রবীন্দ্রব্যবসা নয়, উত্তরাধিকার ভেঙে ভেঙে সমুদ্রের দিকে যাত্রা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর - ছবি সংগৃহীত
উনিশ শতকে উপনিবেশিক ভারতের মধ্যবিত্ত জীবনে পাশ্চাত্য প্রভাব ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, গণতন্ত্র, যুক্তি ও বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনাদর্শ সৃষ্টি করে। ফলে কলকাতাকেন্দ্রিক শিক্ষিত মধ্যবিত্ত নাগরিক জীবনকে সেই আদর্শ নতুন স্বপ্ন, সম্ভাবনা ও কল্পনায় উজ্জীবিত করে তোলে। যদিও বাঙালি মুসলমানের জাগৃতি শুরু হয় উনিশ শতকের শেষ দিকে। বিশ শতকের গোড়ায় এসে বাঙালি হিন্দু-মুসলিম সমাজের গান্ধীজীর ‘সত্যাগ্রহ’ আন্দোলন, খিলাফত-আন্দোলন, ফরায়েজী আন্দোলন ও সন্ত্রাসবাদী সশস্ত্র বিপ্লব ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলে জনমানসে স্বপ্নভঙ্গের বেদনা তীব্র হয়ে ওঠে। আসলে এসব আন্দোলন কোনো সুনির্দিষ্ট পরিবর্তন সমাজমানসে নিয়ে আসতে পারেনি। ফলে বিরাজমান আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত থেকে যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত (১৮৮৭-১৯৫৪), মোহিতলাল মজুমদার (১৮৮৮-১৯৫২), সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত (১৮৮২-১৯২২) এবং কাজী নজরুল ইসলামের (১৮৯৯-১৯৭৬) উত্থান। এসব কবি রবীন্দ্রকাব্যের মেজাজ ও চরিত্রের বাইরে এসে এক স্বতন্ত্র কাব্যলোক নির্মাণ করেন। আর পরিবর্তিত পটভূমিতে রবীন্দ্রোত্তর কবি ও কবিতার সোপান হিসেবে ভূমিকা রাখে ‘কল্লোল’ (১৯২৩), ‘কালি-কলম’ (১৯২৬), ‘প্রগতি’ (১৯২৭), ‘পরিচয়’ (১৯৩১) ও ‘কবিতা’ (১৩৪২)-র মতো প্রভাবশালী ও আধুনিক-মনস্ক সাহিত্য পত্রিকা।
বিশ শতকের তৃতীয় দশকে বাংলাদেশের যেসব লেখক সাহিত্যক্ষেত্রে খ্যাতিলাভ করেন তাদের সবারই প্রথম ও প্রধান অবলম্বন ছিল ‘কল্লোল’, ‘ভারতী’ (১৮৭৭) ও ‘সবুজপত্র’ (১৯১৪)। এ ছাড়া ‘কল্লোলে’র লেখকরা ‘কল্লোলের দল’ নামে পরিচিত ছিল এবং এই সময়কে ‘কল্লোলযুগ’ নামে অভিহিত করা হয়। ‘কল্লোল’ রবীন্দ্র পরবর্তী লেখকদের ওপর কতটা প্রভাবসঞ্চারী ছিল তা প্রকাশিত বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-৭৪) ও অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের (১৯০৩-৭৬) লেখায় :
তার কথা মনে হলে এখনো আমার সেই দিনটির কথা মনে পড়ে, যে দিন প্রথম কম্পিতবক্ষে ‘কল্লোল’ আপিশে ঢুকেছিলাম। ১০/২ পটুয়াটোলা লেনের সেই আড্ডার নেশা কখনো ভুলতে পারব না আমি। সেখানে সকলেই আসতেন- নজরুল ইসলাম, প্রেমেন্দ্র, শৈলজানন্দ, অচিন্ত্যকুমার, প্রবোধকুমার, হেমন্তকুমার, মনীন্দ্রলাল, মণীশ ঘটক (‘যুবনাশ্ব’), পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়, ধূর্জটি প্রসাদ, কালিদাস নাগ, নলিনী সরকার (গায়ক), জসীম উদ্দিন, হেমচন্দ্র বাগচী, নৃপেন কৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়, ভূপতি চৌধুরী, সরোজকুমার রায় চৌধুরী, শিবরাম চক্রবর্তী, অজিত দত্ত, বিষ্ণু দে ও আরো অনেকে।
‘কল্লোল’ বললেই বুঝতে পারি সেটা কী। উদ্ধত যৌবনের ফেনিল উদ্দামতা, সমস্ত বাধা-বন্ধনের বিরুদ্ধে নির্ধারিত বিদ্রোহ, স্থবির সমাজের পচা ভিত্তিকে উৎখাত করার আলোড়ন।
‘কল্লোল’ ছাড়া অন্য পত্রিকাগুলোর মধ্যে ‘কবিতা’ ও ‘পরিচয়’ সবচেয়ে বেশি দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং অগ্রণী ভূমিকা রাখে। প্রকৃতপক্ষে, এ পত্রিকাগুলো ঘিরেই বাংলা কবিতায় আধুনিকতার সূত্রপাত ঘটে। যদিও অনেকাংশে তা আধুনিকতার খোলসে পশ্চিমাকরণ বা উপনিবেশিক প্রকল্পের মধ্যে প্রবেশ করা ও বদলে যাওয়া।
২
বাংলা কাব্যে পশ্চিমবাহিত আধুনিকতার শুরু রবীন্দ্র-বিরোধিতা এবং যুগসচেতনতার মধ্য দিয়ে। রবীন্দ্রযুগে যেসব কবি রবীন্দ্র-প্রভাব অতিক্রম করে স্বাধীনভাবে কবিতা রচনার মাধ্যমে স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের পরিচয় দিয়েছেন তাদের মধ্যে নজরুল ইসলামের স্থান শীর্ষে। আর রবীন্দ্রনাথের পরে বাংলা ভাষায় তিনিই প্রথম মৌলিক কবি। পৌরুষ ও শক্তির চিত্তচাঞ্চল্যে, গণচেতনা ও নির্যাতিত মানুষের মুক্তির আকাক্সক্ষায়, স্বাজাত্যবোধ ও স্বাধীনতার স্পৃহায়, মানবতা ও সাম্যবাদের বাণীবিন্যাসে তার কবিতা সমুজ্জ্বল।
রক্ত ঝরাতে পারি না তো একা,
তাই লিখে যাই এ রক্ত-লেখা,
বড় কথা বড় ভাব আসে নাক মাথায়, বন্ধু, বড় দুখে!
