল্যবোধ ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের বিষয়ে সজাগ। এটা প্রাচীন চীনের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যকে পুরোপুরি বিবেচনায় নিয়েছে।
বিশে^র সর্বত্রই মুসলিম সংস্কৃতি বিকাশ, শ্রীবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধ হওয়ার অন্যতম কারণ স্থানীয় ভাষার বোধগম্য ও কৌশলী ব্যবহার। পশ্চিম আফ্রিকা ক্ল্যাসিক্যাল আরবি ভাষার চর্চা করেছে। তা সত্ত্বেও তারা আঞ্চলিক প্রাচুর্যপূর্ণ ভাষা ও বাচনের সমৃদ্ধ ও মূল্যবান ব্যবহার সুনিশ্চিত বিশ্বাস ও দৃঢ় আস্থার সাথে করেছে। বাংলাভাষা মুসলিম শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতার ফলে সমৃদ্ধি লাভ করে (বাংলা সুলতানাত-শাহী বাঙ্গালাহ- ১৩৫২-১৫৭৬)।
একটি সুস্থ-কল্যাণকর মুসলিম সংস্কৃতি বিনির্মাণের জন্য যা ইতোমধ্যে সুপ্রতিষ্ঠিত তা বিবেচনায় নেয়া দরকার, বিশেষ করে সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীর সফল উদ্যোগকে। এ ক্ষেত্রে সম্ভাবনাময় সকল কর্তব্যকর্ম, গতিপথ ও অভিমুখকে অবশ্যই শনাক্ত করতে হবে এবং ভুলত্রুটিকে অবশ্যই সংশোধন করতে হবে। সফল দেশজ মুসলিম সংস্কৃতি পুনর্নির্মাণ করার জন্য প্রয়োজন ইসলাম ও ইতিহাসের সুগভীর জ্ঞান, সেই সাথে সকল টেকসই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে বিবেচনায় নেয়া ।
নৃতাত্ত্বিক ও সামাজিক অভিজ্ঞতা ও পটভূমি যাই হোক না কেন সংস্কৃতিকে অবশ্যই ইসলামের অতুলনীয়, উদ্দীপক ও বিশ^জনীন নীতি ও মূল্যবোধকে বিবেচনায় নিতে হবে। একটি সফল মুসলিম সংস্কৃতিকে একই সাথে ইসলামের অতুলনীয় আদর্শ এবং দেশজ সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য ও নান্দনিক মূল্যবোধের সাথে সাদৃশ্য রেখে সহাবস্থান করতে হবে।
ইসলামের গতিশীল বহু-রূপটি দু’টি পর্যায়ে দৃষ্টিগোচর হয়। প্রথম পর্যায় হচ্ছে বিভিন্ন মাজহাবের মূলভাষ্যের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য এবং দ্বিতীয় পর্যায় হচ্ছে সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য। বিভিন্ন সমাজের মুসলমানরা তাদের নিজস্ব রীতি-আচার-অভ্যাস অনুশীলন পুরোপুরি রদ করেননি। আরব, তুর্কি, দক্ষিণ এশীয় ও আফ্রিকানদের জীবনযাপন প্রণালী থেকে তা স্পষ্ট। আফ্রিকার ও এশিয়ার মুসলমানরা ইসলামের মূলনীতি লঙ্ঘন বা এর সীমারেখার বাইরে না গিয়েই নিজেদের রীতি-আচার-সংস্কার-আদব-কায়দা বজায় রেখেছে।
