‘যবন’ পরিচয়ের সেকাল-একাল
‘যবন’ পরিচয়ের সেকাল-একাল - ছবি : নয়া দিগন্ত
ভারতীয় উপমহাদেশে বিশেষত আজকের ভারতে ‘যবন’ শব্দটি একটি বিশেষ মানবগোষ্ঠীর জাতিগত পরিচয়ের রূপ নিয়ে বিরাজ করছে। পরিষ্কার করে বললে, মুসলমানদেরকে এই অভিধায় চিহ্নিত করা হয়। মূলত ‘বহিরাগত’ অর্থে ভারতের হিন্দুদের কট্টরবাদী অংশটি মুসলিমদের ‘যবন’ হিসেবে উল্লেখ করে থাকে। যদিও আদিতে তা ছিল অন্য কিছু। আর বর্তমানে তা কিভাবে মুসলমানদের উপর আপতিত হলো এই নিবন্ধে সেটিই তুলে ধরার চেষ্টা করা হলো।
বাংলা একাডেমির অভিধানে ‘যবন’ শব্দটি সংস্কৃত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আর অর্থ লেখা হয়েছে ১. প্রাচীন গ্রিক জাতি, ২. অহিন্দু বা ম্লেচ্ছ জাতি। (স্ত্রী-যবনী)।১
সংসদ বাংলা অভিধান বলছে : ১. প্রাচীন গ্রিক জাতি, ২. যেকোনো অহিন্দু বা ম্লেচ্ছ জাতি, ৩. বিধর্মী। (যবনানী-যবন জাতির লিপি সমূহ; যাবনিক-যবন সংক্রান্ত, যবনসুলভ) ইত্যাদি।২
ড. মোহাম্মদ আমীন উল্লেখ করেন, প্রাচীন ভারতে আলেকজান্ডার পরিচিত ছিলেন যবনরাজ হিসেবে। বেদ বিশ্বাসী ভারতীয়দের কাছে বেদ-অবিশ্বাসী বিদেশীমাত্রই ছিল যবন। শব্দটি খাঁটি সংস্কৃত বলে মনে হয় না। এর ব্যুৎপত্তি (যু+ অন(যুচ)-ক); অর্থ বৈদেশিক, বর্বর, ইউরোপীয়, ইংরেজি, মুসলমান, গ্রিক বা আইওয়ানবাসী ও বেগবান অশ্ব প্রভৃতি। প্রাচীন ভারতীয়দের কাছে ম্লেছ ও যবন সমার্থক।
ড. আমীন উল্লেখ করেন, কালিদাস যবন বলতে গ্রিকদের বুঝিয়েছেন। আইওনিয়া (Ionia) বা প্রাচীন গ্রিস যবন শব্দের মূল উৎস। আইওনিয়া ফারসিতে ইউনান বা য়ুনান। এ ইউনান বা য়ুনান থেকে সংস্কৃত যবন শব্দের উৎপত্তি। প্রথমে যবন শব্দের অর্থ ছিল গ্রিকবাসী। কারণ তারা বেদ মানত না। গ্রিকদের মত ভারতের পশ্চিমের দেশগুলোর মানুষও বেদাচারী ছিল না। তাই প্রাচীন ভারতীয়দের কাছে তারাও ছিল গ্রিকদের মতোই যবন। এ জন্য আইওনিয়া, গ্রিস ও পরবর্তীকালে আগত আরবীয়, ইউরোপীয়, ইংরেজ সবাই যবন। শব্দটির আর এক অর্থ বেগবান অশ্ব। প্রাচীন গ্রিকরা বেগবান অশ্বে চড়ে এসেছিল বলে হয়ত ভারতীয় বৈয়াকরণরা শব্দটির এ রকম অর্থ নির্ধারণ করেছিলেন।
ড. আমীন আরো উল্লেখ করেন, “উপরের আলোচনায় যবন শব্দের চারটি বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। প্রথমত, তারা বিদেশাগত ও বিভাষী, দ্বিতীয়ত, তারা বেদ মানে না বা বেদ বিশ্বাস করে না, তৃতীয়ত, তারা গোমাংস ভক্ষক ও সদাচারহীন এবং চতুর্থত, তারা বেগবান অশ্বারোহী। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যবন শব্দটির চূড়ান্ত অপব্যবহার ঘটান। তিনি তার সাহিত্যকর্মে যবন শব্দকে মুসলমানের ব্যাঙ্গাত্মক প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহার করেন। অর্থাৎ তিনি যবনের চারটি বৈশিষ্ট্যই মুসলমানের মধ্যে খুঁজে পেয়েছিলেন। সাহিত্যকর্মে ঋষি বঙ্কিমের এমন অঋষিসুলভ আচরণ বাঙালি এখনও ভুলতে পারেনি।”৩