অমর কাব্য তোমরা লিখিও, বন্ধু, যাহারা আছ সুখে।
এ ধরনের উচ্চারণ রবীন্দ্র-দ্রোহিতায় তখন প্রয়োজন হয়েছিল। আবার রবীন্দ্রনাথের মতো কবি তার ভক্তদের অসন্তোষ অগ্রাহ্য করে নজরুলকে নিতান্ত অল্প বয়সে বই উৎসর্গ করেন। বাংলা সাহিত্যের পক্ষ থেকে তার কাছে দাবি জানিয়েছেন। নজরুলের প্রতিভার সূচনাকালেই মোহিতলালের মতো কবি-সমালোচক তাকে সাহিত্যসমাজে স্বাগত জানান। রবীন্দ্রনাথের পথ ছাড়াও অন্য পথ বাংলা কবিতায় যে সম্ভব, সেটা তিরিশের কবিদের সামনে নজরুলই প্রথম দেখিয়ে দেন। নজরুলের স্বাতন্ত্র্য নির্দেশ করে একজন সমালোচক বলেন : ‘ভারতীয় পুরাণ এবং পশ্চিম এশীয় ঐতিহ্য-ব্যবহারে তিনি অর্জন করেছেন সমান সাফল্য। নান্দনিক ঐকান্তিকতায় এবং জৈবসমগ্র ঐক্যসূত্রে দুই ভিন্ন উৎসের শিল্প-উপাদান নজরুল-কাব্যে সৃষ্টি করেছে ব্যঞ্জনার একক অনুভূতি।’
যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত উত্তররৈবিক বাংলা কাব্যে একজন মৌলিক ও স্বতন্ত্র কবি। বাংলা কবিতাকে অবাস্তব কল্পনার জগৎ থেকে কঠোর বাস্তবে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে তার অবদান উল্লেখযোগ্য। ভাবের দৃঢ়তায়, দুঃখময়তায়, ব্যঙ্গের ঝাঁজে, মধ্যবিত্ত বাঙালি-জীবনের স্বপ্ন ও বাস্তবের সঙ্ঘাত-চেতনায় এবং বিদ্রোহী মনোভাবে তার কবিতা স্বকীয় ও উজ্জ্বল।
কল্পনা, তুমি শ্রান্ত হয়েছ ঘন বহে দেখি শ্বাস,
বারোমাস খেটে লক্ষ কবির একঘেয়ে ফরমাস।
সেই উপবন, মলয় পবন, সেই ফুলে ফুল অলি
প্রণয়ের বাঁশি, বিরহের ফাঁসি, হাসা কাদা গলাগলি।
এ ধরনের পঙক্তির সৃষ্টি মূলত ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের জীবনাদর্শ থেকে পৃথক। তিনি দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন যে, আবেগের রুদ্ধশ্বাস জগৎ থেকে সাংসারিক সমতলে নেমে এসেও কবিতা বেঁচে থাকতে পারে। পরিশীলত ভাষা ও সুবিন্যস্ত ছন্দের বাইরে চলে এলেও কবিতার জাত যায় না। তবে পরবর্তীকালে বাংলা কাব্যে তার প্রভাব আঙ্গিকগত দিক থেকে, বিষয়বস্তু বা চেতনাগত দিক থেকে নয়।
সাহিত্য সাধনার প্রথমার্ধে রবীন্দ্র-অনুগত থাকলেও পরবর্তী সময়ে মোহিতলাল মজুমদার ভাব ও ভাষার স্বাতন্ত্র্যে রাবীন্দ্রিক জগৎ থেকে পৃথক হয়ে যান। কাব্যসৃজনে দেহাত্মবাদী-মনোভাবের অধিকারী মহিতলাল কবিতার ভাষা, শব্দ প্রয়োগ ও ছন্দ-নির্মাণ-কৌশলের দিক থেকে স্বকীয়তার পরিচয় দেন। অন্য দিকে তিনি কবিতায় আরবি-ফার্সি শব্দের প্রয়োগেও সার্থক। এসব কাব্যগুণের কারণেই তিনি রবীন্দ্রদ্রোহীর দলে অন্তর্ভুক্ত হন।
রবীন্দ্র-সমকালে রবীন্দ্রনাথের প্রতি প্রচুর শ্রদ্ধা সত্ত্বেও যতীন্দ্রনাথ, মোহিতলাল ও নজরুল কাব্যিক দিক থেকে প্রাথমিক রবীন্দ্র-দ্রোহিতা এবং নিজস্ব কাব্যধারা সৃষ্টির আয়োজন করেন; যা পরে তিরিশের কবিদের সাথে রবীন্দ্রনাথের একটি সম্ভ্রান্ত দূরত্ব রচনা করে। প্রকৃতপক্ষে, এ তিনজন কবির দ্রোহী কাব্যপরীক্ষার পরেই দেখা দেয় ‘কল্লোল’-গোষ্ঠীর ‘নতুনতর প্রচেষ্টা’ এবং এরই সাথে বাংলা কবিতার ‘মোড় ফেরা’র ঘণ্টাধ্বনি শোনা যায়।
যতীন্দ্রনাথ-মোহিতলাল-নজরুলের অগ্রজ কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত রবীন্দ্রযুগের ও রবীন্দ্রভক্ত হলেও নানা দিক থেকে একজন স্বতন্ত্র কবি। এ স্বাতন্ত্র্য প্রকাশিত তার কাব্যের বিষয়বস্তুতে, ছন্দ-নির্মাণের কৌশলে, শব্দ ও ভাষা ব্যবহারের কারুকার্যে। কল্পনা ও হৃদয়াবেগকে পরিত্যাগ করে তিনি জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে কবিত্ব প্রকাশ করেন। তার কবিতার ভাববস্তু দেশাত্মবোধ, শক্তির সাধনা ও মানবতার প্রশস্তিতে নির্মিত। বুদ্ধদেব বসুর মতে, ‘সমসাময়িক, কাছাকাছি বয়সের কবিদের মধ্যে তিনি রচনাশক্তিতে শ্রেষ্ঠ, সর্বোতভাবে যুগপ্রতিভূ এবং রবীন্দ্রনাথের পাশে রেখে দেখলেও তাকে চেনা যায়।’
