গুজবের মাথামুণ্ডু
গুজবের মাথামুণ্ডু - ছবি সংগৃহীত
একবার শোনা গেল ছেলেধরা বেরিয়েছে। ছেলেমেয়েদের মাথা কেটে নিয়ে যাচ্ছে। কাটা মাথা পদ্মাসেতু তৈরিতে ব্যবহার করা হচ্ছে। এই কথা যখন চারপাশে সরব হয়ে ওঠল, তখন অভিভাবকরা আতঙ্কিত হয়ে উঠল। ছেলেধরা সন্দেহে দেশের বিভিন্ন স্থানে গণপিটুনি দিয়ে বেশ কয়েকজন মানুষকে হত্যাও করা হলো। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছাল যে, মানুষ অপেক্ষাকৃত দুর্বল, দরিদ্র, ভবঘুরে মানুষকে ছেলেধরা সন্দেহে অবিশ্বাস করতে লাগল। উদ্দেশ্যহীনভাবে কাউকে ঘোরাফেরা করতে দেখলে তাকেই ছেলেধরা সন্দেহে নানাজন নানা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে থাকল। মানুষ বিব্রতবোধ করল আবার অল্প দিনের মধ্যে এ আতঙ্কের নিরসনও হলো।
গুজব মানেই হলো রটনা বা তৈরি করা কথা। লোকমুখে ছড়িয়ে পড়া ভিত্তিহীন কথা। মানুষ গুজবে বিশ্বাস করে এবং বেশ ভালোভাবে বিশ্বাস করে। শিক্ষিত-অশিক্ষিত সবাই কমবেশি গুজবে বিশ্বাস করে। মানুষ গুজবের মতো মিথও বিশ্বাস করে। মিথ হলো অতিপ্রাকৃতিক বা পুরনো কথা, পৌরাণিক, যা দীর্ঘদিন যাবদ চলে আসছে এমন। মিথ মোটামুটি সব দেশের সব সমাজেই রয়েছে, চলেও বেশ ভালোই কিন্তু গুজব মাঝে মাঝে রচিত হয়; কখনো সখনো শোনা যায়। তবে ছেলে ধরার গুজবটি মাঝে মধ্যেই শোনা যায়। কিছুদিন আগেও শোনা গেছে। যেমন পদ্মা সেতুতে মানুষের মাথা লাগার কথাটি। যদি জনরবটা এরকম হতো যে, পদ্মা সেতু তৈরি করতে মানুষের মুণ্ডু লাগবে, তাহলে মাথা ও মুণ্ডুর অর্থ ভিন্নভাবে করা যেত। কিন্তু গুজব উঠেছে মাথা লাগবে। আপত্তি এই ‘মাথা’ শব্দটাতে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলগুলো ছাত্রছাত্রীদের বাংলা ভাষায় দক্ষ করে গড়ে তুলতে ‘মাথা’ দিয়ে বাংলা বাক্য তৈরির অনুশীলন করতে বলে। তখন শিক্ষার্থীরা চেষ্টা করে দেখে, ‘মাথা’ শব্দটি ব্যবহার করে কতগুলো বাক্য তৈরি করা যায়। যেমনÑ মাথা বুদ্ধি অর্থে ব্যবহার করা হয়। উদাহরণ, ছেলেটির গণিতে মাথা ভালো। মাথা অংশীদার অর্থে ব্যবহার হয়, যেমনÑ ওমুক এই বিষয়ে মাথা না গলালেও পারতেন। এমনি এমনি হয় না, এত বড় ব্রিজ তৈরিতে মানুষের মাথা লাগে। এভাবে মাথা শব্দটি নানান অর্থে ব্যবহার হতে পারে। ‘এরকম বিশাল সেতু তৈরিতে মানুষের মাথা লাগে’ বাক্যে মাথা বুদ্ধি অর্থে ব্যবহার হয়েছে। তাহলে ‘সেতু তৈরিতে মানুষের মাথা লাগে, মানে বুদ্ধি লাগে। এটা তো গুজব নয়, নির্ভেজাল সত্য কথা। সত্যিই সেতু তৈরিতে মানুষের মাথা লাগে (বুদ্ধি লাগে)। কিন্তু বিষয়টি হয়ে গেল উল্টা। মাথা বুদ্ধি অর্থে প্রকাশ না হয়ে হলো মুণ্ডু অর্থে। কথার ছলে কেউ হয়তো মাথাকে বুদ্ধি অর্থে নিয়েছে কিন্তু অন্য কেউ সেই মাথাকে মুণ্ডু অর্থে প্রচার করেছে।