দুর্গাদাস লাহিড়ী তাঁর ‘পৃথিবীর ইতিহাস’ গ্রন্থে এবিষয়ে আরো বিস্তারিত উল্লেখ করেন। ‘যবনগণ’ শিরোনামে তাঁর উল্লেখ নিম্নরূপ :
“ভারতে বৈদেশিক সংশ্রবের সূত্রপাত- গ্রীকবীর আলেকজান্ডারের সময় হইতেই আরম্ভ হয়। তাহার আগমনের পূর্বেও বৈদেশিকগণ ভারতে আগমন করিয়াছিলেন বটে; কিন্তু তাহারা কেহই ভারতের অঙ্গে অঙ্গ মিশাইতে প্রয়াস পান নাই। পুরাণাদিতে তৎসম্বন্ধে যে প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহা প্রায়ই বিচার-সাপেক্ষ। সমসাময়িক উপাদান-খোদিত লিপি, স্তূপ ও মুদ্রাসমূহ-যে সাক্ষ্য বক্ষে ধারণ করিয়া আছে, পণ্ডিতগণ তাহাই প্রামাণ্য বলিয়া স্বীকার করিয়া থাকেন। ঐতিহাসিক উপাদান হিসাবেও তাহার যথার্থ্য বিষয়ে কেহ সন্দিহান নহেন। সুতরাং সেই সব প্রামাণ্য উপাদান হইতে যে তথ্য নিষ্কাশিত হয়, তাহার সত্যতা অবিসংবাদিত বলিয়া নিঃসন্দেহে গ্রহণ করা যাইতে পারে। রাজচক্রবর্তী অশোকের সময় হইতেই ভারতে লিপি ক্ষোদিত হইবার পরিচয় প্রাপ্ত হই। অশোকের ক্ষোদিত ত্রয়োদশ অনুশাসনলিপিতে পাঁচজন বৈদেশিক নৃপতির নাম উল্লিখিত আছে।
লিপিতে এন্টিওকাস যোনরাজ অর্থাৎ যবন-রাজ বলিয়া উক্ত হইয়াছেন। সুতরাং প্রতিপন্ন হইতেছে, প্রাচীনকালে ‘যবন’ বলিতে গ্রিকগণকেই বুঝাইত। আবার অনেকে বলেন, ‘আইওনিয়ান’ শব্দ হইতে ‘যবন’ শব্দের উৎপত্তি। কিন্তু ‘আইওনিয়ান’ শব্দ ‘যবন’ রূপে উচ্চারিত হওয়াও অসম্ভব নহে। যাহা হউক, গ্রিকবীর আলেকজান্ডারের সমভিব্যাহারে গ্রিকগণ, ভারতবর্ষে আগমন করেন সত্য; কিন্তু তখন তাহারা ভারতে অধিক দিন তিষ্ঠিতে পারেন নাই। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর, রাজচক্রবর্ত্তী চন্দ্রগুপ্ত গ্রিকদিগকে ভারত হইতে বহিষ্কৃত করিয়া দেন। গ্রিকগণ ভারতবর্ষ হইতে বিতাড়িত হইলেন বটে; কিন্তু পারস্যের পূর্ব-প্রদেশে হিন্দুকুশ-পর্ব্বতের সন্নিকটে ‘বাকত্রিয়ানা’ প্রদেশে তাহাদের প্রভাবপ্রতিপত্তি অক্ষুণœ রহিল। মৌর্য্যবংশের অবসানে শুঙ্গ-বংশের অভ্যুদয়ে তাহারা এই স্থান হইতেই ভারতে আধিপত্য-বিস্তারে সমর্থ হইয়াছিলেন। তখন কেবল পাঞ্জাবে নহে; পাঞ্জাবের দক্ষিণপূর্বে যমুনা নদীর তীর পর্যন্ত এবং কাথিয়াবাড়-প্রদেশে তাহাদের প্রভাব বিস্তৃত হইয়াছিল। ....পণ্ডিতগণ অযোধ্যোকে ‘সাকেত’ বলিয়া নির্দেশ করেন। তাহাদের মতে, উদয়পুররাজ্যে, চিতোরের উত্তর দিকে, নগরী মাধ্যমিকার অবস্থিতি নির্দিষ্ট হয়। এসব ক্ষেত্রে গ্রিকগণই ‘যবন’ বলিয়া পরিচিত ছিলেন।”
যবনগণ কি হিন্দু হইয়াছিলেন?