এভাবে ভাবগত ও রূপগত উভয় দিক থেকেই বাংলা কবিতাকে এসব কবি রবীন্দ্রকাব্যের বিপ্রতীপে স্থাপন করেন। যতীন্দ্রনাথ তীব্র ব্যঙ্গের দৃষ্টিতে রাবীন্দ্রিক মঙ্গলবোধ, রোমান্টিক কল্পনা, ভগবদ্ভক্তি ও অস্তিবাদী চেতনাকে আঘাত করেন এবং এক দুঃখময় বাস্তব কাব্যলোক নির্মাণে সচেষ্ট হন। অন্য দিকে মোহিতলাল কামনা-বাসনাযুক্ত দেহাত্মমূলক কবিতা সৃজন করেন রবীন্দ্রনাথের ‘স্নিগ্ধ যৌবনবন্দনা’র বিপরীত প্রান্তে। আর নজরুল প্রথমত, সর্বাত্মক বিদ্রোহের মাধ্যমে আমিত্বকে ঐশ্বরিক আমিত্বে প্রতিস্থাপন এবং সমস্ত অসুন্দর, অকল্যাণ ও অমানবিকতার ধ্বংস কামনা করেন; সাথে সাথে নতুনের, সত্যের ও মানবতার বিজয় কেতন উড়ান। দ্বিতীয়ত, ইন্দ্রিয়চেতনাসম্পন্ন প্রেমের কবিতার বিস্তার ঘটান অতীন্দ্রিয় বিশুদ্ধ প্রেমের স্থানে। বাংলা কবিতায় এসব পরিবর্তনের পেছনে বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং নতুন কালের কশাঘাতই প্রধানত দায়ী।
৩
কালের রূপ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কবিতার রূপান্তরও সম্পন্ন হয়। বিশ শতকের বিশ্ব ও সমাজ সংগঠন অর্থনীতিবিদদের ভাষায় ধনবাদী সমাজব্যবস্থা নামে পরিচিত; আর সমাজতাত্ত্বিকগণ নামকরণ করেছেন ইন্দ্রিয়বেদী বা ঝবহংঁড়ঁং সভ্যতা। বলা বাহুল্য, এ সভ্যতা যন্ত্রভিত্তিক। বিজ্ঞান উদ্ভাবিত এ যন্ত্র যেমন ধনসম্পদ উৎপাদনের ব্যবস্থাগুলো প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত ও রূপান্তরিত করে চলেছে, তেমনি স্থান ও কালকে জয় করে তা পুরো পৃথিবীকেও অবিশ্বাস্য রকমে ক্ষুদ্র করে ফেলেছে। এ ক্রমবর্ধিষ্ণু রূপান্তরের অবসম্ভাবী পরিণাম মানুষের চিন্তায় ও প্রচলিত বিশ্বাসে পরিবর্তন, সনাতন মূল্যবোধের ক্ষয় ও নতুনতর আচরণের উদ্ভব ঘটে। ফলে এ সমাজ মানুষকে মানবিক সত্তা থেকে বঞ্চিত ও বিচ্যুত করে তাকে নিছক এক বস্তুতে পরিণত করেছেÑ যার মূল্য ধনোৎপাদনে প্রয়োজনীয় বস্তু বা পণ্য অপেক্ষা কম। সুতরাং এ মানুষকে শোষণে, অত্যাচারে, পীড়নে, অস্বীকারে কোনো বাধা নেই; আর যন্ত্রের যেহেতু কোনো বিবেক নেই, সেহেতু মানুষের প্রতি এবং বিধি ব্যবহারে বিবেকের কোনো দংশন নেই। এমন পরিবেশে ভালো-মন্দ, সুন্দর-কুৎসিত, স্থূল-সূক্ষ্ম ইত্যাদির বিচারও যেন কেমন হাস্যকর। সব কিছুই অস্তিত্বশীল অথচ কিছুরই যেন কোনো সর্বসম্মত মূল্য নেই। জীবনের সব দিকে সব কিছুকে গ্রাস করে নিয়ে সৃষ্টি হয় এক নৈরাজ্যকর রাজত্ব। এ রাজত্বের চিত্রাবলী প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ের কবিতায় অঙ্কিত হয়ে আছে। এ সময়ই ইউরোপ ও আমেরিকা উভয় মহাদেশে আধুনিক কবিতার প্রবর্তন ও প্রসার হয়। আধুনিক বাংলা কবিতা প্রত্যক্ষভাবে পাশ্চাত্য আধুনিক কবিতায় প্রভাবিত ও সম্প্রসারিত।
ইতিহাসের পটভূমি ও কাব্যপ্রকৃতি বিচারে ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’কে আবু সায়ীদ আইয়ুব (১৯০৬-৮২) কালের দিক থেকে মহাযুদ্ধ পরবর্তী এবং ভাবের দিক থেকে রবীন্দ্র-প্রভাবমুক্ত, অন্তত মুক্তিপ্রয়াসী রূপে গণ্য করেছেন। এ মতটি আমরা এই আলোচনায় গ্রহণ করেছি। যদিও মাইকেল মধুসূদন দত্তকে (১৮২৪-৭৩) রবীন্দ্রনাথ আধুনিক বাংলা কবিতার পথিকৃৎ বলেছেন।