বিশ^াসের ক্ষেত্রে ইসলাম অভিন্ন। তবে যদি কেউ বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, সেন্ট্রাল এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, বসনিয়া এবং পাশ্চাত্যের দেশগুলোর মুসলমানদের জীবন ও জীবনাচারের দিকে তাকায়, সামগ্রিকভাবে তাদের জীবনযাপনের পার্থক্য তার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠবে। ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং অন্যান্য অমুসলিম দেশের মুসলিম অভিবাসীরা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিন্যাস ও ধরনে পরস্পর ভিন্ন। যারা সউদি আরবে হজ পালনে আসে, তাদের মাঝে আমরা নানা রূপ ও বৈচিত্র্য লক্ষ করি। ইসলামী সংস্কৃতি ‘বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যে’র ভেতরে দৃঢ়ভাবে প্রোথিত।
অনার কিলিংসহ যেসব সমস্যা মুসলিম সমাজে বিদ্যমান তা প্রকৃতপক্ষে সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, কুসংস্কার, শিক্ষা ও অপশাসনের সমস্যা। গোত্রীয় ও নৃতাত্ত্বিক বিধানকে ভুলবশত অযৌক্তিকভাবে ‘ইসলামসম্পর্কিত সমস্যা’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। ধর্ম সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করে। অপর দিকে সংস্কৃতি প্রভাবিত করে জনগণের ধর্ম চর্চা। ইসলামে এ দুয়ের মাঝে সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। একজন আরব মুসলমান অথবা একজন ইন্দোনেশীয় মুসলমান কিংবা একজন নাইজেরিয় মুসলমান বা একজন বসনীয় মুসলমানের জীবন ও জীবিকার দিকে তাকালে তা সুস্পষ্ট হয়। তাদের পোশাক, খাদ্য এবং ভাষা আলাদা- পৃথক। বিশে^র বিভিন্ন অঞ্চলের মুসলমানদের রয়েছে পৃথক সংস্কৃতি, যদিও তারা একই ধর্মের অনুসারী। এ প্রসঙ্গে থাইল্যান্ড ইউনিভার্সিটির ফেলো জোসেফ আই ফার্নান্ডোর বক্তব্য উল্লেখ করা যেতে পারে। তার ভাষায় : ‘ইন্দোনেশিয়া বা মালয়েশিয়ার মুসলমান আর সউদি আরবের মুসলমান হুবহু এক নয়। একজন সউদি আরবের মুসলমান আরব সংস্কৃতি ও তার নিজস্ব ইতিহাস, পরিবেশ ও ঐতিহ্যের ফল।’১০
ডাচ সমাজবিজ্ঞানী ও রাজনীতিক পিম ফরটুইন বলেছেন : এ কথা মনে জাগরূক থাকতে হবে যে সংস্কৃতি, যা অন্যরা জীবনাচার হিসেবে আখ্যায়িত করে, তা এত সহজে পরিত্যাগ করা যায় না। বিখ্যাত জার্মান স্কলার মুরাদ হফম্যান যথার্থই বলেছেন, তিনি ইসলামকে ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তবে তিনি সেই সাথে ধারণ করেন পরিচ্ছন্নতা, ত্রুটিহীন, নিখুঁত ও চরম উৎকর্ষতার মতো পাশ্চাত্যের মূল্যবোধ। আরবের একটি বিখ্যাত ও সুপরিচিত প্রবাদ হচ্ছে, যারা নিজ ইতিহাস ভুলে যায়, তারা হারিয়ে যায়। ইতিহাস বলতে এখানে যশ-গৌরব-মহিমা, উত্তরাধিকার ও সংস্কৃতিকে বুঝানো হয়েছে।