দুর্গাদাস লাহিড়ী উল্লেখ করেন, “লিপিসমূহের নাম এবং সেই নাম যাহাদের, তাঁহাদের অনেকের কার্যকলাপ দেখিয়া, মনে স্বতঃই প্রশ্ন উঠে,Ñ যবনগণ কি হিন্দু হইয়াছিলেন? লিপি-সমূহে উৎকীর্ণ যবন-নামের মধ্যে ইরিলা বৈদেশিক নাম বলিয়া প্রতিপন্ন হয়। তাস্তুন্ন, অন্যান্য নামের সহিত হিন্দু-নামের সৌসাদৃশ্য আছে। পণ্ডিতগণেব মতে- কার্লির লিপিমধ্যস্থ ধেনুকাকাতাব যবন-হিন্দু, বলিয়া প্রতিপাদিত। কারণ, তাঁহারা ‘সিংহধয্য’ নামের সহিত ‘সিংহধৈর্য্য’ নামে, ধম্ম নামের সহিত ধর্ম নামের অভিন্নতা লক্ষ্য করিয়া থাকেন।
যবনের হিন্দুধর্ম্ম-গ্রহণ :
পশ্চিম-ভারতের গুহালিপি-সমূহে উৎকীর্ণ যবনগণের নামের সহিত হিন্দুনামের যে সাদৃশ্য আছে, তদৃষ্টে আমরা কি সিদ্ধান্তে উপনীত হইতে পারি? বৌদ্ধগণের চৈত্য-বিহারে ও সারামে যবনগণের যে বদান্যতার পরিচয় প্রাপ্ত হই, তাহাতে তাহারা যে বৌদ্ধধর্মের পরিপাষেক ও বৌদ্ধধর্মাবলম্বী ছিলেন, তাহা নিঃসন্দেহে সপ্রমাণ হয়। যবনগণ কেবল বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করিয়াই ক্ষান্ত হন নাই। পরন্তু তাহারা হিন্দুর নাম-পর্যন্ত গ্রহণ করিতেও কুণ্ঠাবোধে করেন নাই। ফলতঃ, নামে ও কর্মে তাহারা হিন্দুর সহিত এমনিভাবে অঙ্গে অঙ্গ মিশাইয়াছিলেন যে, লিপিসমূহে ‘যবন’ শব্দের উল্লেখ মাত্র না থাকিলে, তাহাদের প্রকৃত পরিচয়-নির্দেশ অসম্ভব হইয়া পড়িত। যবনগণ বৌদ্ধধর্ম্মই গ্রহণ করিয়াছিলেন, হিন্দুধর্ম্মের সহিত তাঁহাদের কোনোই সংশ্রব ছিল না,-প্রত্নতত্ত্ববিদগণ প্রথমত, এই ধারণারই বশবর্তী হন। কিন্তু মালব-প্রদেশের গোয়ালিয়র রাজ্যের অন্তর্গত বেজনগরে আবিষ্কৃত স্তম্ভলিপি-দৃষ্টে তাহাদের সে ভ্রমধারণা তিরোহিত হইয়াছে। ঐ লিপিতে গরুড়ধ্বজের বিষয় উল্লিখিত আছে। দেবাদিদেব বাসুদেবের প্রতি সম্মান-প্রদর্শন জন্য ‘দিয়ার’ পুত্র ‘হেলিওডোরা’ ঐ গরুড়ধ্বজ নির্মাণ করেন। রাজা আন্টালিকি (এন্টিয়ালকিডাস), রাজা ভাগভদ্রকে ঐ গরুড় উপহার দেন।
বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী শকগণ :
গ্রিকদিগের সঙ্গে সঙ্গে শকজাতির প্রসঙ্গ উল্লিখিত হয়। যবন বা গ্রিক যেমন বৈদেশিক জাতি; শকগণও তেমনি বিদেশাগত। তার পর গ্রিকগণ বা যবনগণ যেমন ভারতে আসিয়া ভারতের অঙ্গে অঙ্গ মিশাইয়া ফেলিয়াছিলেন; শকগণও সেইরূপ ভারতে আসিয়া আপনাদিগের অস্তিত্ব ভারতেরই অন্তর্নিবিষ্ট করিয়া লইয়াছিলেন। যে সময়ের ইতিবৃত্ত আলোচনা করিতেছি, সে সময়ে শকজাতি পাঞ্জাবে এবং আফগানিস্তানের পূর্ব-প্রদেশে আধিপত্য স্থাপন করিয়াছিলেন। তখন তাঁহাদের শৌর্যবীর্য্যে ও তাহাদের গৌরব-গরিমায় ভারতের উত্তর মধ্য ও পশ্চিমাঞ্চল সমাচ্ছন্ন হইয়াছিল।”৪