এমনও হতে পারে, কোনো দু’জন শিক্ষিত লোক স্যুট-টাই পরা, দেখতে অবিকল ইঞ্জিনিয়ারদের মতো, তারা নিজেদের মধ্যে আলাপচারিতার একপর্যায়ে পদ্মা সেতুর নির্মাণকৌশল দেখে অবাক-বিস্ময়ে বলে ফেলেছে, ‘এই বিশাল সেতুর কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন করতে মানুষের মাথা লাগে’। এই আলাপ হয়তো পাশে অবস্থান করা অশিক্ষিত নির্মাণশ্রমিক কান পেতে শুনেছে। এসব শ্রমিক তো আর বোঝে না যে, মাথা শব্দটাকে এই ভদ্রলোকরা দক্ষতা অর্থে ব্যবহার করেছে। শ্রমিকরা মনে করল, সত্যি সত্যিই বুঝি পদ্মা সেতুতে মানুষের মাথা (মুণ্ডু) লাগবে। তাদের এই ধারণা করা, আর এক দুই করে ধীরে ধীরে প্রচার করা। এই শ্রমিকরা হয়তো এও দিব্যি করে বলেছে যে, সে নিজের কানে শুনেছে দু’জন ইঞ্জিনিয়ার বলাবলি করেছে, ‘পদ্মা সেতুতে মানুষের মাথা লাগে’। এ কথা শুনে অন্য লোকও বিশ্বাস করতে শুরু করে এবং তারাও এই কথা প্রচার করতে থাকে। হতে পারে গুজব এভাবেই রটতে পারে।
এমন কথাও শোনা গেছে, পদ্মা সেতুর কাজের অগ্রগতি নিয়ে চাইনিজ ইঞ্জিনিয়ারদের সাথে মিটিং চলাকালে ইঞ্জিনিয়াররা নাকি একপর্যায়ে বলেছে, ‘ইয়েট উই নিড মোর হেডেড টু কমপ্লিট দিস ব্রিজ’। ‘উই নিড মোর হেডেড’ দিয়ে চাইনিজরা বুঝাতে চেয়েছেন, পদ্মা সেতুর কাজ শেষ করতে তাদের এখনই আরো বেশি লোকের দরকার হবে। এই ‘হেডেড’ শব্দ দিয়ে তারা শ্রমিক বুঝিয়েছেন আর বাঙালি সেটা দিয়ে অনুবাদ করে নিয়েছেন মানুষের মাথা। হতে পারে ঠাট্টা-মশকরার ছলে এভাবেই গুজবটি ছড়িয়ে পড়েছে।
বাংলা ভাষার একটি প্রবাদ রয়েছে, হালে পানি পাওয়া; কিংবা পালে বাতাস লাগা। অর্থ শুকনা জিনিস তাজা হওয়া বা শক্তি বৃদ্ধি হওয়া বা কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেয়া। গুজবের অবস্থাও সেরকমই হয়ে থাকে। সেসময় নেত্রকোনায় একটি শিশুর কাটা মস্তক গুজবের গায়ে নুনের ছিটা দিয়েছে। এ কারণে গুজবটি শেষ পর্যন্তু আর গুজব থাকেনি, তা সত্যে রূপান্তরিত হয়ে যায়। এমনিতেই গুজব ডালপালা বিস্তার করে। তার মধ্যে দেশের প্রায় সবগুলো দৈনিকে একটি খবর প্রকাশ হয়েছিল, যে খবরে বলা হয়েছিল, ‘শিশুর কাটা মস্তক নিয়ে পালানোর সময় জনতার হাতে ঘাতক নিহত’।