উপসংহারে, আমাদের বুঝতে হবে যে, আইনি-রাজনৈতিক পরিচিতি আর নৃতাত্ত্বিক পরিচিতি এক নয়। বাঙালিরা বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে বসবাস করে। তাদের আইনগত ও রাজনৈতিক পরিচয় ভিন্ন। প্রায় ২.৫ মিলিয়ন বাঙালি করাচিতে বসবাস করে। তাদের আইনি-রাজনৈতিক পরিচয় হচ্ছে তারা পাকিস্তানি। উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বাঙালির স্থায়ী নিবাস যুক্তরাজ্যে। তাদের আইনি-রাজনৈতিক পরিচয় হলো তারা গ্রেট ব্রিটেনের নাগরিক। মক্কার মিসফালাহ এলাকায় বিপুলসংখ্যক বাঙালি স্থায়ীভাবে বাস করে। তাদের রয়েছে সউদি আরবের পাসপোর্ট, তাদের আইনি-রাজনৈতিক পরিচয় হচ্ছে তারা সউদি আরবের নাগরিক। প্লুরালিজম এবং মাল্টিকালচারালিজম কোনো নতুন বিষয় নয়। তুরস্কের মিল্লাত একধরনের স্বায়ত্ত্বশাসন ভোগ করত।
তথ্যনির্দেশ
‘সংস্কৃতি হচ্ছে সেসব নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধ যা মানুষকে জন্মের পর হতে প্রভাবিত করে’। মালেক বেন্নাবি, দি কোশ্চেন অব কালচার, ইসলামিক বুক ট্রাস্ট, কুয়ালালামপুর ২০০৩, পৃষ্ঠা ৫১।
‘ইসলাম দেশপ্রেমের বিরোধী নয়। শর্ত হচ্ছে, তা মানবজাতির সযতœলালিত সমতা ও ভ্রাতৃত্ব, ন্যায়বিচার, পক্ষপাতহীন সহমর্মিতার নীতির পরিপন্থী হবে না। ইসলামের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তা অসুয়া সাম্প্রদায়িকতা, আগ্রাসী ও উৎকট স্বাদেশিকতার পরিপন্থী।’ আব্দুর রহমান মোমিন, প্লুরালিজম অ্যান্ড মাল্টিকালচারালিজম : অ্যান ইসলামিক পার্সপেক্টিভ, আমেরিকান জার্নাল অব ইসলামিক সোস্যাল সায়েন্সেস, আইআইআইটি অ্যান্ড এএমএসএস, হার্নডন, যুক্তরাষ্ট্র, ভলিউম ১৮, নং ১, বসন্তকাল ২০০১, পৃষ্ঠা ১৪১।
উপদলীয় মনোভাব; আসাবিয়্যাহ। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আসাবিয়্যাহ সংজ্ঞায়িত করতে অনুরোধ করা হয়। তিনি বলেন, এটা হলো নিজের লোকদের এমনভাবে সাহায্য করা যা নৈতিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে ভুল। অতঃপর তিনি বলেন, যে মানুষকে আসাবিয়্যাহর দিকে আহ্বান জানায়, সে আমাদের একজন নয়। যে এর জন্য যুদ্ধ করে, সে আমাদের একজন নয়। যে এর জন্য মৃত্যুবরণ করে, সে আমাদের একজন নয়। ... একজন সাহাবি নবীকে প্রশ্ন করেন, নিজের লোকদের ভালোবাসাও আসাবিয়্যাহর অংশ কিনা। তিনি এর নেতিবাচক জবাব দেন এবং বলেন, আসাবিয়্যাহ হচ্ছে অবিচার ও নির্যাতনের বিষয়ে নিজ সম্প্রদায়কে সাহায্য করা। প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৩৯।