রবীন্দ্রনাথ ‘আধুনিক সাহিত্য’ (১৯০৭) নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন, যেখানে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টপাধ্যায়, বিহারীলাল, সঞ্জীবচন্দ্র চট্টপাধ্যায়, শ্রীশচন্দ্র মজুমদার, শিবনাথ শাস্ত্রী, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, আবদুল করিম, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, যতীন্দ্রমোহন প্রমুখ। মোহিতলাল মজুমদার ‘আধুনিক বাংলা সাহিত্যে’ (১৯৩৬) বঙ্কিমচন্দ্র, বিহারীলাল, সুরেন্দ্রনাথ মজুমদার, দীনবন্ধু মিত্র, দেবেন্দ্রনাথ সেন, অক্ষয়কুমার বড়াল, শরৎচন্দ্র চট্টপাধ্যায় ও সত্যেন্দ্রনাথ দত্তকে বিষয়ীভূত করেন। আবু সায়ীদ আইয়ুব ও হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’ (১৯৪০) এবং বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’ (১৯৫৪) সংকলন দু’টি শুরু হয়েছে রবীন্দ্রনাথের কবিতা দিয়ে, শেষ হয়েছে তৎকালীন তরুণতম কবির কবিতার মাধ্যমে। কিন্তু দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় ও দীপক রায় সম্পাদিত ‘বাংলা আধুনিক কবিতা-১’ (১৯৯২) জীবনানন্দ দাশকে দিয়ে সূচিত হয়েছে। অর্থাৎ রবীন্দ্রদ্রোহী তিরিশোত্তর কালের ‘কল্লোল’ (১৩৩০) প্রভৃতি পত্রিকাবাহিত নতুন ভাবধারা ও আঙ্গিকশৈলীর কবিতাকেই আমরা আধুনিক কবিতারূপে চিহ্নিত করছি।
‘আধুনিক’ শব্দটি সময়ের দিক থেকে ক্রম-অগ্রসরমান, ক্রমপরিবর্তমান ও সঞ্চরণশীল। রবীন্দ্রনাথ ‘পাঁজি মিলিয়ে’ আধুনিকতার সীমানা নির্ণয়ের ব্যাপারে প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। তার মতে, ‘এটা কালের কথা ততটা নয় যতটা ভাবের কথা। নদী সামনের দিকে সোজা চলতে চলতে হঠাৎ বাঁক ফেরে। সাহিত্য তেমনি বারবার সিধে চলে না। যখন সে বাঁক নেয় তখন সেই বাঁকটাকেই বলতে হবে মডার্ন। বাংলায় বলা যাক আধুনিক। এই আধুনিকটা সময় নিয়ে নয়, মর্জি নিয়ে।’ এই ‘মর্জি’র সাথে তিনি শাশ্বত গুণের কথা বলেন : ‘আধুনিক বিজ্ঞান যে নিরাসক্ত চিত্তে বাস্তবকে বিশেষণ করে আধুনিক কাব্য সেই নিরাসক্ত চিত্তে বিশ্বকে সমগ্রদৃষ্টিতে দেখবে, এইটেই শাশ্বতভাবে আধুনিক।’ জীবনানন্দ দাশের (১৮৯৯-১৯৫৬) মত রবীন্দ্রনাথের অত্যন্ত কাছাকাছি : ‘সব সময়ের জন্যেই আধুনিক-এ রকম কবিতা বা সাহিত্যের স্থিতি সম্ভব। ...মানুষের মনের চিরপদার্থ কবিতায় বা সাহিত্যে মহৎ লেখকদের হাতে যে বিশিষ্টতায় প্রকাশিত হয়ে ওঠে তাকেই আধুনিক সাহিত্য বা আধুনিক কবিতা বলা যেতে পারে।’ সুধীন্দ্রনাথ দত্ত (১৯০১-৬০) আধুনিক কবিকে অনাদিকালের ‘চারণের উত্তরাধিকারী’ এবং আধুনিক কবিতাকে ‘মহৎ কবিতা’ রূপে অভিহিত করেন। অন্য দিকে বুদ্ধদেব বসু বিচিত্র দৃষ্টিতে আধুনিক কবিতাকে চিহ্নিত করেন : ‘আধুনিক কবিতা এমন কোনো পদার্থ নয় যাকে কোনো একটা চিহ্নদ্বারা অবিকলভাবে শনাক্ত করা যায়। একে বলা যেতে পারে বিদ্রোহের, প্রতিবাদের কবিতা, সংশয়ের, ক্লান্তির, সন্ধানের, আবার এরই মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে বিস্ময়ের জাগরণ, জীবনের আনন্দ, বিশ্ববিধানে আস্থাবৃত্তি।’ আধুনিক কবি ও কবিতা বলতে অধিকাংশ লেখক রবীন্দ্রোত্তর তথা তিরিশোত্তর কবি ও কবিতার দিকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন। যাকে সমকালে ‘অতি আধুনিক’ বা ‘অত্যাধুনিক’ বাংলা কবিতা বলা হতো। প্রকৃতপক্ষে, আধুনিকতার দু’টি অর্থই বর্তমান; এক অর্থে সাম্প্রতিক, সমকালীন ও সমসাময়িক; অন্য অর্থে চিরকালীন, শাশ্বত, ভাস্বর। এ অর্থময় আধুনিক বাংলা কবিতার স্রষ্টারা হলেন : জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী (১৯০১-১৯৮৬), অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত (১৯০৩-৭৬), প্রেমেন্দ্র মিত্র (১৯০৪-৮৮), বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে (১৯০৯-৮২), অজিত দত্ত (১৯০৭-৭৯) প্রমুখ।