অপব্যবহারের সূচনা
যবনবিষয়ক উপরোক্ত পরিচয়পর্বের পর এখন দেখা যেতে পারে বর্তমান সময়ে এই শব্দটির ব্যবহার বা অপব্যবহার কিভাবে শুরু হলো। ইতিহাস রচনার আগে সম্ভবত সাহিত্যের মাধ্যমেই এই শব্দের অপব্যবহার শুরু হয়। এ ক্ষেত্রে পথপ্রদর্শকের ভূমিকায় থাকেন বাংলা সাহিত্যে গদ্যসম্রাট অভিধায় বিবেচিত বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮-১৮৯৪)। তাঁর পথ ধরে এই কাজ করেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, ঔপন্যাসিক শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ।
ভারতবর্ষে যেসব বহিরাগতের আগমন ঘটে তাদের মধ্যে ছিল সুদূর ইউরোপের গ্রিক, ওলন্দাজ, পর্তুগিজ, আর্মেনিয়ান, বেলজিয়ান, ফরাসি, ইংরেজ এবং ভারত সীমান্তসংলগ্ন মুসলমানরা। তারও আগে ভারতের আদি নিবাসী বলে দাবিদার আর্যরা আসে মূলত উত্তর ইউরোপীয় উপত্যকা অঞ্চল থেকে। আর এরাই হিন্দু জাতিগোষ্ঠী ছাড়া অন্যদেরকে বিশেষত মুসলমানদেরকে ‘বহিরাগত’ অর্থে যবন বলে থাকে। যবন শব্দ ব্যবহারকারী লেখকগণ বহিরাগত ইউরোপিয়ান তথা ইংরেজদেরকে কোথাও যবন বলে উল্লেখ করেছেনÑ এমন দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় না।
বঙ্কিমচন্দ্রের অধিকাংশ ইতিহাসনির্ভর উপন্যাসই রচিত হয় হিন্দু-মুসলিমের দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে। আর এই ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনার জন্যও প্রখ্যাত হয়ে আছেন তিনি। এর মধ্যে কয়েকটি উপন্যাস বহুল আলোচিত। এসব উপন্যাসে তিনি বিভিন্ন রাজকীয় ও সামাজিক ঘটনাবলীর চিত্র অঙ্কন করতে প্রয়াস পেয়েছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, দুর্গেশনন্দিনী (১৮৬৫), কপালকুণ্ডলা (১৮৬৬), মৃণালিনী (১৮৬৯), চন্দ্রশেখর (১৮৭৪), রাজসিংহ (১৮৮২), আনন্দমঠ (১৮৮২), সীতারাম (১৮৮৭) প্রভৃতি।
এসব কাহিনীর মধ্যে তিনি মুসলমান চরিত্রগুলোকে মূলত ‘যবন’ হিসেবেই উল্লেখ করেছেন। এই যবন শব্দকে বঙ্কিম বহুবিধ যুগল শব্দরূপে ব্যবহার করেন অত্যন্ত সার্থকভাবে। যেমন : যবনসেনা, যবনসেনাপতি, যবনসম্রাট, যবনসাম্রাজ্য, যবনদূত, যবনবিপ্লব, যবনধর্ম, যপননিপাত, যবনসমীপে, যবনশ্রেণী, যবনকন্যা, যবনবেশ, যবনহস্ত, যবন-ইতিহাসবেত্তা, যবন-সমাধিখাত, যবনাগমনকালে প্রভৃতি। উদাহরণস্বরূপ কয়েকটি নমুনা নিচে উদ্ধৃত করা হলো।