উম্মাহ একটি আরবি শব্দ যার অর্থ ‘সম্প্রদায়’। এটা শা’ব হতে পৃথক যার অর্থ অভিন্ন বংশাণুক্রম বা ভৌগোলিক সীমানার অধিকারী জাতি। তাই এটাকে আখ্যায়িত করা চলে একটি সুপরা-ন্যাশনাল মানবগোষ্ঠী হিসেবে যাদের রয়েছে অভিন্ন ইতিহাস। উম্মাহ হচ্ছে ‘একটি সম্প্রদায় যার ভিত্তি হচ্ছে আধ্যাত্মিক আকাক্সক্ষা ... একটি সম্প্রদায় যারা সুবিচার, পারস্পরিক সাহায্য-সহায়তা, সংহতি, ভ্রাতৃত্ব সম্বন্ধে সম্যক ধারণা রাখে।’ আলিয়া আলী ইজেতবেগোভিচ, ইসলাম বিটুইন ইস্ট অ্যান্ড ওয়েস্ট, আমেরিকান ট্রাস্ট পাবলিকেশন্স, যুক্তরাষ্ট্র, পৃষ্ঠা ১৭০-১৭১।
তাফসির আল-জালালাইন, কুরআন সম্পর্কিত বিখ্যাত তাফসির, ইংরেজি অনুবাদ ফেরাস হামজা, রয়্যাল আলা আল-বায়েত ইনস্টিটিউট ফর ইসলামীক থট্্, ফন্স ভিটি, লুইসভিল, কেওয়াই ৪০২০৭, ২০০৮, পৃষ্ঠা ১৫৪।
র্উ্ফ বা প্রথা হচ্ছে ইসলামী আইনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎস। আহকাম বা আইনি বিধিবিধান-সিদ্ধান্ত যা পরিস্থিতি, স্থান ও সময়ের পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে পরিবর্তিত হয়। ‘র্উ্ফ হচ্ছে বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীর সমষ্টিগত অনুশীলন-চর্চা ... তা কারো ব্যক্তিগত অভ্যাসের দিকে ইঙ্গিত করে না ... প্রথা যা শরিয়াহর মূলনীতির লঙ্ঘন করে না তা বৈধ ... উলামা (ইসলামের ধর্মীয় স্কলারগণ) কুরআনের ব্যাখ্যার উদ্দেশ্যে র্উ্ফকে বৈধ মান হিসেবে সাধারণভাবে গ্রহণ করেছেন ... হালাল (অনুমোদিত) ও হারাম (নিষিদ্ধ) সংক্রান্ত নিয়মরীতি নির্ধারণের ব্যাপারে একটি বৈধ ভিত্তি হিসেবে অনুমোদিত প্রথার নীতিগত স্বীকৃতি দিয়েছে শরিয়াহ।’ মোহাম্মদ হাশিম কামালী, প্রিন্সিপল্্ অব ইসলামিক জুরিসপ্রুডেন্স, চতুর্দশ অধ্যায়, র্উ্ফ (কাস্টমস), ইসলামিক টেক্সটস সোসাইটি, কেমব্রিজ, যুক্তরাজ্য, ১৯৯১, পৃষ্ঠা ২৮৩-২৮৪।
আল-তাবাকাত আল-কুবরায় আবু হুরায়রা সূত্রে ইবন সাদ বর্ণিত হাদিস। উদ্ধৃত আহম্মদ আল-রায়সুনি, আল-সুরা, আইআইআইটি, লন্ডন-ওয়াশিংটন, ২০১১, পৃষ্ঠা ১৮, ৪৮।
মসজিদ স্থাপত্য পাঁচ ধরনের : পারস্য বা ইরানি, তুর্কি, ভারতীয়, ক্লাসিক্যাল আরবীয় ও চীনা। প্রতিটি মসজিদের রয়েছে নিজস্ব পৃথক বৈশিষ্ট্য। মসজিদের একটির নকশা অন্যটি থেকে আলাদা হওয়ার মূল কারণ একদিকে নির্মাণ সামগ্রীর প্রাপ্যতা ও পরিবেশ এবং অন্য দিকে সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য। বহুজাতিক সংস্কৃতির পরিবেশ মসজিদের ধরন, নকশা ও স্থাপত্যের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে থাকে।