‘কল্লোল’ পর্বের এই কবিদের লক্ষ্য মূলত দু’টি দিকে প্রবাহিত; এক. সচেতনভাবে ‘রবীন্দ্রেতর হওয়া’, দুই. নিজস্ব কাব্যলোক সৃষ্টির প্রচেষ্টা। ‘কল্লোলে’র লেখকদের মানসিকতার পরিচয় মেলে জীবনানন্দ দাশের আলোচনায় : ‘কল্লোলের লেখকেরা মনে করেছিলেন যে রবীন্দ্রনাথ অনেক সার্থক কবিতা লিখেছেন- কিন্তু তিনি যাবতীয় উল্লেখ্য বিষয় নিয়ে কবিতা লেখবার প্রয়োজন বোধ করেন না- যদিও তার কোনো-কোনো কবিতায় ইতিহাসের বিরাট জটিলতা প্রতিফলিত হয়েছে বলে মনে হয়; তিনি ভারত ও ইউরোপের অনেক জ্ঞাত ও অনেকের মনে শাশ্বত বিষয় নিয়ে শিল্পে সিদ্ধি লাভ করেছেন, কিন্তু জ্ঞান ও অন্তর্জ্ঞানের নানা রকম সঙ্কেত রয়েছে যা তিনি ধারণ করতে পারেননি বা করতে চাননি।’ সুধীন্দ্রনাথ দত্ত সমকালের সাথে রবীন্দ্রনাথের দূরত্ব সম্পর্কে বলেন : ‘এ কথা না মেনে তার উপায় নেই যে প্রত্যেক সৎ কবির রচনাই তার দেশ ও কালের মুকুর এবং রবীন্দ্রসাহিত্যে যে দেশ ও কালের প্রতিবিম্ব পড়ে, তাদের সঙ্গে আজকালকার পরিচয় এত অল্প যে উভয়ের যোগফলকে যদি পরীর রাজ্য বলা যায়, তাহলে বিস্ময় প্রকাশ অনুচিত।’ অন্য দিকে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত রবীন্দ্রদ্রোহের ফলে ‘নতুন পথ’ ও ‘নতুন পৃথিবী’র সন্ধান পেয়েছেন : ‘ভাবতুম, রবীন্দ্রনাথই বাংলা সাহিত্যের শেষ, তাঁর পরে আর পথ নেই, সঙ্কেত নেই।
তিনিই সবকিছুর চরম পরিপূর্ণতা। কিন্তু ‘কল্লোলে’ এসে আস্তে আস্তে সে ভাব কেটে যেতে লাগল। বিদ্রোহের বহ্নিতে সবাই দেখতে পেলুম যেন নতুন পথ, নতুন পৃথিবী। আরো মানুষ আছে, আরো ভাষা আছে, আছে আরো ইতিহাস। সৃষ্টিতে সমাপ্তির রেখা টানেননি রবীন্দ্রনাথ- তখনকার সাহিত্য শুধু তারই বহুকৃত লেখনীর হীন অনুকৃতি হলে চলবে না। পত্তন করতে হবে জীবনের আরেক পরিচ্ছেদ’’। আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে তিনি কবিতায় ইশতেহার রচনা করলেন :
পশ্চাতে শত্র“রা শর অগণন হানুক ধারালো,
সম্মুখে থাকুন বসে পথ রুধি রবীন্দ্রঠাকুর,
আপন চক্ষের থেকে জ্বালিব যে তীব্র তীক্ষè আলো
যুগ-সূর্য ম্লান তার কাছে। মোর পথ আরো দূর।
তিরিশোত্তর আধুনিক কবিদের ‘পথ’ অনেক দূরবর্তী বন্দরের দিকে এবং ‘আপন চক্ষের’ আলোয় তারা সেইখানে পৌঁছাতে চান। আর পৌঁছাতে চান বলেই দ্রোহী মনোভাবের প্রতিধ্বনি শোনা যায় কবি বিষ্ণু দের কণ্ঠে :
রবীন্দ্রব্যবসা নয়, উত্তরাধিকার ভেঙে ভেঙে
চিরস্থায়ী জটাজালে জাহ্নবীকে বাঁধি না, বরং
আমরা প্রাণের গঙ্গা খোলা রাখি, গানে গানে নেমে
সমুদ্রের দিকে চলি, খুলে দেই রেখা আর রং
সদাই নূতন চিত্রে গল্পে কাব্যে হাজার ছন্দের
রুদ্ধ উৎসে খুঁজে পাই খরস্রোত নব আনন্দের।
‘বরীন্দ্রব্যবসা’ ছেড়ে আধুনিকরা ‘সমুদ্রের দিকে’ যাত্রা করেন নতুন দিগন্তের প্রত্যাশায়। এ ক্ষেত্রে বুদ্ধদেব বসুর মন্তব্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ : ‘বাঙালি কবির পক্ষে, বিশ শতকের তৃতীয় ও চতুর্থ দশকে, প্রধানতম সমস্যা ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আমাদের আধুনিক কবিদের মধ্যে পারস্পরিক বৈসাদৃশ্য প্রচুর- কোনো-কোনো ক্ষেত্রে দুস্তর; দৃশ্যগন্ধস্পর্শময় জীবনানন্দ আর মননপ্রধান অবক্ষয়চেতন সুধীন্দ্রনাথ দুই বিপরীত প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছেন, আবার