দুর্গেশনন্দিনী উপন্যাসে তাঁর উদ্ধৃতি : “ঐ দেখ, সুরাস্বাদপ্রমত্ত যবনকে ক্ষিপ্ত করিলে। এই কৌশলেই বুঝি সকলকে বর্জিত করিয়া কতলু খাঁর প্রেয়সী হইয়া বসিয়াছ?” ... “এবার ওসমান জগৎসিংহকে পদাঘাত করলেন। রাজকুমারের আর ধৈর্য্য রহিল না। শীঘ্র হস্তে ত্যক্ত প্রহরণ ভূমি হইতে উত্তোলন করিয়া শৃগাল দংশিত সিংহবৎ প্রচণ্ড লাফ দিয়া রাজপুত্র যবনকে আক্রমণ করিলেন। সে দুর্দম প্রহার যবন সহ্য করিতে পারিলেন না। রাজপুত্রের বিশাল শরীরাঘাতে ওসমান ভূমিশায়ী হইলেন। রাজপুত্র তাহার বক্ষোপরি আরোহণ করিয়া কহিলেন, “কেমন সমর সাধ মিটয়াছে ত?” তারপর রাজপুত্র ওসমানকে সম্পূর্ণ নিরস্ত্র করে বললেন, তুমি যবন হইয়া রাজপুতের শরীরে পদাঘাত করিয়াছিলে, এই জন্য তোমার এই দশা করিলাম নচেৎ রাজপুতেরা এত কৃতঘ্ন নহে যে, উপকারীর অঙ্গ স্পর্শ করে।” দুর্গেশনন্দিনীতে জগৎ সিংহ ও কল্পিত আয়শাকে পরস্পর প্রণয়াবদ্ধরূপে দেখানো হয়েছে। আর আয়শাকে ‘যবনী’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
বঙ্কিমচন্দ্রের আরেকটি আলোচিত ঐতিহাসিক ঘটনাকেন্দ্রিক উপন্যাস ‘মৃণালিনী’ (১৮৬৯)। এই উপন্যাসে বখতিয়ার খলজির বঙ্গ বিজয়ের পটভূমিতে হেমচন্দ্র-মৃণালিনীর প্রণয় কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। তবে সমগ্র উপন্যাসেই মুসলিম প্রসঙ্গ লক্ষ করা যায়। এর একটি সংলাপ এরূপ: “মাধবাচার্য বললেন, ‘...তুমি দেব কার্য্য না সাধিলে কে সাধিবে? তুমি যবনকে না তাড়াইলে কে তাড়াইবে? যবন নিপাত তোমার একমাত্র ধ্যান হওয়া উচিত। এখন মৃণালিনী তোমার মন অধিকার করিবে কেন?’ তিনি আরো স্মরণ করিয়ে দিলেন, ‘এর আগে যবনাগমনকালে হেমচন্দ্র মৃণালিনীর মোহে মথুরায় ছিল বলেই মগধ শত্রু দখল করতে সক্ষম হয়েছে।’
মৃণালিনীতে বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষ্য : “মাধবাচার্য বললেন, এই ধনের বলে পশুপতির বিনাশকারী বখতিয়ার খিলজিকে প্রতিফল দেওয়া কর্তব্য, দক্ষিণে সমদ্রের উপকূলে অনেক প্রদেশ জনহীন হইয়া পড়িয়াছে...তথায় নূতন রাজ্য সংস্থাপন কর এবং তথায় যবন দমনোপযোগী সেনা সৃজন কর।... রাজ্য সংস্থাপন অতি সহজ হইয়া উঠিল, কেননা যবনদিগের ধর্মদ্বেষিতায় পীড়িত এবং তাহাদের ভয়ে ভীত হইয়া অনেকেই তাঁহাদিগের অধিকৃত রাজ্য ত্যাগ করিয়া হেমচন্দ্রের নবস্থাপিত রাজ্যে বাস করিতে লাগিল। হেমচন্দ্র দক্ষিণ হইতে মুসলমানদের প্রতিকূলতা করিতে লাগিলেন। বখতিয়ার খিলজি পরাভূত হইয়া কামরূপ হইতে দূরীকৃত হইলেন। প্রত্যাগমনকালে অপমানে ও কষ্টে তাহার প্রাণ বিয়োগ হইল।”