এই খবরটি প্রকাশ পাওয়ার পর ছেলেধরা গুজবটি আর গুজব থাকেনি, সমগ্র দেশে এটি সত্যে পরিণত হয়েছে। খবরটিতে বলা হয়েছিল, ময়মনসিংহের নেত্রকোনার মেথর পট্টিতে অজ্ঞাত এক মদ্যপ যুবক মাতলামি করার সময় ওই যুবকের ব্যাগ থেকে শিশুর সদ্য রক্তমাখা কাটা মস্তক পড়ে গেলে উপস্থিত লোকজন ভয়ে আঁতকে ওঠেন। এ সময় যুবকটি মস্তক ফেলে পালানোর চেষ্টা করলে জনতা তাকে (কথিত ছেলেধরা) হাতেনাতে ধরে ফেলে এবং পিটিয়ে হত্যা করে। ঘটনাটি টিভি, ফেসবুক, পত্র-পত্রিকাতে মুহূর্তে ভাইরাল হলে ছেলেধরা গুজবটি বাস্তবের রূপ নিয়ে সমগ্র দেশে তরঙ্গায়িত হয়ে ওঠে। এতে অভিভাবকরাও বেসামাল হয়ে তাদের শিশুসন্তানদের নিরাপত্তার স্বার্থে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। অন্যদিকে ছেলেধরা সন্দেহে আইনশৃঙ্খলারও অবনতি হতে থাকে। কেউ কেউ বলেছে, পদ্মা সেতু হোক, এটা যারা চায়নি তারাই এসব গুজব রটিয়েছে। কিন্তু বিষয়টি এমনই জটিল আকার ধারণ করেছিল যে, কোনটা গুজব আর কোনটা বাস্তব তা নির্ধারণ করা কঠিন হয়ে পড়েছিল।
হতে পারে ‘ছেলেধরা’ বা ‘পদ্মা সেতুতে মাথা লাগা’ ব্যাপারটি নিছকই গুজব। কিন্তু এর মধ্যে নেত্রকোনার ঘটনাটা কেন ঘটল তারও তো কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি। কে কোন উদ্দেশ্যে মুণ্ডু কাটার লোমহর্ষক ঘটনা ঘটাল সেটাও জনগণ জানতে চেয়েছিল। কিন্তু পরিষ্কারভাবে তা জানতে পারেনি। ছেলেধরা না হোক কিংবা পদ্মা সেতুতে মুণ্ডু না লাগুক, সেটা ভিন্ন কথা। কিন্তু এদেশে শিশু ও নারী পাচারকারীরা তো এখনো সক্রিয়। তারাই তো আসল ছেলেধরা। গুজবের আড়ালে এসব ছেলেধরা নিরাপদে নিজেকে রক্ষা করতে পারে। এদের কবল থেকে শিশুদের বাঁচাতে যেন সময় না লাগে।
কখনো কখনো কোনো একটি খবর আড়াল করতে উদ্দেশ্যমূলকভাবে গুজব সৃষ্টি করে তা সমাজে ছড়িয়ে দেয়া হয়। যাতে মূল খবরটি মানুষের কাছে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। সাধারণত এ কৌশলটি ফ্যাসিস্ট সরকারের লোকজন গ্রহণ করে থাকে। আবার কোনো একটি খবর ব্যাপক প্রচার হতে থাকলে ফ্যাসিস্টদের বিপক্ষে প্রভাব ফেলতে পারে, এমন আশঙ্কা থেকে ফ্যাসিস্টরা বলতে থাকে, এ খবরটি নিছক গুজব ছাড়া কিছুই নয়। গত এক দশকে মানুষ একাধিকবার এ ধরনের গুজবের অভিজ্ঞতা পেয়েছে।