এ-দু’জনের কারো সঙ্গেই অমিয় চক্রবর্তীর একটুও মিল নেই। তবু যে এই কবিরা সকলে মিলে একই আন্দোলনের অন্তর্ভূত, তার কারণ এরা নানা দিক থেকে নতুনের স্বাদ এনেছেন; এদের মধ্যে সামান্য লক্ষণ এই একটি ধরা পড়ে যে এরা পূর্বপুরুষের বিত্ত শুধু ভোগ না করে, তাকে সাধ্যমতো সুদে বাড়াতেও সচেষ্ট হয়েছেন, এদের লেখায় যে-রকমেরই যা-কিছু পাওয়া যায়, রবীন্দ্রনাথে ঠিক সে-জিনিসটি পাই না। কেমন ক’রে রবীন্দ্রনাথকে এড়াতে পারব- অবচেতন, কখনো বা চেতন মনেই এই চিন্তা কাজ ক’রে গেছে এদের মনে; কোনো কবি, জীবনানন্দের মতো, রবীন্দ্রনাথকে পাশ কাটিয়ে স’রে গেলেন, আবার কেউ-কেউ তাকে আত্মস্থ ক’রেই শক্তি পেলেন তার মুখোমুখি দাঁড়াবার। এই সংগ্রামে- সংগ্রামই বলা যায় এটাকে, এরা রসদ পেয়েছিলেন পাশ্চাত্য সাহিত্যের ভাণ্ডার থেকে, পেয়েছিলেন উপকরণরূপে আধুনিক জীবনের সংশয়, ক্লান্তি ও বিতৃষ্ণা। এদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্বন্ধসূত্র অনুধাবন করলে ঔৎসুক্যকর ফল পাওয়া যাবে; দেখা যাবে, বিষ্ণু দে ব্যঙ্গানুকৃতির তির্যক উপায়েই সহ্য করে নিলেন রবীন্দ্রনাথকে; দেখা যাবে সুধীন্দ্রনাথ, তার জীবন ভুক্ পিশাচ-প্রমথর, রাবীন্দ্রিক কাব্যবিন্যাস প্রকাশ্যভাবেই চালিয়ে ছিলেন, আবার অমিয় চক্রবর্তী, রবীন্দ্রনাথেরই জগতের অধিবাসী হ’য়েও, তার মধ্যে বিস্ময় আনলেন প্রকরণগত বৈচিত্র্যে, আর কাব্যের মধ্যে নানা রকম গদ্য বিষয়ের আমদানি ক’রে। অর্থাৎ এরা রবীন্দ্রনাথের মোহন রূপে ভুলে থাকলেন না, তাকে কাজে লাগাতে শিখলেন, সার্থক করলেন তার প্রভাব বাংলা কবিতার পরবর্তী ধারায়।’ অর্থাৎ ‘রবীন্দ্রেতর’ হওয়ার সংগ্রামে এইসব আধুনিক কবি রবীন্দ্র-ব্যতিক্রমী মন ও মর্জি, ভাষা ও ভঙ্গির অবলম্বন করেন। এর প্রমাণ তাদের প্রাথমিক কাব্যপ্রয়াসে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে : জীবনানন্দ দাশের ‘ঝরা পালক’ (১৯২৭) ও ‘ধূসর পান্ডুলিপি’ (১৯৩৬); সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘তন্বী’ (১৯৩০); বিষ্ণু দের ‘উর্বশী ও আর্টেমিস’ (১৯৩৩); বুদ্ধদেব বসুর ‘বন্দীর বন্দনা ও অন্যান্য কবিতা’ (১৯৩০); প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘প্রথমা’ (১৯৩০) ইত্যাদি।
১৯৩০-এ ‘পরিচয়ে’র প্রথম সংখ্যায় সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘কাব্যের মুক্তি’ প্রকাশিত হলে আধুনিক কবিদের মধ্যে আধুনিকতার অন্তর্গূঢ় চেতনা ও বহুমাত্রিক ধারণা সঞ্চারিত হয়। এ লেখার মাধ্যমে আধুনিক কবিরা এলিয়ট, পাশ্চাত্যের আধুনিক কাব্য ও কাব্যতত্ত্বের সাথে পরিচিত হন এবং নিজেদের পূর্ব ভাবনা-চিন্তার পুনর্বিবেচনা করেন। এ রচনা থেকেই আধুনিক কবিরা কবিতায় ‘রূপে’র গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন হয়ে যান। সুধীন্দ্রনাথের মতে, ‘... ভাবানুষঙ্গ অভিধানের সাহায্যে স্পষ্ট হয় না। কারণ এদের অনিবর্চনীয়তার মূলে শুধু শব্দার্থ নেই, আছে শব্দের অন্তঃশীল আবেগ। সমাবেশ ও ধ্বনিবৈচিত্র্য এবং ছন্দের শোভনতা।