মালিতে অবস্থিত গ্রেট জেন্নি মস্ক এতদ অঞ্চলের বৃহত্তম মসজিদ, যা পশ্চিম আফ্রিকার স্টাইলে নির্মিত। মালির মসজিদের ছাদ বৃষ্টি সামান্য হওয়ার কারণে সাধারণত সমতল হয়ে থাকে এবং এ ধরনের ছাদ মুক্ত ও শীতল বায়ুর মধ্যে ঘুমানোর উপযোগী। মালির মসজিদের একটি বৈশিষ্ট্য হলো মসজিদের মেহরাব বাইরের দিকে প্রসারিত যা দেখতে একটি ছোট রুমের মতো।
উত্তর আফ্রিকার তিউনিশিয়ায় কাইরোয়ান গ্রেট মস্ক ত্রিমাত্রিক উপস্থাপনা হাইপোস্টাইলের একটি উদাহরণ। ইসলাম-পূর্ব আর প্রাচ্য ইসলামের শিল্পকলার সম্মিলন উত্তর আফ্রিকার ধর্মীয় স্থাপত্যে কিভাবে হয়েছিল এটা তার দৃষ্টান্ত। এ মসজিদের গম্বুজের উপাদান রোমান এবং বাইজেনটাইন স্থাপত্যের কাছ থেকে নেয়া।
আন্দালুসিয়ার গ্রেট মস্ক অব কর্ডোভা উমাইয়ারা পুরোপুরি নির্মাণ করে। এ মসজিদ বিদ্যমান আঞ্চলিক ঐতিহ্যর ভিত্তিতে অতি উজ্জ্বল স্থাপত্যশৈলী উদ্ভাবনে মুসলিম বিশ্বের যোগ্যতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এ মসজিদে বিদ্যমান ও নবধারার অনন্য সমন্বয় সাধিত হয়েছে।
এ মসজিদটিতে রয়েছে একটি সুবিশাল হাইপোস্টাইল প্রার্থনাগার (অর্থাৎ স্তম্ভ বা পিলারে পরিপূর্ণ), একটি প্রাচীরবেষ্টিত ছাদবিহীন অঙ্গন যার মাঝখানে রয়েছে ফোয়ারা, কমলা কুঞ্জবন, অঙ্গনঘেরা প্রসারিত হাঁটার পথ এবং মানুষকে সালাতের জন্য আহ্বান জানাতে একটি মিনার। সালাত আদায়ের বিস্তীর্ণ হলকে জ্যামিতিক নকশার পুনঃ পুনঃ ব্যবহারের মাধ্যমে আকর্ষণীয় করে তোলা হয়েছে। কর্ডোভার মসজিদ রিসাইকল করা প্রাচীন রোমান কলাম বা স্তম্ভের সাহায্যে নির্মাণ করা হয়েছে, যা থেকে উদগত হয়েছে ভারসাম্যপূর্ণ দুই স্তর বিশিষ্ট চমক লাগানো খিলান। এটি পাথর ও লাল ইট দিয়ে নির্মিত।
এর মেহরাব অপরূপ অলঙ্কৃত খিলানের সাহায্যে নির্মিত যার পেছনে রয়েছে একটি লক্ষণীয় আকারের ফাঁকা জায়গা যা সাইজে একটি ছোটখাটো রুমের সমান। গোল্ড টেসেরা বা সোনালি টেসেরা পাথর, ছোট সোনালি কাঁচখণ্ড এবং রঙের সাহায্যে চোখ ঝলসানো গাঢ়-নীল, লাল-বাদামি, হলুদের সংমিশ্রিত আবহ তৈরি করে খিলানকে সূক্ষ্ম ক্যালিগ্রাফি বন্ধনী ও উদ্ভিদজাত অলঙ্কৃত শিল্পকর্মের নকশার মাধ্যমে (ভেজিটাল মোটিফস) অলঙ্করণ করা হয়।
ভিসিগোথদের স্থাপত্যে সাধারণত হর্সসু-স্টাইল বা অশ^ক্ষুরাকৃতির প্রাধান্য দেখা যায় যারা রোমানদের অব্যবহিত পর এবং উমাইয়াদের আগমনের পূর্বে এসব অঞ্চল শাসন করে।
