এবার ঝেড়ে কাশুন, প্রাণ খুলে হাসুন

ড. নূর জাহান সরকার | Nov 07, 2021 05:37 pm
এবার ঝেড়ে কাশুন, প্রাণ খুলে হাসুন

এবার ঝেড়ে কাশুন, প্রাণ খুলে হাসুন - ছবি সংগৃহীত

 

চরম ভাবাপন্ন আবহাওয়াই এখন ‘নতুন স্বাভাবিকতা’ যেমন করোনা নিয়ে নতুন স্বাভাবিকতা! বিশ্বে তাপদাহ, দাবানল, বন্যা, খড়া, ঝড়-ঝঞ্ঝা, জলোচ্ছ্বাস কিনা। বিশ্ব উষ্ণতায় আহত মেরুঅঞ্চলের বরফ গলে গেলে পৃথিবীর অবয়ব গিলে খাচ্ছে সমুদ্রের জলরাশি!

২০২১ সাল যেন এমন যে, এসব চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো হচ্ছে। দুর্ভাগ্য যে, সৃষ্টির সেরা মানুষ নামক দানবের দানবতা ও অজ্ঞতা-মূর্খতাই শুধু নয়, লোভ-লালসা, নির্লজ্জতাই এর জন্য দায়ী। কপ-২৬ গ্লাসগোতে অনুষ্ঠিত তথ্য-প্রমাণ প্রদর্শন গবেষণাভিত্তিক। তবে ইতোমধ্যেই বিশ্বের মোড়লরা প্রকারান্তরে এ ক্ষেত্রে শতভাগ স্বীকারোক্তি রাখবে না বা নতুন কোনো কার্যকর ভূমিকা কাঁধে নেবে না, বরং কেটে পড়ার উদ্যোগের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।

মেরু বরফ গলে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়ে পৃথিবীর অবয়ব গিলে ফেলল, লবণাক্ততায় সিক্ত করে ফসলাদির ক্ষতি করে দুর্ভিক্ষের প্রবণতাও বাড়িয়ে দিলো। জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, পৃথিবীর জন্য সম্মেলনটি অবশ্যই একটি ‘টার্নিং পয়েন্ট’ হবে। কতটা টার্নিং পয়েন্ট হবে তা ক্ষুদ্রতম পরিবেশ দরদি গ্রেটা থুনবার্গ নামের ছোট্ট মেয়েটি থেকে শুরু করে ব্রিটেনের রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ পর্যন্ত সবাই জানে। ফ্রাইডে ফিউচারের নেতৃত্বদাতা সে ছোট্ট মেয়েটির কথা- ‘গ্লাসগো সম্মেলন নিয়ে সে আশাবাদী নয়। তেমনি ব্রিটেনের রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ হতাশা ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, নেতারা শুধু বড় বড় কথা বলে যাচ্ছেন, কার্যকর কিছু করছেন না।’ গাঁওগ্রামে কথা আছেÑ বুড়োর কথা, আর গুরুর কথা এক হলে ভাবতে বসতে হবে।

জাতিসঙ্ঘ একটি ঃড়ড়ঃযষবংং ঃরমবৎ যা আমরা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলাম মুক্তিযুদ্ধকালে। প্রতিদিন ঘুম ভাঙত নতুন আশায় আজ হয়তো আমাদের জন্য কোনো পদক্ষেপের সংবাদ আসবে জাতিসঙ্ঘ থেকে, কিন্তু এভাবে মাসের পর মাস। বরং দেখা গেল, আমেরিকার যুদ্ধজাহাজ হাজির পাকিস্তানের পক্ষে আমাদের নিশ্চিহ্ন করতে! হায়রে জাতিসঙ্ঘ! ভারত নিজেদের স্বার্থ ছাড়া আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করেছে যে, তা নয়, সেটি তাদের ব্যাপার। আমরা সহযোগিতা পেয়েছি পাকিস্তানের হাত থেকে মুক্ত হতে; এটিই বড় কথা। আমরা ভারতের কাছে চিরকৃতজ্ঞ। ওহ! এখানে উল্লেøখ করতেই হবেÑ জাতিসঙ্ঘ যে একটি দন্তবিহীন বাঘ তা আমার মন্তব্য নয়, আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষাগুরু মরহুম প্রফেসর কাজী জাকের হোসেন স্যারের কথা। বিশে^র মোড়লদের অনেকেই এবার সম্মেলনে যোগ দিচ্ছেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোÑ চীন, ব্রাজিল, রাশিয়া প্রভৃতি যারা দূষণকারী দেশ হিসেবে যথাক্রমে- ফার্স্ট, সেকেন্ড, থার্ড প্রভৃতি। এসব দেশ যদি নিজেদের মধ্যে মানবতা পোষণ করত তাহলে রোহিঙ্গা সমস্যা নামক সিন্দাবাদের ভূত আমাদের কাঁধে কালাকালের জন্য চেপে বসে থাকত না, একটা না একটি সুরাহা হতো। ভাবা যায়, জন্মস্থানবিচ্যুত হলো লাখ লাখ মানুষ, পাশের দেশটি জনসংখ্যার ভারে ন্যুব্জ; তা সত্ত্বে¡ও মানবিক কারণে আমরা তাদের সহায়তা করলাম; যেমন সহায়তা করেছিল ভারত আমাদের। তাও বলি কি, সেই ভারত বলছে- কয়লাভিক্তিক তথা জীবাশ্ম জ্বালানি এখনই প্রশমিত করতে পারবে না অন্য ২০ দেশের মতোই। এখানে মানবতা কোথায়? চীন ভারতের লগ্নি রয়েছে মিয়ানমারে । আমরা রোহিঙ্গার কারণে অসংখ্য বন্যপ্রাণী হারিয়েছি, মারা পড়ল গণ্ডায় গণ্ডায় হাতি, বন হারালাম, আরো অনেক ক্ষতির খাতায় নাম লেখালাম। জানা যায়, কপ-২৬ সম্মেলনে ২০০টি দেশের সিদ্ধান্ত হচ্ছে ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ কমানোর। ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তি কতটা সাফল্যের মুখ দেখেছে? ওই সম্মেলনে প্রতিশ্রুতি দেয়া মোড়ল দেশগুলো কি যথাযথ কাজ করেছে? ওই সব দেশের কিছু লুটেরা যারা আমাদের সব দেশ নিঙড়ে সম্পদ লুট করে নিজেদের হৃষ্টপুষ্ট করেছে, এসব অনুন্নত দেশ যাদের ভদ্র ভাষায় পোশাকী নাম উন্নয়নশীল দেশ, তাদের জন্য বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলার সহায়তা দেবে জলবায়ুর পরিবর্তন ঠেকাতে, তারা কি প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছে?