এই গুণসমষ্টির নাম রূপ; এবং রূপের প্রত্যেক অঙ্গ অপরিহার্য। রূপ আর প্রসঙ্গের পরিপূর্ণ সঙ্গমেই কাব্যের জন্ম। তাই কাব্যের ভাষান্তর অসাধ্য; তাই কাব্যের ভাষা আর কথ্যভাষা স্বভাবত স্বতন্ত্র; তাই আধুনিক কাব্যে রূপের এত প্রাধান্য।’ অন্য দিকে তিনি ‘প্রেরণা’র সনাতন ধারণাকে পুনর্মূল্যায়ন করে বলেন, ‘আধুনিক কবি প্রেরণা মানে বটে, কিন্তু প্রেরণা বলতে সে বোঝে পরিশ্রমের পুরস্কার।’ অর্থাৎ সে মননধারায় স্নাত হয়ে কবিতা সৃজন করবে। কবিতার প্রয়োজনেই সে বিশ্বভ্রমণে বের হবে; ‘বিশ্বের সেই আদিম উর্বরতা আজ আর নেই। এখন সারা ব্রহ্মাণ্ড খুঁজে বীজ সংগ্রহ না করলে, কাব্যের কল্পতরু জন্মায় না।’ এইভাবে ‘কাব্যের মুক্তি’ রবীন্দ্রোত্তর আধুনিক কবিদের ‘রবীন্দ্রেতর’ হওয়ার সাধনায় উৎসাহ ও সাহস জোগায়; অপর দিকে ‘পাশ্চাত্য সাহিত্যের ভাণ্ডার’ এবং ‘আধুনিক জীবনের সংশয়, ক্লান্তি ও বিতৃষ্ণা’ তাদের স্বতন্ত্র স্বরায়ণের ক্ষেত্রে ‘রসদ’ হিসেবে কাজ করে। ফলে তিরিশোত্তর কবিরা বাংলা কাব্যে নতুন পথ ও নতুন পৃথিবীর স্রষ্টারূপে আত্মপ্রকাশ করেন।
৪
প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে আধুনিক কবি ও কবিতা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ নানা সময় নানা মন্তব্য করেন- যেখানে তার কাব্যাদর্শের সাথে নতুনদের সাদৃশ্য অনুপস্থিত। তিনি তরুণদের কখনো স্বাগত জানিয়েছেন, কখনো সমালোচনা করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ‘সর্বমানবের’ ‘চির আধুনিক’ সাহিত্যে বিশ্বাসী। সে কারণে তিনি মনে করেন : ‘সাহিত্যের সম্পদ চিরযুগের ভান্ডারের সামগ্রী- কোনো বিশেষ যুগের ছাড়পত্র দেখিয়ে সে আপনার স্থান পায় না। তবে অনস্বীকার্য, এই নতুন যুগের নতুন মেজাজ ও চরিত্রের সাহিত্য তাকে চিন্তিত করে তোলে; আবার সাহিত্য সম্পর্কে তার পূর্বতন আদর্শের পুনর্মূল্যায়নে রচনা করেন ‘সাহিত্য’, ‘সাহিত্যের পথে’ ও ‘সাহিত্যের স্বরূপ’ গ্রন্থগুলো। কিন্তু তিনি এসব গ্রন্থে তার আজন্মলালিত সাহিত্যাদর্শকেই প্রতিষ্ঠা করেন।
রবীন্দ্রনাথ নিজের পরিচয় নিজেই দিয়েছেন ‘আমি জন্ম রোম্যান্টিক’ বলে। আবু সয়ীদ আইয়ুব তাকে ‘রোম্যান্টিকতার পরাকাষ্ঠা’ বলেছেন । সে জন্য রবীন্দ্র-কাব্যে সত্য, সুন্দর, স্বপ্ন, কল্পনা, অস্তিবাদ, প্রেরণা, অতিন্দ্রীয় বিশ্বাস, মঙ্গলবোধ ইত্যাদি রোম্যান্টিক গুণাগুণের রূপায়ণ হয়েছে বিস্তৃতভাবে। বিষ্ণু দের মতে, ‘রোম্যান্টিকের পরিবর্তন-অভীপ্সা, হৃদয়বৃত্তির সূক্ষ্ম সৌকুমার্য, পেলবতা তাঁরই দান। বড়ো কথা, সৌন্দর্যতত্ত্বের প্রথম পরীক্ষাতেই প্রয়োজন যে নিছক সৌন্দর্যের চেতনা, সেও আমরা রবীন্দ্রনাথেই দেখেছি। ভিক্টোরীয় চরিত্রের বলিষ্ঠ সততা, কর্মের দায়িত্ববোধও বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের রচনা।’ কিন্তু ‘মানসী’ প্রকাশের পর অর্ধশতাব্দী গত না-হতেই রবীন্দ্র-কাব্যবিচারে খুব বড়োরকমের পটপরিবর্তন দেখা যায়; কাব্যের মানদণ্ডই যায় পালটে। ইংরেজি সাহিত্যে প্রথম মহাযুদ্ধের পর রোম্যান্টিক মনন ও সংবেদনা, বিচার ও রচনাশৈলী খুব দ্রুত গতিতে অশ্রদ্ধেয় হয়ে পড়ে। বিশ শতকের তৃতীয় দশকের মধ্যভাগে যে-মেজাজ ও রুচি ইংরেজি সাহিত্যে প্রতিষ্ঠিত হয়, তার কাছে রবীন্দ্রনাথ অকস্মাৎ অত্যন্ত ছোটো হয়ে যান, অন্যান্য রোম্যান্টিক কবিরা যতটা হয়েছিলেন তার চেয়েও যেন কিছুটা বেশি। সে কারণেই নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেন ‘পরিশেষ’ (১৯৩২) এর ‘আগন্তুক’ কবিতায়:
কালের নৈবেদ্যে লাগে যে-সকল আধুনিক ফুল
আমার বাগানে ফোটে না সে।