এভাবে মৃণালিনী উপন্যাসের প্রায় পুরোটা জুড়ে বঙ্কিম মুসলিম পক্ষকে ‘যবন’ বলে চিহ্নিত করেছেন এবং শব্দযুগল ব্যবহার করে উপন্যাসকে পরিণতি দিয়েছেন।
বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর ‘চন্দ্রশেখর’ উপন্যাসেও যবন শব্দ একই অর্থে ব্যবহার করেন। একটি বাক্য : “যেমন যবনকন্যারা অল্প দ্বার খুলিয়া, আপনাদিগের শয়নগৃহ হইতে দেখিতেছিল, শৈবালিনীও সেইরূপ দেখিতেছিল।”
“তখন তরবারি হস্তে তিনজন ইংরেজ অকুতোভয়ে, সেই অগণিত যবনগণের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল। একজন যবন, আমিয়টকে সেলাম করিয়া বলিল, কেন মরিবেন? আমাদিগের সঙ্গে আসুন।”
“তখন দশ-বারজন যবনে গলস্টনকে ঘেরিয়া প্রহার করিতে লাগিল।”
“মীর কাসেমের সেনা কাটোয়ার রণক্ষেত্রে পরাভূত হইয়া হঠিয়া আসিয়াছিল। ভাঙা কপাল গিরিয়ার ক্ষেত্রে আবার ভাঙিলÑ আবার যবনসেনা, ইংরেজের বাহুবলে, বায়ুর নিকট ধূলিরাশির ন্যায় তাড়িত হইয়া ছিন্ন ভিন্ন হইয়া গেল। ধ্বংসাবশিষ্ট সৈন্যগণ আসিয়া উদয়নালায় আশ্রয় গ্রহণ করিল। তথায়, চতুঃপার্শ্বে খাদ্য প্রস্তুত করিয়া যবনেরা ইংরেজ সৈন্যের গতিরোধ করিতেছিলেন।”
“তিনজনে পলায়নোদ্যত যবন-সেনার পশ্চাদ্গামী হইলেন। অকস্মাৎ দেখিলেন, সম্মুখে একদল সুসজ্জিত হিন্দুসেনাÑ রণমত্ত হইয়া দৃঢ় পর্বতরন্ধ্র-পথে নির্গত হইয়া ইংরেজরণে সম্মুখিন হইতে যাইতেছে।”
বঙ্কিমের আরেক ঐতিহাসিক উপন্যাস ‘রাজসিংহ’ (১৮৮২)। মূলত রাজসিংহ এবং মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের মধ্যে সংঘর্ষকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে উপন্যাসের মূল কাহিনী। এই উপন্যাসে মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবকে আগাগোড়া বিপুলভাবে নিন্দিত করার প্রয়াস লক্ষ করা যায়। তবে এতে ‘যবন’ শব্দের ব্যবহার দেখা যায়নি।