আমি প্রায় প্রতি বছরই বাড়ি যাই। করোনার বছর দুয়েক আগে বাড়ি গিয়েছিলাম। আমার বাড়ি সুগন্ধা নদীর পাড়ে। যেমন সুন্দর নাম তার, তেমন সুন্দর পানি, প্রায় আগের মতোই স্বচ্ছ, স্রোতের কিছুটা ঘাটতি। পানির স্বচ্ছতার কারণ হলো তেমন কোনো শিল্পকারখানা এখনো গড়ে ওঠেনি। মনটা অনেকটা জুড়িয়ে গেল। প্রাণের সুগন্ধা যার বুকে ছোট ভেলায় সাঁতার কেটেছি তার এক আঁজলা পানি তুলে মুখে পুরে দিলাম। আহারে আমার সুগন্ধা! তোমাকে মারণাস্ত্র আঘাত করল, নোনা হয়ে গেল তোমার পানি। আমার চোখেন নোনা জল আর সুগন্ধার নোনা জল সেদিন এক হয়ে গেল। অথচ ছোট বেলায় মাকে দেখেছি তার সাহায্যকারী মালার মা, মজির মা, এদের দিয়ে কলসি ভরে ভরে পানি আনিয়ে মটকি ভরে ফিটকিরি দিয়ে রাখতেন। স্বচ্ছ সে পানি কি ঠাণ্ডা! প্রাণভরে খেতাম। কোনোদিন কোনো পেটের পীড়া তো হয়নি। এখন কার ডিপটিউবয়েলের পানির মতো।

দেশে দেশে নেতারা যেমন তাদের দেশবাসীকে আশায় আশায় ভাসান, ঠিক তেমনি বিশ^নেতারা যারা কেটে পড়েছেন, গ্লাসগো সম্মেলনে আসবেন না, তারা তো বটেইÑ অন্যরাও ওই বড় বড় আশ^াসের ভাঁওতাবাজিতে বোকা দেশগুলোর মধ্যে উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে দেবে আর আমরা উচ্ছ্বাসের হাওয়ায় ভেসে বেড়াব।

এ বিষয়ে আমার একটি রম্যকথা মনে পড়ে গেল। এক লোক রাস্তার পাশে শুয়ে, মরা কি জ্যান্ত বোঝা যায় না। এক পথিক পা দিয়ে নাড়া দিয়ে বলল ‘কি তুই জ্যাতা, না মরা রে?’ ও তখনএকটু আস্তে চোখ খুলে বলল ‘গরিবের মরণ! কোনোরকম চক্ষু বুইজ্যা রইছি।’ এই হলো আমাদের মতো তথাকথিত উন্নয়নশীল দেশের অবস্থা।

ঝেড়ে কাশার গল্পটি হলো- এক বিকেলে দুই বন্ধু একজন বাঙালি ও একজন ইংরেজ, নদীর পাড়ে হেঁটে বেড়াচ্ছিল। নানা রকম গল্প। এক সময় ইংরেজ বন্ধু বলে উঠল, ‘আমার বাংলায় পিএইচডি ডিগ্রি হয়ে গেল জানো তো। এবার আর বাংলায় আমার কোনো সমস্যা নেই’, বলে নিজেই হেসে ফেলল! বাঙালি বন্ধু বলল, ‘বটে, তবে ওই মাঝিকে পাড়ে আসতে বল তো’, ইংরেজ বন্ধু বলতে থাকল, ‘ওহে কর্ণধার, তরী তটে সংলগ্ন করো, ওহে কর্ণধার, তরী তটে সংলগ্ন করো।’ মাঝি তাকিয়ে আছে, কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। তখন বাঙালি বন্ধু বলল, কী বাংলা শিখলে? ইংরেজ বন্ধু বলল, ‘ও কানে শোনে না’। বাঙালি বন্ধু তখন মাঝিকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘ওই ব্যাটা নৌকা ভিড়া’। ওমনি মাঝি পাড়ে চলে এলো, নৌকা ভিড়াল। এবার বিশে^র নিপীড়িত মানুষকে যথাযথ ভাষায় কথা বলতে হবে, ঝেড়ে কাশতে হবে। তবেই একসময় প্রাণ খুলে হাসতে পারবে। সুতরাং ঝেড়ে কাশুন, প্রাণ খুলে হাসুন। সম্মেলন শুরু হয়েছে আজ চার দিন হলো। জানা গেছে, ১২০ হাজার কোটি ডলারের একটি তহবিল গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে, তা বাস্তবায়ন হবে হয়তো। তবে রাজার পুকুরে এক ঘটি করে দুধ না ঢেলে পানি ঢালা হবে না তো?


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us