কিন্তু ‘দানের একান্ত দুঃসাহসে’ তাকে ‘বড়ো কিছু দান’ যে দিতে হবে, সে সম্পর্কে তিনি সচেতন ছিলেন। ফলে তিনি রচনা করেন গদ্যছন্দ ও আটপৌরে জীবন আশ্রিত কাব্যগ্রন্থ ‘পুনশ্চ’ (১৯৩২)। যদিও গদ্যছন্দের সূচনা ‘লিপিকা’ (১৯২২) থেকেই। ‘অসংকুচিত গদ্যরীতিতে কাব্যের অধিকারকে অনেকদূর বাড়িয়ে দেয়া সম্ভব’- এ বিশ্বাস থেকেই তার গদ্যছন্দের অবলম্বন। ‘পরিশেষ’ ও ‘পুনশ্চ’- একই বছরে (১৯৩২) প্রকাশিত এ দু’টি কাব্যগ্রন্থ রবীন্দ্র-কাব্যের রূপান্তরে বিশেষভাবে স্মরণীয়। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ভাষায় : ‘এই গ্রন্থ-দুখানিতে রবীন্দ্রনাথ ভাষা, ধ্বনি ও প্রসঙ্গের দিক দিয়ে যেখানে পৌঁছেছেন, তার পরে আর এগোনো অসম্ভব।’ গদ্যছন্দের বৈচিত্র্য ও সাধারণ মানুষের জীবনচিত্র নিয়ে এই দু’টি কাব্যের ধারাবাহিকতায় রচনা করেন ‘শেষ সপ্তক’ (১৯৩৫), ‘পত্রপুট’ (১৯৩৬) ও ‘শ্যামলী’ (১৯৩৬)। অবশ্য এইসব কাব্যে রবীন্দ্রনাথের নানা রূপ দৃশ্যমান : ‘নানা রবীন্দ্রনাথের একখানা মালা।’ প্রকৃতপক্ষে, সদাচলিষ্ণু, বৈচিত্র্য সন্ধানী ও বিপুল সৃজনীশক্তির অধিকারী রবীন্দ্রনাথ নিজেকে বারবার ভেঙেছেন, আবার নতুনভাবে গড়েছেন, নতুন কালের সঙ্গে পা মিলিয়ে চলার চেষ্টাও করেছেন।
তিরিশের দশকে প্রকাশিত তার গদ্যকাব্যগ্রন্থগুলোতে তিনি নবযুগের ধর্ম ও ছন্দের মুক্তির মাধ্যমে তরুণ কবিদের কাছে নিজেকে গ্রহণযোগ্য করে তোলার চেষ্টা করেন। কিন্তু তারপরে ১৯৩৭-১৯৪১ পর্যন্ত লেখা তার শেষ পর্যায়ের কবিতায় তিনি প্রত্যাবর্তন করেন আপন জগতে, যা আজীবনের সাধনায় নির্মিত। আসলে রবীন্দ্রকাব্যে বারবার প্রসঙ্গ ও প্রকরণের নব্যতা ঘটলেও ‘আজন্মলালিত বিশ্বাসের ধ্র“ববীজটি, কোনো না কোনোভাবে বর্তমান থেকেছে। তবে তিনি বুঝেছিলেন জন্মদিনের ধারাকে বহন করে ‘মৃত্যু দিনের দিকে’ চলেছেন, কালের নিয়মেই পুরনো কবি চলে যাবেন, নতুন কবির আগমন ঘটবে, তার জন্য ‘পথ ছেড়ে দিতে’ হবে :
সব লেখা লুপ্ত হয়, বারম্বার লিখিবার তরে
নতুন কালের বর্ণে, জীর্ণ তোর অক্ষরে অক্ষরে
কেন পট রেখেছিস পূর্ণ করি। হয়েছে সময়
নবীনের তুলিকারে পথ ছেড়ে দিতে। হোক লয়
সমাপ্তির রেখা-দুর্গ। নবলেখা আসি দর্পভরে...
ইতিহাসের এ ধর্ম রবীন্দ্রনাথের গভীরভাবে জানা ছিল বলেই বাংলা কাব্যের পরিবর্তন সত্ত্বেও তিনি নিজ আদর্শচ্যুত হননি। বরং ‘আধুনিক কাব্যে’ সেই আদর্শ প্রতিষ্ঠায় ব্রতী হন। তবে অনস্বীকার্য যে, সামাজিক-রাজনৈতিক-দৈশক-বৈশ্বিক ও সাহিত্যিক উপপ্লবে রবীন্দ্রনাথের অটুটপ্রায় অস্তিত্ববাদ, শান্তিস্বর্গ, স্থৈর্য ও আত্মপ্রত্যয় ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হয় শেষ দিকে।
৫
বাংলা কবিতায় আধুনিকতার নামে পশ্চিমাকরণ হতে থাকে ভাব ও আঙ্গিক। তিরিশোত্তর বাংলা সাহিত্যের কেন্দ্রীয় প্রবহণগুলো- অনিশ্চয়তা, মানববিচিত্রতা, সংহতি, গদ্য-পদ্যের সমীকরণ প্রয়াস, সমকালীন বিশ্বসাহিত্য সম্পর্কে আগ্রহ, বিশ্বের সঙ্গে একাত্মবোধ তথা বিশ্ব পটভূমিকায় মাতৃসাহিত্যের স্থাপনা, বাস্তবতা, শারীরিকতা, মনস্তত্ত্ব, নিখিলনাস্তি, অমঙ্গলবোধ, নিম্নবিত্তের সম্পর্কে আগ্রহ, আঞ্চলিকতার প্রতি আগ্রহ, সামাজিক সাম্য, অনীশ্বরবোধ- এসব কেবলি তার সাহিত্যিক প্রত্যয়ে অস্বস্তির সৃষ্টি করে। অন্য দিকে রবীন্দ্রোত্তর কবিতায় উল্লিখিত প্রবণতাগুলো অঙ্কিত হতে থাকে নতুন কবিদের হাতে। তবে ‘কল্লোল’ ও ‘পরিচয়’- যুগের এ নতুন কবিরা শিক্ষা পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের পাঠশালাতেই, তাদের চোখ, কান, কণ্ঠ ও মন তৈরি হয়েছিল তারই ঝরণাতলায়। স্নাতকোত্তর কালে তারা অবশ্য অনুভব করলেন রবিতন্ত্র থেকে মুক্তিলাভের প্রবল তাগিদ, একাধারে স্বতন্ত্রের প্রেরণা এবং ‘আধুনিক’ অর্থাৎ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী পাশ্চাত্য সাহিত্যের আকর্ষণ। অর্থাৎ রবীন্দ্রোত্তর আধুনিক কবিদের ‘রবীন্দ্রেতর’ হওয়ার সাধনা এবং স্বতন্ত্ররূপে আত্মপ্রকাশের প্রেরণা বাংলা কাব্যে সৃষ্টি করে কথিত আধুনিকতার নতুন এক ধারা।