প্রাচীন ভারতে অধিকাংশ ভবন ছিল কাঠের তৈরি, কেননা কাঠ সহজলভ্য ছিল। সেই সাথে খিলান কিংবা গম্বুজের সাথে তাদের পরিচয় ছিল না। মধ্যযুগে কাঠ দুর্লভ হয়ে পড়ে। তখন ভারতীয়রা কাঠের বদলে পাথর দিয়ে কাঠামো নির্মাণ করতে শুরু করে।
চীনে নিউজিয়ে মসজিদ হচ্ছে সে দেশের প্রাচীন মসজিদগুলোর অন্যতম (প্রতিষ্ঠা ৯৯৬ সাল)। এ মসজিদে স্থানীয় উপাদান হিসেবে প্রধানত কাঠ ব্যবহৃত হয়েছে। মসজিদটি চীনা স্টাইলে নির্মাণ করা হয়েছে। গোটা ভবনের ভার বহন করেছে কাঠের একটি কাঠামো। বিরাট বিরাট টিম্বার লগ বা কাঠের খণ্ড ব্যবহার করা হয়েছে লোড বিয়ারিং কলাম বা ভার বইবার স্তম্ভ এবং ল্যাটারাল বিম নির্মাণের কাজে যা ভবন নির্মাণ এবং ছাদকে ধারণ করতে সহায়তা করে।
http://www.kamit.jp/27_mali/mal_eng.htm
https://www.khanacademy.org/humanities/art-africa/north-a/x1f9f8bff:tunisia/a/the-great-mosque-of-kairouan
https://www.khanacademy.org/humanities/ap-art-history/early-europe-and-colonial-americas/ap-art-islamic-world-medieval/a/the-great-mosque-of-cordoba
https://www.sciencedirect.com/science/article/pii/S1110016817302442 All assessed on 28.10.2020
আবি শাইবাহ, আত তিরমিজি, আল-হাকিম ও আল-বায়হাকি বর্ণিত হাদিস, নবী সা: বলেন : ভুল সিদ্ধান্তের ফলে কোনো দোষী ব্যক্তি নির্দোষ হিসেবে গণ্য হওয়া, নির্দোষ কারো শাস্তি ভোগের ভুল সিদ্ধান্তের চেয়ে উত্তম।
জোসেফ আই ফার্নান্ডো, টুওয়ার্ডস আন্ডারস্ট্যান্ডিং দ্য রিলেশন বিটুইন রিলিজিয়ন্স অ্যান্ড কালচার্স ইন সাউথইস্ট এশিয়া, আমেরিকান জার্নাল অব ইসলামিক সোস্যাল সায়েন্সেস, আইআইআইটি অ্যান্ড এএমএসএস, হার্নডন, যুক্তরাষ্ট্র, ভলিউম ২৪, নং ৪, শরৎকাল ২০০৭, পৃষ্ঠা ১৩৫।
পুস্তকনির্দেশ
ঈসমাইল রাজি আল ফারুকি এবং লুইস লামইয়া আল ফারুকি, দ্য কালচারাল অ্যাটলাস অব ইসলাম, ম্যাকমিলান পাবলিশিং কোম্পানি, নিউ ইয়র্ক।
লুইস লামইয়া আল ফারুকি, আনমার ফারুকি এলজেইন, হাওয়াজিন ফারুকি, তাইমা আল ফারুকি, অ্যান অ্যানোটেটেড গ্লোসারি অব অ্যারাবিক মিউজিক্যাল টার্মস, গ্রিনউড প্রেস, ১৯৮১।
জোসেফ প্রোগলার, দ্য সাউন্ড অফ আজান : মুসলিম রিফ্লেকশনস অন দ্য কল টু প্রেয়ার, দ্য প্রোগলার পেপারস, অ্যান আরকাইভ অফ রাইটিংস, ০২.১২.২০০৩।
http://progler.blogspot.com/2011/06/sound-of-azan-muslim-reflections-on.html Assessed 28.10.2020
আর এম শ্যাফার, দ্য টিউনিং অফ দ্য ওয়ার্ল্ড, আলফ্রেড এ নফ, নিউ ইয়র্ক, ১৯৭৭।
আর স্টোন, সাউন্ড অ্যান্ড রিদম ইন করপোরেট রিচুয়াল