তবে ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসের কিছু নমুনা দেখা যেতে পারে। “ভবানন্দ রঙ্গ দেখিতেছিলেন। ভবানন্দ বলিলেন, ‘ভাই, নেড়ে ভাগিতেছে, চল একবার উহাদিগকে আক্রমণ করি।’ তখন পিপীলিকাস্রোতবৎ সন্তানের দল নূতন উৎসাহে পুল পারে ফিরিয়া আসিয়া যবনদিগকে আক্রমণ করিতে ধাবমান হইল। অকস্মাৎ তাহারা যবনের উপর পড়িল। যবন যুদ্ধের আর অবকাশ পাইল নাÑ যেমন ভাগীরথীরতরঙ্গ সেই দম্ভকারী বৃহৎ পর্বতাকার মতো হস্তীকে ভাসাইয়া লইয়া গিয়াছিল, সন্তানেরা তেমনি যবনদিগকে ভাসাইয়া লইয়া চলিল। যবনেরা দেখিল, পেছনে ভবানন্দের পদাতিক সেনা, সম্মুখে মহেন্দ্রের কামান।”
“সত্যানন্দ বলিলেন, এত দিনে যে জন্য আমরা সর্বধর্ম সর্বসুখ ত্যাগ করিয়াছিলাম, সেই ব্রত সফল হইয়াছে, এ প্রদেশে যবনসেনা আর নাই, যাহা অবশিষ্ট আছে, এক দণ্ড আমাদিগের নিকট টিকিবে না, তোমরা এখন কি পরামর্শ দাও?”৫
‘যবন’ শব্দের ব্যবহার বিষয়ে বঙ্কিম-গবেষক ড. সারোয়ার জাহান উল্লেখ করেন, বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসে মুসলিম-প্রসঙ্গ এবং চরিত্রের বিকৃত-চিত্রন ছাড়া বঙ্কিমচন্দ্র প্রমুখ হিন্দু সাহিত্যিকের ব্যবহৃত ‘যবন’ শব্দটি নিয়েও মুসলমানগণ অত্যন্ত উত্তেজিত ছিলেন। তাঁদের বক্তব্য ছিল, শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ যা-ই হোক না কেন, হিন্দু সাহিত্যিকগণ মুসলমান সম্প্রদায়কে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্যই যবন শব্দ ব্যবহার করছেন।৬
বিশ্বকবি উপাধিতে ভূষিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) বঙ্কিম বাবুর মতো না হলেও পিছিয়ে ছিলেন না। ‘রীতিমত নভেল’ (১২৯৯ বঙ্গাব্দ) ছোটগল্পের প্রথম পরিচ্ছেদ শুরুই করেছেন: “এভাবে ‘আল্লা হো আকবর’ শব্দে বনভূমি প্রতিধ্বনিত হইয়া উঠিয়াছে। এক দিকে তিন লক্ষ যবনসেনা, অন্য দিকে তিন সহস্র আর্য সৈন্য। বন্যার মধ্যে একাকী অশ্বথ-বৃক্ষের মতো হিন্দু বীরগণ সমস্ত রাত্রি এবং সমস্ত দিন যুদ্ধ করিয়া অটল দাঁড়াইয়া ছিল; কিন্তু এইবার ভাঙিয়া পড়িবে তাহার লক্ষণ দেখা যাইতেছে। এবং এই সাথে ভারতের জয়ধ্বজ্জা ভূমিস্মাৎ হইবে এবং আজিকার এই অস্তচলার সহস্র রশ্মির সহিত হিন্দুস্থানের গৌরবসূর্য চিরদিনের মতো অস্তমিত হইবে।”
“হর হর বোম বোম। পাঠক বলিতে পার কে এ দৃপ্ত যুবা পঁয়ত্রিশ জন মাত্র অনুচর লইয়া মুক্ত অসি হস্তে অশ্বারোহণে ভারতের অধিষ্ঠাত্রী দেবীর করনিক্ষিপ্ত দীপ্ত বজ্রের ন্যায় শত্রুসৈন্যের উপরে আসিয়া পতিত হইল, বলিতে পার কাহার প্রতাপে এই অগণিত যবনসৈন্য প্রচণ্ড বাত্যাহৃত অরণ্যানীর ন্যায় বিক্ষুদ্ধ হইয়া উঠিল? কাহার বজ্রমন্দ্রিত ‘হর হর বোম বোম’ শব্দে তিন লক্ষ ম্লেচ্ছ কণ্ঠের ‘আল্লা হো আকবর’ ধ্বনি নিমগ্ন হইয়া গেল?”৭
কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৮৩৮-১৯০৩ খ্রি.) কাব্যসজ্জায় সুস্পষ্ট মুসলমান বিদ্বেষ পাওয়া যায়। ডক্টর মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের ভাষায়, “হেমচন্দ্র তাঁর বীরবাহুতে (১৮৬৪ খ্রি.) লিখেছেন,
আরে রে নিষ্ঠুর জাতি পাষণ্ড বর্বর,
পুরাব যবন-রক্তে শমন-খর্পর।”৮
গল্পকার শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ঐতিহাসিক কাহিনী গল্প সংকলনে ‘যবনেরা ছল, কপট, শঠ, নৃশংস, ভোগী এবং কদ্যপি বিশ্বাসযোগ্য নয়’- একাধিকবার এ জাতীয় বাক্য ও বাক্যবন্ধ ব্যবহার করেছেন। তাঁর ‘শঙ্খ কঙ্কন’ গল্পে তিনি সুলতান আলাউদ্দীন খলজিকে ‘যবনসেনাপতি’ এবং মেøচ্ছ রাজা হিসেবে আখ্যায়িত করেন।৯
উপরোক্ত উদ্ধৃতি ও আলোচনা থেকে দেখা যায়, যবন শব্দটি কী অবস্থা থেকে নিছক বিদ্বেষগত কারণে কোন অবস্থায় পৌঁছালো! এটি একটি জাতির প্রতি বিদ্বেষ ছুড়ে দেয়ার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকল। আর সাহিত্যের এই দিকপালদের ছুড়ে দেয়া অস্ত্র নিপীড়নের হাতিয়ারে পরিণত হয়ে গেল। অতঃপর তা বিদ্বেষী ইতিহাসকারদেরও উপকরণ জুগিয়ে গেল।
তথ্যসূত্র :
১. আধুনিক বাংলা অভিধান, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, এপ্রিল ২০১৮।
২. সংসদ বাংলা অভিধান, সাহিত্য সংসদ, কোলকাতা, জুলাই ১৯৯০।
৩. ড. মোহাম্মদ আমীন: শুদ্ধ বানান চর্চা (শুবাচ), https://shubach.blogspot.com/2014/04/blog-post_9314.html..
৪. দুর্গাদাস লাহিড়ী: পৃথিবীর ইতিহাস (অষ্টম খ-), হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ১৩৩৩ বঙ্গাব্দ।
৫. সূত্র: বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়: উপন্যাসসমগ্র, খান ব্রাদার্স এন্ড কোং, ২০১৩।
৬. সূত্র: সরদার আবদুর রহমান: ড. সারোয়ার জাহানের গবেষণায় ‘বঙ্কিম-মানস’, নতুন এক মাত্রা, জুলাই-আগস্ট ২০২১।
৭. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রীতিমত নভেল (প্রথম পরিচ্ছেদ), গল্পগুচ্ছ।
৮. ডক্টর মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, আধুনিক বাংলা কাব্যে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক, প্রথম প্রকাশ, ঢাকা, বাংলা একাডেমি, ১৯৭০।
৯. শরদিন্দু বন্দোপাধ্যায়: ঐতিহাসিক কাহিনীসমগ্র (গল্প সংকলন), প্রকাশক- আনন্দবাজার, কলকাতা।